প্রতিকৃতি
প্রতিকৃতি
হাওড়া স্টেশনে মানুষের ভীড় গিজগিজ করছে। সবাই এক প্ল্যাটফর্ম থেকে অন্য প্ল্যাটফর্মে ছোটাছুটি করছে। সবার মধ্যে চরম ব্যস্ততা। কেউ কাজে যাচ্ছে!!!, কেউ বেড়াতে যাচ্ছে!!!!! আবার কেউ আপনজনদের নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে!!!!রিমাও আজ এদের মধ্যে একজন!!!! রিমার বাড়ির কাছে অফিস,, অটো ধরে যাওয়া যায় তাই.....এই ট্রেনের ঝামেলা নিতে হয়না!!!! তবে!!!! রিমা আজ অফিসের কাজের জন্য বর্ধমান যাচ্ছে, তাই সকাল সকাল এই হাওড়া স্টেশনে আসতে হয়েছে।
ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্ট হওয়ার সাথে সাথে এক মুহুর্তের মধ্যে ফ্ল্যাটর্ফমটা মানুষের ভীড়ে ভরে উঠল। আর ট্রেন ঢোকার সাথে সাথে হুটোপুটি লেগে গেল সবার ওঠার। রিমা একটু দূরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, সবার ওঠে যাওয়ার পর রিমা ধীরে ধীরে লেডিস কম্পার্টমেন্টে উঠে কোন রকমে চার নম্বরে একটা বসার জায়গা পেয়ে বসে গেল!!!!তবে চার নম্বরে বসাকে বসা বলেনা!!! ঝুলে থাকা বলে!!!! সে..... যাই হোক কিছুক্ষনের মধ্যে ট্রেন ছেড়ে দিল এবং তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছুটতে লাগল।
ঘন্টা দুয়েক পর ট্রেন এসে থামল বর্ধমান স্টেশনে। স্টেশনে নেমে আর কোনদিকে না তাকিয়ে রিমা তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়ল স্টেশন থেকে। তারপর একটা অটো ধরে নিজের কাজের জন্য বেড়িয়ে পড়ল। নিজের সমস্ত কাজ সেরে ক্লান্ত শরীরে রিমা যখন আবার বর্ধমান স্টেশনে এসে পৌঁছাল তখন ঘড়িতে সময় জানান দিচ্ছে বিকেল পাঁচটা। তবে ফেব্রুয়ারি মাস!!!! বেলাটা কিছুটা বড় হয়েছে তাই সূর্য তখনও পশ্চিম আকাশের কোন থেকে অল্প আলো বিস্তার করছে পুরোপুরি ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়নি। স্টেশনে এসে চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে কিছুটা জল খেয়ে তেষ্টা মিটিয়ে, একটা বেঞ্চে চোখটা হাল্কা বন্ধ করে কানে হেডফোন গুজে বসল রিমা, কারন ট্রেন আসতে এখনও দশমিনিট দেড়ি আছে!!!!! ক্লান্তি যেন আজ রিমার সারা শরীর এবং মনকে গ্রাস করেছে।
হঠাৎ রিমার কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল!!!!!, কারন রিমার মনে হতে লাগল কেউ ওকে বারবার লক্ষ্য করছে। রিমার সন্দেহ ঠিক প্রমানিত হল কারন.... একটু দূরে প্ল্যাটফর্মে বসে রিমার থেকে বয়সে ছোট একটা ছেলে সাদা কাগজে কিছু একটা করছে আর বারবার রিমার দিকে তাকাছে। রিমা উঠে ছেলেটার দিকে এগিয়ে যাবে জিজ্ঞাসা করতে ঠিক সেই সময় ট্রেনের অ্যানাউন্সমেন্ট হল। রিমা আর ব্যাপারটায় বিশেষ গুরুত্ব না.... দিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।
কিন্তু রিমা এগিয়ে যেতে গিয়ে লক্ষ্য করল,ছেলেটা ছুটে আসছে ওর কাছে। ছেলেটা রিমার সামনে দাঁড়িয়ে সাদা কাগজটা মেলে ধরল।
কাগজটার দিকে তাকিয়ে রিমা অবাক হয়ে গেল কারন কাগজে অসম্ভব সুন্দর ভাবে রিমার প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রিমা বিস্ময়ের চোখে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বল
------------এত সুন্দর আঁকতে পারো তুমি!
---------------ছেলেটা একটু হেসে বলল, দিদি এটা মাত্র দশ টাকা দাম তুমি নেবে!!!!!, সকাল থেকে এখনও কেউ নেয়নি!
---------------রিমা কোন কথা না বাড়িয়ে ওর হাতে একশো টাকা দিয়ে আঁকাটা নিয়ে নেয়। ততক্ষনে ট্রেন চলে এসেছে। রিমা ট্রেনে উঠে বলে, এরপর যখন এখানে আসব!!!!! তখন আর একজনকে সাথে করে নিয়ে আসব. তখন আমাদের দুজনের একসাথে প্রতিকৃতি বানিয়ে দিও। আর এই আঁকা বন্ধ করোনা চালিয়ে যাও।
--------------ছেলেটা ঠোঁটের কোনে অল্প হাসি হেসে মাথা নাড়ল আর কিছু বলার আগেই ট্রেন তার নিজস্ব গতিতে ফ্ল্যাটর্ফম ছেড়ে ছুটতে শুরু করল।
রিমা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, ফ্ল্যাটর্ফমে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটা তখন হেসে হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে। দমকা হাওয়ায় রিমার চুল গুলো অবাধ্য হয়ে উড়ে চলেছে। ধীরে ধীরে সবকিছুকে পিছনে ফেলে ট্রেন ছুটে চলল সামনের দিকে। রিমা দূরে আকাশের দিকে চেয়ে রইল আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসছে প্রকৃতির বুকে, আর বিন্দুমাত্র আলোর রেশ কোথাও নেই। রিমা নিজের মনে ভাবতে লাগল কত প্রতিভা এই ভাবে নষ্ট হয়ে যায়!!!!!!! যথা উপযুক্ত মূল্যের অভাবে!!!!!, কালের অতল গভীরে তলিয়ে যায়, এদের অসাধারন শিল্পসত্তা ভূলুন্টিত হয়, কেউ এই শিল্প সত্তার মূল্য দেয়!!!!আবার কেউ এর মূল্য বোঝেনা অবহেলায় মাড়িয়ে যায়!
