Pradip Biswas

Horror Classics Children

4  

Pradip Biswas

Horror Classics Children

পৌষল্লা

পৌষল্লা

11 mins
565


         

আমার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে কৃষি-প্রধান মফস্বল বাংলায়। পৌষের সন্ধ্যায়, ধান-কাটা খালি ক্ষেতে, আমরা সব খেলুড়িরা মিলে, চড়ুইভাতি বা স্থানীয় ভাষায় পৌষল্লা' তে মেতে উঠতাম।

খেলুড়ি মানে খেলার সাথীরা ।  তাতে কোনো, আর্থিক বা জাত-ভেদ ছিল না । অঘ্রান মাস পড়তে না পড়তেই শুরু হয়ে যেত নবান্ন উৎসব। আর সেই উপলক্ষে, বাড়ি-বাড়ি ভোজের নেমতন্ন আর বড়োমাঠের মেলাতে, আমরা সব খেলুড়িরা একসাথে হলে, নিম্নসুরে আলোচনা করে দিতাম যে সেবার কোন মাঠে পৌষল্লা করা ঠিক হবে। 

বছরকারের মতো, পৌষল্লার মাঠটা ঠিক করা, একটা বেশ জটিল ব্যাপার। গ্রামের পূর্ব আর পশ্চিম সীমানায়  ছিল  বিশাল দু’ দুটো দীঘি, পদ্মবাঁধ আর শ্মশানদীঘি। এই দীঘি দুটো ঘিরে যে বিশাল এলাকা তার নাম দীঘির ঢাল যেখানে বিঘার পর বিঘা ধানের ক্ষেত।

শ্মশানদীঘি তার নামেই  বুঝিয়ে দেয় যে এই দীঘির পাড়ে আছে এক বিশাল শ্মশান। তবে আমাদের ওইদিককার প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী, শ্মশানদীঘিতে জ্যোৎস্না-পক্ষের রাত্রে দাহ হতো না । একমাত্র কৃষ্ণপক্ষেই রাত্রে দাহ হতো । শ্মশানদীঘির আরও ক্রোশ-খানিক দূরে, মুন্ডেশ্বরী নদীর  এককোণে একটি বাঁধানো ঘাটের পাশে  আর একটি শ্মশান। সেখানে দাহের কোনোরকম বিধিনিষেধ নেই। 

পৌষল্লার জন্য আমাদের পছন্দের জায়গা  ছিল  দীঘির ঢালের পদ্মবাঁধের কাছের জায়গাগুলো।  এইদিকে প্রায় সবটাই ধানের ক্ষেত হওয়ায়, অনেক বেশী নিজের-নিজের  সুবিধে অনুযায়ী জায়গা বাছা যায়। হাওয়া এবং শীতের কামড় অনেক কম।

এখানে মাঝে-মাঝে বেশ কিছু বেগুন, টমেটো আর মটরশুঁটির ক্ষেত এবং তার বেশির ভাগই বেড়া না দেওয়া।এইসব সবজি ক্ষেতগুলো থেকে, চুরি করে আনা শিশিরে ভেজা টমেটো, বেগুন, আনামাত্রই আগুনে ঝলসে নেওয়া যায় আর খিচুড়িতে মটরশুঁটি অনেক কাজের।খিচুড়ির ফুলকপি আর আলু আমার যে যার ঘরের ক্ষেত থেকে তুলে আনতাম। 

একদিকে পৌষল্লার রান্না যেমন এগোতো, সেইসাথে অন্য গল্পগাছার সাথে শ্মশানদীঘির গল্প-কাহিনীও কেউ না কেউ সুরু করেই দিত। 

সূর্য পাটে গেলেই, এই শ্মশান-দিঘিতে, অপদেবতা আর পেত্নীরা  উঠে আসেন।  তখন শ্মশান-দীঘির পশ্চিম-পারের বড়ো বটগাছটার কোটরে নাকি আগুন জ্বলে ওঠে । শোনা যায়, এসব চাক্ষুষ দেখলেই মানুষ বেহুঁশ হয়ে সেখানেই পড়ে থাকে। তার চিকিৎসা, গাঁয়ের সদাশিব ওঝা আর আজকাল তার ছেলে জয়গোপাল ছাড়া, আর কেউ করতে পারে না । 

এই জয়গোপাল বা আমরা যাকে জয় বলে ডাকি, সে আমাদের এই খেলুড়ি-দলের একজন সদস্য। জয় আমাদের বলেছে যে  জ্যোৎস্না-পক্ষের রাতে, শ্মশান-দীঘিতে  এসব নাকি হয় না।

আমাদের খেলুড়িদের পৌষল্লা, বরাবরই এইসব কারণে, পৌষ মাসের জ্যোৎস্না-পক্ষের রাত ধরেই করা হয় আর সেটা পদ্মদিঘির কাছেই হয়। জায়গাটা বলাই বাহুল্য, বেগুন-টমেটো ক্ষেতের কাছাকাছিই হতো।বছরের এই সময়টায়, বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর, সকাল থেকেই আমাদের অখণ্ড অবসর। জয়’কে সাথে নিয়ে, আমরা খালি ক্ষেতগুলোতে ঘুরে পৌষল্লার জন্য দু-তিনটে জায়গা ঠিক করতাম । 

দলের সর্বসম্মতিক্রমে, পৌষল্লার জায়গা একবার ঠিক হয়ে গেলেই, তার পরের দিন বিকেলে, খেলার মাঠে না গিয়ে, আমরা পৌষল্লার জায়গাটায় গিয়ে, খালি ক্ষেতের ঠিক মাঝে একটা লম্বা বাঁশ পুতে দিতাম।

জয়, সেই বাঁশে কিসব মন্ত্র বিড়বিড় করে বলতে-বলতে, কাঁচা-হলুদবাটা আর সিন্দুরলেপা একটা কাপড় পেরেক দিয়ে পুঁতে দিত।  

এই খুঁটিপুজো আর তার এই নিয়মটা, শুধু আমাদের গ্রামেই নয়, আশেপাশের গ্রামেও আছে । অন্য সব দলের মতো, খুঁটিপুজোর এক সপ্তাহের মধ্যেই, আমরা পৌষল্লা সেরে ফেলতাম। আর তার তোড়জোড়, খুঁটিপুজোর পরদিন থেকেই, শুরু হয়ে যেত।চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ প্রায় সব ঘরেই প্রচুর পরিমাণে থাকতো।

কিন্তু ভালো খিচুড়ির জন্য চাই, সুগন্ধি দানাগুড়ি আতপ চাল আর সোনামুগ ডাল, যার সবচাইতে ভালো চাষ হত মোড়লপাড়া বা মণ্ডলপাড়ায় । 

এই মন্ডলপাড়ার সুদেব আর চাঁদু নিজের বাড়ি থেকে তার জোগান দিত। সেইরকম, চাটনির জন্য, আমার বাড়ি থেকে  ইরানে থাকা ছোটকাকার আনা মনক্কা আর খেজুর, গয়লাপাড়ার দুখু আর দেবুর বাড়ি থেকে ঘি, এইসব জোগাড় হয়ে যেত  দুপুরবেলায় । 

মা আর কাকিমা’রা তখন, ছাদে বড়ি আর আচার রোদে দিতে গিয়ে, গল্পগাছায় মত্ত হয়ে যেতেন । এই সব অপহৃত মূল্যবান সামগ্রী, খাজনা-মহাল বলে একটি পরিত্যক্ত ভুত-বাংলোর চোরকুঠুরিতে, আমরা লুকিয়ে রাখতাম। 

তবে আমাদের জয়, এই জায়গায় যাবার আগে মন্ত্র বলতে-বলতে, আমাদের  সবার আগে-আগে যেত।জয় বলে যে অশরীরীরা নাকি সব জিনিসের গন্ধ পান। সেইসময় তাঁদের যদি কোনো জিনিষে নজর লেগে যায় তবে তা মানুষের ভোগে লাগবার সময় নানারকম ভাবে তারা বাধা দেন বা নষ্ট হয়ে  যায় । পৌষল্লার দিন দুপুরের পর এই সব সামগ্রী সেখান থেকে বার করে সিধা পৌষল্লার মাঠে রাখা হত, ত্রিপল চাপা দিয়ে।  

এছাড়া, যে যার সময়মত পৌষল্লার জায়গাতে এসে, রেখে যেত শুকনো কাঠ, নারকেল গাছের ডাল, ঘুঁটে ইত্যাদি। পৌষল্লার আগের দিন, জয় আর আমরা বাড়ি থেকে কোদাল-শাবল নিয়ে এসে, একসাথে মিলে তিন-চারটে উনুনের জন্য গর্ত কেটে তার ওপরে হাঁড়ি-কড়াই বসাবার জন্য মাটির পুরু দেওয়াল বা ঝিঁক দেওয়া হতো। 

মুন্ডেশ্বরী নদীর শ্মশানঘাটের দিকে মুখ করে, আর শ্মশান-দীঘির দিকে মুখ করে, দুটো উনুন আলাদা করে তৈরি করা হতো। পৌষল্লার অন্য সব উনুন জ্বলবার আগে, এই দুটো উনুন সর্বপ্রথম জ্বলত । এই দুটো উনুনের কাঠের জোগান আর বাকি খুঁটিনাটি ব্যাপার  পুরোপুরি জয়ের তত্ত্বাবধানে থাকতো। এর জন্য বিশেষ আকৃতির বেল আর নিম কাঠ এবং তার সাথে আরও কি কি সব শুকনো লতাপাতা আর শিকড় ও জ্বলত । আমাদের কিছু না বললেও এই দুটো চুল্লি যে ভূতপ্রেতের ঝামেলা থেকে বাঁচবার  উদ্দেশে সে কথা কেউ আর সাহস করে জিগ্যেস করতো না। 

প্রায় সবারই ঘরে ধান সেদ্ধ করবার জন্য বড়ো বড়ো হাঁড়ি আর কড়াই থাকতই। সেইগুলোর মধ্যে, সুবিধা-মতো  হাঁড়ি-কড়াই আর বড়ো-বড়ো হাতা-খুন্তি-ঝাঁজরি, এইসব নিয়ে আসত  বলাই-ময়রার ছেলে অভি। ফুটবল খেলাতে, অভি যেমন গোল সামলাত নিপুণভাবে, তেমনি এই পৌষল্লার রান্নাবান্না মানে খিচুড়ি, বাঁধাকপির তরকারি, আর টমেটোর চাটনি ওরই হাতে তৈরি হতো। আমরা বাকিরা, জোগাড়ি হয়ে, বাকি কাজগুলো করতাম। তবে আমিষও রান্না হত। 

এমনিতেই, দু’দিকে দুটো প্রেত-উনুনের জন্য চাই কালো মাগুরমাছ আর শোল মাছ। সেই জোগাড় করতে গিয়ে মাছ বা মাংসের জোগাড়ও হয়ে যেত। 

এইরকম সবচেয়ে বেশি জোগাড়, মানে বেশ ভালোরকম মাছ-মাংসের জোগাড় হয়েছিল একবার।তবে সেইসাথে, একটা ঘটনাও ঘটেছিল, যা মনে করে, আজও ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে কথায় পরে আসছি।

সূর্য ডোবার আগেই সবাই এসে পৌষল্লার মাঠে এসে জড়ো হয়ে যেতাম। সূর্য ডুবতেই, প্রতিবারের মতো শুরু হতো সবার প্রথমেই, দুটো প্রেত-উনুনে  আগুন জ্বালানো। একের পর এক বিশেষ আকৃতির  কাঠ আর শিকড়-বাকড় সাজিয়ে, সবাইকে চুপ করতে বলে, মন্ত্র পড়তে-পড়তে, আগুন ধরাত জয় । আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলেই, ও আমাদের সবাইকে আর পৌষল্লার প্রাঙ্গণকে বাঁধন করে দিত, যাতে ওনাদের নজর না লাগে। দুটো উনুনের কাছে কাদার পাড় করে, তাতে একজোড়া কুচকুচে জ্যান্ত কালো সিঙ্গি মাছের মাথা আটকে দিয়ে, এক বড়ো চাকুতে, তাদের মাথা  কেটে, মাছ দুটোর  রক্তমাখা ধড় উনুন দুটোতে উৎসর্গ করা হত । 

সিঙ্গি মাছ জ্বলে ছাই হবার পর, শোলমাছের পালা। মন্ত্র পড়ে, তাকে শালপাতায় মুড়ে, আহুতি দেওয়া হত প্রেত-উনুনের দাউ-দাউ করে জ্বলে ওঠা, লেলিহান আগুনের শিখায়। মাছ-পোড়ার গন্ধ এলেই পোড়া মাছ, শালপাতা সমেত, বার করে আনা হতো । শালপাতা পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও শোলমাছ কিন্তু একটুও পুড়তো না।  আগুনে সেদ্ধ হয়ে মাখন-নরম হয়ে যেত, যা নুন-লঙ্কা-টমেটোর সাথে, উপাদেয় প্রসাদ হিসেবে সবাই বেশ তারিয়ে-তারিয়ে খেত।  উনুনের চারদিকে গোল হয়ে বসে, এই মাছ-পোড়া খাবার সাথে-সাথে, শুরু হয়ে যেতো পৌষল্লার হৈ-হল্লা।  

এখনকার মতো, লাউড-স্পিকার বা বক্স বাজানোর চল ছিল না, তবে  খিচুড়ি- বাঁধাকপি রান্নার সুবাস ছড়াবার সাথে সাথে, আমাদের বিশেষ আমন্ত্রণে, চলে আসতেন যাত্রা আর কীর্তনের শিল্পী দলের কয়েকজন। বাউল গান, ঝুমুরের নাচ- গান এইসবের মাঝে পুরোদমে রান্না চলত।তিন-চারটে বড়- বড় উনুনের তাপে, শীত মোটেই টের পেতাম না।  

গ্রামের দিকে সন্ধ্যের একটু পরেই নিশুতির স্তব্ধতা নেমে আসত।   পৌষল্লা শেষ হতে তেমন রাত হতো না ।  সবার শেষে, কালীপূজো আর নবান্নের পরব থেকে বাঁচিয়ে রাখা, কিছু বাজি আর বিশেষ করে হাউইবাজি আকাশে ছেড়ে, আসর শেষ হত। 


কিন্তু একবার, আমাদের নিজেদের গড়িমসির কারণে পৌষল্লা করবার জায়গা ঠিক করতে  একটু দেরি হয়ে গেল। ততোক্ষণে পদ্মদিঘির কাছের জায়গাগুলো অন্য দলের ছেলেরা খুঁটিপুজো করে নিয়ে নিয়েছে।  অনেকটা নিরুপায় হয়ে আমাদের পৌষল্লার জায়গাটা স্থির করতে হল পদ্মদিঘির থেকে বেশ দূরে আর শ্মশানদীঘির থেকে বেশ কাছে।   

পদ্ম দীঘির শোল আর সিঙ্গি মাছের খুব নাম। সেবার পৌষল্লার দিন বিকালে আমাদের খেলুড়ি দলের জেলেপাড়ার ছেলেরা, বিকালে গেছিল ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে পদ্মবাঁধে। বেশ কটা তাগড়া সাইজের শোলমাছ আর অনেক কালো সিঙ্গি তাদের  জালে পড়েছিল।কায়স্থপাড়ার অনুপম আর মনমোহন এরাও ছিল সেই ডিঙ্গি নৌকায়। ওদের হাতে দু-দুটো এয়ার গান ছিল । যখন জাল টেনে গুটিয়ে আনা হচ্ছিল, সেই সময় একটা বড়ো পানকৌড়ি  জল থেকে উড়ে পালাতে যাচ্ছিল।  

অনুপম আর মনমোহন দু’জনেই এয়ারগান চালিয়ে দেয়। পাখিটা ডানায় গুলি লেগে জলে পড়তেই জালে জড়িয়ে যায় আর সেই সাথে কিছু তিতির আর বটের। মাছের সঙ্গে এই সবগুলোকেও ওরা ধরে আনে । কিছু-কিছু ক্ষেতে কচি সবজিগুলোকে বাদুড়ের কামড় থেকে বাঁচাবার জন্য জাল দেওয়া থাকতো।সেই সব জালে এক ঝাঁক বগেড়ি পাখিও ধরা পড়েছিল। এরা পদ্মদিঘি থেকে পৌষল্লাতে আসবার পথে জালে ফেঁসে যাওয়া সেই পাখিগুলোকেও ছাড়ে নি। বগেড়ি অনেকটা চড়াই পাখির মতো দেখতে তবে সাইজে একটু বড়ো। ঘটির জলে ডুবিয়ে দিলেই মারা যায় আর ছালচামড়া সহজেই উঠে আসে। আগুনে সেঁকে বা সামান্য তেলে হাল্কা ভেজে নিলে খেতে খুব সুস্বাদু আর মুচমুচে হয়। 

জয় আর আমরা অনেকে, এই সব দেখে বকাবকি করলেও, একটু পরেই দেখি, পানকৌড়ি আর বাকি পাখিগুলো, এয়ারগানের গুলি না লেগে হোক, বোধহয় ভয়েই মারা গেল। পানকৌড়ি আর তিতির-বটেরগুলোর পালক-চামড়া ছাড়াবার লাল-লাল মাংস দেখে আমাদের সকলের রাগ জল হয়ে গেল আর এর সাথে উপরপাওনা হিসেবে পাওয়া গেল, সবার প্রিয় বগেরি’র মুচমুচে  সুস্বাদু মাংস-ভাজা। 


কিন্তু সমস্যা হলো অন্যত্র । দেখা গেল যে সিঙ্গি আর শোল মাছগুলো তেমন সুবিধের মনে হচ্ছে না । সূর্যাস্ত অবধি তারা টিকবে কি না সেই সন্দেহ হতে লাগলো। জয় সেই দেখে অনুপম আর মনমোহনকে বলে “তোরা কিন্তু আজ বিকালে ভালো কাজ করিস নি। ওই কালো রঙের পানকৌড়ি, ওইখানের বাস্তুপাখি। ওকে মেরে, তোরা অনেককে চটিয়ে দিয়েছিস”। আমাদের উদ্বিগ্ন মুখগুলো দেখে, ও বলে,“চিন্তা করিস না। আমি কি করতে আছি?এই মাছগুলো আর কিছু মিনিট বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা কর, জলের ঝাপট দিয়ে। আমি উনুনগুলোতে আগুন লাগিয়ে, কাদা-মাটির পাড় বানাব আর ইশারা করলেই সিঙ্গি মাছগুলো নিয়ে আসবি আমার কাছে”।


শেষ পর্যন্ত এক-দুটো মাছ আমাদের চেষ্টা সত্ত্বেও বাঁচে নি। জয় প্রথমেই মরা মাছগুলো নদী আর শ্মশান দীঘির দিকে ছুড়ে, কর্কশ স্বরে কিসব মন্ত্র পড়লো, আর তার পর বাকি সিঙ্গিগুলোকে বলি দিয়ে তাদের রক্ত আর ধড় উনুনগুলোতে দিতে দিতে চারপাশ হাতজোড় করে ঘুরতে ঘুরতে বেশ কয়েকবার আকাশপানে চেয়ে চেয়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলো ।   এইসব দেখে পৌষল্লার মেজাজটাই কিরকম পানসে হয়ে গেল। 


আমাদের দলনেতা ব্যাপারটা চাপা দেবার জন্য সবাইকে রান্নার কাজে লাগিয়ে দিলে । রান্নার সুগন্ধ আসার সাথে-সাথেই দোতারা আর গুপীযন্ত্র বাজাতে বাজাতে এসে হাজির হয়ে গেল বাউল পূর্ণ আর দেবু। ওরা এসেই ঘুরে ঘুরে নাচতে নাচতে গাইতে শুরু করে দিল “ভালো করে পড়গা ইশকুলে/ নইলে কষ্ট পাবি শেষকালে”। এরপর “গোলেমালে-গোলেমালে পিরীত করোনা” গানের সাথে আমরাও ঘুরে-ঘুরে নাচতে লাগলাম। আসর জমে উঠলো । 


ততক্ষণে গরম-গরম চা আর ধামায় ধামায় মুড়ি- তেলেভাজা-বেগুনপোড়া এসে গিয়েছে। বাউল-দলকে, আমরা অনুরোধ করলাম, একটু চা আর মুড়ির সাথে বিশ্রামের জন্য।চা-মুড়ি চলছে, শোলমাছ পোড়ার গন্ধে চারপাশ বেশ আমোদিত হয়ে উঠেছে। 


সন্ধ্যে থেকে বিঘ্ন ঘটায়, এই আইটেমটা সামান্য দেরি হয়ে গেছে। বাউল-বোস্টমদের সাথে বসে, এইটা খাওয়া উচিত হবে কি না, আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। আমাদের দ্বিধার ব্যাপারটা বুঝে, পূর্ণ বাউল বসে বসেই বেশ চড়ায় ধরলে “কি দোষ আঁশের ঘ্রাণে/ যখন তুলসিপাতে চোখ জুড়াবে/ কোন আঁশ তোমার সাথে রবে?” আমরা সবাই হেসে উঠলাম। 


এমন সময়, আমাদের সবার ছোটো নুটু, চিৎকার করে বলে “ জয় দাদা, ঐ দেখো গে, কারা কারা যেন আসছে”। সেদিক পানে চোখ ফেরাতে দেখি, পদ্মদিঘির আর নদীধার থেকে, বেশ কয়েক জোড়া নীল আর লাল আলোর   চোখগুলো  যেন এদিক পানেই আসছে । 

জয় ইশারায় আমাদের বলে  চুপ থাকতে, আর পৌষল্লার সুরুতেই যে বাঁধন করে দিয়েছে, তার গণ্ডীর বাইরে, কেউ যেন না আসে। এরপর দুটো প্রেত-চুল্লি থেকে, জ্বলন্ত দুটো চেলা কাঠ নিয়ে বাজফাটা চিৎকারে বলে, “যা- যা দূর হয়ে যা, নইলে এই আগুন খা” এই বলে দুটো জ্বলন্ত চেলাকাঠ সেই আগুনে- চোখগুলোর দিকে ছুঁড়ে দেয় ।সেগুলো ছোঁড়বার সাথে-সাথেই জ্বলন্ত চোখগুলো নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায় । তবে কি খাবারের গন্ধ পেয়ে শেয়াল আসছিল? কিন্তু শেয়ালের চোখ কি অন্ধকারে এইরকম নীল আর লাল হয়ে   জ্বলে? 


আমাদের একজন বলে ওঠে,“এক-প্রহর রাত হলে, তবেই শেয়াল আসে”।  তবে কি হায়েনা এলো? হায়েনার চোখ কি এইরকম হয়ে জ্বলে? কিন্তু আজ অবধি, ধান কাটবার সময়  ক্ষেতে রাত-পাহারা যারা দেয়,   তাদের মুখে এমন কথা তো শুনি নি। 


ব্যাপারটা আমরা না বুঝলেও, বাউলের দল নিজেদের মধ্যে নিম্নস্বরে কিছু একটা আলোচনা করছিল । পূর্ণ বলে “বাবুভেয়েরা, রাত সুবিধের নয়।একটা কথা মানো আমাদের, রান্না যা হয়েছে,তাই দুটি করে খেয়ে সব গাঁয়ে ফিরি”. জয় চেঁচিয়ে বলে “সবাই নির্ভয়ে খাওয়া শুরু কর। আমি থাকতে, তোদের কেউ কিছু বিগড়াতে পারবে না”

আমি বলি “ আর জয় তুই? তুই ও আমাদেরই সাথে বসে পড়। জয় বলে, “ আমার জন্যে তোরা ভাবিস না। প্রতিবছর সবাই যেমন তারিয়ে-তারিয়ে খিচুড়ি-বাঁধাকপি-টমেটো চাটনি যেমন খাস তেমনি খা। এইসব পুঁচকেদের খেলা সামলাতে আমার হাতের মশালই যথেষ্ট”। 

একটু পরেই দেখা গেল যে পুঁচকেরা পালিয়ে গিয়েও খেলা শেষ হয় নি। এবারে বড়োরা নামতে চাইছে । রবি বাউল সবে মাত্র তার খাওয়া সেরে, একটা গান ধরতে গিয়ে, অভ্যেস মতো আকাশ পানে চাইতেই, চিৎকার করে উঠলো “ সাবধান সবাই, রক্ত-খেকো কালো বাদুড়ের দল আসছে আমাদের ঘিরতে”। 

আমরা জয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, সে একটা বড়ো মশাল তুলে, তাতে কিসব শিকড়-বাকড় লাগিয়ে, মন্ত্র পড়তে-পড়তে, “জয় মা শ্মশানকালীর আজ্ঞা, জয় বাবা ভূতনাথের আজ্ঞা” বলতে-বলতে, আকাশে ছুড়ে দিতেই, হাড়-হিম করা চিৎকারে “হুট ট্যাঁ ট্যাঁ- হুট ট্যাঁ ট্যাঁ ”করে একটা নয়, তিন-তিনটে, রাক্ষুসে পাখি, কালো কিম্ভুতকার বিশাল ডানা মেলে, শ্মশান দীঘি আর নদী-ধারের শ্মশানঘাটের দিকে পালিয়ে গেল। 

শুধু আমরা কেন, আমাদের মধ্যে যারা ব্যাধঘরের ছেলে, বাপ-কাকাদের সঙ্গে বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, তারাও এমন ধরনের পাখি দেখে নি বললে। উড়ে পালিয়ে যাওয়া পাখিদের দিকে তাকিয়ে, জয়, চ্যালেঞ্জের সুরে, কর্কশ গলায়, চেঁচিয়ে বললে,“এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। ফিরে যদি আসিস, তবে তোদের খেলা শেষ করে ছাড়বো”। 

এসব দেখে আমাদের দলের ছোটোরা বেশ ভয় পেয়ে গেল। আমরা তাদের মুখ চেপে ধরে ফিসফিস করে বলে দিই,“ভয় পেয়ে কাঁদলে, সবার বিপদ ডেকে আনবি” । প্রেত-উনুনের সামনে দাঁড়িয়ে যে আছে সে যেন আমাদের চিরচেনা খেলুড়ি জয় নয়, সে এখন সদাশিব ওঝার বেটা জয়গোপাল ওঝা। তার সঙ্গের  টুকটুকে লালরঙের ঝোলা থেকে বার করেছে একটা  ছোটো সাইজের ছড়ির মতো একটা লাঠি । তার প্রান্তে লাগানো মোটা একটা দড়ি টেনে লাগিয়ে ধনুক বানিয়ে ফেলল নিমেষে । ঝোলা থেকে একটা মশাল বার করে সেটা ধনুকের গুণে লাগিয়ে আমার দিকে চেয়ে বলে, “ আমার কাছে আয়। আমি বলা মাত্র এই মশালে উনুন থেকে একটা কাঠ বের করে আগুন লাগিয়ে দিবি”। মানে! জয় কি অগ্নিবাণ ছুঁড়বে নাকি? চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি সবাই উৎসুক হয়ে আছে। 

হঠাৎ দেখি, আকাশে, সেই আগের মতো ট্যাঁ-ট্যাঁ করে বিকট চিৎকার করে, একটা কালো পাখি  উড়ে আসছে আর তার সাথে কি যেন একটা যেন জ্বলছে । দেখে মনে হবে যেন বাতি-জ্বলা একটা ফানুস আসছে। তবে বেশ দ্রুত গতিতে। একটু সামনে আসতেই বুঝলাম সত্যিই একটা ফানুস তাহলে আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে? 

জয় আমাকে ফিসফিস করে বললে “ এটা একটা গুনিনের খেলা। ফানুসের ভেতরে একটা পাখি আছে। সেটা প্রাণভয়ে ওইরকম ডাকছে। আর একটু পরে পাখিটা ফড়ফড় করে ঝাপট দিলেই ফানুসের পর্দা ফেটে, সেটা  নিচে নেমে আসবে। ওই পাখিটা যাকেই ঠোকরাবে তার মরণ কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমি ঠিক সময়ে জয় মা বলে ডাক দেব, তুই মশালে আগুন লাগাবি”।  

মিনিট-খানিক পরে সত্যি-সত্যি ফানুসটা আমাদের পৌষল্লা মাঠের কাছাকাছি এসে নামতে শুরু করতেই, জয় বললে, “অরুণ”। আমি প্রেত-উনুন থেকে  জ্বলন্ত চেলা কাঠ হাতে নিয়ে তৈরিই ছিলাম। “কাটান-কাটান-কাটান” জয়ের গলায় এই আওয়াজটা শোনবার সাথে সাথে ধনুক থেকে সাঁই- সাঁই করে জ্বলন্ত  তীর ফানুসের দিকে গিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দিল। পাখিটার আওয়াজ আর শোনা গেল না। দেখলাম, জ্বলন্ত তীর, ফানুসকে  ভেদ করে, সোজা এগিয়ে যাচ্ছে দীঘির  দিকে। জ্বলন্ত ফানুসটার একটা অংশ পড়লো আমাদের পৌষল্লা মাঠের একটু দূরে। আর একটা অংশ পড়লো ঠিক আমাদের থেকে হাত-খানিক দূরে। 

পৌষল্লাতে প্রথা হলো, খাওয়া শেষ হলে, সামান্য বাজি আর হাউই ছেড়ে সমাপ্তি ঘোষণা করা। সেইজন্য পৌষল্লা মাঠের ঠিক সীমানায়, নরম গোবরে, একটু ফাঁক-ফাঁক করে বেশ অনেকগুলি হাউই আর তার পাশে কিছু বাজি রাখা ছিল। জ্বলন্ত ফানুসটার যে অংশ আমরা পড়তে দেখেছিলাম, সেটা নিশ্চয় এর কাছাকাছিই পড়েছিল।আর তার পর যে ব্যাপারটা ঘটলো সেটা মিনিট-খানিকের মধ্যেই কেননা আ্মাদের দুজনের বাকি সবা’র কাছে, মানে যে উনুনগুলোর পাশে বসে খাওয়াদাওয়া চলছিল, সেখানে উপস্থিত বাকি সবার কাছে পৌঁছাতে, এর বেশি সময় লাগা উচিত নয়। 

আর এর মধ্যেই, আমাদের সবাইকে হতভম্ব করে, প্রথমে  কটা বাজি আর তারপর আকাশ আলো করে  এক-দুটো আর তারপর, একের পর এক হাউই আকাশে দেখা দিতে লাগলো। আগেই বলেছি সেইবারে আয়োজন সব ব্যাপারেই বেশ ভালো ছিল। বাজি–হাউই এও আমরা কোন কৃপণতা করি নি। বাজিতে হঠাৎ কে আগুন লাগাল? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা দু’জন শুধু জানতাম। কিন্তু সবাইকে তা বলার সময় পেলাম কই? 

আমার ব্যাপারটা বলতে শুরু করতে না করতে, আকাশে এইবার অনেকগুলো হাউই একসাথে চলে এলো। তার মধ্যে সবাইকে বিস্মিত করে, দুটো বেশ শক্তিশালী হাউই । 

তারা ধূমকেতুর মতো আকাশের অনেক উপর উঠে, সোজা চলে গেল শ্মশান দীঘির দিকে। আর সাথে- সাথে শ্মশান দীঘিতে একটা জোর আলোর ঝলকানি আর তারপর একটা জোর বিস্ফোরণের আওয়াজ শোনা গেল । এর পর ওই দীঘির বুক থেকে আরও জোরে পরপর দু-তিনটে বোম ফাটার মতো আওয়াজ আর আলোর ঝলকানি শোনা গেল। এইসবেতে আমাদের সম্বিত ফিরে পেতে বেশ দেরি হয়ে গেল । পৌষল্লার সব বাসনপত্র ওইখানে ছেড়ে আমরা ছুটতে ছুটতে গ্রামে ঢুকে বুঝলাম আর এক দু মিনিট দেরি করলেই আমাদের আর আশেপাশের গ্রামের লোকেরা ডাকাত পড়েছে ভেবে মাঠের দিকে লাঠি-বল্লম-বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন আর তাতে আমাদেরই  ভয়ানক বিপদ হতে পারতো । 

আমাদের মুখে সব শুনে গ্রামের মোড়ল রায় দিলেন, “এই রাতের দিকে শ্মশান দীঘির দিকে না যাওয়াই ভালো, সকালে গিয়ে দেখলেই ভালো বোঝা যাবে” ।

সকালের আলোতে দেখা গেল, দীঘির জল হঠাৎ করে কমে গেছে। বিস্ফোরণের ফলে অনেক মাছ আর তার সাথে একটা মেছো-কুমির পাড়ে এসে মারা গেছে। এই কুমীরের কথা আশেপাশের গ্রামের লোকেও জানত না।লোকে এইটুকু জানতো যে চরতে চরতে  গরুছাগল দিক-ভুলে এদিকে এসে তাদের অনেককেই আর খুঁজে পাওয়া যেতো না । মানুষজনে এইটাই ভাবতো যে এটা ভূতপ্রেতের খেল । তবে সেই রাতে  আমরা যা যা দেখেছিলাম, তা পুরোটা শোনার পর সেটা যে ওইখানের বাস্তু-প্রেতের রুষ্ট হবার ফল এটা জয় আর তার বাবা সদাশিব ওঝা আর তার মারফত পুরো গ্রাম আর আশেপাশের গ্রামের লোকেরাও মেনে নিল । 

এরপর শ্মশান দীঘি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে শুরু করল। বর্ষার সময় কিছুটা ভরলেও পরে আবার জল কোথায় নেমে যায়। শ্মশান দীঘির এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে আমাদের আর আশপাশের গ্রামের মোড়লেরা একসাথে মিলে দিঘির ঢালের ধানক্ষেতে  পৌষল্লা করা  বন্ধ করে দিলেন। 

বহুবছর পরে বিজ্ঞানের আলোয় বুঝেছিলাম যে শ্মশান-দীঘিতে রাতের দিকে মিথেন গ্যাস বেরয় এবং শীতকালে সেটা জলের ওপরেই ঘনীভূত হয়ে যায় । সম্ভবত সে রাতে পরপর অনেকগুলো হাউই-বাজির আগুনের ফুলকিতে তাতে আগুন ধরে গেছিল। কিন্তু বাকি ব্যাপারগুলো?আকাশের বুকে কালো পাখিগুলো আর তাদের হাড়হিম করা আওয়াজ আর শেষটায় সেই ফানুস আর তাতে আটকে থাকা কালো পাখি? কে এইসবের পেছনে ছিল? জয় ওঝার এখন নামডাক দারুণ আর তার  এইসব প্রশ্নের জবাব আমি কেন আমরা কেউই দিতে পারি নি। 

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror