নিশি রাতে প্লুটোর প্রভু
নিশি রাতে প্লুটোর প্রভু
অসুস্থ শরীরে বাড়ি ফেরবার তাড়ায়, আমার নীল বোলেরোতে পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে লাল মোরামের রাস্তাটা ধরলাম। অনেকটা এগিয়ে দেখি পূর্ণা সেতুটার কাছে একটা নতুন ভি-ডব্লিউ বিশ্রী ভাবে কেউ পার্ক করেছে। একে পাশ কাটিয়ে যাবার রাস্তা, গাড়ি থেকে নেমেই দেখতে হবে।
টিপ-টিপ বৃষ্টির হাত থেকে মাথা বাঁচাতে আমার প্রিয় স্ট্রাইপড গলফ ক্যাপ আর চার ব্যাটারির ফ্ল্যাশ লাইটটা সঙ্গে রাখলাম।
ভি-ডব্লিউটা পরিত্যক্ত। ডান দিকের মাটিতে চাকা বসবে কি না দেখার জন্য আলো ফেলতেই, সেতুর ওপর এক পাটি কোলাপুরি চপ্পল আর ব্রিফকেসের ভাঙ্গা হাতল নজরে এলো।
হঠাৎ আমার কানের কাছে আর মেরুদণ্ডে একটা মোক্ষম রদ্দা পড়ল । জ্ঞান ফেরবার একটু পরে কোন রকমে ইঞ্জিন চালু করে দেখি, গাড়িটা এখন পূর্ণা সেতুর অন্য পারে । আমার মোবাইল, পার্স সবই আছে। শুধু গলফ ক্যাপটা নেই।
হাইওয়ের মোড়ে সিগনালের জন্য থামতে হল। ঘটনাটা একটা নিছক ছিনতাই হলে, আমার সঙ্গে থাকা বা গাড়ির মধ্যে থাকা দামি জিনিসগুলোর একটাও থাকত না ।
ঘাড় এদিক ওদিক ঘোরাতেই দেখি গাড়ির পেছনের সিটে রেশমি কালো রঙের এক স্পানিয়েল ভয়ে কুঁকড়ে নেতিয়ে বসে আছে। সাহস করে ওর দিকে চেয়ে চাপা হুইসিল দিতেই ও বার দুয়েকের চেষ্টায় উঠে বসল। আমি ওকে “প্লুটো” বলে ডাকতেই ও “গর-গর” করে আপত্তি জানাল ।
আবাসনের গ্যারাজে গাড়ি রেখে পেছনের দরজা খুলতেই মুখে এক পাটি কোলাপুরি চপ্পল নিয়ে প্লুটো বেরিয়ে এলো । এটা কি ব্রিজের ধারে পড়ে থাকা একপাটি চপ্পলের জুড়িদার? একটা ঠাণ্ডা স্রোত উঠছে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে, সদ্য চোটের যন্ত্রণাটা সেখানে ফিরে আসছে।
ফ্লাটে ঢুকতেই, প্লুটো লিভিং রুমে সোফা আর ডিভানের মাঝে কম্বলের আসন পাতা দেওয়ালের কোণটা পছন্দ করল। একটা প্লেটে বিস্কুট আর বাটিতে জল নিয়ে প্লুটোর সামনে আসতেই ইথারের গন্ধ নাকে এলো । ওর মুখের কাছে একটা কালশিটে পড়ার মত দাগও দেখলাম। মনে হয়, আমার গাড়িতে ফেলার আগে প্লুটোকে চুপ করাবার জন্য ইথার শুঁকিয়েছে ।
টি ভি চালু করতেই এলো লোকাল নিউজ চ্যানেল। আরে! স্থানীয় নেতা মনু সিংকে কারা যেন অপহরণ করেছে! মনু সিং আসলে অপরাধ জগতের এক ধুরন্ধর ব্যক্তি। সবরকমের অস্ত্রধারী তিন-চার জন স্বাস্থ্যবান যুবকের একটা দল এর সাথে সদাই ঘোরে। এ রকম এক জন ভি আই পি ব্যক্তির অপহরণের খবর টি ভি র ব্রেকিং নিউজ তো বটেই এবং কাজটা বেশ শক্তিশালী লোকের কাজ।
এই মনু সিংয়ের কাছে একটা বড় কাজের বেশ মোটা টাকা পাওনা আছে আমার। টিভিতে এবার মনুসিংয়ের গাড়িটা দেখাচ্ছে। আরে: এই গাড়িটাইতো একটু আগে দেখেছি পূর্ণা সেতুটার ধারে।
পুলিস বলছে যে মোবাইলে একটা কল পেয়ে, মনু সিং তার নতুন গাড়ি নিয়ে বাড়ি থেকে একাই বেরিয়ে যায়। টিভিতে এর মধ্যে এক’জন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষাতকার নিয়েছে।
এই ক্লিপিংটা আমাকে বেশ ভয় পাইয়ে দিল। প্রত্যক্ষদর্শী বলছে যে পূর্ণা সেতুর কাছে একটা নীল রঙের বোলেরো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সে গাড়ির স্পিড কমিয়ে আনে । সে খুব স্পষ্ট দেখেছে যে বোলেরোর বনেটে হেলান দিয়ে, স্ট্রাইপড গলফ ক্যাপ পরা, ছ’ফুটের কাছাকাছি লম্বা, শ্যামবর্ণের, বেশ স্বাস্থ্যবান একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল । এই লোকটার বর্ণনা আমার সাথে হুবহু মিলে যায়।
ব্রিজের মাঝখানে একপাটি কোলাপুরি চটি, একটা ব্রিফ কেসের ভাঙ্গা হাতল, স্ট্রাইপড গলফ ক্যাপ এবং ব্রিজের তলায় কিছু পায়ের ছাপ এবং একটা ভাঙ্গা ব্রিফকেস পুলিস দেখেছে। তবে মুক্তিপণ চেয়ে কোনও ফোন এখনো আসে নি।
পুলিস একথা ভাবতেই পারে যে মনু সিংয়ের কাছে বকেয়া টাকা আদায়ের জন্য অপহরণের চক্রান্ত আমি করতে পারি। কেবল মাত্র ঘটনার দিনই আমি আমার রোজকার ফেরবার রাস্তা বদলে, ওই কাঁচা রাস্তা ধরে আমার নীল বোলেরোতে ঘটনাস্থল দিয়ে ফিরেছি এবং তাও ঠিক অপহরণের সম্ভাব্য সময়ে।
বোলেরোর বনেটের সামনে দাঁড়ানো গাড়ির মালিকের চেহারার সাথে আমার চেহারা অনেকটাই মিলে যায়। অনেকেই জানে যে আমি স্ট্রাইপড গলফ ক্যাপ ছাড়া অন্য কোনও টুপি মাথায় দিই না।
মোটের ওপর অপহরণের ষড়যন্ত্রে যুক্ত সন্দেহভাজনদের তালিকায় আমি ওপরের দিকেই আছি এবং পুলিস আমাকে গ্রেফতার করতে পারে। তবে মুক্তিপণ চেয়ে কোনও গোপন ডেরা থেকে ফোন এসে গেলেই আমার বিপদ অনেকটাই কেটে যাবে । সেটা এখনও কেন এলো না?
তবে কি কোনও ছোট দল মনু সিংকে অপহরণ করার পর খুন করেছে? এই কারণে ওর এত বড় নেটওয়ার্ক থাকতেও মনুসিংয়ের লোকেরা কোনও গোপন ডেরাতেও তার খোঁজ পায় নি বা মুক্তিপণ চেয়ে কেউ ফোনও করে নি। এমনটা হলে আমি কিন্তু খুনের দায়ে ফেঁসে গেছি বেশ ভাল মত।
টিভিতে মনুর কোনও পুরানো জনসভা দেখাচ্ছে আর কেউ মনুকে দেখে থাকলে ফোন করবার জন্য আবেদন করছে।
মনুর ছবি দেখেই প্লুটো একবার আমার দিকে এসে কুই কুই করে আর একবার মনুর দিকে জোরে তেড়ে যায়। ব্যাপারটা দেখে মনে কিছু অন্য রকম ভাবনার শুরু হল।
ঘটনার শুরুতে, মনু সিং তার মোবাইলে একটা কল পেয়ে কোনও কারণে তার গ্যাং ছাড়াই নতুন গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল লাল মোরামের রাস্তার দিকে ।
মনু অনেক রকম ব্যবসার আড়ালে স্মাগলিং, ড্রাগ কেনা-বেচা এসবও করে। ওর কোনও পুরানো পাওনাদার বকেয়া মোটা পাওনার জন্য মনুসিংকে কল করেছিল । সে তার গাড়িতে বাহিনী সমেত এসে পূর্ণা সেতুর তলায় লুকিয়ে ছিল ।
ব্রিজের ওপর এই লোকটিকে দেখে মনু ব্রিজের মুখের কাছেই হঠাৎ দাঁড়ায় । টাকা নিয়ে বচসা শুরু হতেই সেতুর তলাতে লুকিয়ে থাকা বাহিনী মনুকে গাড়ি থেকে টেনে বার করে । সেই সময় টানাটানিতে টাকাভরা ব্রিফকেসের হাতল ছেঁড়ে। শেষটায় এরা মনুকে সেই গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
কিন্তু খটকাগুলোর শুরু এখান থেকেই।
মনু স্নিকার পরে, কোলাপুরি চটি নয়। সাধারনতঃ তাড়াতাড়ি কেউ পালাতে গেলেই চটি খুলে যায় । চটি মনু সিং পরে নি, তাহলে এটা কার চটি? পালালে কে?
ব্রিফকেসকে ও ঘৃণা করে। কোথাও টাকা দিতে হলে সেসব ওর ব্যাক-প্যাকে থাকে। এটা আমি অনেকবার দেখেছি। টানা-হেঁচড়াতে তবে ব্যাক-প্যাকেরই কিছু ছেঁড়া উচিত। ব্রিফকেসের হাতল ছিঁড়ল কেন?
গোপন নির্জন জায়গাতে লেনদেনের সময় পোড় খাওয়া মনু সিং তার বাহিনী সঙ্গে নেয় নি। এটা কি করে হয়?
মনুর কোনও পোষা কুকুর নেই । এটা অপহরণকারীর বা তার দলের। কুকুরটাকে তাহলে কি জন্য এবং কে মারল এবং অজ্ঞানই বা কেন করল? তবে কি কেসটা উল্টো? তাহলে অনেক কিছু ব্যাপার কিন্তু ঠিকঠাক খাপ খেয়ে যায়।
ড্রাগের কারবারি যে তাকে কল করেছিল, সে তার পুরানো আর বিশ্বস্ত হলেও, তার পয়সার খাঁই বেড়েই চলছিল। ইদানীং তার মতি-গতিও মনু সিংয়ের কাছে বিপদজনক ঠেকছিল। একে চিরতরে সরিয়ে দেবার প্ল্যান ও আগেই করেছিল। ওর পাওনার কল পেতেই এই লাল মোরামের রাস্তার সেতুর নিচে আসতে বলে।
এই লোকটি একটি বোলেরোর মতো জিপে তার কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ণা সেতুর নিচের দিকেই যাচ্ছিল । সেই সময়ে মনু সিংয়ের গাড়ি ব্রিজের মাথায় ঢুকতে যাচ্ছে। আর সময় নষ্ট না করে কোনও রকমে গাড়িটা রেখেই মনু সিং আর তার পুরো দল নেমে পড়ে ব্রিজের তলায়।
গ্যাং সমেত মনুসিংকে দেখে লোকটি পুরানো অভ্যাসমত ব্রিফকেস ভরতি ড্রাগ নিয়ে ওদের কাছে যাচ্ছিল কিন্তু বিপদ বুঝে পালাবার চেষ্টা করে । ব্রিজে পৌঁছে ওর চটি-জোড়া পা থেকে খুলে যায়। ওর পিছনে দৌড়াতে থাকা প্লুটো কোনও রকমে ওর মুখে একপাটি চটি কামড়ে ধরে ।
ব্রিজের মাঝ অবধি পৌঁছানর আগেই, মনুসিংয়ের দলবল দুজনের কাছে এসে ইথার স্প্রে করে দুজনকেই অজ্ঞান করে মারধর করে। কুকুরটাকে ওইখানেই ফেলে রেখে অজ্ঞান ড্রাগ কারবারিকে তার গাড়িতেই মনুসিংয়ের লোক, খুব সম্ভবত: নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে খুন করে ফেলে দেয়।
এই গাড়িতেই পরে মনু সিং সমেত পুরো দল ফেরত যায় সম্ভবত: কোনও গোপন ডেরায়। নিজের অপহরণ সাজাবার জন্য মনুসিং তার নতুন গাড়ি ফেলে যায়।
আমি যখন ব্রিজের মুখে এসে পড়েছি তখন মনু সিং আর তার দলবল সেতুর তলায় ব্রিফকেস ভেঙ্গে ড্রাগ প্যাকেটগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগিতে ব্যস্ত।
টর্চের আলোতে আমি যদি কিছু দেখে ফেলি সেইজন্য আমাকে মেরে অজ্ঞান করে দেয়। মনু সিং আমাকে দেখেই চিনতে পারে এবং সাথে সাথে ছক কষে নেয় যাতে করে সবার সন্দেহ আমার ওপর পড়ে ।
আমাকে মেরে অজ্ঞান করে গাড়িতে চালান করে। ব্রিজ যাতে জ্যাম না হয় সেজন্য গাড়ি সেতুর ওপারে রাখে। প্লুটোকে তার মুখে তখনো কামড়ে রাখা কোলাপুরি চটি সমেত আমার গাড়িতে চড়িয়ে দেয়। ওর দলে একজন লোকের সাথে আমার কিছুটা সাদৃশ্য আছে। দূর থেকে উল্টো দিক থেকে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখতে পেয়ে ওর সেই লোকটি আমারই গলফ ক্যাপ পরে আমার বোলেরোর বনেটের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যাতে মনে হয় গাড়ির মালিকই ওখানে কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছে।
লোকাল নিউজ চ্যানেল থেকে মনুকে কিডন্যাপ করা হয়েছে এ রকম একটা ধোঁকার প্রচারের ব্যবস্থা মনু আগেই ফেঁদে রেখেছিল। এখন আমি নীল বোলেরো সমেত এসে পড়াতে ওর অনেক সুবিধেই হল। পুলিস ধোঁকায় পড়ে আমাকে নিয়ে টানাটানি করবে । এই অবসরে মনু আর তার গ্যাং সব কিছু ধুয়ে মুছে ফেলবে।
অন্ধকার ঘরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কাছেই যেন একটা সাইরেনের আওয়াজ শুনলাম মনে হল। তাহলে পুলিস এসে গেল?
চোখ ভালো করে খুলতেই বুঝলাম আওয়াজটা সাইরেনের নয় প্লুটোর। সে মধ্যে মধ্যে কেঁদে কেঁদে উঠছে। হঠাৎ একটা জড়ানো গলা শুনলাম “ডোন্ট ক্রাই রাজা, ডোন্ট ক্রাই”। প্লুটোর নাম তাহলে রাজা আর রাজার প্রভু তার সন্ধানে এসে গেছে ?
চুপিসাড়ে এই লোকটাকে যেভাবেই হোক ধরে ফেলতেই হবে। একে ধরে ফেললেই আমি বেঁচে যাই। ফ্ল্যাটের আনাচ-কানাচ ভালো করে খুঁজে নিলাম। কেউ কোথাও নেই। পুরো কমপ্লেক্সে আলো জ্বলছে,সিকিউরিটির লোকজন হুইসিল বাজিয়ে ঘোরা-ফেরা করছে। নিশীথ রাতে প্লুটোর প্রভু হয়তো পালিয়ে গেছে । কিন্তু আবার আসবেই।
জেগে থাকবার ব্যর্থ চেষ্টা শেষ হলে দেখি দেখি সবে মাত্র ভোর হয়েছে। একি! প্লুটো আর ওর মনিবের কোলাপুরি চপ্পল দুটোই যেন কোথায় উপে গেছে। গেল কোথায় ও?। নিশি রাতে তাহলে কার গলা আমি শুনলাম?
পুবের আকাশ এবার গোলাপি লাল । একটু দূরে সেইদিকেই নদীর পাড় থেকে ভিজে হাওয়া এ ফ্ল্যাটে ঢুকতেই প্লুটো কি কিছুর গন্ধ পেয়ে সেদিকেই গেছে?
একটা পুলিস জিপ সোজা আমার ফ্ল্যাটের নিচে থামল। পুলিস এই আবাসনের সবার সামনে দিয়ে আমাকে জীপের পেছনে বসিয়ে নিয়ে যাবে থানায় আর জামিন না হওয়া অবধি আমাকে তাহলে...?
একটা আর্তনাদ আমার গলা থেকে বের হতে গিয়েও পারল না। তার আগেই কোনও শীতল হাওয়া এসে কানে কানে আমার ডাকনাম ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকল “ ডোন্ট ক্রাই রাজা, ডোন্ট ক্রাই।সব ঠিক হো জায়েগা।”। কে সে? নিশি রাতে আসা সদ্য অশরীরী হয়ে যাওয়া প্লুটোর প্রভু?
পুলিসের গাড়ী হাইওয়েতে আসার আগেই ওয়্যারলেসে খবর আসে আমাকে ছেড়ে দেবার জন্য। নদীর ধারে জ্বলন্ত শবদেহের কাছে একজনকে দেখে পুলিসের নিশিপ্রহরীর দলের সন্দেহ আরো দৃঢ় হয় যখন একটা কালো রঙের স্প্যানিয়েল কুকুর সেই লোকটার পা কামড়ে ধরে। তাকে জেরা করে মনুসিং সমেত পুরো দলটাকে ধরে নিয়ে এসেছে পুলিস। এইমাত্র টিভিতে দেখাচ্ছে দলের সবাই অপরাধ স্বীকার করায় প্রভাবশালী মনু সিংয়ের জামিন হওয়া মুস্কিল।