Pradip Biswas

Classics Thriller Others

4  

Pradip Biswas

Classics Thriller Others

গড়বাড়ির দুর্গাপুজা

গড়বাড়ির দুর্গাপুজা

17 mins
442


  

 

দুর্গের অন্ধকার বন্দীঘরে, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে, রঘুনাথ  পরপর দু’বার শুনলেন হুতোম প্যাঁচার ডাক। তিনি, নবাব আলীবর্দির সফল সেনানায়ক ছিলেন।  এই আওয়াজটা যে জঙ্গলি প্যাঁচার ডাক নয়, মানুষের গলা থেকে আসা সাংকেতিক ডাক, সেটা এক লহমায় বুঝে নিলেন। সঙ্কেতটার অর্থ হল, “তৈরি থাকো, খুব শীঘ্রই আমরা  তোমাদের  উদ্ধার করতে আসছি” । 

চাপা কিন্তু দ্রুত পদক্ষেপে, রঘুনাথ কারাকক্ষের ঘুলঘুলির কাছে এসে থামলেন। গঙ্গার ঠাণ্ডা বাতাসের আশায়, এইখানেই মেঝেতে শুয়ে আছে  ভাই চন্দ্রনাথ। এক হাল্কা চাপড়ে তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেবার সময়, এবার দুই ভাই একসাথ  শুনলেন, হুতোম প্যাঁচার হাড় হিম করা ডাক। 

রঘুনাথ কাছে থাকায় ভাইকে সামলে নিলেন, বললেন, “মনে হচ্ছে, এই গুমঘর থেকে আমাদেরকে মুক্ত করতে, আমার ঝটিকা বাহিনীর সামু আর দামু দুজনে আসছে।“

গঙ্গা থেকে সামান্য দূরে, একটা উঁচু টিলার ওপর, পরিখা আর উঁচু দেওয়ালে  ঘেরা, বাংলার নবাব আলীবর্দির এই দুর্গের গুমঘরে  থেকে  সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত  বোঝবার একমাত্র উপায়, দামামা, বড় শিঙ্গা, পেটাঘড়ির ঘণ্টার মিলিত আওয়াজ আর প্রহরীদের কুচকাওয়াজের পদধ্বনির শব্দ।  

দুর্গের একটি গোপন কক্ষের ভেতরে আছে ঘোরানো সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে,  একটা লম্বা সুড়ঙ্গ পার হয়ে এক বারান্দা আর তাতে সার দিয়ে  দুর্গের কারাগার বা গুমঘরগুলো।  

বারান্দায় একটাই বড় ঘুলঘুলি আছে।  সেটা  দিয়ে সারা দিনে একটু আলো কিছুক্ষণের জন্য আসে।  দূর থেকে নদীর ঠান্ডা হাওয়া, এই ঘুলঘুলি দিয়ে সবসময় আসে। গুমঘর থেকে কোনো বন্দি পালাতে চাইলে, তাকে  এই বারান্দা আর সুড়ঙ্গে মোতায়েন প্রহরীদের আর দুর্গের জায়গায়-জায়গায় লুকিয়ে থাকা প্রহরীদের ফাঁকি দিতে হবে যা  একদম অসম্ভব। তা সত্বেও, মৃত্যুদন্ড কার্যকরী হবার  অপেক্ষায় থাকা  রঘুনাথ আর চন্দ্রনাথকে নবাবের এই দুর্গ থেকে  মুক্ত করার জন্য, এক দারুন ছক কষেছিল তাদের বাহিনীর লোকেরা।

রঘুনাথ আর চন্দ্রনাথ এই দুই ভাই ছিলেন নবাবের উচ্চপদের রাজকর্মচারী । রঘুনাথ ছিলেন এক বিশাল সেনাদলের সফল সেনাপতি আর চন্দ্রনাথ ছিলেন নবাবের অর্থ ভাণ্ডারের মুখ্য খাজাঞ্চি । উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া তাঁদের বিশাল জমিদারী সম্পত্তির দেখভাল করতেন ছোটভাই রুদ্রনাথ, তাঁদের চাঁপাডাঙ্গার প্রাসাদ থেকে। 

রুদ্রনাথ একবার তান্ত্রিক সাধনা শেখবার জন্যে কিছুদিন তিব্বতে গিয়েছিলেন। একবছর পরে, তিনি ফিরে এলেন, সঙ্গে তাঁর তিব্বতি গুরু। সেই গুরু তন্ত্রবিদ্যার সাথে-সাথে হাতাহাতি সামরিক যুদ্ধের, সোরা, গন্ধক, ধাতু চূর্ণ দিয়ে  আগুনে গোলা( বর্তমানের বোমা, হাউই) বানাবার গোপন বিদ্যাও জানতেন। 

একবার এই গুরুর হাতাহাতি যুদ্ধের মহড়া, বোমা-পটকার বিকট আওয়াজ আর সেই সাথে হাউই বাজির খেলা দেখে, রঘুনাথ বুঝে নিলেন এর শত্রূসেনাকে বিভ্রান্ত করবার  আর পিছে হটিয়ে দেবার ক্ষমতা। আর দেরি না করে, রঘুনাথ এই তিব্বতি গুরুকে  কুলগুরু করে বরণ করে নিলেন।   তাঁর ঝটিকা বাহিনীর  সেনাদের ছোটো ছোটো  দল, কুলগুরুর কাছে পাঠালেন, এই বিদ্যেগুলো শিখে নেবার জন্য।

রঘুনাথ আর চন্দ্রনাথ তাঁদের কর্মগুনে নবাব আলীবর্দির অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন। মীরজাফর আর তার অনুগতেরা রঘুনাথের নবাবের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠাকে খুব হিংসে করতেন। যুদ্ধে পাওয়া ধনভাণ্ডারের সবটা, রঘুনাথ  তার ভাইয়ের সাথে যোগসাজশে  নবাবের কোষাগারে জমা করেন না  বলে তাঁরা আলীবর্দির  কানভারী করতে লাগলেন। 

একবার রঘুনাথ  মারাঠা বর্গিদের সাথে উড়িষ্যা আর বিহারের রণাঙ্গনে ব্যস্ত ছিলেন। সেই সময় মীরজাফরের চরেরা নবাবী কোষাগার থেকে বেশ কিছু রত্ন আর মোহরের থলি রঘুনাথের প্রাসাদের ভেতর এক শিবমন্দিরে গোপনে পুঁতে রেখে কোতোয়ালের লোকজনদের খবর দিয়ে দেয়। 

মারাঠা বর্গিদের সাথে  সেই যুদ্ধে তাদের রাজ্যের সীমানার বাইরে তাড়িয়ে ফিরে আসতে রঘুনাথের বেশ দেরি হয়ে যায়। এই দেখে, মীরজাফর রটিয়ে দেয় যে রঘুনাথ যুদ্ধে হেরে পালিয়ে গেছেন এবং  শিবমন্দিরে লুকিয়ে রাখা এই ধন-ভাণ্ডার আসলে মারাঠাদের কাছে যুদ্ধে হারবার জন্য রঘুনাথের নেওয়া ঘুষ । 

এই রটনা, অসুস্থ বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দির কানে আসামাত্র, তিনি ক্রোধে অন্ধ হয়ে, নির্দোষ রঘুনাথ এবং চন্দ্রনাথ দু’জনকেই কেল্লার জেলে বন্দি করে কাজীর বিচারের আদেশ দিলেন।  

কাজীর দল যথারীতি দুই ভাইকে প্রাণদণ্ড দিলেন। নবাব সেইসময়ে খুব অসুস্থ, তাঁর অনুমতি পেতে বেশ দেরি হল। ততদিনে রমজান শুরু হয়ে গেছে। কাজীরা স্থির করলেন ঈদ পরব চুকলেই তার পরদিন  সকালেই দুই ভাইয়ের শাস্তি  কার্যকরী করা হবে। 

তাঁদের ছোটোভাই রুদ্রনাথকে, তাঁর তিব্বতি তান্ত্রিক গুরু আদেশ দিলেন যে এই বিচারের প্রহসন তাঁর ওপরও নেমে আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। 

এখন তাঁর উচিত, জঙ্গলে আত্মগোপন করে, ঝটিকা বাহিনীর সাহায্যে, দুই ভাইকে নবাবের কারাগার থেকে মুক্ত করবার ছক তৈরি করা। 

রুদ্রনাথ, ঝটিকা বাহিনীর মধ্যে গুপ্তচরের কাজে দক্ষ এমন  সেনাদের থেকে বাছা-বাছা দশজনকে, সামু আর দামু নামে দুই কুশলী সেনানায়কের   নেতৃত্বে পাঠিয়ে দেন কেল্লায় । 

সেই সময়ের উচ্চশ্রেণীর  হিন্দু রাজবন্দীদের প্রাপ্য সুবিধা অনুযায়ী,  পুরোহিত, নাপিত, রাঁধুনি, বৈদ্য এই সব পরিচয়ে ঝটিকা বাহিনীর লোকেরা সেইখানে সর্বক্ষণ থাকতে পায়। এদের আসল কাজ হল, কেল্লার ভেতরে পাহারার আর পালাবার ফাঁকফোকরের সুলুক সন্ধান করা। 

ঈদের পরের দিন সকালেই যে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হবে সেই খবর আর দুর্গের এক দেওয়ালে একটা পাথর চাপা দেওয়া ফাঁক ছাড়া, প্রহরীদের দুর্বলতার কোনো খবর তারা দিতে পারে নি। 

রমজান শেষ হয়ে আসছে, আর রুদ্রনাথের কপালে ভাঁজ বেড়ে চলেছে। রমজানের আগের দিন সূর্য ডুবে আসছে, এমন সময় সামু-দামুর চরেরা একটা দারুণ খবর আনলো। 

দুর্গের বড় ফটকের ঠিক বাইরে এক সালঙ্করা, অপরূপ সুন্দরী মধ্যবয়স্কা মহিলা বাঁকে করে বেশ কয়েক জালা  ঘোল নিয়ে এসে খুব সস্তায় বিক্রি করছে। ঈদের বাজার সেরে, রমজানের উপবাস ক্লান্ত সেপায়ের দল সেই  ঘোল খেয়ে, আরো খাবার জন্য ভীড় করে আছে। 

সন্ধ্যের অন্ধকার সবে নেমেছে। কেল্লার  ফটকে একটা টিমটিমে  লণ্ঠনের আলো কোনোরকমে জ্বলছে।  সামুর চোখে এলো ফটকের সেপাইদের হাঁকডাক বন্ধ। ওদের একজন মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে, বাকিরা গাছতলায় বসে ঢুলছে । 

এমন সময় কেল্লার ভেতরে, সামু দামুর লোক যারা রঘুনাথদের সেবা করছে, তারা ঘুঘুর আওয়াজে সাঙ্কেতিক ডাকে বলল, “এখানে নিদালী নেমেছে। ভাগ্যিস আমরা গোপিনীর ঘোল খেতে গিয়েও খাই নি”।

নিকষ কালো রাতের অন্ধকারের চাদর আর পুরো কেল্লার সব প্রহরীদের  নিদালীর কবলে পড়ার  সুযোগ নিয়ে, কেল্লার কারাগার থেকে বেরিয়ে এলেন রঘুনাথ আর চন্দ্রনাথ।  তাঁদের আগে- পিছে ঝটিকাবাহিনির বেষ্টনী। দুর্গের  পেছনের দিকের দেওয়ালে, এক জায়গায় পাথরচাপা দিয়ে লুকানো মানুষ প্রমাণ গর্তের কথা তাঁর ঝটিকা বাহিনীর নজরে আগে থেকে জানা ছিল।  তাঁরা  সেই জায়গা দিয়ে, বাইরে বেরিয়ে এসে, দ্রুত পদক্ষেপে গঙ্গাপারের অরণ্যের দিকে চলে গেলেন। 

নদীর এ’পারে, তাঁদের আর একটি প্রাসাদের ঘোড়াশাল থেকে আনা, চারটে    কালো রঙের শিক্ষিত আরবি ঘোড়াগুলো, রঘুনাথ চন্দ্রনাথ, সামু আর  দামুকে নিয়ে চলল রাঢ় বাংলার দিকে।  সকাল হবার আগে রুদ্রনাথ, আর তার ছ’জন অশ্বারোহী দেহরক্ষীর বাহিনীও তাঁদের সাথে যোগদান করলো। 

সকাল হতেই তাঁরা,  গেরুয়া বসনে জটাজুটধারী  সাধুর বেশ ধরে, এগিয়ে  চললেন জঙ্গলের পথ ধরে । কেউ তাঁদের চিনে ফেলতে পারে, এইকারনে তাঁরা গ্রামগুলো এড়িয়ে চললেন। 

এইভাবে চারদিন চলবার পর, তাঁরা এক সন্ধ্যেয় খুব ক্লান্ত হয়ে এক গাছতলায় এসে আশ্রয় নিলেন। তাঁদের দেহরক্ষীর বাহিনী জানালো, পথে সব গ্রামেই মারাঠিদের  দল, খাদ্যশস্য, আনাজ, জোর করে লুঠ করে নিয়ে গেছে। তবে জংগলে এক জায়গায় তাঁরা বেশ কিছু  বিরাট বড়-বড়  মেটে আলু পেয়েছেন। 

সামু আর দামূ একটু পরে এসে জানালো, তাঁরা আজ যেখানে বিশ্রাম করছেন, তার কাছেই আছে, একটা খুব বড়ো দীঘি।  এইখানে একসময়  একটা গ্রাম ছিল বলে মনে হচ্ছে। তারা দু’জনে কিছু পরিতক্ত্য কুটীর দেখেছে। কাল সকালের  আলোতে ব্যাপারটা আরও খোলসা হবে। 

মেটে আলু-পোড়া দিয়ে, কোনোরকমে আধপেটা খেয়ে, তিন ভাই শুয়ে পড়লেন গাছের তলায়। তাঁর দুই ভাই ঘুমিয়ে পড়লেও রঘুনাথের দুচখে ঘুম আসতেই চাইল না। চোখ বন্ধ করলেই, তাঁর কানে আসছিল অসহায় গ্রামবাসীদের বুক ফাটা কান্না।  তাদের একমাত্র সম্বল, দু’মুঠো ধান, মারাঠারা লুঠ করে নিয়ে যাচ্ছে। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কি কিছু করা যায় না?

ভোররাতে একসাথে ঘুম ভেঙ্গে, তিন ভাই একের পর এক বলতে শুরু করলেন তাঁদের দেখা স্বপ্নের কথা। কি আশ্চর্য! তিন ভাইই দেখেছেন একই স্বপ্ন। বড় দীঘির দিকে পৌঁছে থমকে দাঁড়ালেন রঘুনাথ আর তাঁর পেছনে আসা দুই ভাই। দীঘির সামনে এসে, তিনজনে মিলে যা দেখলেন, তাতে তাঁদের গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলো। স্বপ্নে তিনজনেই যা দেখেছেন, দীঘির পূর্বদিকে কোনাকুনি হয়ে সেটি সত্যি ভাসছে”। 

ঠাকুমার কথা শেষ হবার আগেই, তাঁর অতবড়ো ঘর  খাঁটি ঘি আর বাদাম এলাচের গন্ধে ভরে উঠলো। দু’জন পরিচারিকা, দুটি বিশাল বড় পিতলের থালাতে, অনেক হলুদ রঙের নাড়ু্ নিয়ে এসেছে।

ঠাকুমা তাঁর মেহগিনির পালঙ্কে, এবার আধশোয়া থেকে সোজা হয়ে  বসে, ডাকলেন, “নন্দিতা, তোমার বন্ধু রিয়াকে ডাকো আর তোমরা সবাই এসো । নাও রিয়া, এ হল আমাদের বাড়ির দুর্গাপুজোতে বোধনের দিনের নারায়ণ শিলা পুজোর প্রসাদের মিষ্টি। এর নাম আনন্দনাড়ু্”।

এইসময় আর এক পরিচারিকা ঠাকুমাকে চাপা স্বরে বললে, ” রানিমা, গুরুজি লামা ওয়াংচুক, বড়নালার সিং-দরজার কাছাকাছি চলে এসেছেন”

এই বয়েসেও অশীতিপর ঠাকুমা, তাঁর মেহগিনির খাট থেকে, দ্রুতপদে নেমে বললেন “রিয়া, আমার গল্প শেষ হয় নি, বাকিটা কাল শোনাবো। এই বাড়ির দুর্গাপুজোতে নেপাল থেকে আমাদের কুলগুরু নিজে আসেন তন্ত্রধারী হয়ে। উনি একজন তিব্বতি লামা। আমায় এখন তাঁকে বরণ করতে নাট মন্দিরে যেতে হবে”।

নন্দিতা আর রিয়া কারশিয়াং এ, খুব ছোটো থেকে  এক  বোর্ডিং স্কুলে একসাথে পড়ে । নন্দিতার মুখে অনেকবার তাদের বাড়ির দুর্গাপুজোর গল্প শুনেছে। এইবার নন্দিতার বিশেষ অনুরোধে রিয়ার মা-বাবা রাজি হয়েছেন তাকে এখানে আসতে দিতে।   

“তিব্বতি লামা সেই নেপাল থেকে আসেন পুজো করতে? নন্দিতা তুই এই কথাটা বলিস নি তো আমায়?আচ্ছা উনি যে গল্পটা বলছিলেন তাতেও তো এক তিব্বতি গুরুর কথা ছিল। ”

ছাদে যাবার সিঁড়ির মুখে এসে, নন্দিতা ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,”সেইটাতো আমাদের বংশের ইতিহাস”। 

রিয়া বলে, “বাপরে! তুই তাহলে এক ঐতিহাসিক রাজবংশের রাজকন্যে”।

নন্দিতা ঘাড় নাড়ে,”নাঃ রে ! আমরা সবাই এখন  সমান। চল ছাদে যাই। কাল রাতে আসার সময়, তুই অনেক কিছু দেখতে পাস নি”। 

ছাদ থেকে, মেটে-লাল রঙের দুর্গা দালান, নাট মন্দির, সিংহ দুয়ার আর তার পাশে রাখা বিশাল কামান, সব কিছু যেন রিয়াকে  পেছনে টানছিল, সেই ঐতিহাসিক ব্রিটিশ পূর্ব শাসনকালের সময়ের দিকে। 

একটা বেশ চওড়া নালা, পুরো  রাজবাড়িকে ঘিরে   আছে। নালার পার হবার জন্য একটা বড় সেতু আর তার দুপাশে  দুটো চাকা লাগানো আকাশের দিকে মুখ করা কামান। নালার একটু  পরে, সিংহ- দুয়ারের সাথে লাগোয়া  তিন চার মানুষ প্রমাণ উঁচু প্রাকার।  সেই প্রাকারে, মাঝে মাঝে ফাঁক করে দেওয়া আছে। 

রিয়া ওই দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে আছে দেখে নন্দিতা বলে, “এই চওড়া নালাটা এই গড়ের পরিখা। ঠাকুমার মুখে শুনেছি এক সময়ে এই পরিখার নালাতে অনেক কুমির ছিল”। 

“কুমীর থাকতো?”

“শত্রুসেনা যদি দুর্গের প্রাকার বা সিংদরওয়াজা পার করে এই পরিখার সেতু পার হতে চাইলে তারা সেতুর মাঝে এলেই কামানের গোলায় সেতু ভেঙ্গে যেত। যারা বেঁচে যেত তারা কুমীরের শিকার হতো।

গুপ্তধনের লোভে ডাকাত দলের পরপর দু’বারের আক্রমনকে দুর্গের সেনারা এভাবেই শেষ করে দিয়েছিল। ঠাকুমার মুখে এই গল্প আমরা শুনেছি”।

রিয়া বলে, “ইস! তোমাদের বংশের ঐতিহাসিক গল্পটা কি দারুণ বলছিলেন। একদম জমাটি মুহূর্তে আনন্দ নাড়ুর থালাগুলো নিয়ে না এলে গল্পটা শুনে নিতে পারতাম। উনি আজ আবার কখন ডাকবেন?”

নন্দিতা হেসে বলে, “ তাঁর মুখে শুনতে চাইলে তোকে দশমীর পরদিন অবধি অপেক্ষা করতে হবে। আর যদি আমার মুখে শুনতে চাস তাহলে দুপুরে খাবার পর আমরা বসবো  ছাদের কোনে আমার ঘরে। ”

রিয়া অবাক হয়ে বলে, “ ওই সেতুর ওপর এখন মনে হচ্ছে অনেক লোকজন আসছে”

নন্দিতা সেদিকে চেয়ে বলে, “আমাদের গুরুদেব আসছেন শিষ্যদের নিয়ে।   ঠিক মাঝখানে, খয়েরী লাল রঙের বিশাল ছাতার নিচে, মাথা কামানো, পরনে খয়েরী রঙের আলখাল্লা, টকটকে ফর্সা রঙ, উনিই হলেন কুলগুরু। ওনাকে ঘিরে আছেন ওনার শিষ্যেরা। ওনার পেছনে, গুম্ফাতে যে রকম গুমগুম করে ঢোল মতো বাজে সেই বাজনদারেরা। তিনদিনের পুজোতে, তালপত্রে লেখা প্রাচীন পুঁথি থেকে মন্ত্রোচ্চারণ করবেন ওনারা, নাটমন্দির গমগম করবে সেই সব শব্দে”। 

রিয়া বলে, “ তাহলে এখানের দুর্গাপুজোতে ঢাক বাজবে না” 

নন্দিতা বলে “নিশ্চয় বাজবে। ঢাকি, সানাই নিয়ে সে প্রায় পঞ্চাশ জনের দল। আজ বোধনের সময় থেকে সেসব বাজবে দশমীর দিন অবধি। কিন্তু সন্ধিপুজোর সময় আর প্রতিদিন সন্ধ্যারতির আগে গুম্ফার ওই ঢোল ধুম-ধুম আওয়াজ করে বাজবে ”।

“বেশ জমে উঠবে তাহলে তোদের এই পুজো’

“হ্যাঁ। এই বাড়ি এখন গমগম করবে। বাবারা ছ’ভাই, চার পিসি। পিসতুতো, খুড়তুতো, মামাতো ভাইবোন মিলে আমরা প্রায় সত্তরজন। নিচের খাবারঘরের দালানে একসাথে সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া, হৈ-হৈ, মজা, ফুর্তি  চলতেই থাকবে। সপ্তমীর সন্ধ্যেতে যাত্রা, অষ্টমীর বিকেলে পুতুল নাচ, আর নবমীর বিজয় উৎসবের দিনে, মারাঠি পাড়ার লোকেদের ছোরা আর তরোয়ালের খেলা আর আমাদের লাঠিয়ালদের লাঠি, খেলা এইসবে জমে থাকে। সেদিন দরিদ্রনারায়ন উৎসব থাকায়, আশেপাশের সব গ্রাম থেকে প্রজারা এসে ভিড় করে”।

রিয়া ওকে হাত  থামিয়ে দিয়ে বলে, “থাম, থাম একটু। এখানে মারাঠি আবার কোথা থেকে এল? আর বিজয় উৎসব বা কি? কার বিজয়? কাল শুনছিলাম, এই অঞ্চলের সব গ্রামের লোকেরাই তোদের প্রজা ছিল। তা মারাঠিরা কি করে তোদের প্রজা হল?”

“ সে অনেক কথা।  দুপুরে খাবারের পর শুনিস।   ঠাকুমার সেই শেষ না করা কাহিনীটা   শুনলেই মারাঠাদের কথা বুঝতে পারবি। ”

নীচে দোতলার ঘরে বিরাট কলরব শুনে নন্দিতা বলে, “পিসিরা সবাই এসে গেছে মনে হয়। এখুনি আমার ডাক পড়বে। আমি যাচ্ছি। তোর জন্য চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।  আমার এক সই ছন্দা, সে নিয়ে আসবে। ” 

ছন্দা এক বিরাট ট্রেতে চা নিয়ে এসে, রিয়াকে ছাদের এককোনে নন্দিতার ঘরের   দিকে আসবার কথা বললে। সেদিকে যাবার সময়, রিয়ার চোখে পড়ে এক বিরাট দীঘি। এখান থেকে মনে হচ্ছে, কে যেন, অনেকগুলো পদ্মফুল আঁকা  একটা বিরাট নীল চাদর, শুকাতে দিয়েছে।  

ছন্দা, রিয়ার দিকে চেয়ে বলে “ যে দিঘিটা দেখছো, সেটা অনেক যুগ আগের কথা। এই বংশের পূর্বপুরুষ রঘুনাথ, ওই দীঘির জল থেকেই মা দুর্গাকে তুলে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন”। 

রিয়া বলে “দীঘির পাড় থেকে অনেক দূরে, জঙ্গলের মাঝে লাল রঙের একটি মন্দিরের চুড়া দেখা যাচ্ছে। কোন ঠাকুর আছে ওই মন্দিরে” ।

ছন্দা বলে “ওই মন্দির রঘুনাথেরও  আগের সময়ের। জল থেকে তুলে আনবার পর, ওইখানেই দেবী থাকতে চান। এখানে দুর্গা দালানে যে  চতুর্ভুজা  দুর্গাদেবী দেখা যাচ্ছে, সেটি ওই দেবীর মৃন্ময়ী রূপ”।

দু’জনের চা শেষ হতে না হতে, নিচ থেকে আওয়াজ শুনে ছন্দা  ফিরে এসে বলে “ রিয়া, তোমাকে সবাই দেখতে আর আলাপ করতে চাইছেন। এস এখন আমার সাথে”।  

দুপুরের আহার সেরে, ছাদে নন্দিতার ঘরে, দুই বন্ধুতে বসেছে।  রিয়ার দিকে তাকিয়ে নন্দিতা বলে, “ ঠাকুমার গল্পে ছিল, তিনভাই রাতে একই স্বপ্ন দেখে ছিল আর সকালে তারা সেই কথা বলতে বলতে এক দীঘির পাড়ে এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল”।

রিয়া বলে “ ঠাকুমা বলছিলেন যে তাঁরা তিনজনই  স্বপ্নে  কিছু একটা দেখেছেন যা  দীঘির মাঝখানে পূর্বদিকে কোনাকুনি হয়ে সে সত্যি সত্যি ভাসছে”। 

নন্দিতা বলে, “গল্পের সেই দিঘি কিন্তু চোখের সামনে যে য নীলপদ্মে ভরা দীঘিটা দেখতে পাচ্ছিস সেইটাই। তিনভাই একসাথে স্বপ্নে দেখেছিলেন যে চাঁপা ফুলের মত গাত্রবর্ণের  এক  তেজস্বিনি নারী, এক দীঘির জল থেকে আবির্ভূতা হয়ে বলছেন, “মারাঠি দস্যুরা যাতে আমার ক্ষতি না করতে পারে, সেইজন্য আমার মন্দিরের  প্রধান পুজারী, আমাকে এই দীঘির জলে ছুড়ে ফেলে দেয়। তোরা, আমায় এই দীঘির জল থেকে উঠিয়ে নিয়ে, আমার মন্দিরে আমার পুজো কর। আমার আশীর্বাদে বর্গিরা তোদের সাথে যুদ্ধে  হেরে পালিয়ে যাবে। দীঘির মাঝখানে একটা বড় নীলপদ্ম দেখতে পাবি। তার পেছনে, পুবদিকে কোনাকুনি হয়ে একটা বড়ো কাঠের তক্তা ভেসে আছে দেখতে পাবি। আমি আছি সেই কাঠের তক্তার ঠিক নিচে”। 

সূর্য তখন সবেমাত্র উঠেছে। তাকে প্রণাম জানিয়ে তিনভাই পরের পর ঝাঁপ দিলেন। তার একটু আগেই সামু আর দামু পুরো এলাকাটা ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুরে এসে একটা হঠাৎ ধংস হয়ে যাওয়া গ্রাম আর পোড়ো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান পেয়েছে । 

তাদের তিন সেনাপতিকে জলে ঝাঁপ দিতে দেখে  তারাও লাফাতে যাচ্ছিল।  রঘুনাথ, দীঘির মাঝবরাবরের দিকে সাঁতরে  যাবার সময়, হাত তুলে নিষেধ করলেন।  কাঠের পাটার কাছে এসে, তিন ভাই এক-এক করে ডুব দিলেন। 

তিনজনে অতি দক্ষ সাঁতারু কিন্তু পরের পর অনেকক্ষন ধরে পালা করে ডুব দিয়েও কিছু পেলেন না । বেলা শেষের সময়ও প্রায় হয়ে এল।  হতাশ হয়ে তাঁরা  পাড়ের দিকে ফিরে যাওয়াই মনস্থ করলেন। রঘুনাথের কেমন জানি মনে হল, তিনি জলের অতল থেকে এক নারী কন্ঠের আহবান শুনছেন । কিন্তু এইবার তিনি  সেই মাঝ দীঘিতে ভাসন্ত কাঠের তক্তা ধরে, সেইটা নিয়ে ডুব দেবার জন্য শরীরের সব বলপ্রয়োগ করলেন। 

তিনি ডুব দিতেই দেখলেন সেই তক্তা, তার হাত ফস্কে, শেওলা মাটির একটা স্তুপে ধাক্কা দিল।  সংগে-সংগে, এক হলুদ বর্ণের ধাতুর চতুর্ভুজা দেবী প্রতিমা, মাটীর স্তূপ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলেন। তাঁর একটি হাত বরাভয় মুদ্রায় কিন্তু অন্য হাতগুলির মুষ্টি বন্ধ । এই জলের ভেতর অন্ধকারেও সেই মূর্তি  থেকে মাঝে, মাঝে, হাল্কা নীল রঙের আভা বেরিয়ে আসছে।   রঘুনাথ সাঁতরে সে’দিকে  এগোতেই দেখলেন সেই মূর্তি  তার হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিয়েছে।  এই মূর্তি হুবহু তাঁর কাল রাতের দেখা স্বপ্নের মূর্তি। 

জল থেকে বেরিয়ে, পাড়ে এসে, বড়ো দাদার হাতে সোনার বরন সেই মূর্তি দেখে, বাকি দু’ ভাই চমকে উঠলেন। তাঁরাও কালকে রাতে হুবহু  এই মূর্তি স্বপ্নে দেখেছিলেন।  সামু আর  দামুর মুখে পোড়ো মন্দিরের কথা শুনে, তিন ভাই স্থির করলেন যে  এই  মূর্তিকে আপাততঃ সেখানেই রাখা হোক। তাদের এক অনুচর এসে জানালো যে ঈদের আগের দিন কেল্লার ফটকে যে মধ্যবয়স্কা সুন্দরী গোয়ালিনী  ঘোল  বিক্রি করছিলেন, তাঁর মুখের সাথে দেই দেবীমূর্তির মুখের হুবহু মিল আছে। কথা শুনে সবাই চমকে উঠলেন। 

রাতে তিন ভাই স্বপ্নে আবার দেখেন, সদ্য পাওয়া সেই মূর্তি তাঁদেরকে বলছে “এই আমার আবাসস্থল। আমি এখানেই থাকবো। এইখানেই আছে আমার বাকী আভরন”।  

পরদিন সকালে, তিন ভাই আর সামু-দামুর পুরো দলবল,  অনেক খোঁজার পর জঙ্গলের মধ্যে একজায়গায়  এক সুড়ঙ্গ খুজে পায় । সুড়ঙ্গের মুখ, একটা বড় পাথর দিয়ে বন্ধ করা আছে। দিন গড়িয়ে সূর্য অস্তে গেলেন, কিন্তু সবাইয়ের সম্মিলিত চেষ্টাতেও সেই পাথরকে  একচুল সরাতে পারা গেলো না।

বিফল মনোরথ হয়ে তাঁরা মন্দির প্রাঙ্গণে ফিরে আসতেই দেখেন যে তাঁর গুপ্তচরেরা বনপথে আসছে। তাদের পেছনে, শিষ্য পরিবৃত স্বয়ং গুরুদেব, তাঁদের কুলপুরোহিত এবং গ্রামবাসীদের একটা দল আসছে 

রঘুনাথদের মুখে দীঘির জল থেকে দেবী উদ্ধারের কথা শুনে, গুরুদেব গম্ভীর ও চিন্তিতমুখে  বললেন, “ সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।  আমার ঝুলিতে পুজারতির সব সামগ্রী বার কর”।

আরতির দীপালোকে, দেবীকে দর্শন করে, গুরুদেব চমকে উঠলেন। আরতি শেষে, তিনি তিন ভাইকে ডেকে বললেন, “চতুর্ভুজা ঘোটকমুখি সিংহবাহিনী এই দেবী হচ্ছেন, দেবী ভুবনেশ্বরী । ইনি দুর্গম নামক অসুরকে বধ করে দুর্গা নামে খ্যাত হন। আমার বিশ্বাস  এঁর হাতের ধনুর্বাণ এবং অসি(তরোয়াল) ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে থাকবার প্রবল সম্ভাবনা। আমি আজ সারারাত দেবী ভুবনেশ্বরীর ধ্যান আরাধনা করবো। উনি পূজার্চনায় সন্তুষ্ট না হলে সুড়ঙ্গের মুখের পাথর  সরবে না। রঘুনাথ তুমি আমার পাশে বসে মন্ত্রোচ্চারণ করবে।” 

এর আগেই তাঁর চরেরা মুর্শিদাবাদের খবর এনেছে। কেল্লার কারাগার থেকে তাঁদের মুক্ত হবার পরদিনই অসুস্থ আলিবর্দির মৃত্যু হয়। নবাবী সিংহাসন “ চেহেল-এ-সুতুন” এ সিরাজ অভিষিক্ত হলেও, নবাবের বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রে মীরজাফর এখন খুব ব্যস্ত। 

রঘুনাথ বুঝে নিলেন যে মীরজাফরের কাছে এখন তাঁদের তিন ভাইকে সৈন্য পাঠিয়ে  ধরে আনা অনর্থক, অন্যদিকে এখনকার এই জায়গাটিও অবস্থানের জন্য মন্দ নয়। এইসাথে এইখানের স্থানীয় অসহায় মানুষদের ওপর  মারাঠি বর্গিদের অত্যাচার শুনে, তাঁর মনে বারবার আসছিল যে  তাঁর সমস্ত যুদ্ধশক্তি নিয়ে এদেরকে তিনি রক্ষা  করবেন।   

পরদিন সকালে, তিনভাই বা তাঁর অনুচরেরা সুড়ঙ্গের মুখে কোনো পাথর দেখতে পেলেন না। সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে তাঁরা ধনুর্বাণ, তরোয়াল এবং তালপাতায় দেবনাগরীতে লেখা দুটি পুঁথি উদ্ধার করে নিয়ে এলেন। 

রঘুনাথদের গুরুদেব আর পুরোহিত পুঁথি পড়ে রঘুনাথকে বললেন যে এই পুথিদুটিতে  দেবী পুজার পদ্ধতি এবং সমস্ত মন্ত্র লেখা আছে। ঠিক হল যে  মূর্তি শোধন এবং দেবী মন্দিরের সংস্কারের পর  চৈত্র মাসেই  দেবীর প্রতিষ্ঠা উৎসব করা হবে, ততদিন মন্দিরের পাশে বেলতলায় দেবীর নিত্যপুজা হবে।  

রঘুনাথ এখন এইখানেই অবস্থান করতে চান, এই কথা শুনে, সুদুর মুর্শিদাবাদ থেকে তাঁর সমস্ত প্রজারা  আসতে সুরু করল।  কিছুদিনের মধ্যেই ধংস্বস্তুপে পরিনত একদা বর্ধিষ্ণু গ্রামটি আবার ছন্দে ফিরে এল। 

রঘুনাথদের কথা  বিষ্ণুপুরের মল্লরাজের কানে গেল। রঘুনাথের সুনিপুন সেনাপরিচালনার কথা তিনি জানতেন।  রাজসভায় ডেকে তাঁদেরকে রাজমন্ত্রি নিযুক্ত করলেন।  তাঁদের তিনি দশটি গ্রাম দান করলেন এবং  বর্গি আক্রমন থেকে তাঁর রাজ্যকে রক্ষার ভার দিলেন। 

রঘুনাথের পরামর্শে, রাজ্যের সীমানায় তালগাছের চাইতেও উঁচু প্রহরী চৌকি তৈরি হল । চৌকি থেকে দূরে, মারাঠাদের অশ্বারোহী দেখা গেলেই, প্রহরীরা চারদিকে সঙ্কেত পাঠিয়ে  সব গ্রামকে সতর্ক করে দিত। ঝটিকা বাহিনী, গ্রামে-গ্রামে গিয়ে যুবকদের তীর-ধনুক, বল্লম, তরোয়াল, লাঠি আর হাতাহাতি সমরের সব কায়দা আর রনপা নিয়ে দ্রুত চলা শিখিয়ে প্রতিরোধ বাহিনী তৈরি করল।  প্রতিরোধ বাহিনী আর প্রহরী চৌকির যুগলবন্দিতে রসদ লুঠ করতে গিয়ে মারাঠা বাহিনী অনেক জায়গা থেকেই শূন্য হাতে ফিরে আসতে বাধ্য হল। খাদ্যের অভাবে এবার বর্গিরা দাঁইহাটে(বর্ধমান জেলার) ভাস্কর পন্ডিতের শিবিরে গিয়ে নালিশ জানাল। 

রঘুনাথের গুপ্তচরেরা খবর আনল যে বর্ষার পরে পরেই ভাস্কর পন্ডিত এক বিশাল বর্গিবাহিনী পাঠাচ্ছে, বিষ্ণুপুর মহারাজার কাছে চৌথ আদায় এবং অবাধে লুঠপাট করতে। মাত্র কয়েকমাস আগে, রাজমহল পাহাড়ের তেলিয়াগড় গিরিসঙ্কটের কাছে, সেই সময়ের নবাব বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি রঘুনাথের কাছে ভাস্কর পন্ডিত পরাজিত হয়ে কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। 

রসদ লুঠ করতে ব্যর্থ বর্গিদের শক্তিশালী বাহিনী যে এইদিকে একবার এসে বেশ জোর একটা আঘাত হানবে তা বিচক্ষণ রঘুনাথ আগেই আন্দাজ করেছিলেন।  তাঁর সেনাবাহিনী, কিভাবে  আক্রমন প্রতিরোধ করে মোক্ষম আঘাত হানবে, সে নিয়ে তিনি তাঁর তিব্বতি গুরু এবং দুই ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করে, সেই অনুযায়ী  তৈরি হচ্ছিলেন। 

মারাঠি বর্গিরা, ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঝড়ের গতিতে আক্রমণ করে আর এইখানেই তাঁর দুর্বলতা । তাঁর সেনারা মুলতঃ পদাতিক।  আর্থিক কারনে, মল্লরাজের  অশ্বারোহী বা গোলন্দাজ বাহিনী, মারাঠিদের তুলনায়, সংখ্যায় অনেকই কম। মারাঠিদের আক্রমণের গতির সাথে কিভাবে মোকাবেলা করা যায়, সেই নিয়ে রঘুনাথ এবং রুদ্রনাথ খুবই চিন্তিত ছিলেন । এমন সময় সামু আর দামু এসে জানালো যে মুখ্য কর্মকার একটি যন্ত্র বানিয়ে অস্ত্রাগারে তাঁদের প্রতীক্ষা করছে। 

মুখ্য কর্মকার একটি সরু নলের মত যন্ত্র নিয়ে এসেছে।  যন্ত্রটি আর তার গোলাগুলো  এতটাই হাল্কা যে  একজন গোলন্দাজ একাই এই কামান এবং তার গোলাগুলো বয়ে নিয়ে যেতে পারে।

রঘুনাথের কাছে অনুমতি নিয়ে, মুখ্য কর্মকার দ্রুত ওই যন্ত্রের পেটে কয়েকটা গোলা ঠেসে দিয়ে, নিজের কাঁধে যন্ত্রটি চেপে ধরে, তার তলায় একটা কলে চাপ দিতেই, প্রচন্ড শব্দে গোলা গিয়ে লাগলো অনেক দূরের লক্ষ্য বস্তুতে। কর্মকারের যন্ত্রের কাজ শেষ হতে না হতেই তার সহকারীর যন্ত্রে আবার গোলা বর্ষণ হল। 

রঘুনাথ আর রুদ্রনাথ যন্ত্রের কর্মক্ষমতা দেখে শুধু বিস্মিতই হলেন না কুশলী সমরনায়কের অভিজ্ঞতা থেকে চট করে বুঝে নিলেন, এই যুদ্ধে তাঁদের এই যন্ত্র আসলে ছোটো পাল্লার  হাল্কা কামান।  দুর্গম জায়গাতেও এগুলো সহজেই সেনারা নিজের নিজের কাঁধে করে নিয়ে যেতে পারবে। 

রঘুনাথ মুখ্য কর্মকারকে আদেশ দিলেন যত শীঘ্র সম্ভব এগুলো গোলা সমেত অনেক বেশি সংখ্যায় বানিয়ে  ফেলতে হবে আর সেই সাথে সামু আর  দামুকে বললেন কর্মকারের কামারশালায় দক্ষ সেনাদের লাগাতে যাতে করে  তারা এই নতুন অস্ত্র তৈরির সাথে সাথে চালানোও শিখে ফেলতে পারে।  

মাসখানেক পরে সেই রাতটা আশ্বিনের প্রথম অমাবস্যা। রাজ্যের কিছু প্রহরী চৌকি থেকে খবর এল যে তারা রাত্রে, মুন্ডেশ্বরী নদীর চরে অনেক কালো রঙের ঘোড়া আর লোকজনের আনাগোনা দেখেছে। গুপ্তচরেরা খবর আনল, প্রায় হাজার অশ্বারোহীর একটি বর্গি সেনার দল, মুন্ডেশ্বরী নদী পার করে চরের জঙ্গলে আত্মগোপন করে আছে। সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত নিজে এসেছেন এই দলের সাথে।  তাদের সাথে দুটি কামানের গাড়ির চাকা কাদায় আটকে যাওয়ায় তারা সেটাকে তুলে আনতে ব্যস্ত। 

রঘুনাথ বুঝে নিলেন যে এইবার ভাস্কর পণ্ডিতের দল, রাজধানী বিষ্ণুপুরকে কামান দিয়ে আক্রমণ করে, মল্লরাজ্য দখল করতে চাইছে। জয়পুরের জঙ্গল পেরিয়ে গেলেই, আড়াবনি আর রঘুপুরের জঙ্গলের লাল মাটির শক্ত জমি।  সেখান দিয়ে বিষ্ণুপুরের দিকে কামান নিয়ে যেতে অসুবিধে নেই আর এই জঙ্গলের পরেই, কামানের পাল্লার মধ্যে রাজধানী শহর এসে পড়বে।   রঘুনাথ তার গুরুদেব আর ভাইদের সাথে পরামর্শ করে আড়াবনির শাল জঙ্গলের কাছেই, বর্গিদের সাথে লড়াইয়ের সমরপরিকল্পনা করলেন। 

আড়াবনির শাল জঙ্গলে, শালগাছের মাঝে অনেক লম্বা তালগাছও আছে। প্রতিটি তালগাছে দু- তিনজন সেনা থাকবে সদ্য আবিষ্কৃত হাল্কা কামান নিয়ে অতর্কিতে গোলাবর্ষণের জন্য। এছাড়াও তাঁদেরকে সহায়তা করবে নিচে অশ্বারোহী সেনারা যারা তীর-ধনুক, আর তরোয়াল দুটোতেই সমান দক্ষ। তবে তাদের সাথে থাকবে সাধারন তীরের সাথে সাথে বেশ কিছু অন্য রকমের তীর।  এদের মাথায় তীরের শলাকার সাথে থাকবে তিব্বতি গুরুর তৈরি বিশেষ ধরনের আগুনে বোমা ।  এছাড়াও শুরুতেই থাকবে এক বিশেষ যুদ্ধ কৌশল যার কাছে শুরুতেই ভাস্কর পন্ডিতের দলবল নাস্তানাবুদ হয়ে গেল । 

আশ্বিনের অমাবস্যা কেটে যাবার পর আজ সপ্তমী তিথি। আড়াবনি জঙ্গলের চৌকি থেকে সঙ্কেত এলো, গভীর রাতে চাঁদের অস্পষ্ট আলোতে দেখা গেছে যে কামানের গাড়ি সমেত বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী জয়পুরের জঙ্গলের প্রায় শেষ সীমানায়। জংগলের মাঝে  গ্রামগুলোতে তারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আগুনের শিখাতে বর্গিবাহিনিকে আরও স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে। 

জয়পুরের পর, আড়াবনীর জঙ্গলের মধ্যে, কাঠুরিয়াদের গরুর গাড়ি আসা যাওয়ার ফলে তৈরি শক্ত লালমাটির রাস্তাতেই যে এরা বিষ্ণুপুরের দিকে এগোবে, সে নিয়ে রঘুনাথ নিশ্চিত ছিলেন। এই জঙ্গলে রঘুনাথের সৈন্যবাহিনীর যার যেখানে  থাকবার তারা সেখানে মোতায়েন আগের থেকেই ছিল। 

গুরুর এবং দেবী ভুবনেশ্বরীর আশীর্বাদ নিয়ে  তিন ভাইই  সেনাদের পাশে থেকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য রণাঙ্গনে  যাত্রা করলেন। সেদিন আশ্বিন মাসের  অষ্টমী তিথি ।  তাঁদের তিনভায়ের  অনেক আগে-আগে চলল জ্বালানি কাঠ আর জঙ্গলের কাটা ঘাসে বোঝাই প্রায় একশোর  ওপর গরুর গাড়ি। 

মুন্ডেশ্বরী নদী পার করে, বিষ্ণুপুর রাজ্যে ঢুকে, কোথাও  রাজার পক্ষ থেকে কোনো বাধা না পেয়ে, ভাস্কর পন্ডিতের দল হৈ- হৈ করতে করতে এগিয়ে চলেছে আড়াবনির জঙ্গুলে রাস্তায়। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে তারা দেখে, উল্টোদিক থেকে একসাথে অনেক ছই লাগানো কাঠবোঝাই গরুর গাড়ি  তাদের মুখোমুখি হচ্ছে।

বর্গিদের অশ্বারোহীরা তাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, “ বর্গী বাহিনী আসছে এই পথে। তোরা ভালো চাস তো এখুনি সবাই রাস্তা থেকে গাড়ীগুলো সরিয়ে নে”। 

“ বর্গি? ওরে বাবা! আমরা গরীব কাঠুরিয়ারা,কাঠ নিয়ে হাটে যাচ্ছিলাম। আমাদের দোষ নিও না । আমরা এখনি রাস্তা থেকে গাড়িগুলো সরিয়ে নিচ্ছি, আমাদের প্রানে মেরো না” বর্গীর দল আসছে শুনে, বাকী গাড়িগুলোর গাড়োয়ানদের মধ্যে হুলুস্থুলু পড়ে গেল। গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে, সবাই রাস্তা থেকে গাড়ীগুলো যে যেদিকে পারে সেদিকে সরিয়ে নিল। 

এই সব দেখে  বর্গিরা হাসাহাসি করতে শুরু করে দিলে। আর সেই হাসাহাসির মধ্যে ওরা কেউ লক্ষ্যই করল না যে গাড়িগুলো জঙ্গলের মধ্যে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। সবকটা   ছই লাগানো গাড়ির মুখ এখন পেছন দিকে ঘোরান আর প্রতিটা থেকে বেরিয়ে আসছে তিন চারটে ধাতব নল আর সেগুলো তাক করে লাগানো আছে বর্গিদের দিকে। 

বর্গিদের হাসাহাসির মধ্যেই, গরুর গাড়িগুলো থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। সেই সাথে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা তীরন্দাজেরা, তাদের তীরের আগায় লাগান বোমের লম্বা সলতেয় আগুন লাগিয়ে, সেগুলো ধনুক থেকে ছেড়ে দিল। ঘোড়ার দল এই অনভস্ত্য আওয়াজ আর আলোতে ভয় পেয়ে গেল। তার ওপর গুলিতে কিছু বর্গি সেনা আর তাঁদের ঘোড়া আহত হতেই সব ঘোড়াগুলো একসাথে বিদ্রোহ করল। তারা চিৎকার করে পিছু হটা শুরু করতেই, একে-অন্যের গায়ে পড়ে এক চরম হুটোপাটির অবস্থা শুরু হল। রঘুনাথের তীরন্দাজেরা এবার বর্ষাকালের বৃষ্টির মতো তীর ছোঁড়া শুরু করতেই বর্গি সেনারা অনেকেই ঘায়েল হল। 

কিছু একটা হামলা হয়েছে আন্দাজ করে, এই দলের পেছনে যে দলটা ছিল, তাঁরা দ্রুত এগিয়ে এলো। কিন্তু শাল জঙ্গলের মাঝে- মাঝে  থাকা তালগাছের মাথায় রঘুনাথের যে সেনারা ছিল, তারা এবার  ছোট কামান থেকে গুলি আর ধনুক থেকে ছোড়া তীরবোমা ছেড়ে দিতেই, সেই সেনাদের মধ্যেও হুলুস্থলু বেধে গেল আর সেই সুযোগ কাজে লাগাতে রঘুনাথের তীরন্দাজ আর অশ্বারোহীরা দেরি করল না। 

বর্গিদের হতাহতের সংখ্যা বাড়তেই, ভাস্কর পণ্ডিতের টনক নড়ে উঠল। রঘুনাথের সেনাবাহিনীর রণকৌশল বুঝে নিয়ে, তিনি তার পদাতিকদের, বনের রাস্তা ছেড়ে  শালজঙ্গলের দিকে চুপি- চুপি এগিয়ে আক্রমন করতে বললেন আর সেইসাথে গোলন্দাজদের  হুকুম দিলেন, সব কটা তালগাছের মাথায় গোলা ফেলতে। বর্গি সেনাদের অনুপ্রানিত করতে, নিজে তরোয়াল আর বল্লম হাতে এগিয়ে গেলেন সামনে থেকে নেতৃত্ব করতে। 

শালজঙ্গলে সুরু হয়ে গেল দুই পক্ষের হাতাহাতি লড়াই। তিব্বতি গুরুর কাছে শেখা বিদ্যেয় রঘুনাথের সেনারা বর্গিদের অনেককে ঘায়েল করলেও  নিজেদের ও হতাহতের সংখ্যা কম হল না। রঘুনাথ তীরবেগে তার অশ্বারোহীদের নিয়ে বর্গিদের কামানগুলো দখল করে নিলেন কিন্তু তখন তাঁকে বর্গিরা পুরো ঘিরে ধরেছে। অকুতোভয় রঘুনাথ এবং তার সেনারা “জয় মা ভুবনেশ্বরী” বলে বর্গিদের ওপর হামলা শুরু করে দিলেন। সেই সময় দেখা গেল, ঘোড়ার পিঠে চড়ে  এক তেজস্বিনী দেবী, একহাতে খড়্গ আর অন্যহাতে বল্লম নিয়ে প্রবল বেগে এগিয়ে আসছেন আর সামনে যে বর্গিরা পড়ছে তাদের শিরশ্ছেদ করছেন কিম্বা বল্লম দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছেন। বর্গিরা সেই আক্রমণ দেখে  ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারে সেদিকে পালাতে শুরু করলে। ভাস্করবর্মা সেই দেবীকে দেখে, তাঁকে প্রণাম করে দ্রুত রনাঙ্গন ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।  

রঘুনাথ আর তিন ভাই বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে দেখলেন যে  এই দেবী  আর রঘুনাথ দীঘি থেকে যে দেবীমূর্তি এনেছেন তা হুবহু এক। ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে অস্ত্রত্যাগ করে সাষ্টাঙ্গ প্রনাম করে মাথা তুলে তাঁরা তিনজনেই দেবীকে আর দেখতে পেলেন না। 

রণাঙ্গন থেকে ফিরে তাঁরা প্রথমেই গেলেন গুরুর কাছে। তিব্বতি গুরু তাঁদের শরীরে  যুদ্ধ ক্ষতের শুশ্রূষা করতে করতে বললেন স্বয়ং দেবী ভুবনেশ্বরী এসে বর্গি নিধন করেছেন এবং যে সময়ে রণাঙ্গনে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল, সেটি হল অষ্টমী এবং নবমী তিথির সন্ধিক্ষণ।

বিষ্ণুপুর মহারাজ মল্লদেব, তাঁদের এই জয়ে খুসি হয়ে রঘুনাথকে রাজা উপাধি দিয়ে তামার সনদ দিলেন।  তাঁদেরকে আরো দশটি গ্রাম দিয়ে, গড় বানানোর এবং কামান বসানোর অনুমতি দিলেন। গড় তৈরি শেষ হতে, লোকমুখে এই গ্রামের নাম হয়ে গেল গড়বাড়ি আর সেই থেকে হয়ে আসছে এইখানে দুর্গাপুজো। যে মারাঠারা যুদ্ধবন্দী হয়েছিল তারা  আর না ফিরে যেতে চাওয়ায় এইখানেই থেকে যায়। তাদের পাড়ার নাম মারাঠা পাড়া বা লোকমুখে মাঠাপাড়া। নবমীর দিন রাজা রঘুনাথ মারাঠা বর্গিদের পরাস্ত করেছিলেন বলে আজও দুর্গানবমীর দিন বিজয়োৎসব পালিত হয়। মারাঠাপাড়ার লোকদের সাথে আজও সেই যুদ্ধ খেলা হয়”।  

রিয়া বলে, “ আর সেই দীঘি থেকে পাওয়া দেবী মূর্তি । সেই মূর্তি তো ধাতুর। সেই মূর্তি এখন কোথায়”?

“ দুর্গাদালানে যে দুর্গা মূর্তি  দেখতে পাওয়া যাবে তিনি মৃন্ময়ী মা।  শুদ্ধ মাটি দিয়ে বানানো এই দুর্গামূর্তি ধাতুর চতুর্ভুজা মূর্তিরই হুবহু অনুরূপ। ধাতুর মূর্তিটি আছে এখান থেকে সামান্য দূরে শাল জঙ্গলে ঘেরা পুরানো মন্দিরে। একই সাথে দুই মূর্তিরই পুজো হয় তবে সন্ধিক্ষণে রাজ-রক্ত দিয়ে পুজো হয় জঙ্গল মহালের মন্দিরে”।

রিয়া অবাক হয়ে বলে, “ তার মানে? কার রক্ত?”

নন্দিতা হাসতে হাসতে বলে “ সন্ধিপুজোতে বাবা, কাকা, জ্যাঠা এরা সবাই আঙ্গুল চিরে রক্ত দেন অকাতরে। একসময়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বর্গি আক্রমণ থেকে সাধারন মানুষকে বাঁচাতে অনেক রক্ত দিয়েছিলেন” । 

সূর্য অস্ত যাচ্ছেন দুরের নীল পদ্মদিঘির জলে। অন্যদিকে জঙ্গল মহালে ইতিহাস-প্রাচীন দুর্গামন্দিরে আর গড়বাড়ির নাটমন্দিরে একে একে ঝাড়বাতিগুলো জ্বলে উঠছে। ঢাক, সানাই আর তিব্বতি গোম্ফার ঢোল বেজে উঠতেই নন্দিতা বলে,” চল রিয়া, বিল্ববরন শুরু হবে। এরপর রানীমা আমাদের সবাইকে মুর্শিদাবাদ থেকে আসা তাঁতিদের হাতে এখানে বোনা সিল্ক শাড়ী আর তাঁর নিজের হাতে  শুকানো শিউলি ফুল দিয়ে রঙ করা আমাদের সবাইকে দেবেন”।

রিয়া অবাক হয়, “ রানীমা কে?”

নন্দিতা  বলে “ কুচবিহার রাজবংশের প্রাক্তন রাজকুমারী, আমাদের ঠাকুমা এখন রানীমা। পুজোর কটা দিন আমরা সবাই তাঁকে রানীমা বলি আর তিনি দেরি একদম বরদাস্ত করেন না”। 

হাসতে হাসতে রিয়া বলে, “ জো আজ্ঞা, ইঅর হাইনেস প্রিন্সেস নন্দিতা”। 

(*এটি একটি গল্প- কাহিনী মাত্র যার সাথে ইতিহাসের কোনো যোগাযোগ নেই।  এর কোনো চরিত্রের সাথে, কোনো রাজবংশের লোককথার সাথে সাদৃশ্য থাকলে সেটি কাকতালীয় মাত্র।) 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics