Pradip Biswas

Thriller Others

3  

Pradip Biswas

Thriller Others

সোনার দেশ জিম্বাবোতে

সোনার দেশ জিম্বাবোতে

1 min
301


 জিম্বাবো সত্যি করে সোনা আর হীরের দেশ। একটন পাথরে এখানে কুড়ি- তিরিশ গ্রাম সোনা অনায়াসে পাওযা যায়  নদীর বালুতটে আর পাহাড়ের তলায়।


  এখানে আসার আগে, আমরা ভারতে বসেই উপগ্রহ চিত্র থেকে স্বর্ণসম্ভাব্য জায়গাগুলোর    প্রাথমিক অনুসন্ধান করে নিয়েছিলাম । 

প্রসঙ্গত: বলি সোনা  অনুসন্ধানে, অনেক ভূতাত্ত্বিক দেখে নেন কোথায় সেইরকমের আগ্নেয শিলা আছে যাতে থাকবে   অন্য ছোট ছোট গ্নেয় পাথরের অজস্র  শিরা  এবং  ধুসর কোয়ার্টজ পাথরের উপস্থিতি।  এইরকম পাথরে এমন কি তার কাছাকাছি  পাথরেও  থাকতে পারে মূল্যবান হলুদ ধাতু সোনা। 

আমরা ভারতে বসে দিনের পর দিন জিম্বাবোয়ের  উপগ্রহ চিত্রে খুঁজে বেড়িয়েছি এইরকম পাথরের পাহাড় কোথায় আছে? তাতে ধুসর কোয়ার্টজ  পাথর পাবার সম্ভাবনা কতটা হতে  পারে? এইভাবে আমরা বেশ কিছু জায়গা বেছে নিয়েছিলাম।  

জিম্বাবোতে এসে  আমরা তার ভূপ্রকৃতির সাথে পরিচিত হবার সাথে সাথে, আমরা একজন স্থানীয় ভূতাত্ত্বিকের খোজ পেলাম যাকে সবাই  জীবন বলে ডাকতাম। 

তার সাথে আলাপ আলোচনার পর আমরা ঠিক করলাম, রাজধানী হারারে শহর থেকে একটা  নয় আসনের ছোট চার্টার্ড বিমানে করে প্রাথমিক সমীক্ষার কিছু কাজ শুরু করে নেব। 

আকাশপথে  কিছু গ্রানাইট পাহাড়ের স্বর্ণ আকর সম্ভাবনায় আমরা  মাতৃভাষাতে উল্লাস করছিলাম। এই নাইন সিটার প্লেনে পাইলটের জন্য ককপিট থাকে না। পাইলট  আমাকে বললে, “ মিঃ টিম লিডার, তোমাদের উল্লাস আর উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে তোমরা এইখানে কিছু সোনালি ঈগল আর রামধনু রঙের কাকাতুয়া দেখে ফেলেছ। এছাড়া  খাদ্যের কারণে এই পাহাড়তলির ঘন জঙ্গলে থাকে  গরিলা, ইম্পালা হরিণ, আর অবশ্যই অতি হিংস্র এবং চতুর পুমা। ভয় পেয়ো না, তোমরা যদি তোমাদের গাইডের কথা শুনে জঙ্গলে চলবার সময় জ্বলন্ত মশাল নিয়ে চল তবে বিপদের সম্ভাবনা অনেক কম। তোমাদেরকে এইখানে কাছেই একটা লোকাল এয়ার ডেনে  নামিয়ে দিচ্ছি”।  

এইসব কথা যখন হচ্ছিল তখন আমাদের দলের মুখ্য পথপ্রদর্শক এবং স্থানীয় ভুতত্ববিদ জীবন আর তার দলের লোকেরা বিমানের পেছনের সারির আসনগুলোতে বসে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল । তাদের সবার ঘুম যখন ভাঙল তখন বিমানচালকের সাথে আমাদের পূর্বনির্ধারিত চুক্তি অনুযায়ী জীবনের আর করার কিছু নেই। বিমান আমাদের সম্মতিতে কোনো লোকাল এয়ার ডেনে একবার নেমে পড়লে আবার আমাদের উড়িয়ে নিয়ে অন্য কোথাও যাবে না ।  

লোকাল এয়ার ডেনে আমাদের নামিয়ে দিয়ে, সেই বিমান  উড়ে যাবার পর জীবন রীতিমতো আমাদের বিশেষ করে আমার ক্লাস নিল। “তোমরা এখানে নামবার সিদ্ধান্ত নেবার আগে একবার আমাকে জিজ্ঞাসা করবার প্রয়োজন মনে করলে না।  এই যে টিমলিডার, তুমি জানো কি যদি এইখান থেকে যদি সোজা যাও গ্রানাইট হিলগুলোতে তবে কডোমা থেকে দুরত্ব সত্যি কম হবে। কিন্তু এইদিকের পাহাড়ের ঢাল এতো চড়াই যে রোপ ক্লাইম্বিং করতে হবে আর পাহাড়ের চুড়ায় পৌঁছাবার অনেক আগেই তোমরা পাহাড়তলির জঙ্গল পার করবার সময়  পুমার পেটে চলে যেতে পারো।  গোল্ড একপ্লোরেসনের শহীদ তালিকায় অবশ্য তোমাদের নাম লেখা থাকবে”।

জীবনকে ঠাণ্ডা করার জন্য আমার তরুন বন্ধু দেবায়ন তার ফ্লাস্ক খুলে এক কাপ গরম কফি আর বেকড বিনের টিন খুলে ধরলো। চুরুটে টান দিতে দিতে সে আমায় বলল “ তোমাকে এই এলাকার  যে টোপোশিট(টোপোগ্রাফিক ম্যাপ) দিয়েছিলাম সেটা এইখানে ভালো করে বিছাও দেখি”।  

ম্যাপে আমারও নজরে এলো যে  আমরা যদি উত্তর পূর্বের দিকে যাই সে দিকে গ্রানাইট  পাহাড়ের ঢাল  যেমন কম ঠিক তেমনি বনজঙ্গল কিছুই নেই।  একটা বিশাল নীল রঙের জায়গা দেখে  জীবন  বলে, “এইটা হচ্ছে লেক শিঙাটি যার জন্ম এর কাছেই যে গ্রানাইট হিল আছে সেখান থেকে আসা একটা বড়ো মাপের ঝরনার জলধারা। লেকটা আসলে এক বিরাট প্রাকৃতিক নিচু জায়গা”। 

আমরা তিনজনেই লাফিয়ে উঠি। । আগ্নেয়গিরি যখন জেগে ওঠে তখন তার চুড়ো  থেকে যে গলিত আগুনের মত পদার্থ বেরিয়ে আসে তাকে বলে লাভা। এই লাভা থেকে নানারকম পরিবেশে নানারকমের আগ্নেয় শিলা তৈরি হয়। 

গ্রানাইট একধরনের আগ্নেয় শিলা, নুন আর্ গোলমরিচ মেশালে যে রকম দেখতে হয়, অনেকটা সেই রকম। এই পাথরের রং, অবশ্য এছাড়া আরো রং আছে, যেমন পিঙ্ক গ্রানাইট। 

কোনো আগে তৈরি হওয়া গ্রানাইট পাথরকে  কেটে যেতে পারে শুধুমাত্র তার পরে সে একই জায়গায় পরের অগ্নুৎপাত থেকে সৃষ্টি  হওয়া   পাথর।  তার নামের পরে ডাইক পদবীও দেওয়া হয় যেমন ডায়োরাইট ডাইক, গ্যাব্রো ডাইক ইত্যাদি। 

অনেক সময় এই কেটে যাবার জন্য সেই জায়গার পাথরে,  পাহাড়ের চুড়ো থেকে নিচ অবধি লম্বালম্বি আর গভীর ফাটল  তৈরি হয় ।  এ  থেকে জলধারা ঝর্নার আকারে পাহাড়ের নিচে চলে আসে । 

এই পাথরভেদী জলধারা ছাড়া সেই জায়গায়  ধুসর কোয়ার্টজের থাকবার সম্ভাবনার  সাথে আছে  সেই পাথরে শরীরের শিরার মত  বা পুরো পাথরে বিন্দু বিন্দু হয়ে ছড়িয়ে থাকা সোনার সম্ভাব্য  উপস্থিতি। 

সময়টা সকাল হলেও এর মধ্যেই  কাঠফাটা রোদ চারদিকে । এই রোদে আমাদেরকে  প্রায় দশ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব পায়ে হেঁটে চলতে হবে । ম্যাপ অনুযায়ী এই রাস্তায়  মাঝে মাঝে চড়াই পথ আসবে  আর সেই অংশটা এবড়-খেবড়ো হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। এইরকম  রাস্তায়  চলতে হবে কিন্তু  বেশ ভালো গতিতে। তবেই  আমরা দুপুরের আগেই  লেক শিঙাটি পৌছাতে পারবো। কিন্তু দুপুর হতে  সময় মাত্র পাঁচ ঘন্টা। দুপুর হয়ে গেলে পাথরগুড়োর ঝড় ওঠে। তখন চললে মৃত্যু অবধারিত ।  

খুব পা চালিয়ে চলেও, সেই  ঝরনার গ্রানাইট পাহাড়ের কাছে পৌঁছাতে প্রায় দুপুর হয়েই গেল। পাহাড়তলীতে, ডিমের আকারের  বিরাট  শিঙাটি লেক এই ঝর্নার জলে তৈরি । তার হালকা নীল কাঁচের মতো জলে বেশ গভীরেও দেখা যাচ্ছে বড়ো বড়ো মাছের ঝাঁক। চারিদিকে সুস্বাদু রসাল মিষ্টি ফল ধরা গাছের ছায়াঘেরা লেকের সুস্বাদু জল খেয়ে আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে গেল।  মনে হল, আজকের দুপুরের আহার- বিশ্রামের জন্য এতো ভালো জায়গা আর পাবো না আমরা।  ঝরনার জলে স্নান সেরে, শুকনো কাঠ পাতা জ্বালিয়ে, লেক থেকে ফোল্ডিং বাস্কেট-জাল দিয়ে ধরা বড়ো বড়ো পাঙ্গাস মাছের রোস্ট বানানো হল। । বটল গাছের তলায়,  দেরাদুন চালের প্যাকেট খুলে সুমন্ত   আমাদের তিনজনের জন্য ভাত ফুটিয়ে রেখেছিল। 

 

জীবন এবং তার সহকারিরা তাদের প্রিয় ভুট্টার দানার পাউডার,  পুলটিস মতো বানিয়ে মাছের সাথে খেল। পরে এই গাছের তলাতেই একটা ভয়ানক বিপদ ঘটতে যাচ্ছিল। 

খাবার পর আমাদেরকে ডেকে নিয়ে জীবন আর তার সাথীরা দেখাল  দেখাল যে  লেকের বাঁ-দিকের ঢালের জমিতে পাঞ্জাওয়ালা বেশ বড় বড় পায়ের ছাপ আর সেই সাথে ইম্পালা হরিনের ছাল চামড়া সমেত তার কঙ্কাল। এই ছাপ পুমার নয়, পুমার চাইতেও বড় কোনো হিংস্র জানোয়ার এসে ইম্পালার টাটকা মাংস দিয়ে ডিনারের পর হ্রদের জলে তার তৃষ্ণা মিটিয়েছে। তাহলে রাতের মতো আমরা থাকি কোথায়?

সূর্য পশ্চিমের দিকে যেতে শুরু করেছে। জঙ্গলে সূর্য অস্ত গেলে সন্ধ্যে নামতে বেশি দেরি করে না। জীবন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “টিম লীডার, ওই দিকে তাকাও।”  এখান থেকে দেখা যাচ্ছে সামনে এক পাহাড়।  একটা বড় গাছ ওই টিলাতে জঙ্গল কম।

আমি সেই টিলা দেখতে দেখতে বললাম, “এই লেকের পাড়ে সন্ধ্যে হলেই সবরকমের জন্তু-জানোয়ারেরা আসবে জল খেতে। আমাদের উচিত হবে দূরের ওই টিলাতে চলে যাওয়া।”

আমরা সবাই সেই টিলার দিকে যাওয়া শুরু করেছি প্রায়, হঠাৎ আমার খেয়াল হল আরে সুমন্ত, সে কোথায় গেল? সবাই মিলে তাকে হাঁকডাক শুরু করলাম। দেখি আমরা যে বটল ট্রির তলায় সে পরম সুখে দিবানিদ্রা দিচ্ছে। সেইদিকে আমারে এক সঙ্গী দৌড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ  বন্দুকের গুলির কানফাটা আওয়াজে সেদিকে আমরা সবাই তাকিয়ে দেখি এক বিশাল আকারের সোনালী ঈগল ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে পাশের ঝোপে লুটিয়ে পড়লো। জীবনের নতুন সহকারী অস্কার যে সবে মাত্র আমাদের দলে এসেছে সে এইদিকে যেতে হবে শুনে তার বন্দুক সঙ্গে এনেছিল । উত্তেজিত হয়ে সে সোয়াহিলিতে আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে জীবন বলে, “ বেশীর ভাগ সোনালী ঈগল বটল ট্রিতে বাসা বাঁধে। আর একটু হলে ওই ঈগল নিচে নেমে এসে প্রথমে সুমন্তের চোখদুটো খুবলে নিত আর তার পর সারা শরীরটা জ্যান্ত অবস্থাতে খুবলে খুবলে খেত” । 

বন্দুকের গুলির আওয়াজে জেগে ওঠা সুমন্তকে নিয়ে আসার জন্য  আমরা এগোতেই, জীবন আমাদেরকে হাত তুলে নিষেধ করলে। ও বলে “ অস্কার যাচ্ছে ওইখানে।  সোনালী ঈগলটা কোন ঝোপে পড়েছে ও জানে। ওর পালক ছাড়িয়ে নিয়ে আসার সময় দুজনে একসাথে আসবে”। ঈগলের মাংস না কি রোস্ট হলে চিকেন বা বনমুরগীর রোস্টের চাইতে অনেক সুস্বাদু।

আমরা আর কিছু না বলে পোর্টেবল ব্যাটারি চালিত অগার হোল ড্রিল মেসিনের জ্যাক ফিট করা শুরু করলাম। এই মেসিন দিয়ে ছ’ফিটের বেশী গভীর গর্ত করে মাটি থেকে নমুনা নিয়ে আসা  যায়। আমার দুই সাথী,  বন্দুকধারী অস্কারের সাথে  গেছে ঝরনার কাছে  পড়ে থাকা পাথরের নমুনা আনতে।  

অগার হোল ড্রিল মেসিন চালিয়ে, বালির মধ্যে লুকিয়ে থাকা  গুঁড়ি পাথর তুলে আনতে হবে। এইসব পাথর থেকে একটা অনুমান করবার চেষ্টা করা হবে যে পাহাড়চুড়োতে যে পাথর আছে তাতে সোনার শিরা থাকবার সম্ভাবনা কতো? 

সুমন্তরা ফিরলো প্রায় নিরাশ হয়ে। ওইখানে পড়ে থাকা পাথরের একটাতেও তেমন উল্লেখযোগ্য সোনা বা সোনার শিরা নেই। আমিও পুরো পাহাড়তলিতে প্রায় পনেরোটা গর্ত ড্রিল মেসিন দিয়ে খুড়ে ফেলে তেমন কিছু পেলাম না। আমাদের পথপ্রদর্শকের পরামর্শ মতো সেদিনের মতো কাজ বন্ধ করে আমরা চললাম টিলার দিকে।      

টিলাতে আরও একটা প্রকাণ্ড বড় গাছ দেখা গেল। প্রায় বারো ফুটের বেশি উঁচু এই গাছটার তেলচুকচুকে মসৃণ কাণ্ড যেমন বিরাট মোটা, আর তার নিস্পত্র শাখা-প্রশাখাগুলোও তার কাছাকাছি মজবুত আর স্বাস্থ্যবান। পাইথন বা অন্য কোনও সাপ, কিম্বা শিকারের লোভে অন্য কোনও জন্তু জানোয়ার এই পিছল গাছে ওঠার চেষ্টা করবে না। এই সব সাত-পাঁচ ভেবে আমরা ঠিক করলাম যে ওই গাছটার একটা উঁচু মোটা ডালে হ্যামক টাঙিয়ে রাত্রে থাকা হবে। 

হ্যামক হলো হাল্কা ধাতুর ফ্রেমের ওপর আড়াআড়ি করে বাঁধা শক্ত ও চওড়া নাইলন ফিতের ঝোলানো দোলনা বিছানা। এর লম্বা দুইধারে শক্ত নাইলনের দড়ির গোছা থাকে যা গাছের ডালে ফাঁস লাগিয়ে বেঁধে নেওয়া হয়। হ্যামকের সাথে লাগানো নাইলনের সিঁড়ি নিচে ঝোলে যা দিয়ে  হ্যামকে সহজেই চড়া যায়। 

গাছ থেকে একটু দূরে তাকে বেষ্টন করে গাছের চারদিকে চওড়া চওড়া নালা মতো খুঁড়ে শুকনো ডালপালা সেই নালি বা ট্রেঞ্চে ফেলে আগুন জ্বেলে দিতে হয়। দূর থেকে এই আগুন দেখেই হিংস্র বন্য প্রাণীরা আর আসে না। এই কারণে, জঙ্গলে রাত কাটাতে গেলেই হ্যমকের জুড়ি  আর নেই। 

আমাদের সাথে কোদাল নেই। দুটো চপার আছে। তা দিয়ে বড়ো জোর  গাছের ডাল কাটা যেতে পারে। কিন্তু গর্ত করা যাবে না । অবশ্য সেসব না করতে পারলে, গাছ থেকে একটু দূরে-দূরে ডালপালাগুলো ছড়িয়ে, গোল করে সাজিয়ে, আগুন দিলেও কাজ কিছুটা হবে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা ডালপালাগুলো কুড়িয়ে জড়ো করতে গিয়ে জীবন হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে “ হেই টিম লিডার এদিকে খামের সাইজের অনেকগুলো গর্ত”। ততক্ষণে আমার ধারেও একই রকম সাইজের  আরও অনেক ট্রেঞ্চ । ঝড়ে ভেঙ্গে পড়া অন্য গাছটা থেকে শুকনো ডালপালা আনতে গিয়ে, আমাদের দু’জনের চোখে পড়ল এইরকম অনেক ট্রেঞ্চ। এই ট্রেঞ্চগুলো দেখতে গিয়েই, চোখে পড়ে গেল গায়ের রক্ত হিম করে দেওয়া একটা দৃশ্য।  

সবেমাত্র তার কিছু আগে,  একটা ট্রেঞ্চের গায়ে তিন-চারটে বড়ো  গাঁইতি দেখে আমরা দুজনে সেগুলো কিভাবে এলো সেই নিয়ে বলাবলি করছিলাম যে তাহলে কি  এই জঙ্গলে  মানুষ এসেছিল সোনার খোঁজে? এরপরই আর একটা বড়ো ডালপালার স্তূপ টেনে আনতে গিয়েই দেখি, তার তলায়  একটা বেশ গভীর ট্রেঞ্চ। তাতে শোয়ানো অবস্থায় আছে একটা নরকঙ্কালের অংশ। নরকঙ্কালটি বেশ পুরানো কেননা তার  জায়গায়-জায়গায় হাড় খয়ে গিয়ে মাটি তৈরি হতে শুরু করেছে। 

কঙ্কালটি আমাদের নজরে আসতেই ফিরতেই, দুজনে একসাথে “ওহ মাই গড” বলে  এত জোরে চিৎকার করেছিলাম  যে আমাদের টিমের সবাই তো বটেই এমনকি দূরে লেক থেকে মাছশিকারি পাখিগুলো তাদের শিকার ছেড়ে দিয়ে,  একসাথে উড়ে এসে সেই ভেঙ্গে পড়া গাছেই বসেছিল। 

বিকেলের অস্ত আলোতে, আমরা গাঁইতি দিয়ে অনেকটা মাটি কুপিয়ে এনে, সেই কঙ্কালে মাটি দিয়েছিলাম আর অস্তগামী সূর্যের দিকে পিছন ফিরে, সেই অজানা লোকটির শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করেছিলাম। পুরো দলটা একসাথে “আমেন” বলার পরই, পাখিগুলো ভেঙ্গে পড়া গাছের ডালগুলো থেকে, এক-এক করে, ধীরে- ধীরে উড়ে গেছিল। ঠিক সেইভাবে, আমরা যখন  কোনো শোকসভার অন্তিম প্রার্থনার শেষে, কবরখানা থেকে ধীরে-ধীরে এক-এক করে চলে যাই। 

খনিজ অনুসন্ধানে কোনো জায়গায় যে খনিজপাথরের খোজ চলছে তা দেখতে পাওয়া গেলে সেখানে খোড়া হয় গর্ত। গর্ত খুড়ে প্রাথমিক ভাবে উৎসাহজনক কিছু পেলে প্রতিটা গর্তকে যোগ করে কাটা হয় ট্রেঞ্চ।  অনেকগুলো ট্রেঞ্চ আর সেইখানে রেখে  যাওয়া গাইতি, শাবল এইসব দেখে মোটামুটি ভাবে আমরা নিশ্চিত হলাম যে  এইখানে  আগে এক বা একাধিক দল এসেছে এই অঞ্চলে।  যদিও ট্রেঞ্চগুলো কাটা হয়েছে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ভাবে, কিন্তু এই দেখতে দেখতে আমার একটা ব্রেন ওয়েভ এল। 

দেড় ঘন্টায় পনেরো ফুটের মত গর্ত করবার জন্য আর সেই গর্তের প্রতি ফুটে পাথরের নমুনা নিয়ে আসবার জন্য  আমাদের সাথে ব্যাটারি চালিত কিন্তু খুব শক্তিশালী ড্রিল মেসিন আছে। সূর্যের আলো পড়ন্ত হলেও আরো ঘন্টা দুইএর মত কাজ চালিয়ে যাবার মতো দৃশ্যমানতা এখনো পাওয়া যাবে । 

এই টিলার সোজাসুজি যে গ্রানাইট হিল দেখা যাচ্ছে তার দৈর্ঘ্য বরাবর পাহাড়তলিতে কয়েকটা ড্রিল হোল করলে কেমন হয়? আমার কথাটা মুখ দিয়ে বার করার সাথে সাথে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে পুরো দল সাথে সাথে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে কাজ  শুরু করল।  

আলো বেশী নেই, যা করতে হবে তা তখুনি আর বেশ চটপট। প্রথম গর্তটা একটু গভীরে যেতেই কটকট কটকট করে আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। একটু আগে পাওয়া গাইতি আর শাবল দিয়ে পুরো গূড়ো পাথর সরিয়ে ফেলতেই পাওয়া গেল অনেক শক্ত গ্রানাইট পাথর এবং লঘু এসিড দিয়ে পাথর সাফ করতেই তাতে থাকা  সোনার শিরাগুলো ঝলক দিয়ে উঠলো। আঁধার নেমে আসার আগেই, সব জায়গা থেকে নমুনা নিয়ে  আমরা আন্দাজ করে নিলাম যে হয়ত আমাদের পায়ের সামান্য নিচেই আছে বেশ বড় মাপের স্বর্ণভান্ডার।  


পরদিন সূর্য ওঠার আগেই  টিনফুড খুলে ব্রেকফাস্ট করে  ঠিক হল আমার দুই সাথী অস্কারের সাথে পুরো পাহাড়তলিটা চষে ফেলবে, যেখানে প্রয়োজন মনে করবে ড্রিল মেসিন চালিয়ে নিচের পাথরের খোজ করবে, নমুনা নেবে। আমি, জীবন আর কিম্ভুতের টিম সামনের গ্রানাইট হিলের চুড়োতে উঠবো। সেখানের গ্রানাইট পাথরে সোনার শিরা এবং নাগেট আছে কি না দেখে নেওয়া হবে। 

পাহাড়ে চড়তে চড়তে এবং চুড়াতে  আমরা  কয়েক জায়গায় পাথরের সোনার শিরা দেখেছি, নাগেট( সোনার বড়ো বিন্দু) কিছুকিছু জায়গাতেও দেখেছি। অন্যধারে পাহাড়তলির টিম বেশ কয়েক জায়গায় তাদের পাওয়া পাথরে সোনার শিরা পেয়েছে। এইসব শেষ করতে  দুপুর নেমে এল।  

মোটামুটি ভাবে এই স্বর্ণসন্ধানী অনুসন্ধানে এই এলাকার গ্রানাইট হিলের লুকানো স্বর্ণভান্ডারের উজ্বল সম্ভাবনা  আমাদের উপরি পাওনা। স্বর্ণ-সম্ভাবনার দিকটি পরে আরও খতিয়ে দেখতে হবে।  এই দু’দিন আমাদের কাছে এটি ছিল পরবর্তী আরও দুর্গম জায়গায় স্বর্ণসন্ধানী অভিযানের কন্ডিসনিং ক্যাম্পের মতো। 

আগের দিনই আমরা কডোমাতে আমাদের এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করে জিপ পাঠাতে বলেছিলাম।   ঠা ঠা দুপুর রোদে কোনমতে পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে গিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করা সেই  জিপে চড়ে চললাম পরবর্তী এলাকা কডোমা গ্রানাইট হিলের পাদদেশে। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller