প্রথম প্রেমের সন্ধানে
প্রথম প্রেমের সন্ধানে


আমার একটা স্বভাবত গুণ কিংবা দোষ যে আমি সবসময়ে প্রেমে পড়ে যাই। প্রেমরাসে আমি প্রায় চৈতন্য দেব কিংবা রামকৃষ্ণ দেবের সম কক্ষ। কোথায় যেন শুনেছিলাম ",জীবে প্রেম করে যে ভগবান পায় সে। " তাই আমার প্রেম সাব্বাইকার জন্যে। আবার শুনেছি এক মহাকবি নাকি বলেছেন ,সকালের লাল আকাশ তোমাকে মনে করিয়ে দেয় যে তোমার ভেতর প্রেম গজগজ করছে। আমি সেটাও মানি ; খালি আকাশ নয় , গাছ পালা , পাহাড় নদী ,জঙ্গল ,সাহার সব কিছুর প্রেমে পড়ে গেছি। তাই প্রথম প্রেমটা খুঁজে বার করা সহজ নয়। কিন্তু আমি সহজে হার মানার পাত্তর নই। একবার যখন রেস এ নেমেছি লিখতেতো হবেই।
স্মৃতিচারণ করে আবিষ্কার করলাম সেই হারানিধি।
সমস্যা যে তখন আমার বয়েস ছ থেকে সাতের মধ্যে। প্রেমজ্ঞান হয়নি। তাই তখন বুঝিনি প্রেমে পড়েছি। এই বয়স ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে ওটাই আমার প্রথম প্রেম। পাঠকদের বোঝানোর জন্যে আমাকে Time Table Tennis খেলতে হচ্চ্ছে , এখন থেকে অতীত ,আবার অতীত থেকে এখন। আমি জানি পাঠকগণ নিজ প্রেমে ক্ষমা করবেন।
নায়িকা টুনটুনি। মেয়েদের বয়েস জানতে নেই ,তাই আমিও জানিনা। তবে আমার কাছাকাছি হবে , এই ছ সাত বছর। বাবা বদলি হয়ে আসলেন রাজশাহী। দাদারা ইস্কুলে ভর্তি হলো , মা আমার পরের ভাইটাকে নিয়ে আর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আমি মুক্ত বিহঙ্গ নাকি ছাড়া বলদ জানিনা। তবে বাড়ী থেকে বেশি দূরে চড়তে যাবার সাহস নেই। আমার জগৎ পেছনের বাগান ,কিছু ফুল ফল ঝোপঝাড়। আমাদের আর পাশের বাড়ীর বাগানের মাঝে একটা দেয়াল ;ইঁটের নয় , কোনো একটা ছোটোছোটো পাতাওলা গাছের।
প্রথম দর্শন :
দুপুর বেলা ;মা একটু ঘুমোচ্ছে ,ভাইও ঘুমোচ্ছে। আমি বাগানে ;বসন্ত কাল ,মৃদু মৃদু হওয়া ,মনটা উদাস ,কি করি ,কি করি ভাব। এখন জানি এই অস্থির ভাবই Pre -প্রেম মনের প্রস্তুতি। হামাগুড়ি দিয়ে ঘন পাতার দেয়ালের একটা ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলাম পাশের বাগানে। কেউ নেই। ভাবছি আর কি করবো ? কানে এলো খস খস আওয়াজ। এখন জানি ওটাই নুপুরের ঝুনঝুন। আরো ভালো করে দেখি ,বেড়ার ওপারে প্রায় হাত দুয়েক দূরে হামাগুড়ি দেয়া বেড়াল। সেও আমাদের বাগানটাকে দেখছে। এখন কল্পনার চোখে দেখি : নায়ক -নায়িকা খুঁজছে। একটা পাতার বেড়া মাঝখানে। যে দুটো ঝোপের ফাঁক তাদের দূরত্ব মাত্র এক গজ। কিন্তু তার পাশটাকে দেখছে না। প্রেমভরে দূরে দৃষ্টি। নায়ক প্রথম দেখলো লাল ফিতে বাঁধা মাথা। আর একটু ভালো করে দেখবে বলে ঝোপের মধ্যে মাথা ঢোকাতেই একটু শব্দ ;নায়িকার কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো।
চমকিত নায়িকা মুখ ফেরাতেই চার চোখের প্রথম মিলন। শান্ত চারিদিক ,দূরে কোকিল নয় কাক ডাকছে। কয়েক মুহূর্তের শুভ দৃষ্টি। নায়িকা জিভ বার করে পালালো। তখন মনে হয়েছিল ভেংচি , এখন জানি ওটা লজ্জা রাঙা মুখ লুকোনো।
এলো সই
পরের দিন পাশের বাড়ীর গিন্নী আমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করতে এলেন। অনেক গপ্পো ,পরিচয় আর চা বিস্কুট। বেলা শেষ ,এবার যাবার বেলা। আমার চিবুক ধরে আদর করে বললেন, " ভারি মিষ্টি মুখ ,নাম কি ?" নাম বললাম। তারপর শুরু হোলো মাসিমার বেশে দ্যূত ক্রিয়া। "আমার তোমার মতো মেয়ে ,নাম টুনটুনি। এসোনা একদিন দুজনে মিলে খেলবে। ও তো একাই থাকে ,দাদারা সব বড়ো ইস্কুল কলেজে যায়। আর একলা টুনটুনি পুতুল নিয়ে খেলে। " আমার মা সায় দিলো। এখন জানি এরা বাস্তবিক ভাবে Double দ্যূত , একজোড়া সই।
প্রথম পরশ
পরের দিন দুপুরের পরে গেলাম পাশের বাড়ী। প্রেমের rules আর regulations, do's আর dont's জানা ছিল না। তাই উৎকন্ঠা নিয়ে রাত জাগিনি। দাদাদের সঙ্গে খেলেছি , সময় মতো খেতে বসেছি। পেট ভরে খেয়েছি। দোষটা প্রেমের নয় ,আমার Inexperience .
মাসিমা খুব খুশি ,নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবেন।টুনটুনিকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমরা আমাদের চার চিখের মিলান কাহিনী বলিনি। ওটা আমাদের একান্তই নিজস্ব। মাসিমা বললেন বাগানে গিয়ে`খেলতে। টুনটুনির অনেক পুতুল খেলনা , একটা বড় ঝুড়ি ভর্তি। আমরা দুজনে ধরাধরি করে বাগানে নিয়ে গেলাম। সেই প্রথম পরশ। তখন ভাবিনি , এই বয়সে ভেবেও গায়ের মধ্যে ইলেকট্রিক শক পাই।
এলেম কাছাকাছি
সেই শুরু। এর পর তিন মাস স্বপ্নের মতো কাছাকাছি আসার প্রথম লক্ষণ ,ইচ্ছে প্রকাশ। এক সপ্তাহের মধ্যে রোজ মিলেছি পেছনের বাগানবাগানে।সামনের দরজা দিয়ে যাই নি , গাছের বেড়া ভেদ করে আমার অভিসার। টুনটুনি বললো ,পুতুলের বিয়ে দেবে। দুজনে মিলে প্ল্যান তৈরী। ওর মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে তাই সম্পর্কটা মধুর ;সাজানোর আর অতিথি আপ্পায়ন আমার ,তাই আমি Event Manager ; মন্ত্র পড়বে টুনটুনি ,সেই হবে পুরোহিত ,তা ছাড়া মায়ের`কাজ তো ওকেই করতে হবে.
বিয়ের দিন আমরা দুজনেই ব্যস্ত ,আমপাতা আর ফুল দিয়ে সাজানো দড়ি গাছে গাছে টাঙানো , বিয়ের জায়গা পরিষ্কার করা ,খাবার যোগাড় করা -কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব করে ফেললাম। এই প্রথম বার আমরা ঝগড়া করিনি। কথা নয় ,কাজই কাছে টানে।
বিকেলে সবাই হাজির ,সবাই হাসছে ;দুই বাড়ীর দাদাদিদিগন ,পেছনের আলী সাহেবের মেয়েরা ,এমনকি আমাদের মায়েরাও ,সঙ্গে দুচার বন্ধু। বেশ জমকালো ব্যাপার। টুনটুনি হলুদ শাড়ি পড়েছে ,সরস্বতী পূজোর মতো ;আমি ইজের আর কলার দেয়া গেঞ্জি গায়ে।
শাঁখ বাজিয়ে ,উলু দিয়ে বিয়ে শুরু। টুনটুনি মন্ত্র পড়লো : দু এককে দুই ,দুই দুগুণে চর্চার,দুই তিনে ছয় ,শেষ হলো দুই দশে কুড়িতে। সবাই তার বেদ মন্ত্রে অভিভূত ,কী হাসি আর আনন্দ। এবার আমার পালা : ছাড়ার মন্ত্র : খোকা যাবে শ্বশুর বাড়ী ,সঙ্গে যাবে কে ইত্যাদি আর শেষ ,দাদার হাতে কলম ছিল ছুঁড়ে মেরেছে...জীবনে এত হাততালি কখন পাইনি। আর আনন্দের শেষ হয় না ,সবাই হাসছে। আমরা নায়ক নায়িকা তৃপ্ত ,অভিভুত।
এরপর খাওয়া :কলা আর শশা ছোট ছোট করে টুকরো আমাদের দুজনের হাতে। সবাই হাত পেতে নিলো পুজোর প্রাসাদের মতো। আমাদের শেষ কাজ বাসর ,বর -কনেকে শুইয়ে দেওয়া হলো। এবার আমাদের বিশ্রাম। মাসিমা ছাড়লেন না ,দুবাড়ীর সব ভাই বোনেরা এক সঙ্গে খেলাম। এরই ফাঁকে টুনটুনিকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ওর মন্ত্র সেজদা শিখিয়েছে ,মহামন্ত্র নামতামন্ত্ৰ।
প্রথম প্রেমের শক্তি
শরৎচন্দ্র লিখেছেন ,ভালোবাসা শুধু কাছে টানেনা ,দূরেও সরিয়ে দেয়। আমাদের প্রেম শিক্ষা দিয়েছে ,শুধু দূরে নয় ,ওপরও তুলে দেয়। টুনটুনির নামতা মন্ত্র আমাকে বিচলিত করেছিল। আমাদের বাড়ীতে হারদাদা থাকতো ,বরিশালের লোক। দাদা মেজদার অঙ্কের পথ দেখাতো।আমার ঘনিষ্ঠ : তাকে শুধোলাম। হারদাদা অভয় দিলো আমাকে দশটা নামতা মন্ত্র শেখাবে লুকিয়ে ,যাতে আমি টুনটুনিকে হারাতে পারি। প্রেমের কী শক্তি :এক সপ্তাহে দুই থেকে পনেরোর নামটা মুখস্থ ,এখনো গড়গড় করে বলতে পারি। হপ্তা বাদে যেদিন টুনটুনির কাছে বিদ্যে জাহির করলাম ওর চোখ প্রায় হাতে পড়ছিলো। সেটাই আসল প্রেম দৃষ্টি।
টুনটুনির এই Transferred শক্তি আমার বাবাকেও মুগ্ধ করলো ,আমার মধ্যে এক অঙ্ক বিদ কে খুঁজে পেলেন। তাই আর দেরী যা করে ইস্কুলে ভর্তি করে দিলেন : নিজে না গিয়ে অফিসের একজনের সঙ্গে। পরীক্ষা নিলেন একজন মাস্টারমশাই। আমার শক্তি টুনটুনের কাছে হিরো হবার। মাস্টারমশাই ভর্তি করলেন সোজা ক্লাস থ্ৰীতে।
সেদিন বিকেলে টুনটুনি কথা দিলো ও পড়াশুনা করবে মন দিয়ে যাতে আমাকে হারাতে পারে।
বিচ্ছেদ
প্রেমের একটা অঙ্গ বিচ্ছেদ আর বিরহ। টুনটুনির ইচ্ছে আমাকে যেন হারাতে পারে : সেটা যে চার মাসের মধ্যে সফল হবে কেউ বোঝেনি।
১৯৪৫ সাল ,দেশ বেশ অস্থির। যুদ্ধ শেষ। স্বাধীনতার একটা সুর এসে গেছে। আমরা বুঝিনি। হটাত বাবার বদলির অর্ডার এলো , কলকাতায় হেড অফিসে। এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট করতে হবে। দিনগুলো কাটলো ঝড়ের বেগে। টুনটুনির সঙ্গে কাটানো সময় আস্তে আস্তে কমে গেল। আমরা দুজনেই জানতাম এবার বিদায় নেবার সময়। যাবার আগের দিন শেষ দেখা। টুনটুনি পাখির মতো কলকল করে কথা বলছে ,আমি তাল দিতে গিয়েও পারছি না। বললাম ,চলি। মাথা নেড়ে মুখ ঘুরিয়ে দৌড়ে বাড়ীতে ঢুকলো।
যাবার দিন সবাই এসেছে। আমার চোখ খুঁজছে টুনটুনিকে।
সে হারিয়ে গেছে স্মৃতির অন্ধকারে।