Sarajit Mondal

Fantasy

2  

Sarajit Mondal

Fantasy

পাঠশালার প্রাথমিক প্রথম পথ

পাঠশালার প্রাথমিক প্রথম পথ

8 mins
374


শুচিস্মিতা ওরফে শুচি আমাদের বড় আদরের মেয়ে । ওর বয়স সাত । ক্লাস ওয়ানে পড়ে ।

শুচি যখন যা চায় তখুনি তা ওকে দিই । এইমাত্র ওকে আমার মারুতি কারে করে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এলাম । ওর পড়াশুনার জন্য অসম্ভব খরচ ও রীতিনীতি দেখে আমার মনে হল আমি এখন তো ইঞ্জিনীয়ার হয়েছি । কিন্তু আমাদের পড়াশুনা তো এরকম খরচের বা তদারকির ছিল না ? তাহলে কেন ওদের পড়াশুনার জন্য এখন এত খরচ হয় বা লেখাপড়ার প্রচণ্ড চাপে থাকতে হয় ? আমার এ প্রশ্ন হঠাৎ মনকে রাজি করাল, আমার পাঠশালার প্রাথমিক প্রথম পথ নিয়ে কিছু লিখতে যা কখনো সময় পেলে ওকে পড়িয়ে শোনানো যেতে পারে । আমি সুনিশ্চিত তা ওকে নিশ্চয় অনেক শিক্ষা দেবে । সুতারং, আর দেরি না করে লিখেই ফেলি না ?


*** *** ***

আমার বয়স তখন কত আর হবে ? চার বা পাঁচ বছর ।

বেশ চলছিল মায়ের সাথে হেসে খেলে সেই দিনগুলো । হঠাৎ মা একদিন বলল, তোকে স্কুলে যেতে হবে ।

আমি বললাম, স্কুল ! সে আবার কী ?

- গেলেই বুঝবি । কাল সকালবেলা তোর দাদার সাথে স্কুলে যাবি ।

- না, তুমি বল, স্কুলে গেলে কী হবে ?

- বড় লজেন্স দেব ।

- ঠিক আছে যাব । লজেন্স দেবে কিন্তু ?


পরের দিন সকালবেলায় দাদার সাথে স্কুলে গেলাম, আর সেই স্কুলে যেই দাদা এক ঘরে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল অমনি আমার সে কি কান্না ।

পরদিন আর স্কুলে যাওয়ার নাম করিনি । কিন্তু আমি যাব না বললে কি হবে, দাদা আর তার বন্ধু আমাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যেতে লাগল । আমার কান্না তো আছেই সঙ্গে মাথায় বুদ্ধিও খেলতে লাগল । কিছুক্ষণ চুপ করে আরামে ওদের দোলা খেয়ে যেতে লাগলাম । তারপর, যেই স্কুলের কাছাকাছি এসেছি, অমনি হঠাৎ এক ঝটকায় তাদের হাত হতে মুক্ত হলাম আর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার লাল ধুলো গোটা গায়ে মেখে নিলাম । ব্যস, জামা নোংরা হয়ে গেছে । এবার আর ওরা আমাকে নিয়ে যেতে সাহস পেল না ।

মুক্তি পেয়েই সোজা দৌড়ে বাড়ি ফিরে এলাম মায়ের কাছে ।

মা মারল এবং বলল স্কুলে না গেলে আমাকে নাকি বাড়ির সব কাজ করতে হবে ।

আমি বললাম, তাতেও রাজি ।

মা সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির সব এঁটো বাসন আমায় পুকুরের জলে ধুয়ে আনতে বলল । আমি মহানন্দে তা করতে এগিয়ে এলাম । মা, তা দেখে অবাক হয়েও দূর্বল না হয়ে বেশ কিছু বাসন দিল এবং আমি তা সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে এনে দিলাম । কিন্তু বেশ কষ্ট হল । তার পরের দিনই মাকে বললাম, স্কুলে যাব । মা খুশি হয়ে আমাকে সাজিয়ে দিল আর আমি স্কুলে গেলাম । কিন্তু স্কুল ঘরে গিয়ে যেই মাষ্টারমশাইকে দেখলাম, অমনি আমার খুব ভয় হল । একেবারে প্যান্টে পেচ্ছাব করার মতো অবস্থা । সুতরাং, যেই মাষ্টারমশাই একটু চোখের বাহির হলেন অমনি দে ছুট । একদম পিছনে না তাকিয়ে সোজা ঘর ।

মা’র বকুনি বা মার আমার কাছে অনেক শ্রেয় মনে হল, তবুও স্কুলে আর কোনমতেই যাওয়া নয় ঠিক করে নিলাম ।

পরের দিন, স্কুলে যাওয়ার সময় হাওয়া হলাম । পকুর পার হয়ে সোজা শুকনো ক্ষেতের মাঠে। সেখানে বিধান কাকা গরু চরাচ্ছিল । আমাকে দেখে বলল, কি রে ! তুই এখানে ?

- কাকা, মা আমাকে স্কুলে পাঠাতে চায় । আমি স্কুলে যাব না ।

- ইস্কুলে আবার কেউ যায় নাকি ? এই দেখ না, আমি যাইনি । ভালই গরু চরাচ্ছি । তুই আমার কাছে থাক ’খন । তোকে আমি গুড়পিঠা দেব আর গল্প বলব । -বলেই কাকা আমাকে একটা পিঠে দিল । যেটা খেয়ে আমি ঠিকই করে নিলাম, আমিও কাকার সাথে রোজ গরু চরাব এবং এই সব খেয়ে বেড়াব ।

গরু চরাতে চরাতে কাকা আমাকে বলেছিল, কিভাবে ও অণুদের কুকুরটাকে বশ করেছিল । কাকা নাকি ওকে স্রেফ গুড়মুড়ি খাইয়েছিল । ব্যস, তারপর থেকেই কুত্তাটা সবকিছু ভুলে গেল । তখন থেকেই নাকি ওটা কাকার কাছেই থাকে । ওই তো ওখানে ঘে-উ ঘেউ করছে, ওর নামে বলছি বলে । বাহ্‌ ! বেশ মজার কুকুর তো ?

সেদিন দূপুরবেলা ওই কাকার সাথে বাড়ি ফিরলাম । মা আমাকে পেয়ে বকল না, বরং অনেক আদর করল । আমারও খুব ভালো লাগল ।

পরেরদিন স্কুলের সময় যেই হবে, পালাব পালাব করছি, অমনি দাদা আমাকে খপ করে ধরে ফেলল আর তারপর সাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে স্কুলে নিয়ে এল । তখন অবশ্য জানতাম না যে, ক্যারিয়ারে বসিয়ে দাদা আমার ক্যারিয়ার গড়তে নিয়ে যাচ্ছে । তাই দাদার ওপর খুবই রেগে গেলাম ।

স্কুলঘরে ঢুকে সবার অজান্তে বসার বেঞ্চের নিচে লুকিয়ে পড়লাম । মাষ্টারমশাই ক্লাসে ঢুকেই সোজা আমার কাছে এসে কানে ধরে হিড় হিড় করে বের করে নিয়ে তাঁর সামনে বসালেন । আমি ভয়ে কাঁপছি । সবাই তা দেখে খুব মজা পাচ্ছিল । আমার খুব রাগ হল । শিক্ষকমশাই যেই ক্লাস থেকে বের হলেন, অমনি যথারীতি মা আমাকে বাড়িতে পেয়ে গেল ।

পরদিন আবার জোর করে স্কুলে যেতে হল আর এদিন বিদ্যালয়ের দেওয়ালের পিছনে লুকিয়ে থেকে আমার স্কুল হল । কেউ জানতে পারল না । তবে মা জানতে পারল । কারণ, ছুটির সময়ের আগেই স্কুল থেকে ঘরে পৌঁছে যাওয়ার জন্য ।

একদিন স্কুল থেকে জটাধারী সন্ন্যাসী হয়ে বাড়ি ফিরলাম । আমার সর্দি করেছিল । ফলে যত কফ নাক দিয়ে বের হত সব মাথায় মুছে রাখতাম । তা দেখে পঙ্কজ মাষ্টারমশাই তো আমাকে এমন বকল, যে, আমার ম্যাজিক কাজ করে ফেলল । আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল ।

আর একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলাম পুরো ন্যাংটো হয়ে । মা বলল, কী ব্যাপার । আমি বললাম, কী আর । ঢোলা প্যান্ট পরিয়েছিলে । ওটা স্কুলের ক্লাসে পড়ে রয়েছে । সবাই হাসছিল । তাই আমি পালিয়ে এলাম । মা শুনে খুব হেসেছিল ।

এরকম আরও কতরকম ভাবে যে স্কুলে না গিয়ে কাটিয়েছি মনে নেই । তবে একথা মনে আছে যে সারাদিন গাছেই কাটিয়েছি এক একদিন ।

এ পর্যন্ত আমার কাছে প্রাইমারি কথার অর্থ ছিল ‘প্রায় ফাঁকিমারি’ । কিন্তু না, সবদিন এভাবে চলতে পারে না । এইভেবে একদিন হঠাৎ ঠিক করলাম, আজ স্কুলে ঠিকমতো যাব । যেই ভাবনা সেই কাজ । কোথা থেকে মনের জোর পেলাম জানি না, সোজা স্কুলঘরে গিয়ে বসলাম এবং পড়াও দিলাম । আর সবাইকে আশ্চর্য করে পড়া একেবারে সঠিক বলে দিলাম ।

এই ছিল আমার স্কুলে প্রথমদিন ঠিকমতো ক্লাস করার ইতিহাস ।


গ্রামের স্কুলে তখনকার দিনে কেউ কাউকে ভর্তি করাতো না । এমনি স্কুলে নিজে নিজে কয়েকদিন গিয়ে বসতে হত আর মাষ্টারমশাই একদিন বলে দিতেন, তুমি ক্লাস ওয়ানে । তখন তো আর এখনকার মতো প্রি-প্রাইমারি ছিল না ?

তবে আমরা স্কুলে যেতে খুব মজা করতাম । যেমন, স্কুল পূর্বদিকে, কিন্তু আমরা বন্ধুরা ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমে পশ্চিমে যেতাম, তারপর কিছুদূর গিয়ে ডাইনে বা বাঁয়ে মুড়তে মুড়তে খেলতে খেলতে ওই স্কুলে পৌঁছাতাম ।

আমার এও মনে আছে যে, একদিন আমরা তিন-চার বন্ধু হঠাৎ ঠিক করলাম, এই স্কুল না, পাশের গ্রামের অন্য স্কুলে চলে যাই । বেশ, যেই ভাবা সেই কাজ । আমরা হঠাৎ চার বন্ধু বই খাতা হাতে স্কুল চলাকালীন অবস্থায় সবাইকে থ’ বানিয়ে বেরিয়ে গেলাম । মাষ্টারমশাইরা কিছু বোঝার আগেই আমরা দে ছুট ।

তারপর, ওই অবস্থায় অন্য স্কুলে গিয়ে পৌঁছাই । সেই স্কুলের শিক্ষক ও ছেলেমেয়েরা আমাদের পেয়ে খুব খুশি হয়ে বসতে জায়গা দেয় ।

পরে এই স্কুলই হয় আমার স্থায়ী প্রাইমারি স্কুল । নাম-মঙ্গলবাঁন্দী ২ নম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয় । এই স্কুলে থাকাকালীন সময়ে যে আমি একেবারে রাতারাতি পাল্টে ভাল হয়ে গেলাম তা নয় । এখানেও নানারকম ফাঁকিবাজি চলতে লাগল ।

একদিন আমরা তিন বন্ধু স্কুলে যাওয়ার পথে হঠাৎ ঠিক করলাম, আজ স্কুলে যাব না । কিন্তু কীভাবে ঘরে স্কুলে না যাওয়ার কারণ বলি তা ভেবে পাচ্ছিলাম না । হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি এল । সামনের জলের নালায় লাফ মারলাম । জামা প্যান্ট ভিজে গেল । অন্য বন্ধুদেরও বললাম, জলে লাফ মারতে । ওরাও ধপাধপ জলে পড়ে গেল । ব্যস, আমাদের সবার জামাপ্যান্ট জলে ভিজা আর কাদা মাখানো ।

আমরা বাড়ি ফিরে সবাই একই কথা বলেছিলাম । ‘বৃষ্টির জলে রাস্তা কাদায় পিচ্ছিল হয়ে পড়ায় পা পিছলে পড়ে গেছি । স্কুলে যাব কি করে ?’ সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল বলেই আমরা এই ফন্দি করেছিলাম আর আমাদের মা-বাবাও কথাটা মেনে নিয়েছিল ।

আমরা নাকি ক্লাস ওয়ানে পড়ি তখন । অবশ্য আমরা তিন-চার বন্ধু সেটা জানতামও না আর মানতামও না । আমরা তো স্কুলে যাওয়ার নাম করে এর গাছে পেয়ারা চুরি ওর গাছে আম চুরি এসবই করে বেড়াতাম । একদিন তা ক্রীষ্ট মাষ্টারমশাই জেনে গেলেন আর আমরা যখন আম গাছে তখন গাছের তলায় কাঁটা গাছ ফেলে দিলেন । আমরা তো কিছুক্ষণ গাছেই রইলাম । মাষ্টারমশাই কিছু সময় অপেক্ষা করে স্কুলে শাস্তি দেবে বলে চলে গেলেন ।

আমরা গাছ থেকে নেমে ঘরের সামনের মাঠে ফুটবল খেলে স্কুলের ছুটির সময় বাড়ি ফিরলাম।

ক্রীষ্ট মাষ্টারমশাইয়ের ভয়ে পরেরদিন স্কুলে যাইনি । মায়ের কাছ হতে দূরে দূরে আছি । মা বংশী কাকুকে বলল, আমাকে ধরে দিতে । বংশী কাকু যেই সামনে এল আমাকে ধরতে অমনি আমি তার ধুতি টেনে খুলে দিলাম । কাকু ধুতি ধরে আবার পরছে আর আমি সেই সুযোগে ছুটে পালালাম ।

একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে জানতে পারলাম, মঙ্গলবাঁন্দীর ক্লাবের সাথে চাঁদমুড়ার ফুটবল খেলা আছে । ব্যস, আমি, খোকন ও রবি বইখাতা ঝোপে লুকিয়ে ফেলে, দিলাম দৌড় । আমরা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছুটছি তো ছুটছিই । রাস্তা আর শেষ হয় না । খেলা বোধহয় এতক্ষণ শুরু হয়ে গেছে । আরও জোরে দৌড়, দৌড় ।

কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো জঙ্গল পার হয়ে খেলার মাঠে পৌঁছালাম । খেলা সত্যি শুরু হয়ে গেছে । মঙ্গলবাঁন্দী এক গোলে পিছনে । মন খুব খারাপ হল । খেলার মাঠের বাইরের লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জোরে চেঁচাতে লাগলাম আর যখনই বল চাঁদমুড়ার গোল পোষ্টের কাছে আসতে লাগল, তখন আমার পা সামনের দিকে ছুঁড়তে লাগলাম । যেন আমিই খেলছি । আমার সামনের ছেলেটা তো আমার লাথি বেশ কয়েকবার খেয়ে তেড়ে এল আমাকে মারতে । আমি সে জায়গা ছেড়ে আবার অন্য জায়গাতে গিয়ে চেঁচাতে লাগলাম ।


একদিন প্রভাত মাষ্টারমশাই বললেন, ক্লাস টু-তে ওঠার আগেই ধারাপাত শেষ করতে হবে । ধারাপাত বই বের কর ।

আমি দেখলাম, বইটা আনা হয়নি । ঘরে রয়ে গেছে ।

বললাম, বই ঘরে রয়ে গেছে । ভুলে গেছি আনতে ।

তখন মাষ্টারমশাই মুখ ভেংচে বললেন, ভুলে গেছি । খেতে ভুলে যাস ?

আমি বললাম, হ্যাঁ ।

মাষ্টারমশাই আমার কথা শুনে তো অবাক ! বলে তাই নাকি ?

আমি বললাম, হ্যাঁ, ঘরে খাবার ছিল না ।

মাষ্টারমশাই আমার কথা বিশ্বাস করেছিলেন । বিশ্বাস করার কারণও ছিল । কেননা, কাল যখন আমাদের ক্লাসের সুজল মান্ডি মাষ্টমশাইকে বলেছিল সে হাঁড়িয়া খেয়ে এসেছে তখন মাষ্টারমশাই তাঁকে মেরেছিলেন ঠিকই তবে পরে যখন জেনেছিলেন সুজলদের ঘরে হাঁড়িয়া (মদ) ছাড়া আর অন্য কিছু ছিল না খাবার মত তখন দুঃখ করে ক্ষমা চেয়েছিলেন ।

তাই আজ আমার কথায় বললেন, সরি । জানি, তোমরা অনেকে গরিব । কিছু মনে কর না।

মাষ্টমশাই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলেন । হয়তো মনে কষ্টও পেয়েছিলেন খুব । তা দেখে-শুনে আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম, জীবনে আর মিথ্যা কথা বলব না ।

----------------------------------------------------------------------------------


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Fantasy