arijit bhattacharya

Classics

3  

arijit bhattacharya

Classics

ফুলডুঙরি পাহাড়ের সেই রূপকথা

ফুলডুঙরি পাহাড়ের সেই রূপকথা

6 mins
1.4K


আমাদের কোলকাতা শহর থেকে আড়াইশো কিলোমিটার দূরে ছোট্ট সুন্দর ছবির মতো এক জায়গা ঘাটশিলা। যেমন সুন্দর এখানের পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা সুবর্ণরেখা নদী, তেমনই একরাশ পবিত্রতা নিয়ে বিরাজ করছে রঙ্কিনী দেবীর মন্দির, কাছেই আছে নারওয়া ফরেস্ট। এছাড়া এই স্থানের সৌন্দর্যকে আরোও বাড়িয়ে তুলেছে সুদৃশ্য মনোরম বুরুডি ড্যাম ও দিগন্তে ধূসর ফুলডুঙরি পাহাড়। সুবর্ণরেখা নদীতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত যেন কোনো সুদক্ষ চিত্রকর দ্বারা অঙ্কিত ক্যানভাস। বসন্তে লাল পলাশ আরোও এর সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও যা প্রকৃতিপ্রেমীদের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় সেটা হল দূরে দিগচক্রবালে ধূম্র দলমা পাহাড় ,এছাড়াও আছে তাম্রখনি। মাইলের পর মাইল জুড়ে গভীর শালবন তার শ্যামলিমা আর একরাশ রহস্যময়তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিগন্তের মৌন পাহাড় তার বুকের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে ইতিহাসের কতো না অজানা কাহিনী । যতোই শহরের থেকে দূরে যাওয়া যাবে,ততোই প্রকৃতি পলকে পলকে খুলবে তার অন্তর্বাস।


এই রঙ্কিনী মন্দির সম্পর্কে অদ্ভূত এক কাহিনী প্রচলিত। সবচেয়ে বড়ো অবাক করার ব্যাপার হল, রঙ্কিনী দেবী এখানকার আঞ্চলিক অধিবাসীদের দেবী নন। তিনি রাজপুতদের আরাধ্যা,মা শক্তিরই এক রূপ। ভয়ঙ্করী হলেও তিনি আদিশক্তি,তিনিই কল্যানী।তিনিই করুণাময়ী,তিনিই অনন্তরূপা। অনেকে তাঁর সাথে আমাদের অতি পরিচিতা মা কালীর অনেক মিল পান।তিনি ছিলেন মল্ল রাজপুতানার রাজপুতদের আরাধ্যা দেবী । উপকথায় ছিল,রঙ্কিনী দেবী নরবলিতে তুষ্ট হতেন। আনুমানিক তেরশো খ্রিস্টাব্দের কথা। মাণ্ডু ও ধারের মল্ল রাজপুতদের মধ্যে একজন পরম শক্তিশালী রাজা ছিলেন রাজা জগৎ দেব। তিনি কোনো অজ্ঞাত কারণে নিজের রাজধানীকে স্থানান্তরিত করেন বঙ্গের পশ্চিমে সবুজ অরণ্য ও ধূম্র পাহাড় সংকুল সেই অঞ্চলে যে স্থান পরিচিত ছিল 'জঙ্গলমহল' বলে। সেখানে নিজের সাথে নিজের মিত্র ও অভিজাতবর্গকেও নিয়ে যান এবং ঘন দুর্ভেদ্য জঙ্গলে যে স্থানে তিনি নিজের গড় প্রতিষ্ঠিত করেন সেই স্থানের নাম হয় ধলভূমগড় । কি কারণে রাজা জগৎ দেব মধ্যপ্রদেশের ধার ও মাণ্ডু থেকে তার রাজধানী এই অরণ্যসংকুল দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা অঞ্চলে স্থানান্তরিত করলেন,সেই কারণও সম্পূর্ণ কুয়াশায় ঢাকা। কিন্তু অনেকে বলেন যে, দেবী রঙ্কিনীর স্বপ্নাদেশ পেয়েই নাকি রাজা জগৎ দেব এই আপাতদৃষ্টিতে 'ঝুঁকিপূর্ণ' কাজটি করেছিলেন। রাজা জগৎ দেব পরিচিত হয় রাজা জগন্নাথ দেব নামে। তিনি প্রথম রঙ্কিনী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ঘন রহস্যে ঘেরা শালবনের মধ্যে সেই স্থানে, যেই স্থান এখন গালুডি নামে পরিচিত। পরে সেই মন্দিরকেই স্থানান্তরিত করা হয় ঘাটশিলায়। অনেকে বলেন, এর কারণও সেই দেবীর স্বপ্নাদেশ। যাই হোক, এককালে এই রঙ্কিনী দেবী ছিলেন আতঙ্কের এক প্রতিরূপ। রঙ্কিনী দেবীর মন্দিরে নিয়মিত নরবলি হতো। কিন্তু কালের অদ্ভূত খেয়ালে একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়। এই শাল সেগুনের জঙ্গলে, পাহাড়ের কোলে কতো যে রূপকথার অজানা কাহিনী, রহস্যের গল্প,প্রেমকথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার ইয়ত্তা নেই। আর এইসব কাহিনীর স্বাদ পূর্ণরূপে আস্বাদন করতে হলে,বাস্তব থেকে আমাদেরও চলে যেতে হবে সেই রূপকথার দেশে।


ঘাটশিলার কাছেই হাজার রহস্য বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফুলডুংরি পাহাড়। পাঁচশো বছর আগের কথা!চারদিকে শালবন-অনন্ত ,বিস্তৃত, এক অসীমতা নিয়ে বিরাজ করছে। আর দিগন্তে ধূসর ফুলডুঙরি পাহাড়। তখনো এই ধলভূমগড় ও আশেপাশের অঞ্চলে সূর্যের জ্যোতির মতো বিরাজমান মল্ল রাজপুতদের আধিপত্য। আর এই রাজপুত বংশেরই অনিন্দ্য সুন্দরী রাজকন্যা চিত্রলেখা। চিত্রলেখার বয়স বিংশতি বর্ষ, হরিণীর মতো চক্ষুযুগল এবং উন্মুক্ত ঢেউখেলানো কেশরাশি যেকোনো পুরুষের মনোহরণে সক্ষম। চিত্রলেখা পূর্ণযৌবনা,সম্পূর্ণশরীরা এক তটিনীর মতো। উদ্ভিন্নযৌবনা চিত্রলেখার আঁখির কটাক্ষ যে একবার দেখেছে,সে স্বর্ণরেখার বুকে সূর্য যখন অস্ত যায় দিগন্তকে একরাশ লাল রঙ মাখিয়ে, সেই সৌন্দর্যকেও ভুলে যায়। চিত্রলেখা অপরূপ দেহবল্লরী নিয়ে যখন স্নানসিক্ত উন্মুক্ত কেশে স্বর্ণরেখা থেকে উঠে আসে, তখন তাকে দেখে প্রকৃতি স্বয়ং প্রেমের গান করে, সিক্ত পোশাক থেকে যখন ফুটে বেরোয় তার যৌবন, তখন তার এই অপরূপ দেহসুষমা আর ধীর গতিতে গজেন্দ্রগমনের ভঙ্গি স্বর্গের যে কোনো লাস্যময়ী সুস্তনী অপ্সরাকে ঈর্ষার অগ্নিতে জ্বলতে বাধ্য করবে। চিত্রলেখা দেবী রঙ্কিনীর ভক্ত। প্রতিদিন সে স্নান সেরে শুদ্ধ দেহ ও শুচি মনে দেবীকে আরাধনা করে।


যাই হোক,কিছুদিন হল চিত্রলেখার মন ভালো নেই। রাজকুমারী চিত্রলেখা যে নিজের অপূর্ব ব্যক্তিত্ব আর অনন্য দেহসুষমার গুণে যেকোনো পুরুষের মনোহরণকারিণী হতে পারে ,তার নিজের মনই চুরি গেছে। আর চিত্রলেখার হৃদয় হরণ করেছে এক সুদর্শন সুঠাম দীর্ঘদেহী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজবেশী যুবক।যুবকের পরণে যোদ্ধৃবেশ,চোখের মণি নীলপ্রভ। ধীরে ধীরে চিত্রলেখার অন্তরে সৃষ্টি হয় পূর্বরাগের উত্তেজনা। এদিকে যৌবনবতী চঞ্চলা চিত্রলেখার আঁখির কঠাক্ষে যে যুবক বিদ্ধ হয়েছে তা যুবকের দীর্ঘক্ষণ ধরে কুমারীর দিকে একপলকে তাকিয়ে থাকা থেকেই বোঝা গেছে। হয়তো চিত্রলেখার চোখের সেই অদ্ভূত সৌন্দর্যকে অপাঙ্গে সন্দর্শনের পর সেই যুবকও বিদ্ধ হয়েছে কামদেবের শরে। চিত্রলেখা হয়তো হয়ে উঠেছে ঐ যুবকের স্বপ্নের রাজকন্যা। কিন্তু আবার কখন দেখা হবে ঐ যুবকের সাথে, তার অভিলাষা কি পূর্ণ হবে, বলতে পারবে কি সে ঐ রাজকুমারের তার অন্তরের সেই গভীর গোপন কথা, উত্তেজনায় দিন কাটতে থাকে চিত্রলেখার। উৎকন্ঠা আর ভয় যে এতো মিষ্টি হয়, তা জানত না সে। হয়তো প্রেমে পড়লে সব কিছুকেই মিষ্টি লাগে। চিত্রলেখার নীরব প্রেমের সাক্ষী থাকে স্বর্ণরেখা নদী , দূরের ঐ ফুলডুংরি পাহাড় , ধলভূমগড়ের দুর্গ আর পাহাড় জঙ্গল আর আকাশে ওঠা সেই একলা চাঁদ।


আর চিত্রলেখার মন কিছুটা ভারাক্রান্ত। আগের দিন রাতে অভিসারের সময় ধরা পড়েছে তার প্রেমিক ইন্দ্রসেন,যে সুদূর গুজরাটের সোলাঙ্কি বংশের রাজকুমার। সোলাঙ্কিদের সাথে এই মল্ল রাজপুতদের দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করেছে দ্বেষ আর বৈরিতা। রাজা বিক্রম দেব বুঝতে পারছেন না, এই যুবকের সাহস কি করে হয় তার মেয়ের সাথে প্রেম করার। চিত্রলেখার এই প্রেমের কথা গোপন রাখতে তিনি ঠিক করেছেন পরিবারের গায়ে যাতে কলঙ্ক না লাগে এবং সোলাঙ্কিদের উচিত শিক্ষা দিতে যেন পরের অমাবস্যার রাতে যখন ঘনকৃষ্ণ আঁধারে ছেয়ে যাবে বিশ্বচরাচর , সারা ধলভূমগড়ে রচিত হবে এক অপার্থিব পরিবেশ, তখন রঙ্কিনী দেবীর মন্দিরে যেন বলি দেওয়া হয় রাজকুমার ইন্দ্রকুমার সোলাঙ্কিকে। এতে দেবীও তুষ্ট হবেন এবং তার বংশের কলঙ্কও দূর হবে। তাই বিক্রম দেবের এই নির্মম সিদ্ধান্ত!


চিত্রলেখা বুঝতে পারে না,সে নিজেও তো রঙ্কিনী দেবীর পূজারিণী। প্রত্যহ সকালে দেবীর কাছে করজোড়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে, দেবী কি তার প্রেম সফল হতে দেবেন না! দেবী কি তার অমঙ্গল চাইবেন। রঙ্কিনী দেবী কি ভাবে মানুষের রক্তে তুষ্ট হতে পারেন! তিনিই তো মাতা জগন্ময়ী। মাতা কি কোনোদিন সন্তানের রক্তে পরিতৃপ্ত হন।


অবশেষে ঘনিয়ে এল সেই অমাবস্যার রাত। বিশ্বচরাচর তমিস্রায় আচ্ছন্ন। গহন শালবনের মধ্যে রঙ্কিনী দেবীর মন্দির। পিছমোড়া করে বেঁধে দুজন রাজপুরুষ নিয়ে ঢুকল রাজবন্দি ইন্দ্রকুমারকে। সামনে রাজা বিক্রম দেবের মুখে নির্মমতার হাসি। 'এবার উচিত শিক্ষা দেওয়া যাবে সোলাঙ্কিদের। ' মনে মনে ভেবে এক অদ্ভূত আত্মতৃপ্তি লাভ করেন বিক্রম। পেছনে নির্বাক দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে চিত্রলেখা। একমাত্র মনে মনে মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা করা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই তার। তার চোখ অশ্রুসজল। তার সামনেই তার ভালোবাসার সাথে হতে চলেছে জগতের নির্মমতম ঘটনা। ইশ,কুঁড়ি না ফুটতেই ঝরে গেল।


কিন্তু,এখনো আশা ও আস্থা হারায় নি চিত্রলেখা। সে শুনেছে যে,মা রঙ্কিনী জাগ্রতা দেবী এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এই কথা। হ্যাঁ,মা যদি তার ওপর তুষ্ট হয়ে থাকেন তাহলে কোনোভাবেই তার প্রেম ইন্দ্রসেনকে এই পৃথিবী থেকে এভাবে বিদায় নিতে দেবেন না। হ্যাঁ,মায়ের ক্ষমতা অপার,কিছু একটা চমৎকার তিনি করবেনই । হ্যাঁ,তার প্রার্থনার যদি শক্তি থাকে,মা তার ভালোবাসাকে রক্ষা করবেই করবেন।


হাঁড়িকাঠে বসানো হয়েছে ইন্দ্রসেনের গলা। বাইরে বইছে ঝোড়ো হাওয়া। খড়্গ উঁচু করল ঘাতক।আর কেবল কয়েক মুহূর্ত! তার পরেই ইন্দ্রসেনের মস্তক ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে,পূরণ হবে বিক্রম দেবের অভিলাষা। রাজা বিক্রমের মুখে পৈশাচিক হাসি। আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে চিত্রলেখা। সে দেখতে চায় না তার ইন্দ্রের এই করুণ পরিণতি।


আর তখনই ঘটে সেই অঘটন।সেই অলৌকিক কাণ্ড! ঘাতক ইন্দ্রসেনের মস্তক ছিন্ন করতে উদ্যত হতেই, কোনো এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে দেবীর হাত থেকে বেরিয়ে এল খড়্গ এবং তীব্রগতিতে ঘুরতে ঘুরতে তা ছিন্ন করল ঘাতকের মস্তক। বিক্রমদেব বাকরুদ্ধ। চিত্রলেখার চোখে আনন্দাশ্রু,তার ভালোবাসাকে রক্ষা করেছেন মা স্বয়ং। মা সত্যিই করুণাময়ী,তার প্রার্থনা শুনেছেন।


অবশেষে চিত্রলেখা আর ইন্দ্রসেনের প্রেমে সায় দিলেন বিক্রম। তিনিও বুঝেছিলেন এই বৈরিতা দেবীর কাছেও কাম্য নয়।


তিনদিন পরে তারা এই ধলভূমগড়েই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হল। আর ধীরে ধীরে বিক্রমের প্রিয়পাত্রে পরিণত হলেন ইন্দ্রসেন। আর একসময় বিক্রমও গর্ব করতে লাগলেন জামাতা ইন্দ্রকে নিয়ে।


এরপর এমন দিন এসেছে তিনি কন্যা ও জামাতাকে সমাদরে রঙ্কিনী দেবীর মন্দিরে পূজা করতে নিয়ে গেছেন।


আর সেই অভিশপ্ত রাতেই রঙ্কিনী মন্দিরে বন্ধ হল নরবলি। ভক্তি আর সমর্পণ সত্যিই অসম্ভবকে সম্ভব করে;ভক্তিই শক্তি!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics