কৃতজ্ঞতাবোধ
কৃতজ্ঞতাবোধ


চাঁদবালা ও জোসনাবালা পিঠাপিটি দুইবোন। শৈশবে কোনো এক দুর্ঘটনায় মারা যায় তাদের বাপ। এরপর দুকন্যাকে নিয়ে মা শ্রমজীবী নারী। তাদের বসবাস কুতুবদিয়া পাড়া—সমিতি পাড়ায়। ১৯৯১-এর ঘুর্ণিঝড়ে কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও অন্যান্য উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনেরা এই চরাঞ্চলে জনবসতি গড়ে তোলে। এরা প্রত্যেকেই অভ্যন্তরীণ অভিবাসী। কুতুবদিয়া পাড়া—সমিতি পাড়ার চরাঞ্চলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শুটকি মহাল।
শুটকি মহালে কাজ চলে বছরে চার থেকে পাঁচ মাস। এ ক-মাস এলাকার দরিদ্র নারী পুরুষ শুটকি মহালে কাজ করে মোটামুটি ভালো চলে। এখানে ও নারী শ্রমিকেরা বেতন বৈষম্যের শিকার।
আর অদক্ষ নারী শ্রমিকের অবস্থা আরো খারাপ। শুটকি মহালে মাছে বিভিন্ন প্রকার কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন রোগবালাই লেগেই থাকে। মাসে যদি তারা পনেরো দিন কাজ করে আবার পনেরো দিন অসুস্থ থাকে। সেখানে ঝুকিতে আছে নারী ও শিশু শ্রমিকেরা। তাদের আয় রোজগার, অসুস্থতার ফলে যা আয় হয়, তা আবার চিকিৎসা ও ঔষধের পেছনে চলে যায়। তো তাদের নিত্য অভাব। যখন শুটকি মহালের কাজ বন্ধ থাকে তখন তারা বিভিন্ন বাসা বাড়ি ও অন্যান্য ঝুটা কাজ করে দিন গুজার করে। এমনি একজন নারী শ্রমিকের দুই কন্যা আমাদের টিউটোরিয়াল হোমে পড়ে। আমারা তাদের বিনা পয়সায় পড়াই। এরকম প্রায় দশ পনেরো শিক্ষার্থীকে আমারা বিনা পয়সায় পড়াই। এসব হতদরিদ্র শিক্ষার্থীর মধ্যে চাঁ বালা ও জোসনাবালা দুবোন। দুবোনের মধ্যে এক বোনকে শাহীন তাদের স্কুলে বিনাবেতনে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। তাদের স্কুল সকালের হলেও দুপুরে কোচিং এ পড়তে হয়। সব মিলিয়ে সারাদিন তাদের পড়ালেখার পেছনে চলে যায়। দূরের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসার সময় দুপুরের খাবার সাথে করে নিয়ে আসে। আমরাও স্কুল জীবনে তাই করেছি, টিফিনবক্সে করে স্কুলে খাবার নিয়ে যেতাম। যেদিন খাবার দিতে পারতো না মা সেদিন দুপুরে নাশতা খাওয়ার জন্য টাকা দিতো। চাঁদবালা-জোসনাবালাদের যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে আবার দুপুরে টিফিন খুবই দুরাশা। আমার বাসা যেহেতু তাদের কোচিং সেন্টার। দুরের শিক্ষার্থীরা অনেকেই দুপুরের খাবার আমার বাসায় সারে। অনেকেই মায়ের দেয়া খাবারের সাথে বাড়তি মাছ তরকারি প্রয়োজন হলে পাকঘর তো আছেই। অনেক সময় দেখা যায় তারা আমাদের জন্যও থাকে না। এটা তারা তাদের ম্যাডাম ও আংকেল স্যারের উপর তাদের অধিকার আবদার। চাঁদবালা ও জোসনাবালার যেদিন টিফিন আনার সুযোগ হতো না সেদিন দুজনেই আমার সাথে খেতো।
আজ বিকেলে এক অপরিচিত মহিলাকে দেখলাম তাদের দুই বোনের সাথে। যেহেতু তাদের কোচিং এখনো শুরু হয়নি তাদের আগমন আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত। দুবোন এসে যখন প্রথমে আমার পায়ে ধরে সালাম করলো দেখি এর পরপরই এই ভদ্র মহিলা ও তাদের দেখাদেখি পায়ে ধরে সালাম করছে। আমি হতভম্ব ও ভ্যাপাবাচেকা খেলাম। আমার জন্য খুব বিব্রতকর অবস্থা। তো আমি তাদের জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কে উনি।’
বললো, ‘আমার মা।’
তাদের চেয়ারে বসিয়ে শাহীন কে ডাকলাম। তখন শাহীন ভেতরে কী যেন কাজ করছিল। সে আসার সাথে সাথে মা-মেয়ে সবাই তাকে জড়িয়ে ধরলো। তারা কী খুশি! দুবোন আবার গেলো বছরের থেকে এবছর ভালো ফলাফল করেছে। বড়োটি ভর্তি হবে ক্লাস নাইনে। সব মিলিয়ে তাদের মাও খুব খুশি।
আমি তাদের কথা বলতে দিয়ে ভেতরে চলে এলাম। শাহীন তাদের মিষ্টি খাওয়ালো। পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলে অবশ্য আমার বাসায় মিষ্টির বন্যা চলে। যদিও আমার মিষ্টি খাওয়া বারণ। চাঁদবালা ও জোসনাবালাকে প্রতিবছর বিনা পয়সায় পড়াই আর ওর বড় মেয়ে ক্লাস নাইনে ভর্তি হবে। সব মিলিয়ে তাদের মা কয়েক মাসের আয় থেকে খরচ বাচিয়ে হকার মার্কেটে যেয়ে শাহীনের জন্য আটশো টাকা দিয়ে উপহার নিয়ে এসেছে।
শাহীন তাদের আনা থ্রিপিস নিয়ে মাথায় তুলে বুকে জড়িয়ে কন্যাদ্বয়কে আদর করছে। এরপর শাহীন বললো, ‘আমি আপনার উপহার পেয়েছি, আমি খুব খুশি হয়েছি। সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছি আপনি যে এদের নিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে এসেছেন। আপনার মেয়ে মানে আমার মেয়ে, আপনি তো জানেন আমাদের কোন সন্তান নাই, তাই এদের আমি মেয়ের মতোই দেখি। আপনি খুশি হয়ে আমার জন্য উপহার এনেছেন এতে আরও খুশি, তবে এসব না এনে, আপনার হাতের বানানো একখিলি পান আনলে আরো বেশি খুশি হতাম। এবার আমি আপনাকে আমার পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে দিচ্ছি। আমার অনেক আছে আপনি মনে কষ্ট নিবেন না। আমার এখানে শুধু এরা না আরও অনেককে আমারা বিনা পয়সায় পড়াই। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনাদের ছেলে মেয়েদের মানুষ হিসাবে গড়তে পারলে আমারা সার্থক। সেটাই আমাদের উপহার। এগুলো আমার পক্ষ থেকে আপনি পরবেন।’
এ কথা বলার পরপর ভদ্র মহিলার চোখ জলে টলোমলো করছে। তার কণ্ঠ অভিমানে বাষ্প রুদ্ধ হচ্ছে, কথা বলতে পারছে না, আমি খেয়াল করলাম। সাথে সাথে থ্রিপিসের প্যাকেটটি নিয়ে খুলে কাপড় বের করে শাহীনকে বললাম দাঁড়াও দেখি, সে দাঁড়ানোর পর কাপড়ের একটা অংশ তার গায়ে জড়ালাম। ভদ্রমহিলাকে বললাম, ‘দেখেন তো, আপনার ম্যাডাম কে কেমন লাগছে?’
এরপর মা মেয়ের কী হাসি! চাঁদের হাসিতে ঝুরঝুর ঝরছে জোছনা।