পিতৃ পরিচয়
পিতৃ পরিচয়
টুটুল আজকে ওর ডাক্তারী পাশের ডিগ্রী নিয়ে ফিরছে লন্ডন থেকে। সকাল দশটায় তার ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা এয়ারপোর্টে। সারা বাড়ীতে সাজ সাজ রব। টুটুল আসছে বলে সুনন্দা আর সুমিতের আনন্দের সীমা নেই। ওরা ঠিক করেছিল দুজনে মিলে মেয়েকে আনতে যাবে। কিন্তু মেয়ের কড়া নির্দেশ, বলেছে ‘মামণি আমি কি আর ছোট আছি যে তুমি আর বাপি আমাকে নিতে আসবে? ড্রাইভার কে দিয়ে গাড়ী পাঠালেই হবে।’ তাই শেষ অবধি তাদের বাড়ীতে বসেই মেয়ের আসার অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
এদিকে টুটুল ফ্লাইট থেকে নেমেই ড্রাইভার শিবুকে বলল ‘শিবুদা তাড়াতাড়ি মামণিকে ফোন করে বল ফ্লাইট এক ঘন্টা লেট আছে। আমি ওদের সারপ্রাইজ দেব।’ অগত্যা শিবুকে তাই করতে হল।
সুমিত ও সুনন্দা মেয়ের ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করতে শুরু করল। সুমিত বলল ‘নন্দা, মেয়ের আগামী দিনগুলি নিয়ে কি ভাবছ?’ নন্দা হেসে বলল ‘তোমার মেয়ে, তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর।’ এরপর দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নিঃস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে সুনন্দা বলল ‘সেইদিনটা আমি কোনদিন ভুলবনা, সৌগতকে গিয়ে বলেছিলাম আমার গর্ভে ওর সন্তান। ও উত্তরে বলেছিল আমাকে নাকি ও কোনদিনই ভালোবাসেনি তাই এই সন্তান ওর নয়। এই কথা শুনে যখন বৃষ্টিতে পাগলের মত রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম নিজেকে ও গর্ভের সন্তানটাকে শেষ করে দেব বলে, ঠিক তখনই তোমার গাড়ীতে আমার অ্যাক্সিডে
ন্ট হয়। তুমি নিজের নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে আমাকে সুস্থ করে তুললে। আমার কাছে সব শুনে আমাকে ও আমার সন্তানকে নিজের পরিচয় দিয়ে আমাদের জীবন ও আমার সম্মান বাঁচালে।’
সুনন্দা হয়ত আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, সুমিত ওকে প্রায় থামিয়ে দিয়ে বলল ‘নন্দা এইকথা বলে আমাকে ছোট কোরোনা, জীবন তো আমাকে দিল ওই ছোট মেয়েটা। ওর মুখের মিষ্টি হাসি দেখে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি আসলে ওর জন্মদাতা নই। কিন্তু এখন তো ও বড় হয়েছে যদি ও কোনদিন সত্যিটা জানতে পেরে আমাকে বাবা বলে অস্বীকার করে?’ নন্দা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ চোখ পড়ল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা টূটুলের দিকে। সুমিত ও সুনন্দার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল।
কিন্তু টুটুলের আচরণে কোন অসঙ্গতি চোখে পড়লনা। সে এসে সুমিতের সামনে দাঁড়ালো বলল ‘বাপি তুমি বলত আমার জন্মদাতা কে—যার রক্ত আমার শরীরে বইছে সে? নাকি যার স্নেহ জন্ম মুহূর্ত থেকে আজ পর্যন্ত আমার শরীরে বইছে সে?’ এই বলে টুটুল নিজের গলা থেকে পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার জন্য পাওয়া মেডেলটা খুলে সুমিতের গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল ‘বাপি এত বছর তুমি আমার পিতৃ পরিচয় নিয়ে নিজের সঙ্গে প্রতিদিন যে যুদ্ধ করেছ সেই যুদ্ধ জয়ের পুরষ্কার।’ টুটুল ছোটবেলার মত সুমিতের গলা জড়িয়ে বলল ’বাপি আমার একটাই পরিচয় আমি শুধু তোমার মেয়ে।’ তিনজনের চোখের জলে ধুয়ে গেল অতীত।