Moumita Chakraborty

Inspirational

4.3  

Moumita Chakraborty

Inspirational

যখন সময় থমকে দাঁড়ায়

যখন সময় থমকে দাঁড়ায়

7 mins
994


#প্রতীক্ষা

টিংটং...

দেওয়াল ঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে অতসী ভাবলো ... এই এগারোটার সময় আবার কে এলো! অনিমেষের আসতে তো সেই সন্ধ্যে ছ'টা। ঝট করে হাতের রিমোট টা ওর বসে থাকা সোফায় ছুড়ে দরজা খুলল অতসী। " দিদি , ক'টা ক্লিপ হবে গো... এত উত্তরে হওয়া আজ, ছোট ছোট জামাকাপড় তো! সব উড়ে পরে যাচ্ছে, আর অর্ধেক ক্লিপ তো উনি ফেলেই দিয়েছেন" এক নিঃশ্বাসে বলে হো হো করে নিজেই হাসত লাগলো প্রিয়া। প্রিয়া... পাশের ফ্ল্যাটবাসী। আর ওর কথার "উনি" হল ওর আড়াই বছরের ছোট্ট মেয়ে। ওরই সব ছোট জামা কাপড়। হালকা শুষ্ক হেসে গোটা বারো ক্লিপ তুলে দিল অতসী। প্রিয়া আবার তার খিলখিল হাসিতে বলতে বলতে চলে গেল... " বিকেলে দিয়ে যাবো গো দিদি"। কিছু মানুষ মুখে এমন হাসি মেখে ঘোরে, দেখে মনে হয় যেন সুখ দিযে কেনা নামি কোম্পানির ওষ্ঠ প্রসাধনী। কিন্তু অতসীর এই ওর হটাৎ আগমন আর এত হৈ হৈ যেন রুটিনে রসভঙ্গ করলো। বেশ তো মন কুড়িয়ে জড়ো করেছিল টিভি টাতে। বিরক্ত মুখে সোফায় গা এলিয়ে দিল সে। শীত টাও আজ ভীষণই। বিরক্তিকর।।


    সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোন এলো অনিমেষের.." আজ রেডি থেকো, বিকেলে বইমেলা যাচ্ছি আমরা। রাতে বাইরে খাবো ... আর তুমি শালের কুর্তিটা পোড়ো, এবারে না হলে ওটা নতুনেই ফেলে দেব।" অতসীকে কোন কিছু প্রশ্নের সুযোগ দেয়নি। রাগ করেও অতসী মনে মনে হাসলো ওর ছেলেমানুষীর কথা ভেবে। কারোর সুবিধা অসুবিধার কথা না ভেবেই আবদার করতে শুরু করে। হয়তো জোর বেশি থাকলে মানুষ মানুষের ওপর এমনই করে। আকাশ পাতাল ভাবতে লাগলো অতসী। আজকাল ও যেন আরো কেমন হয়ে যাচ্ছে। কারো সাথে মেশা তো দূরে থাক হাই, হ্যালোটুকুও আসে না ওর। বাইরে ওরা নিয়ম করে প্রায় প্রতিদিন বেরোয়, খায়.. কিন্তু মন যেন ভিজে ভারী হয়ে গেছে যেন পরপর বৃষ্টি ভেজা শীত পোশাক। সন্ধ্যে নামার আগে সেই শালের কুর্তি দিয়ে ঢাকল নিজেকে। চড়া বেগুনি লিপস্টিকে কাষ্ঠ নিরস জীবন এঁকে রেডি অতসী। আর প্রতিবারের মতোই অনিমেষ আয়নার সামনে এসে একটা ছোট্ট কাজলের টিপ লাগিয়ে দেয় সুন্দরী বউকে। এ সবই ওর মন ভালো করার প্রয়াস। সবটাই বোঝে অতসী। কিন্তু সবই যে ব্যর্থ হয়। সেই তো গোমরা মুখ, গুমোট মন। 


২. 

 অনিমেষ আর অতসী দুজনকে দেখে যে কেউ এমন সুখী দাম্পত্যের মোহে পড়বে। কিন্তু এত ঐশ্বর্য আর আধুনিকতার ফয়েলে যে নিঃসন্তান দম্পতির কত হাহাকার আছে তা কে বুঝবে! নেই নেই করে তো আর কম দিন হোলো না.... প্রায় ন'বছর হলো ওদের বিয়ের। প্রথম তিন বছর নৌকার পালে চোখ রেখেই কেটে ছিল বটে। নামি কোম্পানির চিফ এক্সিকিউটিভ আধিকারিক অনিমেষ। মোটা মাইনে, সঙ্গে ঝাঁ চকচকে সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট। চেহারা , ব্যক্তিত্ব কোন দিক থেকেই পিছিয়ে নেই অনিমেষ। পাল্লা দিয়ে অতসীও রূপ গুন নিয়েই যেন জন্মেছে। জিওগ্রাফি তে এম.এ করার পরই সম্বন্ধ করে বিয়ে অনিমেষের সাথে। এযুগে মা বাবার মত সম্বন্ধ করে অনিমেষকে বিয়ে করতে অতসীর কোনো সমস্যা হয়নি। আসলে অনিমেষ এমনই যে কোনো মেয়ের সমস্যা হওয়ার তেমন কথাই না। মা ছেলের সংসারে মা মারা যাওয়ার পর পৈত্রিক ভিটে বিক্রি করে এই ফ্ল্যাট বাড়ি কেনা। বছর তিনেক পর অনিমেষ অতসী নিজেদের ভালোবাসাকে সমীকরণে আঁকতে চায়ল। সমস্যা খাড়া হলো তখনই। 


    মাস চারেক কাটলো। সময় যতই যেতে লাগলো অনিশ্চয়তার ছায়া জড়িয়ে ধরলো ওদের। এমনি একদিন গাইনকলজিস্ট এর কাছে গেল ওরা। অনেক রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেল মা হওয়ার জন্য যে শারীরিক অক্ষমতা তা অতসীর। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম এর কারণে অতসী মা হতে পারছে না। জানার পর থেকে ভেঙে খান খান হয়ে গেছে সে। অনিমেষ সব সময় পাশে থেকেছে। অনেক চিকিৎসাও হয়েছে। কিন্তু ফল শূন্য। যত দিন যাচ্ছে অতসী ভেতরে ভেতরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বেশি। 


   রাস্তাঘাটে কোনো বাচ্চা দেখলে যেন নিজেই বাচ্চা হয়ে যায় অতসী। ছুটে যায়, কখনো সৌজন্যের খাতিরে তার বাবা মায়ের অনুমতি নেয়, কখনো বা তারও দরকার পড়ে না। এমন অবস্থায় বড় অস্বস্তি লাগে অনিমেষের। কিন্তু কিই বা করবে, কিছু বলা যায় না অতসীকে। হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে , কখনো বাচ্চাগুলোর বাবা মায়েদের সঙ্গে কিছুটা আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায়, পরিস্থিতি সহজ করার জন্য।শীতে তিবেতিয়ান উলের পোশাকের পসরা নিয়ে বসে ওখানেরই কিছু ব্যবসায়ী। গতবার শীতে নিয়ে গেছিল অনিমেষ অতসীকে। ও দেখেছে প্রতিটা স্টলে কেমন ছোটো ছোটো টুপি, পা মোজা, হাত মোজা, সোয়েটার .... ঝুলছে। চোখ ধাঁধিয়ে যায় অতসীর। বাবাদের কোলে জুলজুল চোখে চেয়ে আছে জ্যান্ত পুতুলগুলো, মায়েরা মন দিয়ে দর কষাকষি করছে.... যদি বাজেটের মধ্যে আর দুটো কেনা যায়। কাছে গিয়ে গাল টা নেড়ে আদর করে দেয় ও। এখন অনেক সংযমী হয়েছে অতসী। বাড়ি ফিরে এসে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে। খুব শখ ছিল বাহারি টুপি, মোজায় সাজাবে নিজেদের জ্যান্ত পুতুলটাকে। 


মানুষের অর্থ আর ঐশ্বর্য যে সব নয়, সবার থেকে আগে সম্পর্ক, ... হয়তো বা সম্পর্কের বাঁধনের মোহ পার্থিব সুখকে ছাড়িয়ে যায়। দূর সম্পর্কের আত্মীয় পরিজন, প্রতিবেশী শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনেক ভাবে খুঁচিয়ে তার দগদগে ঘায়ে লবন ছিটিয়ে গেছে বহুবার। প্রাণীদের ক্ষেত্রে একটা সুবিধে যাদের হুল থাকে, তাদের দাঁত থাকেনা। কিন্তু মনুষ্য প্রজাতির জীবের উভয়ই বর্তমান.... তারা মুখে শুধু কথা শুনিয়েই ক্ষান্ত হয় না, কাজেও প্রহার দিয়ে থাকে। এই যেমন অতসী যে শুধু লোকের কাছে দু চার কথা শোনে তাই নয়.... অনুষ্ঠান , কোনো মাঙ্গলিক কাজে তার ছায়া নাকি অশুভ.... পরিস্কার বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাকে। ওই শব্দটা তার কান টা বিশ্বাস করতে পারে না... বাঁজা। আগে প্রায় প্রতি অনুষ্ঠান বাড়ি থেকে এসে কাঁদত ও, এখন আর যায় না। এমনকি নিকট আত্মীয়দের দেখেছে , নিজেদের বাচ্চাগুলোকে ও আদর করলে যেন একটু অন্য চোখেই দেখে,.... আঙ্গুল কেটে দেওয়া, ঢাউস সাইজের কালো টিপ পড়ানো.. এই আর কি। 


    এ যুগে কোনো মেয়েই আর তেমন করে সংসার পাতি খেলতে চায় না। বাইরের জগতে পা রাখতে চায়। কিন্তু ছোট থেকে অতসীকে খুব টানতো মা কেমন করে বাঁধাকপি কুচায়... আর সে সময় চুড়িগুলো দোল খেয়ে কেমন টুংটাং শব্দ তোলে, ভাই কে কেমন ধারায় মা সাজিয়ে দেয়, যখন ছোট জামাকাপড়গুলো ভাঁজ করে নিজে হাতে তখন ও দেখেছে মায়ের মুখে এক আকাশ প্রশান্তি। ভাই এর সাথে তার বয়স বৈষম্য থাকায় এত কিছু বুঝতে তার বিশেষ সুবিধা হয়। তাই ভালো রেজাল্ট করেও সংসার বেছে নিয়েছে মোহের বশেই। কিন্তু হায়! ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্না না হলে খাতার পর খাতা শেষ হলেও অংক মেলে না।

    

      এখন অতসীর ফ্ল্যাট টিপটপ সাজানো, যেখানের জিনিস সেখানেই থাকে। আর লন্ডভন্ড করবেই বা কে! অনিমেষও এক কথায় গোছানো। ওর খুব ইচ্ছে করে ওর ঘর বাড়িও প্রিয়াদের মতো অগোছালো হোক। ঘর থেকে ও শুনতে পায় পাশের ঘরে মা মেয়ের চিৎকার.... কখনো দুজনেই কাঁদে, আবার কখনও দুজনেই একই বয়সী... হেসেই পাগল। সত্যি বলতে কি লোভ হয় অতসীর। কতদিন দরজায় কান পেতে শুনেছে ও। অনিমেষ সবটা জানে, আর মনে মনে প্রমাদ গোনে, এই না অতসীকে হারায় ও। কিন্তু সত্যি বলতে কি, অতসী যা চায় অনিমেষ এত আপডেট হওয়া সত্ত্বেও মেনে নিতে পারে না কিছুতেই। ডাক্তার, অসুধ, কোবরেজ, তন্ত্রমন্ত্র যে যা বলেছে সবই করেছে ওরা। বিফল অতসী যেন অঙ্কে ফেল করা অকৃতকার্য পরীক্ষার্থী। বহুবার কাচুমাচু মুখ করে বাচ্চা মেয়ের মত বায়না করেছে অনিমেষের কাছে..... একটা বাচ্চা এনে দিতে... না হয়...অনাথ আশ্রম থেকেই! কিন্তু অনিমেষ এব্যাপারে নরম সুরেও বড়ই কঠোর।  


  অনিমেষ অতসীর প্রতি মুহুর্তের যন্ত্রণা বোঝে। সে নয় বাইরে আসছে, পাঁচটা লোকের সাথে মিশছে। কিন্তু অতু!! ও তো নিজের ফাঁসি লাগানো স্বপ্ন ভিড়ে ক্লান্ত, অবসন্ন। কিন্তু ওই বা কি করে। রাস্তাঘাটে কোন মাতাল বা অসামাজিক প্রকৃতির লোক দেখে কিংবা ধর্ষনের খবর পরে ভাবতে থাকে.... হতে তো পারে এদেরই কারো একজন ওই বাচ্চার জন্মদাতা। না না, ও ভাবনাই আর এগোতে পারেনা।

   

  আজ অফিসের গাড়িটা বিগড়েছে। তাই কিছুটা হেঁটে সামনের মোড় থেকে অটো ধরে নেবে। ক্যাব বুক করলেও হত। কিন্ত আরও দুজন কলিগের ইচ্ছানুসারী হতে হলো তাকে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই দেখে চোখের সামনে প্রায় বছর তিনেকের ছেলে তার হলুদ স্মাইলি আঁকা বলের পিছনে ছুটছে। উল্টোদিক থেকে তিরবেগী প্রাইভেট কার। কিছু না ভেবেই তাকে ছুটে কোলে তুলে নেয় অনিমেষ, সঙ্গে আদরের বলটাও। চারিদিকে প্রচুর লোকের ভিড় হয়ে গেছে। অনেকেই তার উপকারের কথা বলছে। বাচ্চাটার বাবা মা কাঁদছে, আর অনিমেষের সামনে হাত জোড় করে কি বলছে ও কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছে না। ও শুধু দেখছে কোলের বাচ্চাটাকে। এখন অনিমেষের এক হাতে ছোট্ট প্রাণটা আরেক হাতে তার শখের বল। সে তার ছোট হাতদুটো দিয়ে অনিমেষের গলা জড়িয়ে ধরে বলছে " বা... বা ..."., আর বল দেখে সে কি হাততালি। অনিমেষ যেন এমন সুখ ঢক ঢক করে পান করছে, অমৃত পানীয় আগে কোনোদিন খায়নি।  

  

    আজ অতসী একটু আশ্চর্যই হলো অনিমেষকে খাবার টেবিলে চুপচাপ দেখে। আসলে গতকাল অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই যেন অন্য মানুষ। হাসি নেই, থমথমে।অফিস থেকে অনেক রাতে ফিরেছে কাল। অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করায়...... কিছু কাজ বাকি ছিল, কাল না করলে আর নাকি কোনোদিন করা হত না... এমনই উত্তর পেয়েছিল অতসী। ভেবেছে সত্যি হয়তো অফিসে কাজের প্রেসার চলছে। এই তো কদিন আগেই নতুন বসের নানা ফিরিস্তির কথা অতসীকে বলছিল সে। 


  নিত্যদিনের রুটিনে বাঁধা জীবনে আজও এসময় টিভি দেখছিল অতসী। বেলা একটা নাগাদ বেল বাজলো। বিরক্ত মুখে ভাবলো প্রিয়াটা কি ক্লিপ এই সিজনে আর কিনবেই না!! অলস শরীরে দরজা খুলল। সিকিউরিটি গার্ড একটা এইসা পার্সেল পৌঁছে দিয়ে গেল। পার্সেল তো প্রায়ই আসতে থাকে, কিন্তু এত বড়। খুলেই বুঝতে পারলো অতসী ভুল করে এনেছে গার্ড অন্য রুমে দিতে গিয়ে,..... ব্যাগ ভর্তি ছোট বাচ্চার শীত কাপড়। ঈশ্বরের পরিহাস দেখে চোখে জল এলো ওর। তবুও ওগুলো হাত বোলানোর, গন্ধ নেওয়ার লোভ সম্বরণ করতে পারলো না। ইতিমধ্যে আবারও বেল.... অতসী ছুটে দরজা খুলতে গেল.... গার্ড একটা ডায়াপার এর প্যাকেট ধরিয়ে দিল। অতসী আর ঠিক থাকতে পারলো না। চিৎকার করে বলতে লাগলো " কি হচ্ছে কি!" তখনই দেখলো অনিমেষকে পিছনে দাঁড়িয়ে, হাতে জড়ানো পেঁচানো এক কচি প্রাণ, অনাথ আশ্রম থেকে তাদের মেয়েকে আনার সময় বেগুনি রঙের তোয়ালে জড়িয়ে এনেছে, ওই রং যে ওর মায়ের খুব প্রিয় রং। মেয়ে কোলে তুলে দিয়ে অনিমেষ বললো"নাও, সামলাও আমাদের ঘরের লক্ষীকে"। 

  আজ ওদের ঘরের প্রতিটা লাইট জ্বলছে, শুনশান ভেঙে কান্না হাসির সানাই ধরেছে অতসীর আট মাসের মেয়ে। রান্নার দিদিকে আজ অতসী পিঠে পুলি বানাতে বললো প্রায় চার বছর পর। আজ যে পৌষ সংক্রান্তি। এবাড়িতে এমন আহ্লাদের পাট তো কবেই চুকে গেছিল। আজ যে ঘরে লক্ষী এলো। এ শীত সারাজীবন মনে রাখবে সে, আজ এর পরশে হিয়া শুষ্ক মৃতপ্রায় শুকিয়ে আসা নদী থেকে মুক্তো-খনি সাগর হয়েছে।

 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational