Apurba Kr Chakrabarty

Classics

4.4  

Apurba Kr Chakrabarty

Classics

প্রেম বিরহ (৩য় পর্ব)

প্রেম বিরহ (৩য় পর্ব)

13 mins
373


একা দেবে।আমার আগে দুই দাদা জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়। তাই এই মানত ছিল।


অনু কিছুক্ষণ নীরব থাকে তারপর উদাসীন ভাবে বলল,

"আমরা বাড়িতে ছিলাম না।আর বাবা পাশের গ্রামের রক্ষাকালীর পুজোর গেছিল ।দশটার পর বিকাল অবধি সেদিন আমাদের বাড়িতে কেউ ছিল না।তোমার কি চিঠি ছিল জানি না,পিওন কাকু জেঠিমাকে চিঠিটা দিয়ে আমাদের দিতে বলেছিল। জেঠিমার তোমার ঐ চিঠি পড়েছিল।জেঠিমার খুব আনন্দ করে বলে অপু তোকে ভালোবাসে।তুই আমার ছোট বৌ হলে আমার চেয়ে সুখী কেউ নয়।

 পরে আমার জন্ম তারিখ ,ক্ষন সব জ্যোতিষ কাছে, দিয়ে আমার ঠিকুজ কুষ্ঠি তৈরী করে।খরচ সব জেঠিমা দেয়।জ্যোতিষ বিচারে আমার অকাল বৈধব্য আছে।তাই জেঠিমা এ বিয়ে রাজী নয়।

আমিও চাই না।আমাদের ভালোবাসার চেয়েও তোমার জীবনের মুল্য অনেক অনেক দামী। আর আমার স্বপ্নেও দেখেছিলাম, তুমি আমার পূর্ব জন্মের স্বামী, তোমায় বাঘ --"

অপু চেঁচিয়ে ওঠে বলে "ওসব মানি,যতসব ফালতু।তুই কালই বাড়ি যাবি।"

"না অপু দা,আমাকে ভুলে যাও, আমি তোমাকে বিয়ে করব না।তুমি চাইলে মরব,কিন্তু তোমায় বিয়ে করব না"

"তোকে ছাড়া আমিও বিয়ে করব না।"

"তোমার সেটা ইচ্ছা।"

অনুর এমন দৃঢ় মনোভাব অপু বিস্মিত। বলে "তুই কী আমাকে ভালোবাসিস না!"

"আমি তোমাকে ,আমার নিজের জীবনের চেয়েও বেশী ভালোবাসী, তুমি ছাড়া আমার এ জীবন শুন্য কিন্তু আমার জীবনের সব সুখ আনন্দ বিনিময়ে তোমার অকাল মৃত্যু হতে দেবো না"

"কিন্তু আমি তো মরে যেতে পারি,যদি আত্মহত্যা করি!"

"তোমার আয়ু আমি জানি না, কিন্তু আমার জন্যে তোমার মৃত্যু এটা হতে দেবো না।যদি তোমার সাথে আমার বিয়ের পর তোমার মৃত্যু হয়!আমি নিজেকে হয়ত শেষ করতে পারি,কিন্তু জেঠিমার কি হবে! উনি আমাকে মেয়ের মত ভাবেন। না অপু দা,তুমি আমাকে ভুল ভেবে কষ্ট পেও না।আমি অনেক দিন কেঁদেছি, এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছি। তুমি আমার দাদা হয়ে থাকো "অনু,অপুর পা দুটো জড়িয়ে ধরে অনু মিনতি করে "আমাকে ভুলে যাও।"

 অনুর দুচোখ জলে ভরে গেছিল।

অপু ভারাক্রান্ত মনে আর দাঁড়াল না। সোজা বাড়ি চলে আসে।অনুর ব্যবহার তার ভালো লাগেনি। যেন এ অন্য অনু!ব্যাকওয়ার্ড কু সংস্কারাছন্ন আত্মা বিশ্বাসহীন কলের পুতুল।

 অপু কেমন সংসার বিরাগী হয়ে যায়। চাকরীতে আর পড়াশোনায় মন দিয়েছিল ,তার কেরিয়ার বরং উজ্জ্বল হল, এ এম আই ই পাস করেছিল অনেক দিন। তিন বছর আগে কমিশনার রাংকের অফিসারে উন্নত হয়, যদিও তার মনে হতাশা ভরা।বাড়ির কম যেত, ছুটির সময় বেড়িয়ে বেড়াত। পাহাড় তার অতি প্রিয়। 


সে পর্বত অভিযানে যেত। এই সুত্রে, সার্ভিসের অনেক মানুষ তাকে চিনত, পছন্দ করত। অমায়িক অপুর কোন অর্থ মোহ নেই, তার একক জীবন , এক বিশ্বস্ত চাকর তার দেখভাল করে। 

সহকর্মী ,উচু নিচু সব পদের মানুষকে অপু খাওয়াতে ভালোবাসে।লোভী মানুষের ভিড় তার বাড়িতে লেগে থাকত।অপুর সময় কেটে যেত।মায়ের প্রতি তার চাপা ক্ষোভ অভিমান ছিল। কী দরকার ছিল অনুর ঠিকুজী কুষ্ঠী করা! মুখে বলত না,বাড়ি খুব কম আসত।আর তার পদোন্নতি গর্ব করে বাড়ির মানুষদের বলে না।

অপুর বাবা অন্তরে ভীষণ অপুকে ভালোবাসত।  অপুর এই কষ্ট দুঃখ যন্ত্রণা বাবা অনুভব করত, মুখে বলত না। একদিন হঠাৎই স্ট্রোক হয়ে মারা গেল।

অপু নিজের পদ, মাসিক আয় জানাত না।বাড়ি ঘর জমিতে লোভ ছিল না। দাদা সব ভোগ করত।কেমন যেন ছন্ন ছাড়া জীবন। মায়ের চোখের জল ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিল না।বিয়ের কথা বললেই অপু বলত ,"আমি বাড়িতে থাকি তোমার ইচ্ছা নয়! এরপর এককথা বার বার বললে এ বাড়ি ছেড়েই চলে যাব। আমার অনেক থাকার জায়গা আছে।"

মা চুপ করে যেত।

সেদিন ছিল পূর্নিমা। বৈশাখের আদ্র গরমে খড়ি নদীর পাড়ে সেই কোন বিকাল থেকেই অপু বসেছিল।মনটা কেমন ছন্ন ছাড়া, দিশেহারা,বিষন্ন, বুকের ভিতর এক অব্যক্ত কষ্ট ,নির্জন নিরিবিলি পরিবেশ কেমন তার যত বাল্য কৈশোরের স্মৃতিমন্থনে ব্যাকুল হৃদয়ে,মায়ের মুখটা চোখে ভাসছিল।মায়ের স্নেহ ভরা হাসি, যত্নে আর নিষ্ঠা সহ খাবার খেতে দিয়ে অপলকে পাশে বসে থাকা, আর যত দুষ্টমী দোষ করুক সে, রাগে মা যতই হম্বি তম্বি করুক ,কখনও মা তার গায়ে হাত তুলেছে অপুর মনে পড়ে না।

আটাশ বছরে মাকে হারিয়ে সে সত্যিই বিচলিত। অপুর এক দাদা তিন দিদির সবার বিয়ে থা হয়েছিল।সন্তান নিজের সংসার, স্ত্রী আর স্বামীদের নিয়েই তারা ব্যস্ত।

মায়ের মৃত্যুতে দুদিন হাউ হাউ করে খুব কেঁদেছিল। দিদিদের সে কী সুর তুলে কান্নার আওয়াজ! আবার তিন বোনের এক সাথে অনেক দিন পর দেখা,সাক্ষাৎ নিজেদের সংসারের কথা, কিছু কথার ছলে গর্ব অহংকার, আর হাসি মস্করাও করছিল। মায়ের মৃত্যুর পর তাদের দুঃখ কান্না কেমন যেন পেশাদারিত্বে মত অপু মনে হচ্ছিল। তার এসব ভালো লাগছিল না। 

এই শোকে মায়ের শ্রাদ্ধের পর আচমকাই দুপুরে তার বৌদির সাথে মেঝদির সে কী ঝগড়া, বাকী দুই দিদি নীরব যেন মজা দেখছে!

বৌদি একমুঠো গ্যামাকসিং পাওডার মুখে পুড়ে নিয়ে আত্মহত্যা করার অভিনয় করতেই, দাদার উগ্র মূর্তি। মেঝদি কে এই মারে তো সেই মারে।মেঝদি তো কেঁদে একাকার। যেন নাটক চলছিল। অন্য দিদিরা মেঝদির দিকে ঝোল টানতেই পরিবেশ আরও যেন উতপ্ত। দাদা সরাসরি অপুকে নালিশ করে, "দেখ ভাই,এরা আমার সংসারে আগুন জ্বালাতে এসেছে!"

অপু ক্ষোভ দুঃখে বলে "মা মারা গেছে, আমি শোকে দুঃখে দিশেহারা।তোদের এ কেমন শোক দুঃখ আমার কল্পনার বাইরে। কাল মায়ের সব কাজ কর্ম শেষ হবে। আমি পরশু চলে যাব, প্লীজ এই দুটো দিন তোরা ঝগড়া বন্ধ রাখ। মায়ের আত্মা কষ্ট পাচ্ছে।"

এরপর লজ্জায় দাদা দিদিরা ঝগড়া বন্ধ করে।

 মনের দুঃখে সে গ্রামের উত্তরে দু কিমি দুরে একাকী নদীর নির্জনতা নীরবতা মায়ের মৃত্যুর শোক দুঃখ স্মৃতি বহু গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। সারা রাতটাই তার মনে হচ্ছিল এই নদীর ধারেই কাটিয়ে দি।শ্রাদ্ধের পর দুপুরে যে নাটক বাড়িতে ঘটেছিল, বাড়ি যেতেই অপুর ইচ্ছা হচ্ছিল না।

অপুকে দাদা দিদিরা স্নেহ করত,ছোট ভাই, এয়ার ফোর্সের চাকরী, কদিনের জন্য এসেছে। তার ব্যক্তি জীবন সুখের নয়। পাশের বাড়ির শিব মন্দিরের গরীব অশিক্ষিত পুরোহিতের মেয়ে অনুকে সে ভালোবাসত, কিন্তু তার ঠিকুজিতে অকাল বৈধব্য যোগ আছে, তাদের গুরুদেব জ্যোতিষ গননা করে দেখেছে।তাই অনুকে অপুর মা যতই কন্যার স্নেহে ভালোবাসুক, অপুর সাথে তার বিয়ে বাতিল করেছিল।

অপু তখন শিলং পোষ্টিং। অনুর অন্যত্র বিয়ে হয়েছিল। অপু বাড়ি এসে ,হতাশায় খুব কেঁদেছিল। মা বা অনুর মা বাবাকে একটা কথা বলেনি।মনের মধ্যে আর বিয়ে করা,মেয়েদের প্রতি ভালোবাসার আকর্ষণ টাই কেটে গেল। শুধু বাবাকে বলেছিল,

বাবা আমি আর জীবনে বিয়ে করব না।সংসার বড় নিষ্ঠুর, মানুষের নিরীহ নিষ্পাপ আবেগ চাইতে সংসারে আর কিছু বড় হওয়ার ঠিক নয়।তুমি কী বলো।

বাবার দুচোখ জলে ভরে গেছিল। তুমি বুদ্ধিমান জ্ঞানী ছেলে,তোমার এই বয়সে আমি তোমাকে কী বলব,তবে যা হয়েছে ভালো হয়নি। ওরা আমার পরামর্শ নেয়নি। বড় অন্ধ বিশ্বাসী। তুমি এতটা ভেঙ্গে পড়বে তোমার মা হয়ত বোঝে নি। নিশ্চয় বিকল্প ছিল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আর কোন কথা বলেনি।

এরপর অপু বাড়িতেই কম আসত।এলেই মা বিয়ের জন্য চাপাচাপি অপুর ভালোলাগত না। দাদা বৌদির কাছে বিধবা মা থাকত। মা বাবার পেনশন পেতো।বাবা হাইস্কুলের শিক্ষক ছিল।দাদা একটি নিকট সমবায় ব্যাঙ্কে কেরানীর কাজ করে। সে দৈনিক কর্মস্থল যাতায়াত করত। বাড়ির যা কিছু জমি সম্পত্তি দাদাই ভোগ করে।অপুর বিয়ের ব্যাপারে তাই দাদা বৌদি উদাসীন।ভবিষ্যতে অপু এয়ারফোর্স চাকরীর বন্ড শেষ করে বাড়ি ফিরলে তার পেনশনটাও কিছু দেবে। এমন আশা তারা করে।তাই অপু বিয়ে না করলেই তাদের লাভ।

মায়ের সাথে শেষ ক বছর অপুর মনে একটা মানসিক দুরত্ব থেকেছে।কী সব হাত দেখা ঠিকুজী  তার বিশ্বাস নেই এই কারনে তার বাল্যকাল ও কৈশোরে জুটি, অনুকে তার কাছ থেকে সড়িয়ে দেওয়া মায়ের এই পদক্ষেপ অপু মানতে পারত না।মা তার ভালোর জন্য হাজার বলুক।এমন কী, অনুও এসব শুনে অপুকে সরাসরি না বলে দিক! সেটাও অপুর ভালো লাগেনি। অনু যেন কলের পুতুল! আবেগ যুক্তির এসব এরা ধার ধারেনা। নির্বোধ ছাড়া কী!

"আমার জন্য তোমার অকাল মৃত্যু হোক আমি চাই না। স্বপ্নে দেখেছিলাম গত জন্মে তুমিই আমার স্বামী ছিলে।অকালে তোমার মৃত্যুর আমার চোখের সামনেই হয়েছিল। আর নয়। আমার ভালবাসার মৃত্যু হোক, তবু তোমার অকাল মৃত্যু চাই না।অনু ভীষণ দুঃখে সেদিন খুব কেঁদেছিল, কিন্তু অপুকে বিয়ে না করার বিষয়ে অনড় ছিল। "

মা,কোলের ছোট ছেলে অপু অন্ত জীবন,কিন্তু অপু শেষ ক বছর মায়ের সাথে ভালো যোগাযোগ রাখত না।মা কাঁদত ,দাদা বৌদির মুখে শুনেছে, মৃত্যুর সময় মা বার বার অপুকে দেখতে চেয়েছিল।কিন্তু অপু যখন ছুটি পেয়ে বাড়ি ফিরেছিল তার দুদিন আগেই মা মারা যায়।দাহ করা হয়ে গেছিল তাই মাকে সে শেষ দেখাও দেখতে পায় নেই। অপু তার মাকে সেই কবে এক বছর আগেই দেখেছে , অপুর দুঃখ তাই এতটা। নিজেকে সে ক্ষমা করতে পারে না।

ক্ষুধা তেষ্টা সব কিছুই তার আজ তার অনুভূতির বাইরে, মেঘলা আকাশ চাঁদের আলো মাঝে মধ্যেই ম্লান হচ্ছিল সাথে হালকা হাওড়া। রাত তখন সবে আটটা পশ্চিম আকাশ জুড়ে ঘনকালো মেঘ সঙ্গে হাওয়ার গতি বাড়ছে যেন ঝড়ের রূপ নিচ্ছিল, পূর্নিমার চাঁদকে তখন কালো মেঘ গ্রাস করেনি।

কাল বৈশাখী ঝড়ের আগমন আজ যেন বিকালে না হয়ে একটু রাতেই। মনটা বড় বিষন্ন ,কিন্তু আর থাকা যাবে না, জলে ভিজে যেতে হবে।পরশু আবার তার চন্ডগড়ে ফিরতে ট্রেনের টিকিট বুক আছে। শরীর খারাপ হলেই সমস্যা।

আচমকাই এতটা বেগে পশ্চিমের কালো মেঘ ছুটে আসবে অপুর কল্পনায় ছিল না।দ্রুত পা চালিয়ে গ্রামের দিকে রওনা দিল। গ্রীষ্মের সময় মাঠ ঘাট খটখটে শুকনো,অনেক দিন বৃষ্টি হয়নি।মাঠের আল পথে সে খুব জোরে হাঁটছিল। কিন্ত চাঁদের আলোর ঢাকা পড়ছিল।আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুতের চমকে চোখে ধাঁধা লাগছে।মাঠের মধ্যে সাধনগড়ে, পুকুরের সংলগ্ন পাড়।এই পাড়েই এক সাধুর বাসছিল। সে অনেক দিনের কথা কিন্তু তার আশ্রম টা আছে।দু কুঠারি ঘর এখনও জেগে ছিল।

লোকে বলে সাধু নাকি তপস্যায় বিফল হয়ে একদিন দুঃখে হতাশায় আত্মহত্যার মনস্থির করে। দিনে গ্রামের অনেক শিষ্য শিষ্যা তার আশ্রমে এলেও রাতে একাই থাকত। নির্জন মাঠের মাঝে এক মেঠো পুকুরের ধারে আবার অনেক বিষধর সাপের মেলা । পুকুরে আর পুকুরের সংলগ্ন এক পরিত্যক্ত ইটভাটা যেন বিষধর সর্পকুলের পরম নিরাপদ আবাস।

সাধুর প্রানের মায়া না থাক সাধারণ গৃহী তার শিষ্য শিষ্যাদের আছে। তাই সন্ধের পর এ দিকেই আসত না।সাধুর খাবার সামগ্রী আর জ্বালানি উপকরণ শিষ্য শিষ্যাদের দেওয়া সব সময় মুজুত থাকত। একটি ঘরে দেবী শ্মশান কালীর প্রতিমা, আর অন্য ঘরে সাধুর আবাস। রান্না বান্না সাধু নিজেই করত। স্বপাক খেতেন। আতব চলের ভাত ঘী,আলু সিদ্ধ আর দুধ, দুপুরের আহার, আর রাতে নানাবিধ ফলাহার করতেন। সঙ্গে শিষ্যদের দেওয়া মিষ্টি মন্ডা। একটা জলের নলকূপ বসানো ছিল শিষ্য শিষ্যাদের আর্থিক আনুকুল্যে।

সাধু সেদিন গভীর রাতে জলে ডুবে আত্মহত্যার এই পরিকল্পনা কাউকে বলেন নি।কিন্তু সুগভীর পুকুরে গলায় বড় কলস বেঁধে ডুবে মরার তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়।পুকুরের জল নাকি সেই রাতে এক হাঁটুর নিচে নেমে গেছিল। যতই সাধু সারা পুকুর পরিক্রম করুক ডুবে মরার জল সেদিন পুকুরের ছিল না।

সাধু বুঝেছিল তার সাধনা সিদ্ধ ,অর্থাৎ তার এই ধারনাই ভুল যে তিনি সাধনা লাভ করেন নি।এরপরই এই পুকুরের নাম সাধনগড়ে ঐ সাধুই দিয়েছিলেন। সেদিন গভীর রাতে এক অতীব সুন্দরী কিশোরী, শ্যাববর্না পড়নে খাটো লাল পেড়ে সাদা শাড়ি,যাতে তার যৌবনে উচ্ছলিত শরীরের লজ্জা নিবারিত হচ্ছিল না। সাধু বিচলিত হয়ে ভাবে ,এতদিনের সাধনা ফল, আজ তার সিদ্ধ মনে হলেও ঐ কিশোরীর রূপে মুগ্ধ! এ তো পাপ!

কিশোরী জানাল সে ভৈরবী।মায়ের সাধনা করবে !আর নারী বিমুখ হবে সেটা ঠিক নয়। আমি তোমার সাথেই নির্জন রাতে থাকব। দিনে আমায় পাবে না।

সাধু পরদিন তার শিষ্য শিষ্যাদের রাতে এই অলৌকিক অভিজ্ঞতা বলে।

তার পরদিনই সাধু অদৃশ্য হয়ে যায়। তার কোন হদিশ গ্রামের মানুষ পায়নি।সেতো সাত আট বছরের আগের ঘটনা।তবে ঘর দুটো ছিল। মা কালীর প্রতিমা সাধুর শিষ্য শিষ্যাদের আর্থিক মদতে গ্রামের শ্মশানের কাছে এক মন্দির তৈরী করে প্রতিষ্ঠিত কবে। নিত্য পুজা করা হত।আর সাধনগড়ের পাড়ে সাধুর আশ্রম পরিত্যক্ত হলেও, দিনে রাখাল বা জনমজুর দুপুরের রোদ বা বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে আশ্রম নিতো।কিন্তু সে তো দিনে ! রাতে এত বিষধর সাপের আনাগোনা অপু ভাবছিল ওখানে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে সাপের কামড় খাবো না তো!

কিন্তু কাছে এসে অপুর ভরসা হল।কেউ আগে থেকেই সেখানে আছে, সঙ্গে হ্যারিকেনের মৃদু আলোর আভা।

বৃষ্টিটা ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে, ঝেঁপে মুষলধারা আরম্ভ হল বলে।ঝড়ের তীব্র গতি,বিদ্যুতের চমক আর মেঘের ঘন ঘন গর্জন।অপু ছুটে পরিত্যক্ত ঐ সাধুর ঘরে গেল। ভিতরে ঢুকে অবাক। এক সাধু আর তার ভৈরবী বা স্ত্রী । মাটির উনানে ভৈরবী রাতের খাবারের জন্য ভাত চাপিয়েছে।

বিব্রত অপু বলে,"আপনারা এখানে আছেন বুঝতে পারিনি বৃষ্টি ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য এখানে ঢুকে পড়েছি। "

সাধু স্মিত হাসলেন ,পরে বললেন "কার ঘর! এ ঘর সবার ,আমরা ভবঘুরে, আমি কালীর সাধক আর ইনি আমার স্ত্রী। আমি আগামীকাল সকালেই এ গৃহ ত্যাগ করে নবদ্বীপের উদ্দেশ্য রওনা দেবো। "

সাধুর সুন্দরী যুবতী স্ত্রী পড়নে শুধুমাত্র খাটো লাল পেড়ে সাদা শাড়ি ,যাতে লজ্জা নিবারণ ঠিক মত হচ্ছিল না। অপুর তাই সাধুর স্ত্রীর দিকে তাকাতে কুন্ঠা হচ্ছিল।

সাধু বলল,"বাবা তুমি কী এখানকার স্থানীয় !"

"হ্যাঁ এই সামনের গ্রামের," তারপর তার আজকের এই ঝড় বৃষ্টির রাতে আচমকা বিপদের কারণ জানাল।

সাধু বলল,"বৃষ্টি থামলে তোমাকে গ্রামে অবধি আমি হ্যারিকেন আলো দেখিয়ে দিয়ে আসব।এখন নিশ্চিতে বিশ্রাম নাও।"

অপু অগত্যা সাধুর এগিয়ে দেওয়া একটা মোড়ায় চুপচাপ বসে ছিল। মনের কৌতুহলে একবার সে সাধু পত্নী দিকে নজর যেতেই চমকে ওঠে! এ তো অনু!

কিছু বলতে পারে না,আর একই মত দেখতে মানুষ হয়,তার চোখের ভুল হতে পারে।সে তো অনুকেই হরদম জেগে স্বপ্নে দেখে।এমনই এক কালবৈশাখী বিকালে শিবপুকুরে বাগানে অনুর সাথে তার এক হঠকারিতায় কী কান্ডটাই না হয়েছিল !ভাবতে তার লজ্জায় মনটা কেমন হয়ে যায় আজও।


সাধু জিজ্ঞেস করে "বাবাজীর নাম , নিবাস! যদিও এখনকার সবই আমার অজানা। "

অপু বলে,আমার বাড়ি সামনের গ্রাম চক্রধরপুরে, নাম অপু,অপু ব্যানার্জি।

সাধুর স্ত্রী যেন চমকে তার দিকে তাকায়। আবার পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে রান্নায় মন দেয়।

সেদিন একঘন্টার পর একটু বৃষ্টিটা ধরেছিল। সাধু তার কথা মত অন্ধকার রাতে সর্প সঙ্কুল পথে গ্রামের প্রবেশ রাস্তা অবধি নিরাপদে অপুকে তুলে দিল

অপু সংকোচে বলে "আপনার স্ত্রী মাঠ মাঝে, ঘরে একা আপনি এবার ফিরে যান। আমার আর কোন সমস্যা নেই।"

পরদিন খুব ভোড়ে অপু প্রায় দৌড়ে সাধনগড়ের পাড়ে পরিত্যক্ত প্রায় আশ্রম ঘরে গেছিল। যদি তাদের দেখা হয়।কিন্তু বিষ্ময়ে হতবাক অপু তাদের কোন হদিশ পেলো না। ব্যবহার করা রান্নার অবশিষ্ট বা কোন চিহ্ন ছিল না।অপু বিস্মিত হয়ে ভাবে।গতরাতে বিপদে কে তাকে আশ্রয় দিল!

অনুর খোঁজ তো সে জানে না ।বিয়ে হয়েছিল সেই কবে!তার তখন কুড়ি আর অনু সতের। যত খরচ সব নাকি অপুর মা দিয়েছিল, এই বলে আমার বৌমা হলে সব খরচ দিয়ে ওকে ঘরের লক্ষ্মী করে আনতাম।কিন্তু ভাগ্য ওদের এক হতে দিল না। অনুকে সে মনের ভ্রম না চোখের ভ্রম অনেক মেয়ের মধ্যে দেখে। যাকে দেখলে তার ভীষণ ভালোলাগত , তাকেই অনু ভাবত।

কিন্তু এ দিনের ঘটনা তার মনে হয়েছিল আধা ভৌতিক বা অলৌকিক।তারা জীবিত মানুষ, বা সাধারণ মানুষ ভাবতে তার সন্দেহ হয়।

এ ঘটনার পর অনুর এখন কি খবর ! অপু অনিতা কাকীমাকে জিজ্ঞেস করেছিল। এতদিন চাপা ক্ষোভ দুঃখে কামীমার সাথে কথাই বলত না।আজ সে এই বিষয়ে কথা বললে,অনিতা কাকীমা কান্না ভেঙ্গে পরে বলে "বিয়ের তিন মাস অবধি যতদিন কলকাতা ছিল ,ততদিন তার সাথে চিঠির মারফত যোগাযোগ ছিল ।তার স্বামী তাকে কর্মস্থল আরবে নিয়ে গেছিল ।তার পর আর কোন যোগাযোগ নাই। কেমন আছে বেঁচে আছে কিনা আজ আট বছর কোন যোগাযোগ নেই। তোমার মা চেয়েছিল অনু খুব ভালো বিয়ে হোক। বিদেশে চাকরী করে এমন পাত্র খবরে বিজ্ঞাপন দেখে এ বিয়ে হয়েছিল।"

 

"পাত্রের বাড়ি ঘর,ব্যাকগ্রাউন্ড দেছেছিলে!"


"হ্যাঁ, কলকাতায় বাড়ি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান তোমার কাকু আর অনুর মামা নিজে গিয়ে দেখে এসেছিল ! "


"এখন ওদের বাবা মায়ের খবর কী!"


"বিয়ের দুমাস পর ওর বাবা মারা যায়।মাকে অনুর বর কর্ম স্থান আরবে নিয়ে যায়, কলকাতার বাড়ি বেচে দিয়েছিল।"


"অনুর বিয়ের কোন ফটো বা এলবাম আছে?যেখান ওর বরের ছবি শ্বশুর শাশুড়ির ছবি আছে।"


"আছে । অনুর মামার সখ করে বিয়ের রাতে আর বর কনে যাবার কটা ছবি তুলিয়ে ছিল। বর পক্ষের কজন মাত্র কলকাতার থেকে বরযাত্রী আসে।তার মধ্যে ওর বাবা ছিল।"


অনিতা কাকীমার কাছে এলবাম নিয়ে কটা ছবি অপু নিয়ে বলে,"আমি নিয়ে যাচ্ছি, এমন ভাবে ফ্রড বিয়ে করে মেয়ে পাচার হয়।অনু হয়েছে তা বলছি না।আমি দেখব।"

 বিয়ের কার্ড নিয়ে বলে "এটা থাক ওদের ঠিকানা একটু তদন্ত করা দরকার। মরতে আমার সাথে বিয়ে না দাও,গ্রামের ছেলে পাও নি! আর অনুর নাকী অকাল বৈধব্য! বিদেশে চাকরী করা ছেলে সাথে বিয়ে হলে, সে আরও সমস্যা হবে।"


"তোমার মা বলেছিল, এমন বিয়ে দাও, অনু সুখে থাক, কিন্তু দুরে থাক ,তাতে ওদের পরে দেখাদেখি হবে না।দুঃখ হবে না"


"মায়ের কথার এত দাম কেন, অনেক বুঝি টাকা দিয়েছিল!"


অনিতা কাকীমা মুখ নামায়।


"মূর্খ লোভী মানুষের এই জ্বালা। অনুর ঠিকজী কুষ্ঠী তোমারা দেখে ছিলে!"


"একটা কপি আমাদের কাছে আছে।অত শত বুঝি না।

গরুদেবের গননা শুনেছি ব্যার্থ হয় না।"


"আমাকে ঠিকুজী কষ্ঠীটা দাও,অনুর ভাগ্য কী আছে দেখব। আমার জানা শোনা বড় পন্ডিত আছে।"

অপু সেদিন অনুর জন্ম সময় আর কষ্ঠী বিচার সব নিয়েছিল।

অনিতা ভীষণ আফসোস করেছিল,খুব কেঁদেছিল, হতাশায় বলে," বাবা আজও তুমি বিয়ে করোনি, অনুকে এত ভালোবাসা, আমরা সেদিন তোমার সাথে আরও আলোচনা করলে ভালো করতাম।"

"সে সব কথা থাক।বাবার পরামর্শ তোমরা নাও নি।"


অনিতা বলে "হ্যাঁ উনি বলেছিলেন, অনুর বৈধব্য কাল তেইশে তাই চব্বিশ হলে অনুর সাথে অপুর বিয়ে হোক।তোমার মা রাজি ছিল না।আর আমরা ভরসা করি নি এতদিন পর--"


"আমি যদি অন্য কোথাও প্রেমে পড়ে যাই!"


অনিতা কাকীমা মাথা নামিয়ে ছিল, কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,"আমাদের একমাত্র সন্তান, আমাদের দুঃখ যন্ত্রণা কী সেটা বলার ভাষা নেই, ঈশ্বর আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন।"


"ঈশ্বরের দোষ দিও না এটা তোমাদের কর্মফল, অনু ভোগ করছে।"


"বেঁচে আছে কিনা কে জানে!"


"কেন ঠিকজী কষ্ঠি এত ভরসা ! তার আয়ু জানো না! কেমন মা বাপ তোমরা! কথায় বলে না বোকা আপন জনের চেয়ে,চালাক শত্রু ভালো।অনু তখন ষোল বছরের ওর কী জ্ঞান !যেমন বোঝাবে তেমনি ও কলের পুতুলের মত নেচেছিল ।আর কী একটা জ্বরের বিকারে স্বপ্ন দেখেছিল সেটাই সত্যি মনে করেছিল। "

অপু সেদিন বহুবছর পর কাকীমা সাথে কথা বলে।এক, মায়ের সাথে দুরত্ব রেখে সে ভীষণ অনুতপ্ত । কাকীমা তাকে খুব স্নেহ ,করে আবার কবে আসব ! একটু কথা বলি,মানুষের জীবন কবে কে ফুটবে কেউ তো জানে !আর দুই,অপুর মনে হয়েছিল অনু কী ,পরিত্যক্ত ঐ আশ্রমের ভৈরবী ! আর তা তো লৌকিক সত্বা নয় ! অনু মারা গেছে ! তাই অনুর বিষয়ে বহুদিন পর জানার বাসনা হয়।

 আসলে এতদিন অনু বিষয়ে কোন কিছুই জানতে তার কোন আগ্রহ ইচ্ছা ছিল না। অনুর সেদিনের অনঢ় মনোভাব, তাকে ভীষণ আঘাত করে,এ যেন সেই অনু নয়।


আজ মনটা তার ব্যাকুল হচ্ছিল। সত্যিই যদি অনু কোন দুষ্ট মেয়ে পাচার চক্রে পড়ে,তার কী নরক যন্ত্রণা কে জানে! অপু কেমন ভাবুক হয়ে গেছিল।







Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics