Sayantani Palmal

Classics

2  

Sayantani Palmal

Classics

পিতা

পিতা

10 mins
876


মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে বিতানের। কি করবে কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারছে না। রুমণ ওকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিয়ে দিয়েছে, যা ডিসিশন নেওয়ার ওকে আজকের মধ্যে নিতে হবে নাহলে রুমণ চিরদিনের মতো বাড়ি ছেড়ে, বিতানকে ছেড়ে চলে যাবে। কি যে এতো জেদ মেয়েটার বুঝে পায় না বিতান! মায়ের ছোট্ট একটা আব্দার মানতে এতো কষ্ট! আর কি বলছে না সেরকম হলে বিতান ওর সাথে বাড়ি ছেড়ে ওদের নতুন কেনা ফ্ল্যাটটায় শিফট করে যাক! এটা কখনও সম্ভব! বিতান বাবা-মায়ের একটাই ছেলে। দিদির বিয়ে হয়ে গ্যাছে। সেও তো থাকে সেই বস্টনে। বিতান চলে গেলে বাবা-মায়ের কি হবে তাছাড়া এরকম কথা বিতান স্বপ্নেও ভাবে না। ফ্ল্যাটটা কিনেছিল জাস্ট একটা ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে। কিন্তু রুমণকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবলেও তো বিতানের বুকটা হু হু করে ওঠে। ওদের দেখেশুনেই বিয়ে। মা-বাবাই প্রথমে রুমণকে পছন্দ করে এসেছিল তারপর বিতান গিয়েছিল দেখতে। প্রথম আলাপেই রুমণকে ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল বিতানের। অবশ্য এতদিন পর্যন্ত তো রুমণ ওর সেই ভালোবাসার মর্যাদা রেখেছে। বাবা-মাও খুব খুশি ছিলেন ওকে বৌমা হিসেবে পেয়ে কিন্তু হঠাৎ করে মেয়েটার কি যে হলো কোনো কথাই কানে তুলছে না। বিয়ের আগে বিতান কোনোদিন প্রেম ট্রেম করে নি। সে অর্থে বলতে গেলে রুমণ ওর জীবনের প্রথম ও একমাত্ৰ নারী। ভীষণ ভালোবাসে ও রুমণকে। এখন বাড়ির পরিবেশটাই কেমন ভারী হয়ে আছে। দমবন্ধ হয়ে আসে বিতানের। আজ সকালেই তো বাবা ওকে ডেকে বললেন, " বাবু, রুমণকে বোঝা। দেখ আজ পর্যন্ত তোর মায়ের সব আব্দার আমি মিটিয়েছি। আজ এই বয়সে এসে মানুষটাকে বৌমার আচরণে কষ্ট পেতে হবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নেব না। আমার সংসারে তোর মায়ের কথাই শেষ কথা এটা রুমণকে ভালো করে বুঝিয়ে দে।  এসব ঝামেলায় তোর মায়ের প্রেশারটাও বেড়ে যাচ্ছে। রুমণকে বলে দিস তোর মাকে অপমান করে এবাড়িতে থাকা হবে না। " কথাগুলো বাবা বেশ জোরে জোরেই বলছিলেন যাতে রুমণ শুনতে পায়। বিতান ঘরে যেতেই রুমণ কঠিন স্বরে বললো, " তোমাদের বাড়িতে থাকার যদি এটাই শর্ত হয় যে তোমার মায়ের সমস্ত অন্যায় আব্দার মুখ বুজে মানতে হবে তাহলে ঠিক আছে আমি আর এবাড়িতে থাকবো না। এবার তোমাকে বেছে নিতে হবে তুমি কার সাথে থাকতে চাও। " রুমনের কথাগুলো তীরের মতো বিঁধেছিলো বিতানের বুকে। কত সহজে কথাগুলো বললো রুমণ। গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল বিতান। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছে। শহর ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এসেছে। এর আগে রুমণকে নিয়ে কতবার লংড্রাইভে গেছে। লংড্রাইভে যেতে রুমণ ভীষণ পছন্দ করে। 


  ঘ্যাঁচ....।ব্রেক কোষলো বিতান কিন্তু তাও শেষ রক্ষা হলো না। লোকটা সাইকেল শুদ্ধ হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল।সাইকেলে আবার একটা মাইক বাঁধা।বিতান তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এলো। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানটা থেকেও লোকজন ছুটে এসেছে। এবার কি ঝামেলা হবে কে জানে। সবাইতো বিতানকেই দোষী ভাববে কিন্তু আসলে তো দোষ লোকটার। হঠাৎ করে গাড়ির সামনের ঢুকে গেলো যেন। কেউ কিছু বলার আগেই বিতান অবস্থা সামলানোর চেষ্টা করলো, " দেখুন দাদা, আমি ওনাকে ধাক্কা মারিনি। উনি হঠাৎ গাড়ির সামনে চলে এলেন কিন্তু তাও আমি ওনাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে চাই। প্লিজ আমাকে হেল্প করুন। " ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো, " হ্যাঁ, আমি দেখেছি। আপনার দোষ ছিল না। " আর একজন বললো, " কাছেই তো গ্রামীণ হসপিটাল আছে ওখানে নিয়ে যাওয়া যাক। " লোকটার মাথায় চোট লেগেছে, রক্ত পড়ছে। অজ্ঞান লোকটিকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুললো সবাই। দুজন ছেলে পেছনের সিটে লোকটাকে নিয়ে বসলো। বিতান মনে মনে ভাবলো সময়টা সত্যিই ভীষণ খারাপ যাচ্ছে।



   ডাক্তার দেখে বললেন সিরিয়াস কিছু নয় তবে স্টিচ করতে হবে। বিতান একলা বসে আছে। ছেলেদুটো এডমিশন হওয়ার পরই চলে গেল, ওদের নাকি কাজ আছে। কেই বা যেচে ঝামেলায় থাকতে চায়। লোকটার বাড়ির লোক এসে কি করবে কে জানে। আন্দাজ ষাট-বাষট্টি বয়স হবে লোকটার। ফোনটা খুলে বিতান দেখলো প্রথম নামটা হলো অসীম। ওই নম্বরেই কল করলো।ওপাশ থেকে মহিলা কন্ঠ বললো

“ হ্যালো, বাবা বলো।”

বিতান দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললো," দেখুন এই ফোন টা যাঁর তিনি এই সময় মালপুর গ্রামীন হসপিটালে ভর্তি আছেন। এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমার গাড়িতে করে ওনাকে আমি নিয়ে এসেছি। " অপর প্রান্তের মহিলা ডুকরে কেঁদে উঠলেন, " বাবার কি হয়েছে বলুন না সত্যি করে। " 

“ না না ।চিন্তার কিছু কারণ নেই ।”    

“ আমরা এক্ষুণি আসছি।”

স্টিচ করা হয়ে গেছে। নিবারণ বাবুর জ্ঞান ফিরে এসেছে। নিজের নাম বলেছেন নিবারণ সামন্ত। "বাবা" সুতির শাড়ি পরা একজন মহিলা নিবারণ বাবুর বেডের দিকে ছুটে গেলেন। ওনার পেছন পেছন আরও তিনজন লোক গেল। ভদ্রমহিলা নিবারণ বাবুর গায়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিগ্যেস করছে," বাবা তোমার কষ্ট হচ্ছে না তো?" নিবারণ বাবু মাথা নাড়লেন। উফফ! থ্যাংক গড, নিবারণ বাবু ওনার বাড়ির লোকদের বলছেন যে বিতানের দোষ নেই। বরং বিতান ওনাকে হসপিটালে এনেছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো বিতান। আর কোনও ঝামেলা হবে বলে মনে হয় না। কিছু টাকা অবশ্য ও দিয়ে দেবে ভেবেছে। বিতান একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল, একজন লোক ওর দিকে এগিয়ে এলো। 

“ নমস্কার দাদা। আমি অসীম পাল। আমার ফোনেই আপনি ফোন করেছিলেন। আমি ওনার জামাই। আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেবো।”

“ না না ধন্যবাদ দেওয়ার কি আছে। এটা তো মানবিক কর্তব্য।”

“ আপনাকে আটকে থাকতে হলো অনেকক্ষণ। আসলে আজ রবিবার বলে মাঠে চাষের কাজ দেখতে চলে গেছলাম। আমি তালপুকুর হাইস্কুলে পিয়নের চাকরি করি তাই অন্যদিন এত সময় পাই না। মিনু মানে আমার বউ খবর পাঠালো তারপর এলাম। আমার শালাদের খবর দিলাম। ওই যে দুজন অরুণ আর বরুণ। এইসব কারণে দেরী হয়ে গেল।”

“ ইটস ওকে।”

ওদের কথাবার্তার মাঝে শুনতে পেল নিবারণ বাবুর গলা, " ছুটকির কিছু খবর পেলি রে? "

ঝাঁঝিয়ে উঠলো একছেলে সম্ভবত ছোটছেলে বরুণ, " ছুটকি ছুটকি করেই তুমি মরলে। ওকে খুঁজতে গিয়ে মরতে বসেছিলে একসিডেন্ট করে তাও তোমার শিক্ষা হয়নি? " 

“ চুপ একদম চুপ। বেরিয়ে যা আমার সামনে থেকে আর আজই তোর বউকে নিয়ে বেরিয়ে যাবি আমার ঘর থেকে। তোর বউয়ের জন্যই আজ আমার মেয়েটা কোথায় চলে গেল। কি খাচ্ছে কি করছে কে জানে। মেয়েটা আমার একদম খিদা সহ্য করতে পারে নি।”. রাগত স্বরে শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষে হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন নিবারণ বাবু। বরুণকে তার দাদা টেনে নিয়ে গিয়ে ধমকাচ্ছে।

“ অসীম বাবু কি হলো ব্যাপার টা? ছুটকি কে?”

“ আমার শ্বশুর মশাইয়ের চার ছেলেমেয়ে। আমার বউ মিনতি বড় তারপর অরুণ, বরুণ আর সবচেয়ে ছোট প্রণতি মানে ছুটকি। সমস্যা ছুটকিকে নিয়েই। আসলে ছুটকি জন্ম থেকেই অবনরমাল। হাঁটাচলা মোটামুটি করতে পারে কিন্তু ঠিক করে কথা বলতে পারে না। জড়িয়ে জড়িয়ে একটু আধটু বলে। মুখ দিয়ে সব সময় লালা ঝরে। খাইয়ে দিতে হয় নাহলে খাবার যত না ওর মুখে পৌঁছায় তার চেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বিশ্বাস করুন ওই আমার শ্বশুর মশাইয়ের সবচেয়ে আদরের। সেই ছোট থেকেই ওর সমস্ত কাজ উনি নিজেই করেন। খাওয়ানো, স্নান করানো, চুল আঁচড়ানো। চিকিৎসার চেষ্টাও অনেক করেছিলেন। কলকাতা নিয়ে গিয়েছিলেন। ওর হার্টেও সমস্যা ছিল। জমি বিক্রি করে ভেলরে নিয়ে গিয়ে অপারেশন করিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও লাভ সেরকম কিছু হয়নি। ডাক্তার বলে দিয়েছে এইরকম রুগীরা পঁচিশ বছরের বেশি বাঁচে না। ছুটকি প্রায় একুশ বছরের হয়েই গেল। ছুটকির জন্মের পর থেকে বাবা পারতপক্ষে কোথাও যান না গেলেও রাত কাটান না আর ছুটকিও বাবাকে চোখে হারায়।”

“ উনি কি বলছিলেন ছুটকির খবর....।”

“ আসলে আজ সকাল থেকে ছুটকি নিখোঁজ।”

“ নিখোঁজ?”

“ ওই যে আমার দুই শালাকে দেখলেন। অরুণ ব্যবসা করে। ভালোই চালু ব্যবসা। ওর বউও ভালো। বরুন সাবান ফ্যাক্টরিতে ম্যানেজারের কাজ করে। একবছর আগে বিয়ে হয়েছে। ওর বউকে নিয়েই সমস্যা। ছুটকিকে দু চোখে দেখতে পারেনা। ছুটকি ওর কি অসুবিধা করে ভগবান জানে। আপনাকে তো আগেই বলেছি ছুটকির ম্যাক্সিমাম কাজ বাবাই করেন তারপর মা তো আছেনই। বউ দের কিছুই করতে হয়না তাও অরুণের বউ মাঝে মাঝে মায়ের শরীর খারাপ হলে নিজেই ছুটকির কিছু দরকার হলে করে কিন্তু বরুণের বউ করা তো দূরের কথা মেয়েটাকে সুযোগ পেলেই যা তা বলে। আজ সকালে নাকি ছুটকি উঠোনে বসেছিল। বাবার ভোর ভোর মাঠে গিয়েছিলেন। মাঠ থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছিল বলে ওর অস্পষ্ট উচ্চারণে বাবা বাবা বলে ডাকছিল তখন বরুনের বউ ওকে যা তা বলে। একটু পরে কাজ সেরে মা আর অরুণের বউ বেরিয়ে দেখে ছুটকি নেই। আমার শ্বশুর বাড়ি একটু গ্রামের বাইরে বড় রাস্তার ধারে। মেয়েটাকে সেই সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবনর্মাল হলেও কে ওকে ভালোবাসে, কে ঘেন্না করে সব বুঝতে পারতো মেয়েটা। আমার মেয়েদের দেখলে কি খুশিটাই না হতো। চারদিকে খোঁজ করেছেন বাবা। শেষে একটা মাইক ভাড়া করে ছুটকির বর্ণনা দিয়ে চারদিকে ঘুরছিলেন যদি কেউ ওকে দেখে থাকে। বাবার অবস্থাটা আমি বুঝি। আমারও তো দুটো মেয়ে আছে। ওরা বাড়ি না থাকলে আমি ঘরে টিকতে পারি না।”

বিতান একদৃষ্টিতে নিবারণ বাবুকে দেখছিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন আর মিনতি তার সাধ্য মতো বাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। “বাওয়া, বাওয়া, বাওয়া " একটা জড়ানো জড়ানো কন্ঠস্বর ভেসে আসছে কোনার দিকের একটা বেড থেকে। চকিতে নিবারণ বাবুর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। “ছুটকি! এতো আমার ছুটকির গলা।" অসীমও এগিয়ে গেলো," হ্যাঁ, এতো ছুটকির গলা।" নিবারণবাবু ওই অবস্থাতেই টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালেন। মিনতি ধরে ফেলল ওনাকে। অসীম গিয়ে কোনার দিকের একটা বেডে আবিষ্কার করলো ছুটকিকে। হাত, পায়ে সামান্য চোট আছে দেখা গেল। বিতান দেখলো ঢলঢলে নাইটি পরা একটা বছর কুড়ির মেয়ে। শরীরের তুলনায় মাথাটা একটু বড়। চুল ছোট করে কাটা। মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। ঘাড়টা একটু বেঁকে আছে। চোখের দৃষ্টিটা দেখলেই বোঝা যায় মেয়েটি স্বাভাবিক নয়। “আপনারা এই খেপিটাকে চেনেন? আজ সকালেই কারা যেন ওকে হসপিটালের সামনে বসিয়ে দিয়ে গেছে। হাত, পা কেটে গেছিলো দেখে ডাক্তার বাবু ভর্তি করে নিয়েছেন। " একজন নার্স বললেন। “ও আমার মেয়ে। ওর নাম খেপি নয় প্রণতি। " নিবারণবাবু নার্সটির উদ্যেশে কেটে কেটে কথাগুলো বললেন। নার্সটি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। এরপর বিতান যা দেখলো তাতে তার মনের গহ্বরে একটাই কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, " পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম.....। ছুটকি আর ছুটকির বাবা দুজনের চোখেই আনন্দাশ্রু।

“মা, মারে তুই কুথা চলে গেছিলি? তুই তো জানু তোর বাবা তোকে ছাড়া থাকতে পারবে নি।” 

ছুটকি হাত নেড়ে তার জড়ানো জড়ানো কথায় অনেক কিছু বলল। আর কেউ না বুঝলেও তার বাবা ঠিক বুঝলেন। 

“অসীম বাইরে দকানে দেখ না কিছু খাবার পাও নাকি। খিদায় আমার ছ্যানাটার মুখটা শুকি গেছে।”

পকেট হাতড়ে রুমাল খুজলেন নিবারণবাবু। না পেতে নিজের হাত দিয়েই পরম মমতায় ছুটকির মুখের লালা পরিষ্কার করতে লাগলেন। 

“ মা রে। ব্যথা করছে?”

ছুটকি আবার তার 'বাওয়া' কে এক পৃথিবী কথা বলে দিল যা শুধু তার আর তার বাবার একান্ত। অসীম খাবার নিয়ে আসতে মিনতি ছুটকিকে খাওয়াতে গেলে নিবারণবাবু বারণ করলেন। নিজের হাতে একটু একটু করে খাওয়াতে লাগলেন তাঁর আদরের দুলালিকে। বাবা-মেয়ে দুজনের মুখেই তখন এক স্বর্গীয় হাসি।


  এই ঘটনার পর একবছরের ওপর কেটে গেছে। বিতানের গাড়ি আজ ছুটে চলেছে নিবারণবাবুর বাড়ির উদ্দেশ্যে। আজ আর বিতান একা নয়, ওর সাথে আছে রুমণ আর ওদের ছোট্ট গুনগুন। সেদিন এক গ্রাম্য চাষী বদলে দিয়েছিল বিতানের মতো আদ্যন্ত শহুরে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারের সমগ্র সত্ত্বাকে। ছুটকির প্রতি নিবারণবাবুর অপত্য স্নেহ দেখে বিতান যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিল। সেদিন বিতানের বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে গড়িয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ঢুকতেই বাবা-মায়ের বাক্যবান বর্ষিত হয়েছিল, " দ্যাখ তোর বউকে। ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে বাপের বাড়ি যাবে বলে। ওর মন ভালো হবে বলে চাকরি করার পারমিশন দিয়েছিলাম এখন দেখছি সেটা মস্ত ভুল হয়ে গেছে। চাকরিটা না থাকলে এত তেজ বেরিয়ে যেত।" বিতান শান্ত গলায় বলেছিল, " ওর মন ভালো হবে বলে নয় মা তোমার বান্ধবী রীতা মাসির বৌমা এস.এস সি তে ফোর্থ পজিশন করতে তোমার প্রেস্টিজে লেগেছিল তাই তুমি রুমণকে এস.এস.সি তে বসতে দিয়েছিলে।" 

“বাবু!”

বাবা-মা বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই বিতান রুমে চলে গেছিলো। রুমণ সেখানে নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে চলেছিল। 

“ আমার দরকারি ফাইলগুলো নিয়েছ তো?” সহজ গলায় বলেছিল বিতান।

“মানে?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিল রুমণ।

“আরে এবাড়ি চিরদিনের মত ছেড়ে চলে যাচ্ছি দরকারি সব জিনিস গুলো নিতে হবে না।”

রুমনের অন্ধকার মুখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠেছিল। বিতানকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে দিয়েছিল। 


   “বাবু তোর লজ্জা করছে না বউয়ের কথায় মা-বাবা কে ছেড়ে যাচ্ছিস?”

“প্রথম কথা তুমি নিজেই বলেছ মায়ের কোনও আব্দার তুমি অপূর্ণ রাখনি আমি তো তোমারই পদাঙ্ক অনুসরণ করছি বাবা আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা আমি যেমন তোমাদের সন্তান তেমনি রুমনের গর্ভে যে বেড়ে উঠছে সে আমার সন্তান। তার অপরাধটা কি বাবা? সে কন্যা সন্তান আর আমার মা চায়না আমার প্রথম সন্তান মেয়ে হোক কারণ কি না মিন্টুদা আর টিটোদার প্রথমে ছেলে হয়েছে। আমার প্রথমে মেয়ে হলে জেঠিমা আর পিসিমনির সামনে নাকি মায়ের প্রেস্টিজ চলে যাবে তাই আমার সন্তানকে মেরে ফেলতে হবে। সরি বাবা আমার সন্তান তোমাদের খেলার পুতুল নয় যে তোমাদের পছন্দ হচ্ছে না বলে ছুড়ে ফেলবে।”

“আমাদের ফেলে বউ এর কথায় নেচে বাড়ি ছেড়ে যে যাচ্ছিস মুখ দেখাতে পারবি আত্মীয় পরিজনদের সামনে?”  চিৎকার করে উঠেছিলেন বিতানের মা।

বিতান ঠান্ডা গলায় বলেছিল," আর আমি যদি সবাইকে বলে দিই ছোটমামার ডায়াগনেস্টিক সেন্টারের সুযোগ নিয়ে তুমি রুমনের গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করেছ তখন কি হবে আশা করি তোমাদের বলে দিতে হবে না।”

হতভম্ভ বিতানের বাবা-মা দেখলেন তাঁদের অতি বাধ্য ছেলে হঠাৎ করে বড্ড অবাধ্য হয়ে গেছে। তারপর অনেক জল বয়ে গেছে সময়ের নদী দিয়ে। বিতানরা চলে আসার পর বাবা-মা কোনও যোগাযোগ রাখেননি ভেবেছিলেন ছেলে ঝোঁকের বশে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারেন নি তাঁদের বিতানের মধ্যে চিরকালীন পিতৃসত্ত্বা জেগে উঠেছে। গুনগুনের জন্মের পর অবশ্য বাবা ওকে দেখে গেছেন। মায়ের ও ভুল হয়তো আস্তে আস্তে ভাঙবে। বিতানের দিদি-জামাইবাবুও গুনগুনের জন্য খুব খুশি। 



  বেড়ার গেটটা ঠেলে ঢুকল বিতানরা। নিকোনো প্রশস্ত উঠোনের একদিকে বড়ি শুকনো হচ্ছে। আর একদিকে মাদুরের ওপর বসে নিবারণবাবু পরম যত্নে ছুটকিকে খাইয়ে দিচ্ছেন। বিতানদের দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বাড়ির সবাইকে হাঁক ডাক করতে লাগলেন। মিনতি আর অসীম ও ছিল মেয়েদের নিয়ে। বিতান মিনতির হাতে মিষ্টির বিশাল প্যাকেটটা তুলে দিল তারপর নিবারণবাবুর হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বললো, " ছুটকির জন্য একটা জামা আছে। আমার মেয়ে হয়েছে তাই আপনাদের একটু মিস্টি মুখ করাতে এলাম।"

“কি সৌভাগ্য আমার। আপনার মত মানুষ আমাদের কথা মনে রেখেছে।”

বিতান নিবারণবাবুর হাত দুটো ধরে ধরা গলায় বলল, " না নিবারণবাবু সৌভাগ্য আমার যে আমি আপনার দেখা পেয়েছিলাম। আপনাকে দেখে আমি বুঝেছিলাম ' পিতা' শব্দটার সঠিক অর্থ।,"


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics