Pradip Biswas

Horror Thriller

4  

Pradip Biswas

Horror Thriller

বাঘের   কাছাকাছি

বাঘের   কাছাকাছি

10 mins
618


 

বেস ক্যাম্প স্টোর থেকে পেছনে কানায়-কানায় ভরতি  ট্রেলার নিয়ে, সামনে পেছনে   হুড খোলা পুরানো মডেলের উইলিজ জিপ, দুপুর একটার জায়গায় বিকেল চারটের পরে, বেস ক্যাম্প মেন গেট পার হয়ে, লোহাপাহাড়ের রাস্তা ধরল । 

নিয়মিত ড্রাইভারের জায়গায় স্টিয়ারিং হুইলে বসে লোহা-পাহাড় ড্রিলিং ক্যাম্প-ইন-চার্জ নায়ার বাবু অনেক কারনেই ভেতরে-ভেতরে রাগে ফুটছিলেন । ওনার পাশে বসে আমি সেই রাগের আঁচটা টের পাচ্ছিলাম । 

দফায়-দফায় লম্বা মিটিং, স্টোরের অলস সহকর্মী, গ্যারেজের মেকানিক এরা সবাই মিলে দেরি  করিয়েছে । এমন কি তাঁর সাথে আসা  নিজের অধস্তন সহকর্মীরাও টিফিনের নামে আরও ঘণ্টাখানেক  দেরি করিয়ে যখন এল, দূর থেকেই ওদের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়েই জিপের পেছনের সিটে বসবার ইসারা করলেন । 

নায়ারবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ অন-ডিউটিতে এসবের জন্য একদিন এদের চাকরি যাবেই । আমার ড্রাইভারটা এসব ছাইপাঁশ গেলে না, আজ দেখছি এও ওদের সঙ্গে আছে”।      

চার দিক উঁচু পাহাড়ে ঘেরা  জায়গাতে সন্ধে নামার অনেক আগে আলো অনেক কমে যায় ।  আঁকা-বাঁকা সরু পাহাড়ি রাস্তা তার ওপর চড়াই রাস্তা, দিনের আলো চলে গেলে, হেডলাইটের  ভরসায়  গাড়ি চালানো বিপদজনক হতে পারে । 

শুধু যে গাড়ি চালানোই বিপদজনক তাই নয় আরো একটি বিপদও  যে পাহাড়ি জঙ্গলে ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করে আছে তার আশঙ্কাও ছিল নায়ারবাবুর মনে ।  

এই আশঙ্কা আর উদ্বেগই যে তাঁর রাগের আসল কারন  আমি সেটা  বুঝলাম আর একটু পরেই । এই জিপে তখন দলবল সমেত আমরা   পাহাড়ি রাস্তায়  খানিকটা এগিয়ে গেছি লোহাপাহাড়ের  রাস্তায় ।

ছত্রিশগড় রাজ্যের দন্তেওয়ারার কাছে, ঘন জঙ্গলে  ঘেরা, মাইলের পর মাইল জুড়ে, পৃথিবী-বিখ্যাত আকরিক লোহা পাথরের   বিশাল উঁচু চড়াই পাহাড়ের সারি  অনেক দূর থেকে দেখা যায় ।  

সে সময়টায় আকরিক লোহার ভুতাত্বিক অনুসন্ধান চলছে  পুরো পাহাড় জুড়ে । কোথাও প্রাথমিক সমীক্ষা চলছে  তো কোথাও একদম চূড়ান্ত স্তরে পাথর ভেদ করে নমুনা আনার জন্য ড্রিলিং চলছে । 

এই সব ক্যাম্পগুলোর মুল নিয়ন্ত্রন হয় লোহা পাহাড়ের কোলে, পাহাড়ি নদীর  ওপারে, বেস ক্যাম্প থেকে ।  বেস ক্যাম্পের অফিসে বসেন মুখ্য ভূতত্ববিদ আর অনান্য প্রবীণ প্রযুক্তিবিদেরা ।    

কলেজ  থেকে   সদ্য পাশ করে তখন  মাত্র মাস-খানেক হল এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষানবিশ ভূতত্ববিদ  হয়ে যোগদান করেছি বেস ক্যাম্পে আর কাজের খুঁটিনাটি বিষয় শিখছি। এরপর আমাদের একে একে পাঠানো হবে লোহাপাহাড়ের বিভিন্ন ক্যাম্পে । প্রতিটি ক্যাম্পই  লোহা পাহাড়ের   গভীর অরন্যের মধ্যে ।  তাতে নাকি বাঘ, ভালুক, সাপ সবই আছে । 

ব্যাপারটা শুনেই ভয়ে আমার হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে এল ।  ঘটনাচক্রে লোহাপাহাড়ের ক্যাম্পে যাবার সবচাইতে আগে ডাক এল  আমারই ।  

আমি যে মহা ভীতু সেটা সিনিয়র জিওলজিস্তের কানে গেছে । আমাকে অভয় দিয়ে তিনি বললেন যে সবচাইতে ভালো আর  নিরাপদ সাইট লোহাপাহাড় ড্রিলিং ক্যাম্প আর কাজ শিখবার  সব চাইতে ভালো গুরু নায়ার বাবু । 

প্রতি বুধবার উনি লোহা পাহাড় থেকে বেস ক্যাম্পে আসেন সাপ্তাহিক মিটিং এর জন্য । ঠিক হল, ফেরার সময় নায়ার বাবু তার  জীপে আমাকে লোহাপাহাড় নিয়ে যাবেন ।  আগেই শুনেছিলাম উনি  বেশ  নিয়মনিষ্ঠ কড়া লোক, তবে রেগে না গেলে খুব ভালো মানুষ । 

কপাল দোষে, বুধবার সকালে ওনার সাথে দেখা হবার পর থেকেই থেকেই যা সব ঘটনা একের পর এক  ঘটে চলল, তাতে মনে হচ্ছে এখনো উনি বেশ রেগেই আছেন ।  

পাহাড়ি নদীর ওপর পাকা  সেতুর আগে বাম্পের ওপর নায়ার বাবুর মত পাকা ড্রাইভার বোধ হয় ইচ্ছে করেই  ব্রেক প্যাডালে একটু কম চাপ দিলেন । মনে হল গাড়িতে হাল্কা  ঝাঁকুনি দিয়ে  পেছনের আরোহীদের নেশাগ্রস্ত ভাব কাটিয়ে দেবার সাথে সাথে তাদের এ কাজটা যে উনি যে কতটা অপছন্দ করেছেন তার একটা বার্তা দিলেন । 

ব্রিজের পর  লোহাপাহাড় যাবার   একুশ কিলোমিটার  পিচ রাস্তা, কালো সাপের মত পাহাড়কে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একদম ওপরে উঠে গেছে । নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিও পেরিয়ে গেছে । বিকেলের হাল্কা রোদ, সন্ধের আঁধারকে হাতছানি দিয়ে  ডাকছে আর নিজে  উঁচু পাহাড়ের বনের গাছের মাথা দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে ।       

পাহাড়ের কোলে খুব ঘন জঙ্গল, কালো পিচ রাস্তা তাকে  মাঝ বরাবর চিরে এগিয়ে গেছে । এই রাস্তায় আসতেই নায়ার বাবু হেডলাইট অন করে অভ্যাস মতো কপালে হাত ঠেকিয়েই  একটা  বাঁক  দেখে স্টিয়ারিং হুইল  আর গিয়ার লিভারে হাত ঠেকালেন।

জোসেফ এ গাড়ির নিয়মিত  ড্রাইভার, সে মালয়ালিতে  নায়ারবাবুকে কিছু একটা বলল । নায়ারবাবু   গম্ভীর গলায়  জোরে মাথা নেড়ে একবার “ ক্যাট !” বলেই আমার দিকে চেয়ে  বাকি কথা না বলে চুপ করে গেলেন । কিন্তু জিপের পেছনে বসা বাকি লোকরা  বোধহয় সেই বিষয়েই আলোচনা শুরু করে দিল।  

ভাগ্যিস এদের কথাগুলো  মাতৃভাষা  মালয়ালিতে হচ্ছিল । একটু হিন্দি মিশিয়ে  বললেই সামনে পেছনে হুড খোলা এই জীপে   বোধ হয় প্যান্টেই কিছু একটা করে বসতাম ।  

পাহাড়ি রাস্তায় প্রথম বাঁক শুরু হবার আগে, নায়ার বাবু ক্লাচে পা দিয়ে  গিয়ার বদলাবার সাথে সাথে  মনে হয় বেড়াল নিয়ে আলোচনা বন্ধ করার জন্য সবাইকে  এমন ধমকানি দিলেন  যে  চড়াই পথে জিপের  ইঞ্জিনের গর্জন ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছিল না । 

কিন্তু মিনিট খানেক পরে ঘন পাতা ঝোপের আড়ালে যাকে দেখা গেল জোসেফ আর বাকিরা কি তাকেই “ক্যাট” বলছিল?

প্রথম বাঁকটা পার হবার পর বেশ অনেকটা রাস্তা  সমতলের মত, চড়াই-উতরাই নেই।   জীপের ড্রাইভিং সিটের দিকে  মানে নায়ার বাবুর দিকে  মানুষ-সমান উঁচু ঝোপ আর আমার দিকটায়  ঢালু উপত্যকা । দূরে সমতলে  বেস ক্যাম্পের আলোর সারি দেখা যাচ্ছে । 

হঠাৎ কিছু একটা দেখে নায়ার বাবু জোরে ব্রেক দিয়ে জিপ থামিয়ে দিলেন ।  জিপের   পেছন দিক থেকেও সবাই সমস্বরে কিন্তু চাপা আওয়াজে কিছু বলে উঠল   । সবাই, এমন কিছু কি দেখল   আর  আমি সামনের আসনে নায়ার বাবুর  পাশে  বসে তার টেরই পেলাম না ? 

ম্যাথিয়াস আমার পেছনেই বসে ছিল । আজ সকালে নায়ার বাবু ওর সাথে আলাপ করিয়ে দেবার পর মনে হচ্ছিল ড্রিলিং  ক্যাম্পে আমার যাওয়াটা ওর অপছন্দ । নায়ার বাবুর পরেই ওর জায়গাটা আর থাকবে না বলে ?

সেই মাথিয়াস, তার এক হাত দিয়ে আমার মুখটা চেপে ধরে বললে “একদম চেঁচাবে   না ।  আমরা যা করতে বলব তাই করবে” অন্য হাতের আঙ্গুল তুলে আমাকে আবার বললে “ দেখতে পাচ্ছ? একদম তোমার সামনেই”। 

আমি এতক্ষণ যেদিকে তাকিয়ে ছিলুম সেই ঢালু উপত্যকার দিকেই তো ও আঙ্গুল উঁচিয়ে কি বলতে চাইছে? আমাকে  জিপ থেকে ওইদিকে ঠেলে ফেলে দেবে? নায়ার বাবুও চুপ এখন, মানে এরা সবাই মিলে একজোট হয়েছে তাহলে? কি করি আমি তাহলে এখন?

নায়ার বাবু আমার দিকে একবার তাকিয়ে বুঝলেন আমি এখনো দেখিনি  কিছুই । উনি ফিসফিস করে বললেন “ আমার আঙ্গুল বরাবর ঝোপের দিকে তাকাও, ঠিক ওইখানটায় যেখানে  ঝোপ একটু  নড়ছে বলে মনে হচ্ছে দেখতে থাকো আর ম্যাথিয়াস যা বলছে তাই করো, নইলে তোমার জন্যে সবার বিপদ হতে পারে” । ও হরি ! আমি তো এতোক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম উপত্যকার দিকে । 

নায়ার বাবুর কথা মতো ঝোপের দিকে চাইতেই, বড়োজোর পঞ্চাশ মিটার দূরে, একজোড়া জলন্ত আগুনের ভাঁটার মতো কি একটা দেখলাম। 

মুহূর্তখানিক সেদিক তাকাতেই বেশ বড়সড় একটা ডোরাকাটা  মাথা  দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল ।  আমার মনে হচ্ছিল কেউ  আমার হৃৎপিণ্ডটা উপড়ে এনে আমার হাতে রেখে হাতটা  কানের কাছে নিয়ে এল । 

ঠিক এই সময়, যাত্রাতে রাজা যখন স্টেজে ঢোকে ঠিক সেই চালে, জঙ্গলের রাজা এবার ঝোপের আড়াল  থেকে বেরিয়ে এল । পালা এবার সুরু হবে আর আমি যেন সবচাইতে দামী আসনে একদম সামনে বসে সেই পালা দেখছি।      

জিপের জ্বলন্ত হেডলাইটের দিকে একবার তাচ্ছিলভরে তাকিয়েই মুজরার আসরে রাজা মশাই যেভাবে বসেন, তেমন ভাবে সরু কালো পিচ রাস্তাটার ওপর আধ শোয়া হয়ে, ঘাড়টা একবার আমাদের দিকে ঘুরিয়ে তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি হেনেই মাথাটা  উল্টো দিকে সরিয়ে নিলে ।

অবাক কথা, সামনে পেছনে হুডখোলা জিপের সামনের আসনে বসে পঞ্চাশ মিটারের কম দূরে  জঙ্গলের বাঘকে দেখে আমার মত মহাভীতুও যেন ভয় পেতেই ভুলে গেল ।

এই ঘটনার পর টানা তিন বছর গভীর জঙ্গলেই কাটিয়েছি, বাঘ, পাইথন, ভল্লুক এই সব হাড়হিম করে দেওয়া জন্তু জানোয়ারদের সামনা-সামনি পড়েছিও বেশ কয়েকবার কিন্তু ভয় আর পাই নি । 

জঙ্গলের একটা বহুল প্রচলিত মুখে- মুখে ফেরা কথা, এই সব বিপদে বারবার পরখ করে নিয়েছি, “ প্রাণঘাতী ভয়ঙ্কর বিপদ যখন তোমার চোখের সামনে আসবে তখন তুমি ভয় পেতে ভুলে যাবে”।

নায়ার বাবুর মত পোড় খাওয়া লোক আমার দিকে তাকিয়ে এটা বুঝতে পেরে ম্যাথিয়াসকে আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিতে বললেন । লক্ষ্য করলাম নায়ার বাবু তাঁর দুটো পা ব্রেক আর ক্লাচ প্যাডে রেডি রেখেছেন যাতে গাড়ি যে কোনও সময়ে  দৌড়াতে পারে।  

এরকম একটা  বিপদের সামনে পড়ে নায়ারবাবু  বা সদ্য নেশা করে আসা তার সহচরদের কাউকেই নার্ভ হারাতে দেখিনি, কাউকে একটা টুঁ শব্দ করতে শুনলাম না এবং আমিও তাই করলাম । 

অবচেতন মনে এই শিক্ষণীয় ব্যাপারটা যে অনেক গভীরে রেখাপাত করে গেল সেটা অনেকদিন পরে এইরকমই সব ঘটনাগুলোর সামনে এসে  বুঝলাম ।      

গাড়ির আলো আর ইঞ্জিনের শব্দ কি রকম যেন  ঠেকছিল ।  নায়ার বাবু  ফিসফিস করে জোসেফকে বললেন “ বেস ক্যাম্প গ্যারেজের মেকানিককে ফ্যান বেল্ট আর ডায়নামো বদলাতে বলেছিলে?”

“জী সাব”

“ফুয়েল ইঞ্জেকশানটা আর টিউনিং?” 

“ঠিক করে দেবে বলেছিল সাব”

“ফাঁকি মেরেছে সে  আর তুমি তো বন্ধুদের সাথে চায়ের না অন্য কিছুর দোকানে ব্যাস্ত ছিলে । নিজের চোখেই দেখ, ডায়নামো ব্যাটারিকে চার্জ করছে না, টিউনিংও ঠিক করে নি, এয়ার নিচ্ছে এঞ্জিন”

ম্যাথিয়াস বলল “ জী সাব, হেড লাইট তো হলুদ হয়ে আসছে, আর ইঞ্জিনের চাল এখন ভালো না”

নায়ার বাবু  ফিস ফিসিয়েই হুকুমের স্বরে বললেন “ বাজে কথা একদম বন্ধ করো সবাই । সিটের তলা থেকে হাতিয়ার বের করে  তৈরি রাখ । যে কোন সময় দরকার হতে পারে”।

এতক্ষণে আমি আশ্বস্ত হলাম ।  চোরাগোপ্তা বেআইনি হলেও প্রান রক্ষার জন্য বন্দুক-টন্দুক আছে তাহলে । নয়ত এই অবস্থায় ব্যাটারি জবাব দিলেই অন্ধকার নেমে আসবে । এই সাথে  এয়ার নিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেই আর দেখতে হবে না ।  

শব্দ আর আলো দুটোই নেই দেখলেই বাঘরাজা  বিনা দ্বিধায় হুড খোলা জীপে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে।  

পেছন থেকে ডিজেলের গন্ধ নাকে আসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ম্যাথিয়াস আর তার সঙ্গী সাথিরা, সিটের তলা থেকে, একপ্রান্তে অনেকটা মোটা কাপড় বাঁধা বেশ কয়েকখানা কাঠের লাঠি   বের করছে । 

নায়ার বাবু  তাড়া দিচ্ছেন “ নিকাল লিয়া হাতিয়ার সব? ম্যান্টল টাইট করে নিয়ে ডিজেলে চুবিয়ে তৈরি রাখ” ।  তাহলে এই হল হাতিয়ার ! এ দিয়ে রাস্তার নেড়ি কুকুরও তেমন ভয় পাবে না । 

লাথির আগাতে  যে মোটা কাপড় বেঁধে  রেখেছে ম্যান্টল না কি জানি বলছে এ দিয়ে কি করবে ? বাঘের পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে যেতে বলবে? চিড়িয়াখানাতে পিঁজরাতে রাখা বাঘের সাথে এ রকম রসিকতা চলতে পারে, তাই বলে যে জঙ্গলি বাঘ মাত্র পঞ্চাশ মিটার দূরে রাস্তায় আধশোয়া হয়ে নরম নোনতা নরমাংসের অপেক্ষা করছে তার সাথে ?

হেড লাইট  মাঝে মধ্যে দপ দপ করছে আর বেশ হলুদ হয়ে আসছে, ইঞ্জিন একটু বেচাল হলেই এক্সেলেটর দাবিয়ে নায়ার বাবু তাকে উস্কে দিচ্ছেন । 

এমন সময় বাঘ মহারাজ  আলো অথবা  মাঝেমধ্যে এঞ্জিনের ব্যাকফায়ারের ফাটা আওয়াজে বিরক্ত হয়ে এবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে বিশাল মুখ খুলে সব কটা দাঁত দেখিয়ে  একটা হাই তুলল । হেড লাইটের  হলুদ ম্লান আলোতেও তার চোখ দুটো আর দাঁত যেন ঝলসে উঠল । 

নায়ার বাবু আমার  কাঁধে টোকা দিতেই চমকে উঠলাম । ওনার হাতে ধরা একটা সেই মাথার দিকে কাপড় বাঁধা লাঠি আর একটা  গ্যাস লাইটার আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি কাপড় বাঁধা দিকটা হাতে ধরেছি দেখে আমাকে ঠিক করে ধরিয়ে দিয়ে  ফিসফিস করে বললেন “ এটা মশাল । কাপড় বাঁধা দিকটাতে লাইটার জ্বালালেই জ্বলে উঠবে ।  মশাল আর লাইটার হাতে তৈরি রাখো আর আমাদের ইসারার জন্য তৈরি থাক ।  বিপদ আঁচ করতে পারা মাত্র আমি বা ম্যাথিয়াস  তোমার কাঁধে হাল্কা টোকা দেব”।

আমি ভয়ার্ত স্বরে খুব ফিসফিসিয়ে  বললাম “ তারপর”

নায়ার বাবু মনে হল খুবই  বিরক্ত হলেন আমার কথা শুনে “ তারপর আর কি ! আমরা সবাই জীপ থেকে ঝাঁপিয়ে নেমে পড়ব আর মুহূর্তের মধ্যে যে যার মশাল জ্বেলে নেব । কিন্তু আমাদের ইশারার অপেক্ষা  না করে নিজে কিছু করলেই আমরা সবাই বিপদে পড়ব”।       

নায়ার বাবুর কথাটা  শেষ হয়েছে কি হয় নি, ঠিক সেই সময় ইঞ্জিন দু তিন বার কাশতে কাশতে চুপ করে গেল ।  তার একটু পরেই হেড লাইটের  আলোও নিভে গেল । চাঁদের আলো আছে কিন্তু সেটা পূর্ণিমার অর্ধেকের অর্ধেক,তার ওপর মেঘের আনাগোনাতে কাস্তের ফালি চাঁদ মাঝে মধ্যেই গায়েব হয়ে যাচ্ছে।  

সেই হাল্কা আলোতে  রবারঘসা পেন্সিল স্কেচের মত বসে থাকা বাঘের  আবছা অবয়ব বেশ  কষ্টের সঙ্গে  ঠাহর  করা  যাচ্ছে । ইঞ্জিন বন্ধ হবার পর নিস্তব্ধতা ঘিরে এল । শুধু মাঝে মাঝে হাওয়াতে ভেসে আসছে কাছের একটা পাহাড়ি ঝরনার জলনুপুর ।  তার সাথে তাল ঠুকে, বাঘের কপালে, ঝরনার জলের সাথে, তোফা  জলযোগ নেচে চলেছে ।  

নায়ার বাবু বলে উঠলেন “ কেউ নড়বে না, অপেক্ষা কর একটুক্ষণ” । একটুঁ পরে কিন্তু অবস্থাটা আরও বিগড়ালো । মেঘগর্জনকে লজ্জা দিয়ে এবার  বাঘের ডাক শোনা গেল, কিন্তু আওয়াজটা শেষ হবার আগে বোঝা গেল এটা নিচে খাদের দিক থেকে ।  তাহলে আরও  একটা বাঘ  মানুষের গন্ধ পেয়ে গেছে  তারও আসার দেরি নেই আর  ।  

চীৎকার- চেঁচামেচির তো প্রশ্নই ওঠে না কিন্তু দেখলাম আমার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, দুই পা থেকে একের পর এক ঠাণ্ডা স্রোত আছড়ে পড়তে চাইছে ।  মনে হচ্ছে যেন এখানের কুখ্যাত ম্যালেরিয়া আমাকে ধরে ফেলল নাকি । বাড়ির সকলের মুখগুলো একবার ভেসে উঠল । 

একটু জল হাতের কাছে থাকলে বড় ভালো হত, গলা আর ঠোট শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছে । পেছনে দুটো বড় বোতলে জল আছে, ঘাড় ঘুরিয়ে আনতে গিয়ে সবার নির্লিপ্ত মুখভাব দেখে খুব অবাক হলাম।  

বোতলে হাত লাগাতে যাবার আগেই আবার খাদের ধার থেকে বাঘের ডাক শোনা গেল, এটা কিন্তু আগের থেকে আরও জোরে আর স্পষ্ট শোনা গেল ।  জীপের বাকি সবাই কপালে জোড়হাত  ঠেকিয়ে সমস্বরে  হিন্দিতে বলে উঠল “ জয় বজরঙবলি , বাঁচা গেল”

শিয়রে জোড়া শমন আর এরা বলছে “ বাঁচা গেল” কিন্তু দেখি নায়ারবাবুও একগাল হেঁসে বললেন “ হ্যাঁ মনে হচ্ছে   রাস্তা এবার জলদি সাফ হয়ে যাবে”। আমি মনে মনে বললাম “হ্যাঁ তা আর বলতে, আমরা এখন নিজেরাই সাফ হয়ে যাব বাঘের পেটে গিয়ে” 

দেখি  এতক্ষণ আধশোয়া হয়ে থাকা বাঘ এবার উঠে দাঁড়িয়েছে ।  

এত কাছ থেকে বাঘের পিলে চমকানো আওয়াজ শুনিনি আগে  তাই একবার মনে হল একসাথে অনেক মেঘ গর্জে উঠছে ।

একটা  জোর ঝাঁকুনিতে  আমার জ্ঞান  ফিরে এল । এই ঝাঁকুনিটা ডিজেল জীপের ইঞ্জিন চালু হবার ।  বাঘরাজা খাদের ঢালের আড়ালে  অদৃশ্য হতেই আমার অসমসাহসি সহচরেরা  বিদ্যুৎ গতিতে জীপ থেকে নেমে  জোর ঠেলা লাগিয়ে আবার উঠে পড়েছে ।  স্টিয়ারিং হুইলে নায়ার বাবু  শ্যেন দৃষ্টি রেখেছিলেন খাদের দিকে । 

এই জন্য, আমার এক-আধ মিনিটের জন্য জ্ঞান হারানো এবং আবার ফিরে আসা   ওনার নজর এড়িয়ে গেল নইলে পরে সবার হাসির খোরাক হতাম ।

নায়ার বাবু  কুশলী হাতে স্টিয়ারিং সামলে কমজোরি হেডলাইটেও   একের পর  এক চুলের কাঁটার মত পাহাড়ি পাকদণ্ডি রাস্তা   অনায়াসে পার করছিলেন ।  লোহা পাহাড়  হিলটপে পৌঁছাবার অর্ধেকের বেশি রাস্তা পার হয়ে এসেছি । 

কিন্তু এখনো খাদের বাঘের  পর পর  দুটো ডাক নিয়ে আলোচনা চলছেই । ডাকটা বাঘের না বাঘিনির এই নিয়ে জোরালো তর্ক চলছে ।  

মনে হচ্ছে বাঘ নয়, কোনও সদ্য সমাপ্ত টি-২০ ম্যাচ খেলে ফিরছি আমরা আর নায়ার বাবু  কুশলী পোড়  খাওয়া অধিনায়কের মত  ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাচটা  সবাইকে দিয়ে জিতিয়ে আনালেন ।

জোসেফ আমাকে দলে টানবার জন্যে বললে “ সাহেব, এটা বাঘিনির ডাক বলেই আমাদের সামনে রাস্তা জুড়ে বসে থাকা  বাঘটা আর বিলম্ব করতে সাহস পেল না, নয়তো আমাদের ছাড়া পেতে আরও সময় লাগত”।  

জোসেফের পাশে যে বসেছিল সে মানতে রাজি নয় “কিন্তু বাঘিনির আওয়াজ  এতো জোরে পিলে চমকানো হয়?”

জোসেফের বন্ধু মাধবন বলে “ কেন তুই কি ভেবেছিলি বাঘিনী বলে তার গলা দিয়ে বাঁশির সুর বেরোবে? এই তো সবে দু মাস হল এসেছিস আরও শোন তবে না বুঝবি।“

ম্যাথিয়াস আমাকে বললে “ সাহেব, বাঘ আদতে বাউণ্ডলে প্রকৃতির কিন্তু বছরকার এই কয়েকটা মাস সে তখন ফ্যামিলি ম্যান হয়ে যায় আর বাধ্য স্বামীর মত বউয়ের ফাই ফরমাস খাটে । আমরা যখন খাদের ধার থেকে বাঘিনীর ডাক শুনতে পাই  তখনই বুঝে নিয়েছিলাম রাস্তা জুড়ে এই বাঘ আর বেশিক্ষণ নয়”।

আমি বলি “ কিন্তু বাঘ আর বাঘিনীর আওয়াজ আলাদা হয় নাকি?”

জোসেফ বলে “ স্যার, শুনতে শুনতে আপনিও আমাদের মত বুঝতে পেরে যাবেন” 

তার মানে এখানে আরও অনেকবার তাহলে... । 

আমার মুখের দিকে চেয়ে নায়ার বাবু বললেন “ যে বাঘ  দেখা যায়, সে অতটা ভয়ংকর নয় । কিন্তু সে যখন শিকারি হয় তখন শিকার তাকে দেখে একদম শেষ সময়ে । আরও জেনে রাখুন বাঘ নরখাদক না হলে মানুষকে এড়িয়েই চলে” ।

আর একটা বাঁক পেরোলেই লোহাপাহাড় চুড়ো , ড্রিলিং ক্যাম্প সেই চুড়োর ঠিক কোলে অনেকটা সমতল জায়গা জুড়ে। ম্যাথিয়াস সেদিকে দেখিয়ে আমাকে বললে “ পুরো ক্যাম্পটা কাঁটাতারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা আর পাহারাদারেরা সবসময় কড়া নজর 

রাখে ।    নায়ার স্যার পুরো ক্যাম্পটা দুভাগে ভাগ করেছেন  পাহাড়ধার আর খাদের ধার, আপনার তাঁবু কোনদিকে খাটাবো? ”  

 জোসেফ বললে “ পাহাড়ধারে একটু গরম বেশি তবে খুব নিরিবিলি” ।

 “আর খাদের ধারে?”

“খুব সুন্দর ঠাণ্ডা হাওয়া, রোদের তেমন জোর নেই তবে...”

 “তবে কি?” 

জোসেফ বলে “ মাঝ রাত থেকে একটু ঘুমের অসুবিধে হতে পারে । খাদের ধারের জঙ্গল থেকে  হায়েনা আর  শেয়াল   প্রহরে  প্রহরে ডেকে যায় , এছাড়া  কখনো কখনো বাঘের ডাক ও শোনা যায়” । 

দু বছর ধরে সেই খাদের ধারেই আমার তাঁবু লাগানো ছিল । মাঝ রাত নয়, সন্ধ্যে হলেই গাছে গাছে জোনাকিদের আলোর খেলা দিয়ে শুরু হয় দারুন একটা “লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো”।   সারা রাত ধরেই জঙ্গলের সব অধিবাসীদের শোরগোল চলতেই থাকে  । 

যে দিন  জঙ্গলের রাজা-রানীর আগমন হয়, অনেক আগে থেকেই জঙ্গলের  অধিবাসীদের হাঁকডাক শুরু হয়ে যায় । তবে রাজকীয় আদব-কায়দাতেই চলেন তাঁরা, দু-তিন বারের বেশি একসাথে তাঁদের গুরু গম্ভীর আওয়াজ শোনা যায় না । 

ভয় আর লাগে না, প্রথম বার বাঘের কাছাকছি এসে সে যে কোথায় নিরুদিষ্ট হল কে জানে?   



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror