Moumita Chakraborty

Tragedy Fantasy Inspirational

3  

Moumita Chakraborty

Tragedy Fantasy Inspirational

সরযূ ও আগন্তুক

সরযূ ও আগন্তুক

11 mins
293



              (১)

-----------শোন সক্কলে............ আমি কিন্তু এই হপ্তাটা থাকবো না, আগে ভাগেই বলে দিলুম........... যদি কারো ছেলে মেয়ের বিয়ে দিতে হয় তো অন্য পুরুত্‍ আগে থেকেই থির করে নিস............... পরে আবার এই নিয়ে আমায় দোষ দিস নে যেন..............সরযূ তার লম্বা বেণী নাচিয়ে দুলিয়ে বলে গেলো। 

------ না পুরুত্‍ মহাশয়া আপনি না ফেরা পর্যন্ত আমাদের ছেলে মেয়েগুলো আইবুড়ো থাকবে সেও স্বীকার, তবু আপনি ভিনু অন্য পুরুত্‍ আমরা নেবো না................... হেম, প্রভাতী, ভারতী, সুকু..... সকলে মিলে সমস্বরে বলে উঠলো। ©মৌমিতা

এরা সকলেই সরযূর খেলার সাথী। আসলে সরযূ বিবাহ ব্যপারে বিশেষ প্রকার উত্‍সাহী। আর সেই কারণেই সইদের পুতুলের বিবাহ সে নিজে হাতে করে দেয়। এ পেশায় আসা তার তা প্রায় বছর তিনেক হলো। এখন সে সতেরো। 


যখন সে পাঁচ কী সাত........ তখন থেকেই বিবাহ ব্যাপারটা তাকে খুব টানতো। মা যখন শাঁখা-পলা-দু'জোড়া সোনার চুড়ির রিনিঝিনি তুলে বাঁধাকপি কাটতো......... শব্দ সুখে তার চোখ দুটো বুঁজে আসতো। স্নান সেরে যখন আদুল গায়ের ওপর লাল পেড়ে গরদের শাড়ীটা আলুথালুভাবে চাপিয়ে তর্জনীর ডুমো ডগা দিয়ে সিঁদুরের টিপটা অভ্যাস বশত গোল করার ব্যর্থ চেষ্টা করতো................. সরযূ অনিমেষ তাকিয়ে দেখতো মাকে। কী মোহময়ী লাগতো ওই রাঙা ছোঁয়ায়............. সরযূর যেন আর তর সইতো না। ----- ইসস বিয়ে করলে কতই না সাজতে পারবে! গা ভর্তি গহনা, নাকে নোলক, পায়ে ভারী তোড়া, সোনার জল করা কোমরবন্ধ!! যেমনটি ছোট খুড়িমা সাজেন! ..... আর ভাবতে পারতো না সরযূ। চট করে মায়ের কিছু ঝুটা গহনা আর আঁচলে একখান বাড়তি চাবি- গোছা বেঁধে নিয়ে দুলকি চালে ঘরের ভেতর পায়চারী করে অভিনয় করতে থাকতো............... সেই রঙ্গমঞ্চে একটা কাল্পনিক স্বামীর উদয় হতো, যার উদ্দেশ্যে সরযূ লজ্জায় লাল হয়ে ''লক্ষীটি'', ''ইসস, ছাড়ুন বলছি..... আঁখায় হাঁড়ি বসিয়ে এসেছি'' এমনসব স্বামী সোহাগের বাক্যগুলি প্রয়োগ করে এয়োতি সৌভাগ্যের সুখ অনুভব করতো............. যেমনটি ছোট খুড়িমা করেন আর কী! 


সরযূ আজ পিসির বাড়ি গেছে। ওখানে যাত্রা বড় ভালো হয়। পিসতুতো দাদা বিপিন অভিনয় করেন। কিন্তু পিসির বাড়িতে ঘটলো এক বিপত্তি। পিসেমশাই এর আকস্মিক উদর পীড়া শুরু হলো। প্রথমটা উপচার হিসেবে তেল জল বোলানো হলেও পরে পরিস্থিতি গুরুতর বুঝে বাড়িসুদ্ধ লোক তাকে নিয়ে ছুটল সদর হাসপাতালে। পিসিমাকেও দাদা নিয়ে গেলেন............. পাছে কিছু অঘটন ঘটে গেলে শেষ দেখাটাও করতে পারবেন না, এই ভেবে। সমত্ত মেয়ে সরযূকে নিয়ে গিয়ে আর রাত দুপুরে বিপত্তি বাড়াতে চাইনি তারা। তাই মোক্ষদা নামে এক বয়স্কা দাসীর সাথে সরযূকে রাত টা থাকতে হলো। কিন্তু মোক্ষদার বড় জর্দার নেশা। সরযূর অমন তীব্র গন্ধে মাথা ধরে এলে তাকে ভেতর ঘরে গিয়ে শুতে বললো। মোক্ষদার ঘুমের ধরন দেখে তাকে যে কেউ কুম্ভকর্ণের ভগিনী ভাবতে পারে। ©মৌমিতা


রাত তখন গভীর। হটাত্‍ই দরজায় সজোরে কড়া নাড়ার শব্দ। চোখটা সেই মাত্র লেগেছিল সরযূর। পিসিমারা এসেছেন এই ভেবে ঝটপট দরজা খুলতেই আগন্তুক মানুষটি হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়লো। সরযূ ভীত হয়ে ''বাবাগো'' বলে চিৎকার করতেই আগন্তুক মানুষটি তার মুখ চেপে ধরে শান্ত গম্ভীর কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বললো---- আমি ডাকাতও নই, পুলিশও নই...........দয়া করে চিত্‍কার করো না, আমি ভোরের আলো ফোটার আগেই বেরিয়ে পড়বো, পিছনে পুলিশ অনুসরন করেছে, তাই বাধ্য হয়েই আশ্রয় নিতে হলো। কণ্ঠস্বর শুনে আগন্তুক মানুষটি যে পুরুষ, এতক্ষণে সরযূ তা ঠাওর করতে পারলো। হাত আর বন্ধ মুখ নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করলো........... সবটাই সে বুঝেছে, তার দমখানা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে....... এবার যদি দয়াপূর্বক মুখটা খোলেন!! ©মৌমিতা

------- দুঃখিত........... সমরেশ মুখটা ছেড়ে দিয়ে ছিটকে দূরে সড়ে দাঁড়ালো। 

------- আপনি স্বদেশী ডাকাত???

------- আমি বিপ্লবী.......... বিপ্লব কাকে বলে জানো!! আচ্ছা......,এ ঘরে কেউ কী আসবে! 

------ না, আপাতত মনে হয়না.............. বেশ অবাক হয়ে সরযূ অপলক তাকিয়ে ছিল সমরেশের দিকে। 

------ কী দেখছো অমন করে! আগে কোনদিন সংগ্রামী মানুষ দেখ নি তাই তো!

------- না না , সেরকম কিছু............ লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল সরযূ। মনে মনে আউড়ালো-----ইসস, কী হ্যাংলা মেয়েমানুষ সে! কিন্তু কীই বা দোষ তার! এত সমুখ থেকে এমন পুরুষ মানুষও যে আর দেখে নি সে! চালের কারবারী বাবা আর কাকা যাদের সাথে নিত্য দেখাশোনা তারা এককথায় সঙ্কুচিত বক্ষ...স্ফীত উদর পুরুষ, ইংরেজ সাহেবের সামনে পোষা বেড়াল মতো ডাক ছাড়ে। কিন্তু এই মানুষটির দীপ্তিমান চোখ আর ব্যক্তিত্বের ঋজুতা চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিলো তার, এমন তেজে পুড়ে যাচ্ছিল সদ্য যুবতী মন। 

------ আমি কী বসতে পারি...... 

----- অবশ্যই...... ঘরের এককোণে রাখা আরাম কেদারাটা নির্দেশ করে বললো সরযূ। 

-------- আমার পরিচয় তো দিলাম, এবার তুমি বলো তোমার সম্পর্কে.........!

------ আপনি অচেনা পুরুষ, আমি কেন আপনাকে বলবো! আপনার সাথে কথা বললেও আমার সতীত্বে দাগ লাগতে পারে, তা জানেন........! ©অবচেতন

------- এসব কী কথা!!.... সমরেশ গর্জে উঠলো। ----- যতদিন না আমাদের দেশে নারীরা প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, ততদিন আঁতুড়ঘরেই থাকবে সারা দেশ। পেটের জ্বালাকে যথাযথ সম্মান জানিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি মেয়েরা যতদিন না পাকশালা থেকে খানিক বেরিয়ে বিশ্ব দেখবে আর পতিব্রতা তকমাটির যথার্থতা বুঝবে........... দেশ সাহেবদের থেকে মুক্তি পেলেও মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে মুক্তি পাবে না। যে দেশের জননী মাত্রই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সে দেশের সন্তান সকল কোন আধুনিকতার কাণ্ডারী হবে!! 


সরযূ লক্ষ্য করলো হটাত্‍ কেমন যেন লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছিলো মানুষটা। কিছুটা ভয় পেয়েও নিজেকে সামলে বললো ---- তা বলে কী সংসার করবো না! বাউন্ডুলে হয়ে থাকবো! 

------ আচ্ছা আচ্ছা ঘাট হয়েছে আমার, তো নামটা কী জানতে পরি!!

----- সরযূ.......যদিও ইচ্ছে করছিল না তার , তবুও ভদ্রতার খাতিরে ছোট্ট একটা উত্তর দিল 

------ বাহ, সরযূ নামের মানে জানো!!

------ হ্যাঁ........ সরযূ মাথাখানা ঘাড় অবধি নামিয়ে সম্মতি জানালো..... বেশ জ্ঞানী হয়ে বলতে থাকলো------ আমার বাবার ঠাকুমার নাম সরযূবালা, উনি সতীসাধ্বী নারী ছিলেন, সেই থেকেই আমার নাম সরযূ......

সমরেশ খানিক মুখ টিপে হেসে বললেন----- তুমি ছাই জানো! সরযূ একটা নদীর নাম, এই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল রামায়ণের অযোধ্যা। ঋগ্বেদেও........

কথা শেষ করতে না করতেই বাইরে ফিসফাস শব্দ শোনা গেলো। কেরোসিন বাতির আলো একেবারে মিটমিটে করে জানলার খড়খড়ি মৃদু উঠিয়ে সমরেশ দেখলো পুলিশ বাইরে ঘোরাফেরা করছে, মনে হয় কোনরকম আঁচ পেয়েছে। জানালাটা ভালোভাবে এঁটে সে সরযূকে বললো---- পুলিশ আসছে, ওরা মনে হয় সন্দেহ করেছে। পিছনের কোনও দরজা আছে??

------ না.......... ভয়ে কাঠ হয়ে সরযূ উত্তর দিলো। 

সমরেশ বুঝল এ যাত্রায় সে আর রক্ষা পাবে না! কিন্তু সে চিন্তা তো আর তার কোনদিনই নেই....... ভয় এই মেয়েটিকে নিয়ে............ সারারাত ঘরে বহিরাগত পুরুষ ছিল, এ কথা একবার চাওর হলে মেয়েটার কী হবে! ভবিষ্যত বলে কিছু থাকবে না.....। এসব সাত পাঁচ ভেবে সে বললো----- আমি বরং ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তোমায় নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করবে না, এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সমরেশ সত্বর দরজার দিকে পা বাড়লো। 

------- থামুন দিকি..... চুপটি করে বসুন এইকেনে...... সরযূ তাড়াতাড়ি দেরাজ খুলে বিপিনের যাত্রার সাজ থেকে মানানসই একটা বেছে নিলো। ------- এই নিন , চটপট এগুলো পড়ে ফেলুন। কী হলো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না পড়বেন!!

হতভম্ব সমরেশের কাছে এই মেয়েটি হটাত্‍ই অচেনা হয়ে গেলো। সে পোশাকগুলো পরিধান করতে করতে ভাবতে থাকলো, এই কী সেই মেয়ে যাকে এতক্ষণ নির্বোধ ভেবে সে মুঠো মুঠো জ্ঞান বিতরণ করছিলো! 

ততক্ষণে পাশের ঘর থেকে গিন্নি সেজে উপস্থিত সরযূ। গা ভর্তি ঝুটা গহনা আর পূর্ণিমার চাঁদের মত একটা রক্তিম টিপ। শাড়ির আঁচলটা মাথা অবধি ঘোমটা টেনে এক মুখ হাসি নিয়ে দাঁড়াল সমরেশের সামনে------- আমি আপনার স্ত্রী, মানে পুলিশদের সামনে..........

------ তাই!!......... সমরেশ কেরোসিন বাতিটা তার মুখের সামনে ধরলো। এমন রূপে সে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিল ক্ষণিকের জন্য। তার অতল গভীরে থাকা যুবক হৃদয় দেখেছিল তাতে প্রেয়সীর রূপ আর দেশের সন্তান দেখেছিল ভারতমাতৃকার রূপ............ । সমরেশের কানে বাজছিল


........শুভ্র-জ্যোত্‍স্না-পুলকিত-যামিনীম 

                       ফুল্লকুসুমিত-দ্রুমদল শোভিনীম

                             সুহাসিনীং সুমধুরভাষিনীম

      সুখদাঙ বরদাঙ মাতরম। 


সুখ স্বপ্ন ভাঙ্গল কড়ানাড়ার তীব্র শব্দে। নিজেকে গুছিয়ে একবুক নিশ্বাস নিয়ে সরযূ ভেতর থেকে উত্তর দিল

 ------- কে??? কে ডাকে এত রেতে?? 

ততক্ষণে সমরেশ যাত্রাদলের সাদা দাড়ি আর ধূসর কাশ্মিরী শালে বর্ষীয়ান হেঁপো রোগী সেজে বসে রয়েছে পালঙ্কে। 

বাইরে অপেক্ষারত গোরা পুলিশ আর দেশীয় দারোগার দল মহিলা কণ্ঠস্বর শুনে একটু ঘাবড়ে যায়। সচরাচর তো এমন হয়না। এত রাতে বাড়ির ভিতর থেকে পুরুষ কণ্ঠই কাম্য। যাই হোক, দারোগা বললেন-----বাসায় কী পুরুষ নাই! 

------কী দরকার আমাকে বলতে পারেন!

------ বেশ, তবে দরজা খোলো............. আমরা পুলিশ, একজনের সন্ধানে এসেছি....

------- এখানে আমি আর আমার স্বামী ছাড়া কেউ নেই! 

------- বেশ তো, আমরা সেটাই দেখতে চাই.... গোরা সাহেব দাঁড়িয়ে রয়েছেন অনেক সময় হলো, ভালো চাও তো দরজা খোলো.....

আর একটা কথাও না বাড়িয়ে সরযূ কপাল অবধি ঘোমটা টেনে দরজা খুললো।©মৌমিতা

হুড়মুড় করে পুলিশের দল ঘরে ঢুকতেই সরযূ বাঁধা দিয়ে বললো----- আমার স্বামী অসুস্থ, হাঁপের টান উঠেছে, দয়া করে ওনাকে বিব্রত করবেন না। এমন কথা শুনে সমরেশও দমকা কেশে উঠলো, কিছুটা থুথু ছিটকে পড়লো সাহেব পুলিশের সোনালী গোঁফে। সাহেব এমন অপরিচ্ছন্ন গ্রাম্য পরিবেশে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে না চেয়ে দারোগাবাবুকে বললেন----যাহা জিজ্ঞাসা করিবার করিয়া লও, আই থিংক হি ইস নট হিয়ার.... 

------ শোন, একজন বিপ্লবী, নাম সমরেশ দাস, যদি এখানে আসে তো আশ্রয় দেবে না, আর আমাদের জানাবে, বুঝেচ............... 

দারোগার কথা শেষ না করতেই সরযূর বুড়ো স্বামীর আবার কাশির বেগ উঠলো...... কেশে কেশে ঘর মাতিয়ে দিতেই বিরক্ত হয়ে পুলিশের দল বেরিয়ে গেল। দরজা লাগিয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস নিলো সরযূ। মাথা থেকে ঘোমটা খুলতেই আবার কড়া নাড়ার শব্দ

------- আরেকবার খোলো তো! 

----- কেন?

----- আহ, খোলোই না!!

সরযূ দরজা খুলতেই দারোগাবাবু ছিটকে ঘরে ঢুকে বললেন----- গলার স্বর শুনে তো মনে হচ্ছে বয়স তোমার বেশ কচি.......... তবে এমন বুড়ো বর হয় কিভাবে! 

 --------- গোরা সাহেব নয় ভিনদেশী, কিন্তু দারোগাবাবু তো এদেশীয়! উনি কী জানেন না, বাংলাদেশে একনো কুলীন প্রথার কত চল! আর রাঢ় আর বরেন্দ্র বামুনের মধ্যে তো সবথেকে বেশী! আমরা ভচ্চাজ্জি বামুন। আমি ওনার তেতীয় পক্ক............... এই বলে সরযূ দারোগার সামনে স্বামী সোহাগিনী হয়ে লজ্জায় লুটোপুটি করে দাঁত দিয়ে কাপড়ের খুঁট দংশন করলো। 

------ হয়েছে, হয়েছে...........

----- না না , দারোগাবাবু, দাঁড়ান...... স্বামীর উপবীতখান দেকেই যান দিকি.......... সরযূ ছুটে সমরেশের শালের ভেতর হাত ভরে বললো----- এই যে শুনচ গো.............. ওনারা তোমার উপবীত দেখবেন। হেঁপো সমরেশ আরো খানিক হাঁপাতে থাকলো। সরযূ তার নখ দিয়ে সমরেশের সাদা ফতুয়ার কিছুটা অংশ ছিঁড়ে সেখানেই পাকিয়ে জড়িয়ে স্বল্প বের করে দেখালো। 

----- বেশ, বেশ, শক্ত করে দোর দাও। 


সরযূ দারোগার মুখে প্রশান্তির ছাপ দেখে নিশ্চিন্ত হলো। সমরেশ অভিনয়ের সাজ ছাড়লো। ওদের গাড়ী বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ উভয়েরই কানে এলো। 

------- আপনি বসুন, আমি এগুলো খুলে আসি........... সরযূ ভেতরে যেতে উদ্যত হলে সমরেশ তাকে বাঁধা দিয়ে বললো----- থাক না, তোমায় বেশ মানাচ্ছে......... ভোরের আলো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুটবে , তার আগেই আমি বেরবো। এমন কথায় সরযূ যেন একটু দমে গেলো.......... নিজেকে পুরোদস্তুর সামলে নিয়ে বললো----- অভিনয়টা তো বেশ ভালোই করেন দেখলাম। ©মৌমিতা

------ অভিনয়!! আমি তো অভিনয় করিনি, হ্যাঁ শুধু ছল করে কেশেছি মাত্র..... 

কথার মর্মার্থ বুঝে সরযূ লজ্জায় মাথা নামালো খানিকটা সমর্পনের অভিপ্রায়ে। 

ততক্ষণে ফাঁকি দেওয়া রাত শেষে ভোর উঁকি দিচ্ছে। সমরেশ ঝটপট বেরনোর উদ্যোগ নিয়ে বললো----- বিশ্বাস রাখি, আবার দেখা হবে, বন্দেমাতরম................

সরযূ কী যেন বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু সে মানুষটা কোথায়! এক নিমেষে ঝড়ের বেগে ছুটে মিশে গেলো কুয়াশাঘেরা আলো আঁধারী পথে। ©অবচেতন

                         

                     ২ 

--------দিদি , সুখবর আছে ...... তেনার খোঁজ পেয়েছি.............. একটা রোগা বছর কুড়ির ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল সরযূকে। ------ আমার যথাযথ পরিচয় প্রমান দিয়ে যখন তোমার কথা আমি ওনাকে বললাম এক কথায় চিনে নিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেমন আছো, আর .....

----- আর কী বল!........... গভীর আকুতিতে জানতে চাইলো প্রায় চল্লিশ সরযূ। 

------ এই..... তোমার সংসারে আর কে কে আছেন!!........ ছেলেটি উভয়ের সম্পর্কের আঁচ পেয়ে লজ্জায় মাথা চুলকে সেখান থেকে পালালো। 

সরযূ আটপৌরে শাড়ির আঁচলটা সামান্য ঠিক করে নিয়ে নিজেকে আয়নার সামনের দাঁড় করালো। প্রতীক্ষার দিন-রাতের সাক্ষী চোখদুটো আরো গভীর লাগলো। সেও তো কমদিন নয়! মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে কুড়িটা সংগ্রামী বছর।  

 

সেই রাতের পর থেকে সরযূর জীবন সম্পূর্ণ অন্য খাতে বইতে থাকে। বিবাহ পাগল, হালকামতির মেয়েটি নিশ্চুপ হয়ে যায়। বাড়ি থেকে তখন তার বিবাহের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। সে নির্ভীকভাবে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো , বিবাহে সে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। এমন কথা শুনে সকলে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো......... ভাবল এই মেয়েকে নিশ্চয় অপদেবতায় ভর করেছে। ওঝা আনার চেষ্টা পর্যন্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সরযূর দৃঢ় প্রতিবাদে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পাড়া প্রতিবেশী, সই সকলেই তাকে যেন সন্দেহের চোখে দেখছিলো..............প্রাণপণ সন্ধান চালাচ্ছিলো, যদি কিয়দাঙশে ডাইনী কী পেত্নীর দেখা মেলে। ©মৌমিতা


সরযূ কাকে বোঝাবে!! বিবাহ যে তার সম্পন্ন হয়েছে। সারা জীবন ব্যাপীও যেখানে মেয়েরা বৈবাহিক সম্পর্কের সঠিক অর্থ অনুধাবন করতে পারে না, আজ্ঞাধীনতাকে নৈতিক কর্তব্য মনে করে............. সেখানে একটা রাতের একাঙ্ক নাটকে অভিনীত স্ত্রী এর ভূমিকায় সে পেয়ে গেছে জীবনসুধা, অনুধাবন করেছে জীবন সঙ্গীর সঠিক সংজ্ঞা। সে তাকে ভুলবে কিভাবে! আর ভুলবেই বা কেন! তার নামের বৈবাহিক চিহ্নই তো সে মন থেকে অঙ্গে উঠিয়েছিল, তবে এখন কেন পারবেনা তাকে সঙ্গে নিয়ে চলতে!! ঘরোয়া সাধারণ মেয়াটা এককথায় জেদী, একগুঁয়ে হয়ে গেলো। বাড়ি থেকে এলো দুর্বিষহ লাঞ্ছনা, এমনকি প্রহারও সহ্য করতে হয়েছিল দিনের পর দিন। কিন্তু তাতে কী!... সংকল্প একটাই, বিবাহ সে শুধু তাকেই করবে। 


এমন উদ্দেশে চরিতার্থ করতেই যোগ দিল স্থানীয় বিপ্লবী দলে। তত্‍কালীন মেদিনীপুরের তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের 'ভগিনী বাহিনী'তেও যোগ দিল সে। দুঃসাহসিক অস্ত্রবিদ্যায় নিজেকে পারদর্শী করলো। লাঠি খেলা, বন্দুক চালানো এসবে নিজেকে পারদর্শী করতে থাকে সরযূ। পাশাপাশি চলতে থাকে সক্রিয় বৈপ্লবিক কার্যকলাপ। গোপন নথিপত্র স্থানান্তর, আহত বিপ্লবীদের দক্ষ সেবিকার মতো শুশ্রূষা, ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি মুষ্টিভিক্ষার মাধ্যমে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য অর্থসংগ্রহ..... । গোপন স্থানে আশ্রিত বিপ্লবীদের খাদ্য, প্রয়োজনীয় জিনিস এমনকি রাইফেল পর্যন্ত সরবরাহ করেছে সে। ফলত সহজেই পুলিশের নজরে আসে, একবার গ্রেপ্তার পর্যন্ত হয়, কিন্তু প্রত্যুতপন্নমতি সরযূ বিটিশদের চোখ ফাঁকি দিতে সেবারও সমর্থ হয়েছিল। জনসচেতনতার উদ্দেশ্যে মিছিলে যোগদান করেছে, সকলের সাথে গলা মিলিয়ে বলেছে.....     ওরে ও পাগলা ভোলা!

  দে রে দে প্রলয় দোলা   

    গারদগুলা    

জোরসে ধরে হেচকা টানে!


ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে বৃহত্‍ সাগরে পড়েছিল সরযূ। তবু সন্ধান জারী ছিল। মনে মনে খুব খুঁজেছে মানুষটাকে। পরবর্তীকালে দলের বেশ কিছু কর্মী সদস্যকে বলেও রেখেছিল। কত সময় ভুয়া সন্ধান পেয়ে পাগলিনী হয়ে ছুটে গেছে সে। শূন্য হাতে ফিরলেও শূন্যমন কোনদিনও হইনি তার, তিনি যে তার হৃদয়-সম্রাট হয়ে বসে রয়েছেন! 


আজ সরযূ প্রস্তুত............. কিছুকাল আগে হলে হয়তো একে অভিসার বলা যেত। কিন্তু এখন যে উভয়েই মুক্তিযোদ্ধা। সমরেশ যে নির্দিষ্ট স্থানে তাকে পৌঁছতে বলেছিল দলের কর্মী ছেলেটির মারফত, পুলিশের নজর বাঁচিয়ে সে সন্তর্পনে সেখানে পৌঁছলো। একটা পরিত্যক্ত বাড়ি। স্যাঁতসেঁতে উঠোন পেরোতেই দেখলো মানুষটা সমানে দাঁড়িয়ে। সরযূ কন্টকিত হলো, যেন সে সেই সতেরোর তরুণী........... একই রয়েছে মানুষটা, সেই চোখ, সেই উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। কিন্তু সমরেশ খেয়াল করলো ,.....যে সরযূ ছিলো বেলীফুলের গন্ধমাখা আদুরে, আজ যেন তাকে রক্তজবা মনে হচ্ছে, কী ভীষণ তেজ! 

------- আমি জানতাম তুমি মুক্তিমন্ত্রের কাণ্ডারী হতে পারবে.......... সমরেশ বলল। 

------- আমি জানতাম, আমি আপনাকে খুঁজে পাবোই। 

-------বিবাহ করনি কেন!!

------ আমার স্বামী জীবিত, আমি বিবাহ করবো কেন............ লজ্জায় সমরেশের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিলো সরযূ। 

------- নামটা শুনি তার! দেখি চিনি নাকি!..... সমরেশ সরযূর মুখে নিজের নামটুকু শোনার উৎকণ্ঠা সম্বরণ করতে না পেরে বলেই ফেললো। 

-------- ভচাজ্জি বামুন! আমি ওনার তেতীয় পক্ক.................

শুনে সমরেশ হো হো শব্দে হাসতে থাকলো। তখনই বাইরে থেকে গুলির শব্দ। কোনোভাবে খবর পেয়ে গেছিল গোরা বাহিনী। খন্ডযুদ্ধ শুরু হলো দুই পক্ষে। সমররেশের সাথে তার দুজন সাগরেদ ছিল। সরযূ রণাঙ্গনে নামতে গেলে সমরেশ সেই প্রথম তার ওপর ওপর অধিকার ফলিয়ে বলে------ আমি তোমায় নির্দেশ দিচ্ছি, আমি মরে গেলেও তুমি ওদের সামনে বেরবে না। 

সরযূ বাধ্য সহধর্মিনী,........... সেখান থেকে এক পাও নড়লো না। আধঘণ্টা খন্ডযুদ্ধের পর পুলিশের গুলি সমরেশকে বিদীর্ণ করলো। সবটা চোখের সামনে দেখলো পাষাণী সরযূ। পুলিশের গাড়ী বেরিয়ে গেলে ছুটে গেলো সমরেশের কাছে। ভূপতিত সমরেশের হাতখানা ধরলো..... 

---- সরযূ ওই গানটা একবার গাইবে ! জননী গো .......... সমরেশ শেষ নিশ্বাস নিতে নিতে বললো.... 

    তোমার অভয়-পদ-স্পর্শে, নব হর্ষে 

     পুনঃ চলিবে তরণী শুভ লক্ষ্যে। 

   জননী গো, লহ তুলে বক্ষে, সান্ত্বন-বাস  দেহ তুলে চক্ষে.............

সরযূর আকুতি ভরা গানটি সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নির্ভীক সৈনিকের মুখ থেকে শুনল শেষ শব্দ, চিরন্তন ধ্বনি------- বন্দে মাতরম।


যথার্থ প্রেম, ত্যাগ আর পূজা এগুলো একই সরলরেখার ভিন্ন বিন্দু। তাই তো সরযূ প্রেমকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সমরেশের মৃত্যুর পরও থেমে যায়নি। সমরেশের স্বাধীন ভারত গড়েছিল নিজে হাতে করে। 


গান: শ্রদ্ধেয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শ্রদ্ধেয় কাজী নজরুল ইসলাম, শ্রদ্ধেয় অতুলপ্রসাদ সেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy