সূর্যাস্তের আগে
সূর্যাস্তের আগে
‘’আরে...বেলা তো গড়িয়ে গেলো, এক কাপ চা দিতে যদি এত সময় লাগে তবে কী আর বলবো’’.....কর্তার এমন কথা শুনে একবার সচকিতে ঘড়ির দিকে থাকলেন শ্রীময়ী। সবে তো সাড়ে ছ’টা বাজে, এত চেল্লামেল্লি করতে পারে না মানুষটা, উফ্ফ... ভাবতে ভাবতে চিনি ফুটানো জলে দু চামচ চা পাতা ফেলে ঢাকা দিয়ে বেরিয়ে এলেন।
ছোট্ট একফালি বারান্দা। তাতে একটা পাশ করে রাশিকৃত অপ্রয়োজনীয় সাংসারিক টুকুটাকি। সেখানেই শীত শেষের রোদ তিড়িং বিড়িং করছে। শ্রী রোদ্দুর দেখতে বড় ভালোবাসে, তার থেকে বরং বলা ভালো রোদ মাখতে। কিন্তু ঘর সংসারী মানুষগুলোর শখগুলো কেমন যেন গুটিগুটি পায়ে মরুভূমিতে গিয়ে দাঁড়ায়। তাই বালিশ বিছানা রোদে দিয়েই দৌড় দিল রান্নাঘরের দিকে আর ফিরে এলো এক কাপ চা আর দুটো সুগার ফ্রী বিস্কুট নিয়ে। প্রসূনবাবু খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই হাতড়ে চায়ের কাপ টা মুখে তুললেন। এ তার নিত্যিদিনের ছকে বাঁধা রুটিন। কাপটা খালি হতেই মুঠোফোনটায় চোখ লাগালেন। বেশ কদিনই হল কিনেছেন এটা। এখন সকালে উঠেই তিনটে জিনিস ...চা, খবরের কাগজ আর মোবাইল ছাড়া তার নাকি প্রাতঃকার্য ঠিক আসেনা। .........."ঘরে তো মাছ আনাজপাতি কিছুই নেই, কী দিয়ে রান্নাটা করবো বল তো! রান্নাঘর থেকে গলা বললেন শ্রীময়ী। অগত্যা প্রসূনবাবু ফোনটা রেখে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন।
বাজার যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছেন এমন সময় পাশের ঘর থেকে শুনলেন মেয়ের গলার আওয়াজ। মনে হয় ফোনে কথা বলছে জামাই এর সাথে। তিনি বুঝলেন এ জোনে তার প্রবেশ স্ট্রিক্টলি প্রহিবিটেড। কিন্তু এমন ক্ষেত্রে চোখকে শাসন করা যায়, কিন্তু কান বেটা বড়ই অবাধ্য। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনের এপারের কথাগুলো কানে এলো।
........’ কাল কেনো কিনে রাখনি! আজ তো দাম বেশি হাঁকবেই।‘ আবার ওপার থেকে কিছু বলছে এপার তাই নিশ্চুপ। আবার এপারেরটা শুনলেন তিনি ...............’কী বলো! একটা গোলাপ ৫০ টাকা! ওপারে কী বললো শুনতে না পেলেও এপারের চুম্বনশব্দ পাওয়ায় সবটাই ঠাওর করে অবাধ্য বেয়ারা কান নিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়লেন। আচ্ছা, আজ আবার কিসের দিন কোমো যে বলছিলো সুশান্তকে.... মনে মনে ভাবতে ভাবতেই পায়ে চটিটা গলালেন। নাহ, শ্রীকে এসব জিজ্ঞাসা করা বেকার। এসবের খোঁজ সে কি রাখবে..... । এসব উটকো না ভেবে বাজারের দিকে রওনা হওয়ায় সমীচীন বুঝলেন। ফিরে এসে আবার স্কুল বেড়তে হবে।
*************************
পেঁয়াজকলি, মূলো, বেগুন ছাড়া অল্প নতুন আলু নিলেন। ‘’আজ শ্রীকে একটু আলুরদম করতে বলবো। সুগরটা ধরা পড়ার পর সবই তো বন্ধ’’....আনন্দে ঝিলমিলিয়ে উঠলেন খোসা ওঠা আলুগুলো দেখে। বাগানের শখে বাজার এলেই ফুলের দোকানগুলোয় একবার করে ঢুঁ মারেন। এখানেই কিছু নতুন প্রজাতির চারা আনে ওরা। যেমন জবার বিভিন্ন টাইপ, লাল ছাড়া সাদা, হলুদ গোলাপ উনি এখান থেকেই তো পেয়েছেন। এখন ওনার বাগান ভর্তি যে রঙ্গন সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আলো মেখে বসে থাকে , তাও এখান থেকেই প্রাপ্ত। আসলে ওনার বাগান বলতে তো গ্রিল বারান্দার ঠিক সামনে একফালি জায়গা। ওখানেই একে অপরকে জড়াজড়ি করে সংসার বেঁধেছে শখের বাগান। তাই ইচ্ছে থাকলেও খুব বেশি চারা নিয়ে যাবার উপায় ছিলনা। তাছাড়া ঘরে রোদ ঢোকে না বলে এমনিতেই শ্রীময়ীর যেন অভিযোগ আছে। এমনই রোদ পাগল মানুষ।
কিন্তু আজ যে ফুলের দোকানের সামনে এতো কেন ভীড় তিনি ঠিক বুঝে উঠতে না পেড়ে একটু ঠেলাঠেলি করেই এগিয়ে গিয়ে দেখলেন সব গোলাপ...লাল টুকটুকে। বেশ লোভ লাগলো তার। কী যেন বলছে সকলে.....কি! রোজ ডে না কি! ব্যাপারটা বুঝলেন এবার। তাই ভিড়টা কচি বয়সের। আর এখানে থাকাটা খুব একটা সমীচীন নয় ভাবতেই পিছন থেকে কে যেন বলে উঠলো...’’ জেঠু, ভুল জায়গায় এসেছেন, আমাদেরকে দেখতে দিন।‘’ লজ্জায় লাল হয়ে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছেন ...’ এ কি পুন্ন এখানে! আমাকে দেখে ফেলে নি তো! ইসস , কি বাজে ব্যাপার’’.........চটজলদি কেটে পড়লেন ওখান থেকে। আর ফেরার সময় দেখলেন ছেলে পুন্নকে বেশ ডাগর দেখে একটা লাল গোলাপ কিনেছে। আসলে প্রসূনবাবু ফুলের প্রতি তার নির্ভেজাল প্রেমে ছুটে গেছিলেন। কৈশোর কিংবা যৌবনে তিনি সদ্য বা মধ্য যৌবনাদের দেখে যত না উচাটন হয়েছেন বরং এই প্রায় প্রৌঢ়ত্বে বিকাশোনমুখ বা বিকশিত ফুলগুলো দেখে প্রাণে বোধহয় অমন শিরশিরানি ধরে। পুন্ন যে ইন্দ্র্জালে ডুবেছে সে ভেবে মনে মনে কিছুটা হাসলেন।
আজ যে অদ্ভূত ব্যাপারটা তার সাথে হলো সেটা এর আগে কখনো হয়নি। ফুল দেখে তার প্রতি প্রেমে তিনি বিশ্ব জগত্ বিস্মৃত হন, কিন্তু আজ শ্রীময়ীর মুখটা বড্ড মনে পড়ছে যে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন টনটন করে উঠলো। আসলে যে বয়সে এমন সোহাগ তার পাওয়ার কথা ছিল....ছিটেফোঁটাও পায়নি। তখন তো এমন রোজ ডে ছিল না, সে কথা নয় থাক। একটা সিনেমা নিয়ে গেছেন কিনা সন্দেহ আছে। সারাজীবন মেয়েটার কাছে 'টেকার' হয়েই থাকলো তার চৌধুরী পরিবার। সারাটা রাস্তা কী সব মাথায় জিলিপির মত ঘুরপাক করতে লাগলো প্রসূন চৌধুরির।
আটান্নর প্রসূন চৌধুরির দাম্পত্যের বয়স ত্রিশ। কোনভাবেই তার শ্রীময়ীর সাথে বিবাহ যোগ্যতা হয়না, এ কথা তিনি ভালোভাবেই জানেন। বিত্ত ও অভিজাত্যহীন প্রসূনবাবুর তখন ‘আছের’ ভাঁড়ারে শুধু একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা। রুগ্ন মা আর অল্পবয়সী অবিবাহিতা বোনের পাশে সে পরিবারের নারীকূলে নাম লেখালেন বছর বাইশের শ্রীময়ী। আর সাথে যে প্রবাদটি সফল করল তা হলো..... জন্ম , মৃত্যু,বিবাহ তিনটেই মানুষের হাতে নয়। নাহলে কী এমন ঘরে বিয়ে হয় তার। শ্রীময়ীর পরিবার ছিল বড় ব্যবসিক। বাবা কাকার যৌথ ব্যবসা এবং পরিবার। ব্যবসা যখন রমরমা হটাত্ই একদিন কাপড়ের দোকানে ডাকাতি হয়। শোনা যায়, ফাঁকা কটা আলমারি ছাড়া আর কিছুই বলে পড়ে ছিল না। ব্যবসা লাটে উঠল। শ্রীময়ীর বাবা বিছানা নিলেন। এরই মধ্যে তার কাকা পৃথকভাবে কাপড়েরই দোকান খুললো। সবটা বুঝে কী না বুঝেই শ্রীময়ীর বাবা মারা গেলেন। ফলে কাকার সংসারের একটা বোঝা নামানো প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ জামাই হলেন প্রসূন চৌধুরী।
সান্মানিক স্নাতক শ্রীময়ী এ সংসারে যখন এলেন তখন শুধু তার রুপই নয় চেহারায়ও যথেষ্ট আভিজাত্য তার পূর্ব পরিচয় বহন করছে। বাসরঘরে প্রসুনবাবু বড় সোহাগ করে বলেছিলেন ‘’আমি তোমায় শ্রী বলে ডাকবো।‘’ ব্যাস.... ওই পর্যন্তই। মাস দুয়েক যেতে না যেতেই সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব ওই এক রত্তি মেয়েটার কাঁধে এসে পড়ে। যদিও শ্বশুরঘরে আসা মাত্রই এক নিমেষে কোনো এক অলৌকিক মন্ত্রবলে মেয়েরা বয়ঃপ্রাপ্ত হয় আর কিছু শখ আহ্লাদ , ‘পারি না, জানি না, ধুর ভাল লাগছে না’ এমন কিছু শব্দ কনকাঞ্জলি দিয়ে আসতে হয়। শান্ত স্বভাব, বুদ্ধিমতি পিতৃহীনা শ্রীময়ী সে থেকে এই পর্যন্ত হাসি মুখে সবটা করে যাচ্ছেন। নিজের সমস্ত গহনা দিয়ে ননদের বিবাহ দিয়েছেন। শখ বলতে কিছুই নেই, শুধু.... বই আর রোদ,.... বাসরঘরে এমনটাই জানিয়েছিল প্রসূনবাবুকে।
প্রথম যৌবনে প্রসূনবাবু শ্রীময়ীর নরম নিষ্পাপ গনগনে মন আর চক সাদা রঙের সোনালী আলো পিছলানো মোম শরীরে আচ্ছন্ন থাকলেও ডোবার উপায় ছিল না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোমো এলো কোলজুড়ে। কোমো ...মানে ক্যামেলিয়া, প্রসূন শ্রীর ভালোবাসার প্রথম ফসল। ফুল পাগল মানুষ টা সন্তানদের নাম ওই অনুসারে রেখেছেন। তিন বছর পরই ছেলে পুন্নাগ। এও এক ফুলের নাম , একে সুলতান চাঁপাও বলে। ফুল পাগল মানুষ। এর পর ছেলে মেয়ের লেখাপড়া , মেয়ের বিয়ে , সাংসারিক উত্থান পতন .....এসবের মধ্যে কখন যে দাম্পত্যটা ওবেলার বাসি ডাল ভাত হয়ে গেছে কেউ ভেবেও দেখেনি। এখন তো ছেলে মেয়ের ঝক্কি সামলে নাজেহাল অবস্থা শ্রীর। মেয়ে বিএড করার জন্য বাবার বাড়ি এসে আছে। আর ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। দুজনে কলেজে বেরলে আজ শ্রীর সাথেই সময়টা তিনি কাটাবেন, যাবেন না স্কুল। অনেক গল্প, সেই ফণী পিসির মামাতো দাদার পিসতুতো বোন, পাশের বাড়ি সুভাষ দের গল্প ..... পুরোনো আলবাম, শ্রীর বাবার বাড়ি থেকে আনা কাঠের বাক্সের রহস্য......... সব সব ঝালিয়ে নেবেন বৈকালিক আলোয়। তাই তো রবি ঠাকুর বলেছেন ‘’দাম্পত্য একটা আর্ট।‘’
**********************
বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতেই একবার ফোনে গুগল বাছাধনের সাহায্যে দিনটার মাহাত্ম্য একটু খুঁচিয়ে নিলেন। নিজের এরূপ বালখিল্যতায় হাসি পেলেও ভেতরে আজ যেন প্রশ্রয় পাচ্ছেন। ‘’হোক না শরীরী বয়স, সম্পর্ক তো আর বয়ঃবৃদ্ধ হয় না, আজ নয় আরও একবার ছেলে মানুষিই ......’’ এমন ভেবেই ছেলে মেয়ে দুটোর কথা ভাবলেন। আসলে ছেলে মেয়েদের যথেষ্ট জ্ঞানগম্যি হয়ে গেলে তারা ফলাও করে নিজের জীবনে তার রঙ ঢেলে ফেললেও বাবা মাকে কিন্তু রঙ্গবিহীন দেখতেই যেন বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করে। তাই পিতামাতা নামক শব্দটা জুড়লে যেমন অনেক কিছুর স্বার্থত্যাগ করতে হয়, তেমনিই অলিখিতভাবে প্রেম-প্রণয়, কিছু বৈধ প্রাকৃতিক চাহিদাও বেমানান হতে থাকে।
বাড়ি ঢোকার মুখে একটা ছোট গ্রীলের গেট, তারপরই চার হাতের বাগান। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলেন ওরা দুজনেই কলেজ চলে গেছে। গোলাপ গাছের কাছে গেলেন। এ যাবত্ একটা ফুলও কাওকে তুলতে দেননা। আজ নিজেই লাল গোলাপ তুলতে গিয়ে দেখলেন একটাও লাল নেই। বিমর্ষ মুখে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে হলুদটাকে মনে ধরলো। বেশ উত্তেজনা লাগছে মনে। যেন রিভিশন লেশন। এর মধ্যে যৌনতা কতটা আছে কে জানে, তবে কৈশোরের লুকোচুরি খেলে দেখা অদেখা আছে।
সারাঘর খুঁজলেন, কিন্তু কোথায় শ্রী!! কলঘর থেকে গোঙানি মতো শব্দ পেলেন। ধাক্কার সজোরে ছিটকানি ভেঙে গেল। শ্রী কাঁপছে। হাত পা ঠান্ডা, বোঝাতে চেষ্টা করছে ওর বাম দিকের বুকে ব্যাথা করছে। বছর খানেক আগেই শ্রীময়ীর হার্টের ব্যামো ধরা পড়েছিল, কিন্ত এমন তীব্রতা এই প্রথম। ছুটে সামনের বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। প্রাথমিক চিকিত্স্যার পর এখন একটু থিতু হয়েছে ওর শারিরীক অবস্থা, ডাক্তার জানালেন। উদ্বিগ্ন ছেলে, মেয়ে আর প্রসূনবাবু বসে রয়েছেন নার্সিংহোমের বেঞ্চে। দূর থেকে দেখলেন ওরা শ্রীময়ীকে, এখন তো কাছে যাওয়া নিষেধ। শ্রীময়ী হালকা ঘাড় নাড়লেন সংসারকে আশ্বস্ত করার জন্য, যেন কোনো চিন্তা কোরো না , এই তো ভাল হয়ে গেছি, এবারই সংসারের হাল ধরে নেবো।
ভিজিটিং আওয়ার বিকেল পাঁচটায়। সময় যেন আর কাটছিল না বাড়িতে প্রসূনবাবুর। আসলে তিনি কাজে অকাজে শ্রীময়ীকে ছাড়া থাকলেও পিতৃহীনা শ্রীময়ী এই প্রথমবারের জন্য তাকে ছেড়ে গেছেন। তাই দশ মিনিটও দশটা বছর মনে হচ্ছে। এ সংসারে গৃহকর্তী যে কেমন বাঁধন তা ভালই টের পাচ্ছেন। টেবিলের ওপর রাখা হলুদ গোলাপটা দেখে তার চোখ ফেটে জল আসছিল। নাহ, নিজের প্রতি কষ্ট হয়নি, শুধু মনে হচ্ছিল হতভাগী মেয়েটারই কপালে একটু সুখ সোহাগ নেই। নিজেকে আজ খুব দুষলেন। সাহস করে পকেটে গোলাপখানা নিলেন। একে একে ছেলে মেয়ে দেখে আসার পর নিজে গেলেন। কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকলেন। মনে হোলো কতকাল পর দুজনে একান্তে সময় কাটাচ্ছেন। ‘শ্রী ঘুমোচ্ছে মনে হয়’...মনে মনে ভাবলেন,.... সেই টানা টানা চোখদুটোয় সংসারের ঘানি টেনে অনিদ্রার কালশিটে পড়েছে। অযত্নের মেচেতা চকসাদা গাল দুটোতে লেপ্টে আছে। আর কমলা কোয়া ঠোঁট উপচে সেই নিষ্পাপ হাসি,যেন এখনো বাইশ। এমন পরিণত শ্রীময়ীকে বেশ লাগছে প্রসূনবাবুর। হাতটা ছুঁলেন, আঙ্গুলের ডগাগুলো এখনো টোপা কুলের মতই। জেগে উঠলেন শ্রীময়ী। হকচকিয়ে একটু মাথাটা উঁচু করতে যাচ্ছিলেন তখনই প্রসূনবাবু কাঁধে হাত দিয়ে শুইয়ে দিয়ে মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলেন। শ্রীময়ী এমন স্নেহ পান করছেন দু চোখ দিয়ে। একটু ভয়ে ভয়েই হলুদ গোলাপ টা বের করলেন, পাছে শ্রী এই বুড়ো বয়সে কিছু খারাপ ভেবে বসে... । হাতে দিয়ে বললেন ‘’ শ্রী ...আমি বুড়ো হয়ে গেছি!’’ অক্সিজেনের মাস্ক থেকে শুধু হাসলো শ্রী। আদুরে প্রশ্রয়ে প্রসূনবাবু বললেন ‘ আজ যে গোলাপের দিন’। ভালোলাগার আলোয় দুটো মুখ যেন চিরসবুজ লাগছে। শ্রী লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো। ওদিকে বেলের শব্দ। ভিজিটিঙ আওয়ার শেষ। একজন মহিলা কর্মী তাড়াতাড়ি চলে আস্তে বললেন ঘর ছেড়ে। শ্রী শুধু অস্ফুটে প্রসূনবাবুকে তার একমাত্র নিজস্ব সম্পদ কাঠের বাক্সটার কথা কী বলতে যাচ্ছিলেন। আর সময় নেই।
বাড়ি ফিরে বড় একা লাগছে প্রসূনবাবুর। মনটা কু ডাকছে। কিছু বাড়াবাড়ি হবে না তো এই রাতে আবার! উফ্ফ, হালকা ঠান্ডাতেও তার ঘাম হতে লাগলো। ঢকঢক করে জল খেলেন বোতল খুলে। হঠাৎই মনে পড়ল শ্রী যেন কী বলছিল! কাঠের বাক্সটার কথা!... আসলে এই বাক্সটা ওর মেয়েবেলার। ওটাই নাকি তার বাবার স্মৃতি। তাই সংসার খরচ বাঁচিয়ে যা দু পয়সা বাঁচে ওখানেই গচ্ছিত রাখেন। সময়ে অসময়ে পুন্ন, কোমো দুটোতেই ভাগ বসায় ওখান থেকে। তবে না বলে কেউই ওটা খোলে না। এতটুকুই বোধহয় মা বা স্ত্রীকে ওরা ছাড় দিয়েছে। ভাবলেন , নিশ্চয় পাগলীটা নার্সিংহোমের খরচাপাতির কথা ভেবে বাক্স থেকে ওর জমানো টাকা নেওয়ার কথা বলছে। মনে মনে হাসলেন। তবুও আজ প্রথমবার বাক্সটা খুলতে ইচ্ছে হোলো। না, টাকা নেওয়ার জন্য নয়, এমন অমানবিক অন্তত তিনি নয়। ছোট্ট বাক্সের ছোট্ট ছিটকানি খুলতেই একটা টাটকা লাল গোলাপ বেরিয়ে এলো। আনন্দে দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এলো প্রসূনবাবুর। বাইরে ঝিঁঝিঁরা সানাই ধরেছে........ । আর একটু পরই সূর্য উঠবে। সকাল সকাল নিয়ে আসতে হবে শ্রীকে। বাড়ি এসে মেয়েটা রোদ মাখবে যে।