Sonali Basu

Tragedy

2  

Sonali Basu

Tragedy

রাজীবের আর পায়েলের কথা

রাজীবের আর পায়েলের কথা

6 mins
1.5K


সন্ধ্যে সাড়ে ছটা। রাজীব বাস স্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়িয়ে অস্থির হয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছিলো। ওর এই অস্থিরতার একটা কারণ আছে। পায়েল দুপুরে ফোন করে বলেছিল ওর কিছু কথা বলার আছে। অনেকদিন ধরেই ও পায়েলের সাথে সম্পর্ক করতে পারছে না, না ফোনে না সামনাসামনি। সেই সময় হঠাৎ পায়েলের ফোন আর তার ওপর এই কথা, ওর মন আশঙ্কিত হয়েছিল। রাজীব বলেছিল ফোনেই সব বলতে তাতে পায়েল বলল ও সামনে এসেই সব বলতে চায়। রাজীব তখন জিজ্ঞেস করেছিল কোথায় অপেক্ষা করবে ও। পায়েল নির্দেশ দিয়ে দিয়েছিল। সেইমতো এসে ও অপেক্ষা করছে কিন্তু ওর তো এখনো দেখা নেই।

এদিকে পায়েল বাস থেকে নামতেই দেখতে পেলো রাজীব দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ওর জন্য। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর ভেতর থেকে কিন্তু কিছু করার নেই। বাড়ির সবাই জেনে গেছে আর ওকে বলেও দিয়েছে কি করা যাবে আর কি নয়। আজ তাই ওকে কিছু একটা বলে এ সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কি ভাবে শুরু করবে ভাবতে ভাবতেই দেখতে পেলো রাজীব ওকে দেখে হাত নাড়ছে। ও হাতটা তুলল তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো ওর দিকে। কাছাকাছি আসতে রাজীব বলল “এতো দেরী করলে আসতে। আমি কতক্ষণ ধরে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি”

“একটু দেরী হয়ে গেলো। কি করবো বলো। চলো কোথাও গিয়ে বসি এখানে দাঁড়িয়ে তো কথা বলা সম্ভব না” রাজীব মাথা নাড়লো। পায়েল এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলো কেউ ওদের লক্ষ্য করছে কিনা। তারপর ওরা এগিয়ে গেলো রাস্তার ওপারে কফি-শপের দিকে। রাজীব আজ খেয়াল করলো পায়েল অন্যদিনের মতো ওর হাত জড়িয়ে ধরে হাঁটছে না। ওর একবার মনে হল প্রশ্ন করে কিন্তু শেষ অব্দি বাদ দিলো, কে জানে হয়তো কোন অসুবিধা আছে।

কফি শপে ঢুকে একেবারে কোনার দিকের টেবিল পছন্দ করে বসলো ওরা। ওয়েটার এসে অর্ডার নিয়ে যাওয়ার পর রাজীব বলল “কিছু হয়েছে নাকি পায়েল? আজ তুমি এতো চুপচাপ?”

পায়েল উত্তর দিলো না, ওয়েটার এসে কফির কাপ নামিয়ে দিয়ে গেলো। ও চলে যাওয়ার পর পায়েল ধীরে ধীরে কাপটা নিজের দিকে টেনে নিলো। কি ভাবে কথাটা তুলবে ভাবতে পারছে না। খানিক পরে বলল “আজ তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। আমাদের এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা উচিত”

রাজীব এতক্ষণ পায়েলের গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো। ওকে ধীরেসুস্থে কফিতে চুমুক দিতে দেখে ভাবলো ব্যাপারটা হয়তো সেরকম কিছু নয়। পায়েল এমনিতেই ভীষণ মুডি। তাই ওকে শান্ত ভাবে কফি খেতে দেখে ও নিজের কাপ হাতে তুলে নিয়েছিল, চুমুক দিতে যাবে এমন সময় পায়েলের কথায় চমকে উঠলো। এতটাই চমকাল যে ওর হাতে থাকা কফি কাপ থেকে কফি চলকে পড়লো। একটাই প্রশ্ন বেরিয়ে এলো ওর মুখ থেকে “কেন?”

“বাড়ির লোকেরা জেনে ফেলেছে। অশান্তিও শুরু হয়েছে। বাবা পাত্র দেখতে শুরু করেছে”

“তুমি প্রতিবাদ করতে পারনি, বলতে পারনি তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না?”

“কি করে বলবো? তোমার আমার সম্পর্ক কি সেটা কি তুমি আমি জানি না?”

“সেটা কি সম্পর্ক তৈরি করার সময় তুমি জানতে না? ভুলে নিশ্চই যাওনি সেদিনের কথা”

“ভুলে না গেলেও ভুলতে হবে”

“কিন্তু আমি তো তোমাকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনা পায়েল”

“এ আর চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় রাজীব। এই কথাটাই তোমাকে আজ বলতে এসেছিলাম। আজ থেকে তোমার আমার পথ আলাদা হয়ে গেলো। তুমি তোমার মতো সুখী হও আমাকে আমার মতো সুখী হতে দাও” রাজীবকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পায়েল চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লো তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।

রাজীবের মুখে আর কোন কথাই ফুটল না। ও হতভম্ব হয়ে দেখলো পায়েলের চলে যাওয়া। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো কি ভাবে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো ওর ভালোবাসার ঘর। অথচ এই ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলায় পায়েলেরই আগ্রহ ছিল বেশি।

মনে পড়লো সেদিনের কথা। রাজীব এসেছিল ওর মাসতুতো দিদি মিতুর নতুন বাড়ির গৃহপ্রবেশে। জামাইবাবু বহুদিন শহরের বাইরে অন্য শহরে থেকেছে কাজের কারণে। তাই এদিকে থাকা ওদের পৈত্রিক বাড়ির দিকে সেরকম নজর দিতে পারেনি। যখন ফিরে এলো তখন ওদের বাড়িটার অবস্থা বেশ শোচনীয়। জামাইবাবু আর ওর পেছনে টাকা না ঢেলে নতুন বাড়ি করে নিলো। সেই বাড়ির গৃহপ্রবেশেই ওর আসা। নতুন বাড়ি, আর গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান। অনেক আত্মীয় স্বজনের আগমন হয়েছে সেখানে।

এদেরই মাঝে ওর চোখে পড়ে গেলো এক মেয়ে, দেখতে ডানাকাটা পরী না হলেও যথেষ্ট আকর্ষণীয়। প্রথমে ও আকৃষ্ট হয়েছিল বৈকি যেমন যে কোন ছেলে মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। পরিচয় জানলো দিদির কাছেই “ও কে রে দিদি, তোদের পাড়া প্রতিবেশী কেউ?”

মিতু তখন বাড়ির কাজে বেজায় ব্যস্ত ভাইয়ের কথায় আলাদা কোন ঈঙ্গিত খুঁজে পায়নি সহজেই বলেছিল “আরে তুই ওকে আগেও দেখেছিস তবে তখন ও ছোট ছিল। ও আমার জায়ের মেয়ে পায়েল”

রাজীবের অবশ্য মনে পড়লো না কবে দেখেছে ও পায়েলকে তবে আর ওর প্রতি মনোযোগ দিলো না। সারা দিন দিদির ছেলে সৌনক, যে আবার ওরই সমবয়সী, তার সাথে ঘুরে বেড়ালো, একবার পুজোর জায়গায় তো একবার শহরের রাস্তায় রাস্তায় যখনই দিদি তার ছেলেকে পাঠালো কোন ভুলে যাওয়া জিনিস আনতে দোকান থেকে। এতো কিছুর মধ্যে ও কিন্তু পায়েলকে আর মনে রাখেনি কিন্তু পায়েল যে ওকে বিশেষভাবে খেয়াল করেছে সারাদিন ওর গতিবিধি লক্ষ করেছে সেটা টের পেলো সন্ধ্যের পর। সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল তাই মিতু বলল “তুই আজ থেকে যা ভাই, কাল যাবি” রাজীব প্রথমে রাজি হয়নি, পরেরদিন ওর কলেজ আছে। সামনে পরীক্ষা এখন ক্লাস কামাই করার ইচ্ছে ওর একেবারেই নেই। দিদি অনেকবার অনুরোধ করলো কিন্তু ও রাজি হচ্ছিল না। তারপর নিমরাজি হল।

নানা কথার পর ও খেয়াল করলো সৌনক ওকে ছাদে আসতে ইসারা করছে। ও আস্তে আস্তে ছাদে উঠে এলো। সৌনককে দেখে বলল “কি রে কি ব্যাপার?”

“চলে যাচ্ছ তার আগে চলো না একটা সিগারেট খাই”

সৌনককে বাড়ির বড়দের লুকিয়ে অনেক কষ্টে সিগারেটে সুখটান দিতে হয় আজ সমবয়সী মামাকে পেয়ে ও বেশ খুশি। দুজনে সিগারেট ধরিয়ে খানিকক্ষণ গল্প করতে করতেই নীচের থেকে সৌনককে কেউ ডাকতে আরম্ভ করলো। ও বলল “মামা তুমি একটু এখানেই অপেক্ষা করো আমি এখনি আসছি”

রাজীব মাথা নাড়তে ও নীচে চলে গেলো আর রাজীব ছাদের থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে লোকের চলাচল দেখছিল। হঠাৎ কে এসে যেন পাশে দাঁড়ালো। ও সৌনক মনে করে জিজ্ঞেস করলো “কাজ হয়ে গেলো?”

পাশ থেকে তখন উত্তর এলো “কই আর হল” মেয়েলি আওয়াজ পেয়ে ও চমকে পাশে তাকাতেই দেখতে পেলো পায়েলকে। ও বলল “তুমি এই সময় এখানে?”

পায়েল উত্তর দিলো “কি করবো? তুমি যে এখানে”

“আমার এখানে থাকার সঙ্গে তোমার এখানে আসার কি সম্পর্ক?”

“বুঝতে পারছ না নাকি বুঝতে চাইছ না?”

“আমি ঠিক...” রাজীবের কথা ওর মুখেই রয়ে গেলো কারণ ততক্ষণে পায়েলের ঠোঁট ওর ঠোঁটের ওপর নেমে এসেছিল। এর আগে ও কোন মেয়ের কাছে এরকম উষ্ণ আলিঙ্গন পায়নি। উত্তেজনায় ওর শরীরও গরম হয়ে উঠলো কিন্তু ওর মন ওকে জানান দিচ্ছিলো এটা ঠিক নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো জোর করে তারপর বলল “এটা ঠিক নয় পায়েল। আমাদের যা সম্পর্ক তাতে এই সম্পর্ক তৈরি করা অন্যায়”

পায়েল অসন্তুষ্ট গলায় বলল “আমি তোমার সাথে এক মত নই। শুধু কে কি বলবে এই চিন্তাই করবো, মনের যাকে ভালো লাগে তার কথা শুনবো না”

“ছেলে তো আরও আছে তুমি অন্য কাউকে পছন্দ করে সুখী হও”

“সবাই তো তুমি না”

রাজীবের একটার পর একটা যুক্তি পায়েল খণ্ডন করে যেতে থাকলো। শেষ যুক্তি হিসেবে রাজীব বলল “আমি চলে যাচ্ছি তাহলে তোমার মতি ফিরবে। তুমি পরিষ্কার করে ভাবতে পারবে বুঝতে পারবে কোন ভুল পথে পা বাড়াচ্ছ”

“তুমি যদি আজ চলে যাও তাহলে আমি আত্মহত্যা করবো”

এরপর আর রাজীব কিছু বলতে পারেনি। দুজনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠলো। বাড়ির লোককে আড়ালে রেখে দুজনের সম্পর্ক গভীর হল। এখন রাজীব পায়েলকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারে না। আর সেই পায়েল কি না আজকে এই কথা বলে গেলো! আর ভাবতে পারলো না ও। ওর মনে তখন একটাই কথা বারবার ঘুরেফিরে আসছে। এ সম্পর্ক অন্যায়, ও অন্যায় করেছে!

হঠাৎ দূরের টেবিলে বসা একদল ছেলেমেয়ে জোরে হেসে উঠলো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে। রাজীবের মনে হল ওরা ওকে দেখেই হাসছে, ও আর সহ্য করতে পারলো না, ছুটে বেরিয়ে গেলো রেস্তোরাঁ থেকে। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy