রায়বাঘিনী রানী ভবশঙ্করী
রায়বাঘিনী রানী ভবশঙ্করী
রায়বাঘিনী রানী ভবশঙ্করী ছিলেন একজন বাঙালী কন্যা । পিতা চাইলে তার কন্যাকে আর দশটা কন্যার মতো পালন করে বিয়ে দিয়ে কন্যাদায় মুক্ত হতে পারতেন। নিজেও পুজো পাঠ করে নিরূপদ্রব জীবন কাটাতে পারতেন। রাজার উপরে নিজের রক্ষার ভার ছেড়ে দিতে পারতেন।না তিনি তা করেন নি। রাজার সাথে তিনিও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাগ করে নিয়েছেন দায়িত্ব। নিজের কন্যাকেও গৃহকোনে বন্দী হতে দেননি। নিজের মতো করে বীর করে তুলেছিলেন সেই কন্যাকে। বীর কন্যা তার সম্মান রেখেছিলেন। প্রতি পদে নিজেকে যোগ্য প্রমান করেছেন। প্রতিটি সময়ে নিজের ভালো বুঝেছেন, পরিবারের ভালো বুঝেছেন সাথে রানী হয়ে প্রজাপালনের গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।
স্বামী গর্বে ছিলেন গরবিনী তাই সহমরনে যেতে গিয়েও দেশের ভালোর জন্য আবার মন দিয়েছেন রাজকার্যে। পুত্রকে যোগ্য করে তুলে, রাজ্যকে নিষ্কণ্টক করে তবেই তিনি মুক্ত করেছেন নিজেকে। স্বামী মারা যান যখন, তখন তিনি যুবতী। কিন্তু নিজেকে পুত্র ও সমাজের কাজে ব্রতী করেছিলেন।প্রচুর ক্ষমতার অধিকারিণী ছিলেন তিনি। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করেন নি। নিজের আদর্শ থেকে বঞ্চিত হন নি। আদর্শ নারীবাদী মহিলা তিনি, সন্দেহ কোথায়...
রানী ভবানীশঙ্কর কি প্রতিটি বাঙালীনির আদর্শ হয়ে উঠতে কি পারেন না?কারন তিনি ব্যতিক্রম, যদি এটা ধরেও নিই, তাহলেও তিনি গড়ে তুলেছিলেন মহিলা বাহিনী, তারই মতো করে।
সেই অপরাজেয় শৈব বাহিনী সবার আগে থেকে লড়েছিল পাঠানদের সাথে। কে বলে মহিলারা পারেন না ? কে বলে মহিলারা দুর্বল ?
সালটা পনেরশ শতাব্দীর দিকে।
তখন বাংলা ছিল জলা আর জঙ্গল। হিংস্র শ্বাপদ আর জংলী জানোয়ারে পরিপূর্ণ। এরই মাঝে রয়েছে বসতি। বেশিরভাগ ছোট ছোট আদিবাসী জনগোষ্ঠী। শাসকদলও নানাভাগে বিভক্ত। এদিকে পাঠান ওদিকে মুঘল আর তার মাঝে বিভিন্ন ছোট ছোট হিন্দু রাজাদের চলছে রাজত্ব। সবে মিলে বাংলায় নিত্য খেলা বদলের খেলা চলতেই থাকে, যার বেশিরভাগটাই ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা...
ঠিক এরকম সময়ে এই বাংলায় জন্ম তার। নামেই বুঝতে পারছেন ইনি বাংলার মাটি জলে বড় হয়ে ওঠা এক সাধারণ বাঙালীনি। কিন্তু বোধয় এতটাও সাধারণ নন উনি।
যাইহোক, দেখা যাক ওনার পরিচয় ঠিক কি...
দীননাথ চৌধুরী ছিলেন জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ।
কিন্তু তিনি পুজো পাঠে নয়, মন দিয়েছিলেন অস্ত্র শিক্ষায়, ব্রতী হয়েছিলেন দেশ রক্ষায়।
গড়ে তুলেছিলেন নিজের হাজার জনের এক দুর্ধর্ষ বাহিনী। দায়িত্বে ছিলেন পেন্ড দুর্গের। যেহেতু নায়েক ছিলেন তিনি, থাকতেন এই দুর্গেই।
জন্ম:
******
ভবানী মাতা আর শিব শঙ্করের আশীর্বাদে তাদের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন সাক্ষাৎ ভবানী।এই দুর্গেই এক শুভ মুহুর্তে জন্ম হয়েছিল রানী ভবশঙ্করীর।
ছোটর থেকেই তিনি পেয়েছিলেন বাবার প্রকৃতি। দীননাথ চৌধুরী সেটা বুঝেই তাকেও তৈরি করেন তার মতোই করে। ঘোড়ায় চড়া, অস্ত্র শিক্ষা, শারীরিক প্রশিক্ষণ সমেত নিজের কন্যাটিকে গড়ে তুলেছিলেন নিজেরই ধাঁচে। শুধু সামরিক জ্ঞান নয়, তিনি শস্ত্রের সাথে শাস্ত্র শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলেন কন্যাকে। ফলাফলে সেই কন্যা সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, দর্শনবিদ্যা সমেত বিভিন্ন পুরাণ আর রামায়ন মহাভারতের জ্ঞানার্জন করেছিলেন।
বিবাহ:
*******
শিকার ছিল তার নেশা।
যৌবনে ভবশঙ্করী একদিন গিয়েছিলেন দামোদর নদের ধারে শিকারে, সেখানে একদল বাইসন তাকে আক্রমন করলে তিনি একলাই তাদের বধ করেন।
ভুরিশ্রবা বংশের রাজা রুদ্রনারায়ন সেদিন নিজেও বেরিয়েছিলেন শিকারে। স্বচক্ষে দেখেন এক বীরাঙ্গনা একদল বাইসনকে স্বহস্তে প্রতিরোধ করলেন। রাজা রুদ্রনারায়ন তখনই মনে প্রানে ঠিক করে নেন এই রকম বীর অকুতোভয় মহিলাই হতে পারেন উপযুক্ত ঘরণী।
এরপরে তাদের বিবাহ হয়।
রাজকার্য:
************
বিয়ের পরে রানী ভবশঙ্করী চলে যান স্বামীর ঘর করতে।তিনি স্বামীর সাথে রাজকার্যে ব্রতী হন।
স্বামী আর স্ত্রী ভাগ করে নিলেন কাজ। স্বামী সামলাতেন বহিঃবিভাগীয় কাজ আর স্ত্রী সামলালেন অন্তর্বর্তী বিভিন্ন কাজ।
স্বামী ব্যস্ত থাকতেন বেশিরভাগ বহিঃশত্রুর আক্রমন থেকে রাজ্যরক্ষার কাজে।
তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে বিশেষ একটি কাজ হল পাশের রাজ্য গৌড় থেকে পাঠানদের বিতাড়িত করে, সেখানে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
এই সময়ে রানী ভবশঙ্করী মন দেন ভেতরের সুরক্ষা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে। সেই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রাজবাড়ী আর দুর্গ সংস্কার করে তোলেন।
তারকেশ্বর আমতার বিভিন্ন জায়গায় তিনি মন্দির গড়ে তোলেন। গড়ে তোলেন দুর্গ। কৃষিকাজ, বয়নশিল্প, নৌকো তৈরি, গৃহ নির্মাণ, প্রযুক্তি, বাণিজ্য, শিক্ষা সংস্কৃতি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেইসময় এগিয়ে যায় তার রাজ্য।ধীরে ধীরে বর্তমান হুগলী হাওড়া জুড়ে তাদের রাজ্য বিস্তৃত হয়। ভুরিশ্রেষ্ঠ বংশ তথা ভুরশুত বংশ সত্যিকারের শ্রেষ্ঠ বংশ হিসেবে পরিচিতি পায় তাদের সুসাশনে আর পারদর্শিতায়।
সন্তানের জন্ম:
****************
জন্ম নেন রাজকুমার প্রতাপনারায়ন। কিন্তু পুত্রের ভাগ্যে পিতার সুখ দীর্ঘদিন স্থায়ী হল না। শীঘ্রই মারা গেলেন পিতা রুদ্রনারায়ন, তখন তার বয়েস মাত্র পাঁচ।
স্বামীর সাথে সহমরণে উঠবেন চিতায়, সতী হবেন ভবশঙ্করী, এমনটাই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সেই সময়ের কুল পুরোহিত আর উপদেষ্টা দল রানীকে বলেন তার মত যোগ্যা উত্তরসূরি যদি নিজেকে উৎসর্গ করে দেন তাহলে রাজ্য তো ধ্বংস হয়ে যাবে,
রাজকুমার এখনো শিশু তারই বা কি হবে...
রানী ভবশঙ্করী তখন তার ইচ্ছে দমন করে ফিরে এসে রাজ্য পরিচালনার কাজে ব্রতী হন।
পাঠান আক্রমন প্রতিহত:
************************
তিনি বাছাই করা কিছু ডাকাবুকো মহিলাদের নিয়ে গঠন করেন শৈব বাহিনী। প্রতিদিন রাতে রানী করতেন শিব আরাধনা, তখন এই বাহিনী থাকতো পাহারায়।
এরকম একদিনে তার রাজ্যের এক নায়েক বিশ্বাসঘাতকতা করে, চতুর্ভূজ চক্রবর্তী হাত মেলায় ওসমান খানের সাথে, (ওসমান খান ছিল মুঘলদের দ্বারা বিতাড়িত গৌড়বঙ্গের নবাব)।
ওসমানের রাগ ছিল রাজা রুদ্রনারায়নের উপরে।
কারন উড়িষ্যার রাজা গজপত মুকুন্দদেবের সাথে মিলে পাঠানদের বিতাড়িত করেছিলেন বঙ্গ থেকে।
সে কথা জানত চতুর্ভূজ চক্রবর্তী। এটাও জানতো প্রতিদিন রানী বসেন শিব আরাধনায়, এই সময়ে কেউ তার ব্যাঘাত ঘটায় না।এই সময়ে আক্রমন করলে রানীর কাছে খবর গেলে পরে, তিনি তৈরি হয়ে যুদ্ধে আসতে আসতে ততক্ষনে তাকে বন্দী করে নেওয়া যাবে।পরিকল্পনা অনুযায়ী
রাজ্য দখলের পরে চতুর্ভূজ চক্রবর্তী হবে নতুন রাজা। বিনিময়ে সে সাহায্য করবে ওসমান খানকে, গৌড় বঙ্গ ফিরে পেতে।
সেই অনুযায়ী আক্রমন করে ওসমান খানের 200 জনের বাহিনী অতর্কিতে। তখন গভীর রাত।
এদিকে চতুর্ভূজ সাহায্য তো করছেই, ভেতর থেকে। পাঠান বাহিনী অন্দরমহল অব্দি এগুলেই তারা ভেতরের কাজে হাত লাগাবে, সবে মিলে রানীকে বন্দী করা হবে সহজ...
কিন্ত রানীর মহিলা বাহিনী তো কম যায় না।
তারা নিজেরাই এক একজন ভবশঙ্করী। সেই রুদ্রানীদের আক্রমনে পাঠানদের সবাই প্রায় মারা যায়। বাকীরা জঙ্গলে আত্মগোপন করলে পরেরদিন খুঁজে বের করে শৈব বাহিনী। কচুকাটা হয় ওসমানের দল।এই যুদ্ধ কস্টাসনগড়ের যুদ্ধ নামে পরিচিত।
এরপরে ওসমান খান আর চতুর্ভূজ চক্রবর্তী আবার সঙ্ঘবদ্ধ হয়। এবারে আরো বড় প্রায় 500 জনের বাহিনী নিয়ে আক্রমন করার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। খবর পৌঁছে যায় রানীর কাছে।
রানী তার হাতি ঘোড়া সমেত বিশাল বাহিনী সজ্জিত করেন। সাথে যোগ দেয় বাগদি চন্ডাল সমেত বিভিন্ন শিকারি জনগোষ্ঠী আর আদিবাসী দল।বর্তমান খানাকুলের কাছে বাঁশুরি নামক জায়গায় যুদ্ধ হয় প্রচন্ড।
রানীর পছন্দের কামান 'রুদ্রাগ্নিশক্তি'র বহুল ব্যবহার হয় এই যুদ্ধে। ছিন্নভিন্ন হয় পাঠান বাহিনী।
এই যুদ্ধ বাঁশুরির যুদ্ধ নামে পরিচিত।ওসমান পালিয়ে বাঁচে। শেষে প্রায় ভিখিরি হয়ে কোনক্রমে উড়িষ্যা গিয়ে পৌঁছয়।
আকবরের সন্ধি স্থাপন:
**********************
এরপরে আকবর পাঠান সেনাপতি মান সিংকে।
মান সিং এসে সন্ধি করে মিত্রতা স্থাপন করে রানী ভবশঙ্করীর সাথে। উদ্দেশ্য ছিল পাঠানদের থেকে গৌড়বঙ্গকে মুক্ত রাখা, এখানে যাতে পাঠানরা আর ঘাঁটি না জমাতে পারে।
শেষ জীবন:
*************
পুত্র প্রতাপনারায়নের বিয়ে দেবার পরে তাকে রাজার আসনে বসিয়ে কিছুদিন রানী দেখভাল করেন রাজ্যের।পুত্রকে সবকিছু সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিয়ে যোগ্যতার দণ্ডে পুত্রর উত্তরণ ঘটলে তিনি চলে যান কাশি। শেষ জীবন শিব আরাধনা করেই শিবালয় গমন করেন।
তার সময়ের নিদর্শন:
*********************
বর্তমান ভবানীপুর ছিল তার কর্মক্ষেত্র।
তার তৈরি মন্দির দেখা যায় এখনো আমতায় মেলাই চন্ডী দেবী। এই দেবীর আশীর্বাদে তিনি একটি তরোয়াল পেয়েছিলেন যা তাকে অপরাজেয় করে তোলে।এই মেলাই চন্ডী বর্তমান হাওড়ার বিখ্যাত মন্দির এবং সুপ্রাচীন কাল থেকে কুলদেবী মন্দিরও এটাই।এছাড়া মা মকরচন্ডীর নামে রয়েছে মাকরদহ, মা বেতাইচন্ডীর নামে রয়েছে বেতাই, এইসব মন্দির তিনি পুনর্গঠন করেছিলেন।বাঁশুরি নামক জায়গায় তার স্থাপিত বাঁশুরি শিবমন্দির আজও রয়েছে যা পুজো করতেন রানী নিজে।