Tamali Sarkar

Abstract Comedy

3.4  

Tamali Sarkar

Abstract Comedy

প্রকৃত বন্ধু

প্রকৃত বন্ধু

5 mins
301


প্রকৃত বন্ধু


আমি তো মাছ মাংস ছাড়া ভাতই খেতে পারি না। শাক সবজি দিয়ে ভাত খাওয়া যায় নাকি! নাক চোখ কুঁচকে কথাটা বললো জিনিয়া। 

টিফিন টাইম চলছে। টিফিন বক্স থেকে সাদা ভাত আর কুমড়ো ভাজার তরকারি বের করে খেতে বসেছে আলেয়া। 

জিনিয়া পিজ্জার টুকরায় কামড় দিয়ে চিবাতে চিবাতে আলেয়াকে প্রশ্ন করলো, রোজ রোজ সবজি খেতে খারাপ লাগে না তোমার?


তাকে অপমান করার জন্যই প্রশ্নটা করেছে জিনিয়া, আলেয়া টের পায় সে কথা৷ নিজের গায়ে না মেখে আলেয়া হেসে উড়িয়ে দিয়ে জবাবে বললো, বরং মায়ের হাতে সবজি না হলেই খারাপ লাগে।


আলেয়ার হাসিমুখ দেখে জিনিয়া ভেংচি কেটে পাশে থাকা বান্ধবীদের সঙ্গে চাপা স্বরে গজগজ করে বলে উঠলো, মেয়েটার সবকিছু নিয়ে অহংকার। কোনোকিছুতেই তার অপমানবোধ হয় না। ওর মা তো লোকের বাড়িতে কাজ করে, বাবাও নাই। পুরনো একটা চুরিদার তাও রোজ ধুয়ে পড়ে আসে। এত অহংকার আসে কোথা থেকে ওর?

পাশ থেকে অন্যান্য বান্ধবীরা জিনিয়ার কথায় সায় দিয়ে বললো, একদম ঠিক বলেছিস।

আলেয়া ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে, তার উপর আবার যথেষ্ট মেধাবী, স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও খুব প্রিয় ছাত্রী সে। এসব কারণেই আলেয়াকে প্রচন্ড হিংসা করে জিনিয়া। সুযোগ পেলেই তাকে ছোট করার কথা শোনাতে ভুল হয় না জিনিয়ার। 


গতকাল জিনিয়ার জন্মদিন ছিলো। সেই উপলক্ষে আজ ক্লাসের বন্ধুদের জন্য কেক নিয়ে এসেছে সে। সবাইকে কেক দিলেও আলেয়াকে দিলো না। 


কেকের মধ্যে তো সবজি দেওয়া নেই৷ তুমি তো আবার সবজি ছাড়া খেতে পারো না। তাই তোমাকে দিলাম না। কিছু মনে করো না আলেয়া।



জিনিয়ার কথায় আশেপাশের সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। জিনিয়ার এসব আচারণ আলেয়াকে মনে যন্ত্রণা দিলেও হজম করে নেয় সে৷ হাসিমুখে উত্তর দেয় বুদ্ধিমতী আলেয়া, খুব ভালো করেছো তুমি। কেক আমার তেমন পছন্দ না। জন্মদিনের শুভেচ্ছা রইলো। গতকাল স্কুল বন্ধ ছিলো, তাই শুভেচ্ছা জানাতে পারিনি বলে তুমিও কিছু মনে করো না জিনিয়া।


আলেয়া কেক খেতে খুব ভালোবাসে। তার মা যেসব বাড়িতে কাজ করেন, সেইসব বাড়ির কোনো অুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে সেখান থেকে পাওয়া কেকের টুকরোগুলো আলেয়ার জন্য তিনি যত্ন করে নিয়ে আসেন৷ আলেয়া তখন তার মায়ের সঙ্গে মজা করে কেক খায়। আজ জিনিয়ার আনা কেক দেখে আলেয়ার খাওয়ার ইচ্ছে হলেও সেই ইচ্ছে ভেতরেই চেপে রাখলো সে। আলেয়াকে বারবার অপমান করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় আরও রেগে যায় জিনিয়া। আলিয়া কেন তার কথায় কষ্ট পেয়ে মন খারাপ করে না, এটাতেই তার যত ক্ষোভ। অতি আদর আহ্লাদে বড় হওয়া জিনিয়া অন্যকে ছোট করতে পারলেই যেন আনন্দ পায়। সঙ্গের বন্ধুরাও তার এমন আচারণকে প্রতিনিয়ত উসকে দেয়। 


বছর খানেক পরেই মাধ্যমিক শেষ হবে আলেয়া জিনিয়ার। ক্লাসে ভীষণ অমনোযোগী জিনিয়াকে নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই শিক্ষকদের। বাড়িতে টিউটর থাকলেও পড়াশোনা নিয়ে ততটা মাথা ব্যথা নেই তার। মেয়ে কষ্ট পাবে ভেবে বাবা মা'ও কখনো কড়া স্বরে শাসন করেন না। মেয়েও তাই বাবা মায়ের নরম গলার শাসনকে কখনো পাত্তাই দেয় না। 

প্রি-টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হলে শিক্ষকগণ স্পষ্ট স্বরে জানিয়ে দিলেন টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো না হলে তারা জিনিয়ার জন্য কিছুই করতে পারবেন না। এবার আর জিনিয়ার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া হবে না তবে। 


এর আগে এমন কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন জিনিয়া হয়নি। এতদিন বিদ্যালয়ের পরীক্ষার রেজাল্টে বাবা মাকে পটিয়ে স্বাক্ষর করাতে তার খুব একটা বেগ পোহাতে হয়নি। কিন্তু এবার সে কী করবে, আর এটা তো পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা পরিষদের বোর্ডের পরীক্ষা। এখানে তো কোনো রকম বাবা-মায়ের সাক্ষর হলে চলবে না। প্রি-টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসা যাবে। না হলে এবার একটা বছর নষ্ট।

সব সময় উৎসাহিত করা সঙ্গী বন্ধুরাও জিনিয়ার থেকে আজকাল খুব দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। এতদিন পাশে থাকা সেই বন্ধুরাই এখন আড়ালে তাকে ফেলুয়া বলে টিটকারি মারে। বিষন্নতা আর হতাশায় ছেয়ে যায় জিনিয়ার মন। এমন পরিস্থিতিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় অপমানিত হওয়া সেই আলেয়া। বিদ্যালয়ে ঢোকার মুখে আলেয়া দাঁড়িয়ে থাকে জিনিয়ার জন্য! গাড়ি থেকে নামামাত্র বিষন্ন জিনিয়াকে আলেয়া বলে ওঠে, এখনো তো অনেকদিন বাকি আছে জিনিয়া। আমরা ততদিন স্কুলে তাড়াতাড়ি এসে একসঙ্গে পড়াশোনা করতে পারি। অফ পিরিয়ডগুলোকেও কাজে লাগাতে পারি৷ একে অপরকে সহযোগিতা করলে আমরা অবশ্যই আরও বেশি ভালো ফল করবো, দেখবে তুমি।


আলেয়ার এমন কোমল স্বরের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় জিনিয়া। এতদিন বন্ধুদের সঙ্গে গল্প গুজব আর তামাশা করে পার করা জিনিয়া এখন আলেয়ার সঙ্গে পড়াশোনা করে কাটাতে থাকে৷ স্কুল এবং বাড়ি দুই জায়গাতেই দিন দিন মনোযোগী হয়ে ওঠে জিনিয়া। তার এমন পরিবর্তনে খুশি শিক্ষক ও পরিবার। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ দেখে খুশি টিউটরও। টেস্ট পরীক্ষার খুব বেশিদিন বাকি নেই আর৷ আগের মতো ওতটা ভয় এখন আর জিনিয়া পায় না। কেননা তাকে সাহস দেওয়ার জন্য এখন আলেয়াও আছে। 



আজ আলেয়ার জন্মদিন৷ টিফিন টাইমে টিফিনবক্স থেকে সবজি আর সাদা ভাত বের করে খেতে বসেছে সে। জিনিয়া পাশে এসে বললো, আমি কী আজ তোমার সঙ্গে তোমার আনা সবজি দিয়ে ভাত খেতে পারি আলেয়া?

আলেয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো জিনিয়ার মুখের দিকে। তারপর হেসে বললো, অবশ্যই।

খাওয়া শেষ হলে জিনিয়া উঠে হাত ধুয়ে নিজের ব্যাগ থেকে একটা বড় আকারের বক্স নিয়ে এসে আলেয়াকে দিয়ে বললো, তোমার মায়ের হাতের রান্না করা টিফিন তো অর্ধেকের বেশি আমিই খেয়ে ফেলেছি৷ তাই এটা তোমার জন্য।

আলেয়া অবাক স্বরে প্রশ্ন করে, কী আছে এর ভেতরে?

তুমি নিজের হাতে খুলেই দেখো।


আলেয়া বক্সটা খুলতেই দেখে একটা চকলেট কেক। তার উপর রাখা আছে ছোট্ট একটা চিঠি! তাতে লেখা, শুভ জন্মদিন আলেয়া। আমরা কী বন্ধু হতে পারি?

আলেয়া খুশিতে গদগদ হয়ে জিনিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, অনেক ধন্যবাদ তোমায়। অবশ্য, তুমি তো আমার প্রথম থেকেই বন্ধু ছিলে। জিনিয়া আলেয়াকে জরিয়ে ধরে, তোমাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ আলেয়া। কিন্তু তুমি জানলে কী করে আজ আমার জন্মদিন?


সেদিন স্যার আলোচনা করছিল আজ তোমার জন্মদিনে স্কুল থেকে তোমাকে আগে ছেড়ে দেবে! আমি সেখান থেকেই জানতে পেরেছিলাম। জিনিয়া খুশি হয়ে আবার বললো, 

তাহলে আজ থেকে আমরা বন্ধু তো? 

আলেয়া হেসে বলে, একদমই তাই।


জিনিয়া তাড়া দিয়ে বললো, এবার তাড়াতাড়ি কেকটা কাটো। টিফিন টাইম শেষ হয়ে যাবে তো। জিনিয়া কাটা কেকের একটা টুকরো তুলে আলেয়ার মুখে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন হয়েছে খেয়ে বলো। খাওয়া শেষ করে আলেয়া হেসে বললো, খুব সুন্দর হয়েছে।

-আমার মা তৈরি করেছে। বলেছি আমার প্রিয় বন্ধুর জন্মদিন।


খুব খুশি হয়েছি আমি। এর আগে কখনো আমার জন্মদিনে কেউ কেক এনে দেয়নি। সংসারে অভাব থাকলে জন্মদিন হয় নাকি।

আলেয়ার কথাগুলো বিষন্নতা জাগায় জিনিয়ার মনের ভেতরে। নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে বললো, তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি কেক খেতে ভীষণ পছন্দ করো। তবে কী সেদিন মিথ্যে বলেছিলে?


আলেয়া মাথা নেড়ে বললো, হুম।

-খুব পাঁজি মেয়ে তুমি। এবার তাড়াতাড়ি এই টুকরোটা শেষ করো। বাকিটা বাড়িতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে পুরোটাই খেও। হাতে থাকা কেকের টুকরো খাওয়া শেষ করে আলেয়া বললো, কেকটা দারুণ হয়েছে খেতে।


-ভেতরে সবজি দেওয়া আছে যে।

জিনিয়ার কথা শুনে অবাক হয় আলেয়া। 

-সত্যি? 

হেসে উঠলো জিনিয়া৷ মজা করেছি আমি।

-তুমিও কিন্তু কম পাঁজি মেয়ে নও। আলেয়ার কথায় আবার হেসে ওঠে জিনিয়া৷



জীবনের চলার পথটা আরেকটু মসৃণ করার জন্য প্রকৃত একজন বন্ধুর প্রয়োজন। ভালো বন্ধু পেতে হলে প্রথমে নিজের ভালো মানসিকতা গড়া প্রয়োজন। আর ভালো বন্ধু হতে গেলে বন্ধুর বিপদে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন৷ জীবনে সাফল্যের নিরিখে উঠতে গেলে একজন ভালো বন্ধু থাকা ভীষণ প্রয়োজন। একটা প্রকৃত ভালো বন্ধু কখনোই তার বন্ধুকে হারতে দেয় না।


সমাপ্ত 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract