ফিরিয়ে দাও দুর হও
ফিরিয়ে দাও দুর হও
আমরা যখন যৌথ জীবন একান্নবর্তী পরিবারে বড় হচ্ছি তখন বাঙ্গালির ছিলো বারো মাসে তেরো পার্বন।
ঘরময় এক গাট্টি বাচ্চাকাচ্চা, হই হুল্লোড়, ঝগড়াঝাটি। এই আনন্দ এই কান্না।সবাই এক সাথে বাবা মা'র সাথে খেতে বসা,খেতে খেতেই গালগল্প,সবার খোজ খবর নেয়া।
তখন পরিবারের পুরুষ সদস্যরা ঘরের বাহিরে যারযার ব্যবসা বানিজ্য চাকুরি নিয়ে ব্যস্থ। আর ঘরের বউ ও কন্যারা সংসার সামলাতো। শিক্ষার্থী সন্তানেরা লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্থ।আর এসবের সব কিছুর সমন্বয় করতো মা।
সংসারের সব সিদ্ধান্ত মা'ই নিতো।পুরুষ সদস্যদের কাজ ছিলো শুধু আয় রোজগার করা।বাবা মায়ের সিদ্ধান্ত কে জায়েজ করে সবার উপর চাপিয়ে দিতো তাও না কিন্তু। বাড়ির চাচা ও বড় ভাইদের যেকোনো বিষয়ে মতামত যাচাই করে মা'ই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো।
তখন বিশ্ব ছিলো এনালগ আর তিন ভাগে বিভক্ত।
মানুষের অত পুজির পেছনে দৌড়াতে হয়নি।বর্তমান এক কেন্দ্রিক বিশ্বায়নের পুজি ব্যবস্থাপনায় ক্রমাগতভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছে আমাদের যৌথ খামার।বাড়ছে মানুষে মানুষে দুরত্ব। ভাংছে যৌথ সংসার।
মানুষ ক্রমাগত হয়ে উঠছে পুজির দাস।হারাচ্ছে তার মায়া মহব্বত মানবিক সাংস্কৃতিক সব আবেদন।
মানুষের মনে নেই যৌথা আনন্দের হুল্লোড়। আনন্দ ভাগাভাগির উৎসব। শহুরে বিলাসী মানুষেরা গ্রামের স্মৃতি কাতরাতা ধরে রাখতে কিছু লোকদেখানো লোকঠকানো মৌসুমী উৎসবের আয়োজন করে।সেখানে নেই সেই প্রাণের উচ্ছল উজ্জলতা।
গ্রামে নেই বিস্তীর্ণ খেলার মাঠ। জীর্ণ রুগ্ন হয়ে পড়ে আছে আমাদের বাপ দাদাদের গড়ে তোলা শহীদস্মৃতি পাঠাগার।
বৈশাখের চাঁদোয়া রাতে ধান কাটা খোলা মাঠে ডাংগুলি, হাডুডু খেলার আয়োজন।
আমাদের মাঠ গুলো এখন অধিক ফসলের ফলন লোভী কৃষকের চাষ হয় সারা বছর। জমির ও শান্তি নেই বিশ্রাম নেই।ফলে জমি হারাচ্ছে প্রাকৃতিক উর্বরতা শক্তি। যারফলে জমিতে অধিক হারে ব্যবহার হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির রাসায়নিক সার ও কীটনাশক। অধিক ফলন ও সারা বছর উৎপাদনের লক্ষ্যে বহুজাতিক কোম্পানি নিয়ে এসেছে হাইব্রিড বীজ।
এসব কৃষি পণ্যের নেই স্বাদ গন্ধ সুরভি ও ভিটামিন। পেট ভরানো জন্যে,ক্ষুধা নিবারণের জন্যে আমরাও দেদারসে খাচ্ছি আর গিলছি।
এসব রাসায়নিক সার কীটনাশক ও উপশীবীজের উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের ফলে মানুষ হারাচ্ছে তার দৈহিক প্রকৃতিগত ভাবে যে শক্তি তা হারাচ্ছে। ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগের সংক্রমণে নিয়মিত ডাক্তার, মেডিসিন, টেস্ট এসবের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে তার আর পরিবারে দেবার মতো বাড়তি সময় কই।
তথাকথিত লোকদেখানো সামাজিক স্ট্যাটাস মেন্টেন করতে যেয়ে অধিক আয় উপার্জনের লক্ষ্যে স্বামী স্ত্রী উভয়ের চাকুরির পেছনে ছুটছে।
ফলে শহর নগর গ্রাম গঞ্জে সবখানে শিশুরা পাচ্ছেনা তার বাবা মা দাদা-দাদি ঘিরে আনন্দময় শৈশব। আমরা যেভাবে যৌথ সংসারে বড় হয়ে সামাজিকতা শিক্ষা পেয়েছি পরিবার থেকে, কেটেছে আনন্দ হিল্লোল শৈশব, আজ আমার সন্তানের আমার প্রতিবেশী সন্তানের তা নেই।
সে বেড়ে উঠছে ঘরের বুয়ার হাতে,একটু বড় শিশু বইয়ের বোঝা বহন করতে করতে বড় নাহওয়ার পূর্বেই কুজো হয়ে যাচ্ছে। বাসা বাড়িতে এসে টিভি সিরিয়াল, মোবালে গেম, কম্পিউটারে গেম,প্রাইভেট টিউটর করতে করতে সে হয়ে উঠছে একটা মনুষ্য রোবট।
তার ভেতরে নেই মায়া মহব্বত সামাজিক দায় দায়িত্ব। মমত্ববোধের জায়গায় স্বার্থপর।
কথায় কথায় সন্দেহের বীজ থেকে ভেঙ্গে যাচ্ছে শুধু দু'জনে বসবাস করা সংসার।
এখন কার বাচ্ছারা চিনেনা ধান গাছ বৃক্ষ না উদ্ভিদ। সে জানেনা তরমুজ কোথায় ধরে গাছে না লতায়।সে ভীষণ মানসিক ভাবে একরোখা, গোয়ার। নিজেকে ছাড়া কিছুই চিনেনা।
বাবা-মা রা ও চাকুরী ব্যবসা সোসাল সোসাইটির লোকদেখানো সমাজ কর্মের নেত্রী, পার্টি,ড্রাইভ এসব করতে করতে ঘরে রেখে আসা শিশুটি দুপুরে ভাত খেলো না ফিডার খেলো তাও ভুলে যায়।
আর কিশোরেরা ইন্টারনেট এর সুযোগে পর্ণগ্রাফিতে আসক্ত। ফলে বাড়ছে ধর্ষণ,নারী শিশু নির্যাতনের ফলে খুন ও অন্যান্য অপরাধ।
আমি আর এসব উন্নত প্রযুক্তির অধিক আয়ের পুজির দাস হওয়া জীবন চাইনা।
আমাকে ফিরিয়ে দাও সেই এনালগ সময়ে একান্নবর্তী যৌথ খামারের যৌথ সংসারের আনন্দ হিল্লোল শৈশব কৈশোর। ফিরিয়ে দাও বাঙ্গালির পিটাপুলির বারো মাসের তেরো পার্বণ।
আমাদের বস্তুবাদী পুজি ব্যবস্থাপনার আগ্রসানের ভেতর ধর্মীয় উগ্রবাদ নয় ফিরিয়ে দাও মরমি গানের মাইজভান্ডারি, ভাটিয়ালি মারফতি লালন ফকিরের উৎসবময় যৌবন, যৌথ সংসারের আনন্দ বেদনার কাব্যিক জীবন।
আমাদের মা হোক সংসারের কত্রী পিতা হোক সামাজিক মানবিক উদার মানুষ।ভাইয়েরা হোক আদর শাসনের শ্রদ্ধার আদর্শিক পথ প্রদর্শক। চাচা চাচি হোক দোষ ত্রুটি লুকানোর উদার ভালোবাসা বিশ্বাসের বুক।
ফিরিয়ে দাও আমার গ্রামীণ জীবন, দুর হও তোমার বিশ্বায়নের পুজির দাসত্ব।