Sarajit Mondal

Classics

2  

Sarajit Mondal

Classics

বড়মাষ্টমশাই

বড়মাষ্টমশাই

12 mins
670


প্রি-প্রাইমারি তো তখন ছিল না ? তাই, আমাকে, সংখ্যাতত্ত্বের নিয়ম অনুযায়ী ক্লাস ওয়ানে খেলার ছলে মা সরস্বতীর সাথে যোগ দিতে হয়েছিল ।

ক্লাস ওয়ানে যখন ছিলাম, স্কুল মানে কিছুই জানতাম না । স্কুলে তো তখন থাকতামই না । পরে যখন ধীরে ধীরে স্কুলে সময় দিতে লাগলাম, তখন আস্তে আস্তে স্কুলে আসার মজা পেতে লাগলাম । স্কুলের নিয়ম শৃঙ্খলা এত বেশি ভালো লাগতে লাগল, যে, স্কুল না এলেই আমার খারাপ লাগত ।

ঠিক এই সময় সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক, বড়মাষ্টারমহাশয়ের সান্নিধ্যে এলাম । উনাকে ছাত্রছাত্রীরা সবাই বড়মাষ্টমশাই আর গ্রামের লোকের অনেকেই বুড়ামাষ্টার বলত.

বড়মাষ্টমশাই বয়সে তখন প্রৌঢ় । তবে তখনো তার স্বাস্থ্য ছিল খুবই ভালো আর গায়ের রং ছিল বেশ ফর্সা।

তাঁকে দেখে স্কুলের সব মাষ্টমশাইরা ভয় পেতেন আর শ্রদ্ধা করতেন । তার জীবনটাই ছিল একটা আদর্শের উদাহরণ ।

তাঁর পোষাক বলতে মাত্র একটা ধুতি । গায়ে জামা নেই । ধুতির পরা অংশ বাদে বাকি কিছুটা গায়ে ফেলা থাকত । ঠিক শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের মতো ।

পরে জেনেছি, মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত থাকতেন তিনি । অবশ্য তাঁর কাজকর্মও তাই বলত।

শুনেছিলাম, এই বড়মাষ্টমশাই নাকি মাত্র ক্লাস সিক্স পাশ ছিলেন । কিন্তু তাঁর নিয়ম শৃঙ্খলা আদর্শ, জীবন ও যোগ্যতা ছিল অনেক অনেক বেশি । অনুপ্রাণিত হওয়ার মতো ।

বড়মাষ্টমশাইয়ের ঘর ছিল অনেক দূরে । তাই তিনি স্কুলেই থাকতেন । সারা দিনরাত । স্কুলকেই তিনি ঘর হিসেবে মেনে নিয়ে চারদিকে অনেক গাছপালা লাগিয়েছিলেন । বাগান করেছিলেন । আর আমাদেরকেও বাগান করার জায়গা দিয়ে গাছ লাগানো করাতেন । আমরা ক্লাস ওয়ান, টু, থ্রী ও ফোর-এর সব ছেলেমেয়েরা ক্লাস অনুযায়ী চারটে বাগান করেছিলাম । সেখানে কত ফুল ও ফলের গাছ লাগানো হোত । গাছের ফুল কেউ ছিঁড়ত না । গাছে খাবারের ফল হলে কেউ তুলত না । বড়মাষ্টমশাই যেদিন বলতেন সেদিন ফল তোলা হোত আর কেটে কেটে সবাইকে একটু হলেও দেওয়া হোত । গাছের যে প্রাণ আছে তা তখুনি আমরা বুঝে গেছিলাম । আর সেজন্য গাছের ফুল ও ফল তোলার আগে আমরা গাছকে পুজো করতাম ।

পরে বড় হয়ে জানতে পারি, আমাদের বিজ্ঞানী শ্রী জগদীশচন্দ্র বোসের অনবদ্য আবিষ্কার “গাছের প্রাণ আছে”, তত্ত্বের কথা ।

একবার আমার বন্ধু ত্রিভঙ্গ, যে স্কুলে একদিন বলেছিল নাকের কাজ কফ বেরোনো, ভীষণ মার খেয়েছিল এই বড়মাষ্টমশাইয়ের হাতেই । ব্যাপারটা হয়েছিল কী, আমরা তখন তৃতীয় শ্রেণীতে । ত্রিভঙ্গ আমাদের ক্লাসেরই । একদিন বিকেলবেলায় ত্রিভঙ্গ স্কুলে এসে চুপিচুপি চতুর্থ শ্রেণীর বাগানে ঢুকে বেশ কিছু বাচ্চা গাঁদাফুলের গাছ ব্লেড দিয়ে কচ কচ করে কেটে দিয়েছিল । ক্লাস ফোরের দীপক তা দেখে ফেলেছিল । সুতরাং, পরের দিন তা বড়মাষ্টমশাইকে বলে দিল । ব্যস, বড়মাষ্টমশাই ত্রিভঙ্গকে এমন পিটূনি দিয়েছিলেন যে, তারপর তিনদিন ত্রিভঙ্গ স্কুলেই আসেনি । সেদিনিই জেনেছিলাম, বড়মাষ্টমশাইয়ের মার কাকে বলে । সেই ভয়ে আমি জ্ঞানত এই স্কুলে তারপর কোনদিন কোন অন্যায় করার সাহস পাইনি ।


বড়মাষ্টমশাই, প্রতি ক্লাসের দেওয়ালে দেওয়ালে স্মরণীয় মহাপুরুষ ও স্মরণীয়া মহীয়সীদের ছবি আটকে রাখতেন । মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সুভাষচন্দ্র বোস, শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদাময়ী দেবী ও জগদীশচন্দ্র বোসের ছবি দেওয়ালে টাঙানো থাকত । আমরা ওই ছবিগুলোকে তখন ঠাকুর ভেবে পুজোর মত ভক্তি করতাম ।

আর ছবিগুলোর মাঝে মাঝে উনাদের বাণী লেখা থাকত । তখনই আমি দেখেছিলাম, দেওয়ালে দেওয়ালে স্লেটের মতো শক্ত কাগজের পাটায় লেখা আছে, “চুরি করিও না । চুরি করা পাপ ।“ “ঝগড়া করিতে নেই”, “মিথ্যা বলিও না”, “পিতামাতার অবাধ্য হইও না”, ইত্যাদি কত কত মহান অমূল্য বাণী ও হিতোপদেশ ।

এখন সব মনে নেই। তবে বলতে পারি সেসব লেখা পড়ে আমি রাতারাতি পাল্টে গেছিলাম । এমনকি মা পর্যন্ত অবাক হয়ে যেত । মা যা বলছে তাই শুনছি । ঝগড়া করছি না । মিথ্যা বলছি না । দাদা বা বন্ধুরা, কাউকে বাজে কথা বা কুবাক্য বলল তো অমনি মাকে এসে তা বলে দিলাম । বাবাকে ভয় পেতাম । তাই বাবাকে সব কথা বলতাম না ।


আমাদের স্কুলে তখন এখনকার মতো হাতের কাজ বা শরীর চর্চাও করা হোত । মাষ্টারমশাই বললেন, কাল তোমরা তালপাতা নিয়ে এস ।

পরের দিন তা নিয়ে এলাম । শুরু হল তালপাতার চাটাই বোনা বা বাটির মতো পাত্র বা খেলনা তৈরি করা ।

কাদা দিয়ে আমরা মাটির পুতুল, খেলনা, এমনকি নানারকম সব্জি বা ফল; যেমন-বেগুন, ঝিঙে, ঢেঁড়স, আম, তাল ও কলা বানাতাম ।

বিকেলবেলায় কাবাডি বা ফুটবল খেলা হত স্কুলের বাইরের চত্বরে । ফুটবল আমার প্রিয় ছিল । আমি খুব খেলতাম ।


স্কুলে সব মহাপুরুষ আর মহীয়সীদের জন্মদিন পালিত হোত । আমরা সেই দিন নানারকমভাবে অংশ নিতাম । যেমন, কেউ কবিতা আবৃত্তি করত, কেউ গান গাইত, কেউ বা কারা নাচত আবার কোন কোন দল নাটকও করত। আমি একবার কবিতা বলতে বলতে মাঝখানে বলা থামিয়ে কপালে হাত ঠুকে দুম করে বসে পড়েছিলাম । সবাই খুব হেসেছিল । “রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, পতিত পবন সীতা রাম”, এই গানটি প্রায়ই দল বেঁধে গাওয়া হোত আর সঙ্গে সঙ্গে একদল ছেলেমেয়ে গোল হয়ে নাচত । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “অমল ও দইওয়ালা” বা সুকুমার রায়ের “অবাক জলপান” নাটক হোত প্রায় প্রতিবছরই ।

প্রত্যেকদিন সবাই তালে তালে গা দুলিয়ে দুলিয়ে সুর করে কবিতা পড়তাম। রোজ ক্লাসের শেষে সবাই একসাথে নামতা বলতাম । আমাদের প্রতিদিন শেষ কথাটা হত, সউচ্চে –‘দশে দশে শ’ আর অনুচ্চে- ‘ঘরকে পালি চ’ ।


সবদিন স্কুলে এসে প্রথম ঘণ্টা পড়ার সাথে সাথে আমরা প্রতি শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা স্কুলের বাইরের উঠোনে এক একদল করে লাইনে দাঁড়াতাম । সবার সামনে প্রথম শ্রেণী, তাঁর পিছনে দ্বিতীয়, তারপর তৃতীয় ও পরে চতুর্থ শ্রেণী । আমাদের সবার মুখ উত্তর দিকে আর সবার সামনে বড়মাষ্টমশাই আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন । তারপর আমরা সবাই জোড়হাত করে একসাথে সউচ্চে প্রার্থনা করতাম, ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে, ভারত-ভাগ্য-বিধাতা-‘।

প্রার্থনা শেষ হলে এক মিনিট নীরবতা পালন । তারপর, স্কুলের কোন খবর আমাদেরকে জানানোর থাকলে বড়মাষ্টমশাই তা বলে দিতেন । যেমন, কাল স্কুল ছুটি থাকবে, বা পরের সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা হবে বা কাল কোন মহাপুরুষের জন্মদিন পালিত হবে আর কিভাবে তা হবে, ইত্যাদি। এমনকি খবর পড়াও হোত এই প্রার্থনা শেষে । খবর পড়া মানে কোন সেরকম খবর থাকলে মাষ্টারমশাই বা যে ছাত্র বা ছাত্রী তা বলতে চায়, সবার সামনে গিয়ে জোরে তা বলত ।

বেশির ভাগই স্থানীয় খবর, যেমন, কাল বৃষ্টি হয়েছিল বা ঝড় হয়েছিল, কাল আমাদের পাশের গ্রামে আগুন লেগেছিল বা কাল আমাদের বা পাশের গ্রাম ফুটবল খেলাতে জিতেছে বা কারোর জন্ম-মৃত্যুর খবর ইত্যাদি ।

একবার আমি এই খবর পড়াতে সবার আজবের বা হাসির খোরাক হয়েছিলাম। বলি।

যেহেতু, অনেকে খবর বলে, আমারও ইচ্ছে হল একদিন খবর পড়ার। আমি গিয়ে বললাম, ইন্দিরা গান্ধী কাল বিদেশ গেছেন ।

আমার খবর শুনে সবাই প্রথমে চুপ। তারপর কেমন হাসির গুঞ্জন শুনেছিলাম ।

আসলে ছাত্র-ছাত্রীরা যে সব খবর পড়ত তা কেবল ওই এলাকার খবর অর্থাৎ স্থানীয়। কেবল মাষ্টারমশাইরাই স্থানীয় ও বৃহৎ দেশের খবর বলতেন । মাষ্টারমশাইরা খবর বলার আগে উল্লেখ করতেন, ‘দেশের খবর’ কি স্থানীয় খবর’ ।

আমি ভুলে খবরটা আমার কাকার পরামর্শে স্কুলে গিয়ে বলেছিলাম । পরে পুরো একদিন কাকার সাথে কথাই বলিনি ।

একবার দাদা আমায় বলল, আজ স্কুল ছুটি, যাস না । আমি বললাম, কেন?

-নজরুল ইসলাম মারা গেছে কাল ।

-তো-?

-সেইজন্য ছুটি ।

-সে তোমাদের স্কুল ছুটি থাকতে পারে, আমাদের কেন থাকবে?

দাদা, আমাকে আরও কিছু বলেছিল। তবুও স্কুলে আসা থেকে আমাকে বিরত করতে পারেনি সেদিন। অথচ, এই দাদাই একসময় আমাকে ধরে বেঁধে স্কুলে নিয়ে আসত । আসলে আমি স্কুলকে তখন এত ভালোবাসতাম যে স্কুল কামাই করতে চাইতাম না।

দাদার কথাকে অগ্রাহ্য করার প্রধান কারণ ছিল এই যে, আমি তখন দাদার খবরটাকে স্থানীয় খবর হিসেবে নিয়েছিলাম অর্থাৎ ভেবেছিলাম, নজরুল পাশের গ্রামের কেউ হবে, যে হয়তো দাদাদের স্কুলে পড়ত । তখন জানতাম না যে ইনি একজন আমাদের দেশের বরেণ্য কবি।

আগের দিনে স্কুলে কীভাবে যে খবরটা মিশ করেছিলাম তা মনে নেই । সে যাহোক, স্কুলে তো চলে এলাম । এসে দেখি সে কী ভয়ঙ্কর অবস্থা । যেখানে রোজ স্কুল চলাকালে ছেলেমেয়েরা সরগরম করে রাখে, সেই স্কুলই যেন মৃত হয়ে পড়ে আছে বা বিশ্রাম নিচ্ছে। চারদিক নীরব ও নিস্তব্ধ ।

হঠাৎ, আমি বড়মাষ্টমশাইকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম ।

ভয় হোল, ভূত দেখছি না তো ? পরক্ষণেই মনে পড়ল, ওঃ, বড়মাষ্টমশাই তো স্কুলেই থাকেন । ভয় দূর হল ।

উনি হাসতে হাসতে আমার দিকে এলেন । বললেন, কী ব্যাপার, আজ তো ছুটি ?

আমি কিছু বলতে যাব, এমন সময় উনি আবার বললেন, ঠিক আছে, এসছ যখন, আমার সাথে একটু গল্প করে যাও । উনার জন্য বরাদ্যের খাবারের কিছু অংশ আমায় খেতেও দিলেন ।


আমি একবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলাম। না-না, দেশের না; আমাদের স্কুলের । ব্যাপারটা কেমন আশ্চর্যের লাগছে, তাই না? ঠিক আছে, খুলেই বলি ।

এই স্কুলের জন্য প্রতিবছর একজন প্রধানমন্ত্রী মাষ্টারমশাইরা নির্বাচন করতেন । ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে।

সে বছর, আমি তখন ক্লাস ফোরে। পড়াশুনায় ভাল ছিলাম বলে বা রোজ স্কুলে আসতাম বলে হয়তো, উনারা আমাকেই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করলেন । তখন তো আর জানতাম না, প্রধানমন্ত্রী আসলে দেশের কর্ণধার । জানলে হয়তো নিজেকে সেভাবে দেখতাম আর মজা নিতাম আরও বেশি ।

আমাদের স্কুলের এই প্রধানমন্ত্রীর কাজ ছিল অন্যান্য মন্ত্রীদের সাথে অলোচনা করে মষ্টারমশাইদের বিশেষ করে বড়মাষ্টমশাইকে অবগত করা ও তাঁর কথামতো তা আবার বাকি মন্ত্রীদের গোচর করা । অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী হল একেবারে স্কুল ক্যাপ্টেন বা শিক্ষকদের সামনে ছাত্র প্রতিনিধি ।

সব ক্লাসের জন্য একজন করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, সাফাইমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী ইত্যাদি নির্বাচন করে দিতেন মাষ্টারমশাইরা ।

প্রতিদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সকালে নিজের ক্লাসের সবার পোষাক ও পরিচ্ছন্নতা লক্ষ রাখত । যেমন, প্রত্যেকের আঙুলের নখ আর মাথার চুল ঠিকমতো ছোট করে কাটা আছে কি না, ঠিকমতো চুলে চিরুনী দিয়েছে কি না আর ঠিক পরিচ্ছন্ন পোষাক পরেছে কি না, ইত্যাদি । সব সাফাইমন্ত্রী স্কুলে এসেই তার ক্লাসের দলবল নিয়ে বাইরের উঠোন পরিষ্কারের আদেশ করত আর আমরা প্রত্যেকে একটি একটি করে পড়ে থাকা গাছের পাতা, কাগজ বা কুটি-কাঁটা কুড়িয়ে কুড়িয়ে দূরে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দিয়ে আসতাম । সাফাইমন্ত্রী আরও একটি বড় কাজের দায়িত্ব নিত । তা হল প্রত্যেক ক্লাসের সাফাইমন্ত্রী সেই ক্লাসের ছেলে আর মেয়েদের প্রতি সপ্তাহের একটা লিস্ট তৈরি করত । সেই লিস্ট অনুযায়ী ছেলেমেয়েরা যে যার নিজের ক্লাসের মেঝেতে জল ও গোবর দিয়ে নাতা দিত, প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার । কেননা, আমাদের স্কুলের মেঝে তো মাটির থাকত, তাই তা হতে যাতে ধুলো উঠতে না পারে তাই এভাবে নাতা দেওয়ার ব্যবস্থা হোত ।

কৃষিমন্ত্রী বাগান দেখাশোনা করত। আমাদের স্কুলে সব ছাত্র-ছাত্রীদের দুপুরের খাবার মাইলো বা গম-ঘাঁটা দেওয়া হত বিনামূল্যে । এই খাবারের পরিমাণ ও বিতরণ ব্যবস্থা খাদ্যমন্ত্রী ঠিক করত। শিক্ষামন্ত্রী স্কুল শুরু হওয়ার আগে যে যার ক্লাসের মাষ্টারমশাইয়ের পড়ানোর টেবিলে চক, ডাস্টার ও উপস্থিতি নথিভুক্ত করার খাতা মোতায়েন করে রাখত। প্রত্যেকের হাতের লেখার খাতা সংগ্রহ করে মাষ্টারমশাইয়ের পড়ানোর টেবিলে ক্লাস শুরুর আগে রেখে দিত । যদি পড়ানোর সময় ম্যাপ বা মানচিত্রের দরকার হোত তো এই শিক্ষামন্ত্রী তা নির্দিষ্ট জায়গা হতে বের করে মাষ্টারমশাইয়ের টেবিলে এনে দিত । আইনমন্ত্রী লক্ষ রাখত কেউ অন্যায় করছে কি না। যেমন, কারোর বই-খাতা কেউ নিয়ে নিল বা ছিঁড়ে দিল বা চুরি করল কিংবা কেউ অকারণে কারোর পিঠে দুমাদুম বসিয়ে দিল বা চিমটি কাটল, ইত্যাদি ।

আমার সবচেয়ে বেশি মজা হোত যখন স্কুলে সরস্বতী পুজো হোত । সকাল থেকেই আমাদের উপবাস একটা সাড়াজাগানো ব্যাপার ছিল । এর ফাঁকে বলে ফেলি, প্রত্যেকবার আমি আগের দিন ভুলে পেঁয়াজ খেয়ে ফেলতাম আর প্রতিবার মা সেজন্য পুজোরদিন ভোরে সেই প্রচণ্ড শীতে রুটি খাওয়াতো আর স্নান করাত ।

যাহোক, স্কুলে এসে আমরা সকাল থেকেই ঘণ্টা বাজাতাম, ঢং-ঢং-ঢং...। সে ঘণ্টা বাজানোর জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে সুযোগ পেতাম। তারপর, পুজো দেখতাম । পুজো শেষ হলে নানারকম ফলের প্রসাদ পাব বলে লোলুপ হয়ে অপেক্ষা করতাম ।


একবার বড়মাষ্টমশায়ের আদেশে আমরা দশ-বারো জন সহপাঠী পাশের গ্রামে দৌড়ে গেছিলাম। সেখানে কারোর বাড়িতে নাকি আগুন ধরে গেছিল এবং সেই আগুন নেভানোর জন্য আমাদের পাঠানো হয়েছিল।

আমি জানি, এখনকার দিনে এধরণের কাজ কোন শিক্ষক ছাত্রদের দিয়ে করাতে ভয় পাবে । প্রধানতঃ ছাত্রদের মা-বাবার ভয়ে। কিন্তু বড়মাষ্টমশাই সকলের এতই প্রিয় ছিলেন যে তাঁকে কেউ কোনদিন এরূপ সামাজিক কাজ হতে বিরত করতে পারত না ।

বলে রাখি, আমাদের তৎপরতায় আর অন্যদের সহযোগিতায় সেদিন সেই ঘর হতে পুরো সংসারের সবাই প্রায় অক্ষত অবস্থায় সেই আগুনের গোলা হতে বের হতে পেরেছিল । আমরা সব বন্ধুরা বালতি বালতি জল পাশের পুকুর হতে বয়ে বয়ে বড় লোকেদের হাতে তুলে দিচ্ছিলাম আর তারা সেই জল সেই আগুনে ঢেলে ঢেলে তা নিভিয়ে দিচ্ছিল । তখন তো আর এখনকার দিনের মতো আগুনের দমকল বাহিনীর সহজলভ্যতা ছিল না ? তখন তো সেই শহর থেকে দূরের এই গ্রামগুলি তেমন কোন ভাল রাস্তা দিয়ে যুক্ত ছিল না । সব রাস্তাই ছিল সরু আর জল-কাদা-পাথর বা গাছে ভরা ।


আমাদের সেই স্কুল আর বড়মাষ্টমশাইয়ের সম্বন্ধে আর কতই-বা বলব ? শেষ নেই । তবে আর বেশি কিছু না বললেও একটা কথা আমার এখনো বলা হয়নি। তা হল, এত সব করা না হয় মানা যায় যদি সে স্কুলের এ্যাকাডেমিক রেজাল্টও ভালো হয় ।

আমাদের সেই স্কুলের এ্যাকাডেমিক রেজাল্ট মন্ত্রবৎ ভালো হোত । প্রায় সবাই শতকরা ৬০-এর বেশি নম্বর পেত চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি পরীক্ষায় যা বাইরের স্কুলে হোত ও বহিরাগতদের দ্বারা মূল্যায়িত হোত। আর প্রতি বছরই কেউ না কেউ বৃত্তিও পেত ভালো রেজাল্টের জন্য ।

আর এ ব্যাপারে আর একটা কথা বলি, যেটা বলা হয়তো অনেকের কাছে আমার অহংকার প্রকাশ বলে মনে হতে পারে, কিন্তু সে উদ্দেশ্য না নিয়েই বলছি, যে, আমি, তরুণ ও আমার আরও চার পাঁচজন সহপাঠী সেই প্রায়মারি স্কুল ছেড়ে যেদিন ডাবচা স্কুলে ভর্তি হলাম ক্লাস ফাইভে তার একবছর পরেই জানতে পারি আমি সেই নতুন স্কুলে ক্লাস ফাইভে দেড়শ’ ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ফার্স্ট হয়েছি ও আমার পুরানো সহপাঠী তরুণ দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে ।

এই স্কুল ও বড়মাষ্টমশাইয়ের আদর্শে আমি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলাম যে, পিতামাতা আর দেশ ও জাতির প্রতি এক গভীর মমত্ববোধ এবং একনিষ্ঠ দায়িত্ব ও কর্তব্যের তাড়নায় প্রতিমুহূর্তে নিজেকে আদর্শ নাগরিক বানাতে ধাবিত হই । সেই স্কুলশিক্ষা ও শিক্ষকের আদর্শের সুদূর প্রসারী ফল শুধু আমিই না আরও অনেক প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী যে পেয়েছে তা বেশ ভালোভাবেই জানি এবং সংখ্যাটা হাতে গোনার বাইরেই বলা যায় ।


না, এবার আমার আর কিছু বলে প্রমাণ করার তেমন ইচ্ছে নেই । আর কতই-বা বলব । শুধু এটুকু বলি যে, যেদিন বড়মাষ্টমশাই স্কুল ছেড়ে চলে গেলেন, সেদিন, আমরা কেন গোটা গ্রামের সব লোকই খুব কেঁদেছিল আর আমিও বেশ ভালমতোই বুঝে গেছিলাম, কেন সে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ‘শ্রী নরেন পাল’ মহাশয়কে ‘বড়মাষ্টমশাই’ বলা হোত বা হয় ?


গল্পের নামকরণ মিলে গেছে, কাহিনীও এক স্থিতিশীল অবস্থায় এসে পৌঁচে গেছে, অর্থাৎ, এখানেই আমার গল্প শেষ হতে পারত, কিন্তু হল না ।

কারণ, এখনো না-বলা অনেক কথার মধ্য থেকে একটা কথা বলা আমার বাকি রয়ে গেছে । সেটা বলা খুবই দরকার । কেননা, এটা আজও এখানে ওখানে হচ্ছে শুনি ।


বড়মাষ্টমশাই স্কুলের চাকরি ছেড়ে গেছিলেন যখন, তখন আমরা ক্লাস ফোরে সবে উঠি ।

এই ফোরে পড়ার সময় আমাদের জানতে খুব ইচ্ছে হোত, যে বড়মাষ্টমশাই এত ভালো, মাসের পর মাস বাড়ি না গিয়ে স্কুলেই পড়ে থাকতেন, সেই তিনি আজ স্কুল ছেড়ে কোথায় কীভাবে আছেন ? তাই আমরা যেদিন সবাই খুব ভালো রেজাল্ট করে ফোর পাশ করলাম, সেদিন আমাদের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের পরামর্শে আমরা কিছু টাকা যোগাড় করে বড়মাষ্টমশাইয়ের জন্য ভালো উপহার কিনে পাঠালাম ।

এক সপ্তাহ পরে আমরা একটা চিঠি পেলাম । তাতে বড়মাষ্টমশাই লিখেছেন, আমার খুব ভালো লাগছে, তোমরা খুব ভালো রেজাল্ট করেছ বলে । আমি স্কুল ভুলে কিভাবে কষ্ট পাচ্ছি আমিই জানি । এব্যাপারে আমি আর বেশি কিছু বলতে পারছি না ।

পরে, পুনশ্চ করে লিখেছিলেন, তোমাদের উপহার আমি মাথায় তুলে রাখতে চাই, তবে কি জান, এই সময় তোমরা যদি উপহারের বদলে আমাকে কিছু টাকা পাঠাতে তাহলে খুব ভালো হোত ।

চিঠি পড়ে আমরা সবাই খুব দুঃখ পেলাম । দুঃখ পেলাম, বড়মাষ্টমশাইয়ের হতদরিদ্র অবস্থার জন্য । অথচ, শুনেছিলাম, উনার দুই বড় ছেলে ও এক মেয়ে ছিল । সুতরাং, আমাদের আরও জানতে ইচ্ছে হল।

পরে যা জানলাম, তা সত্যিই খুবই দুঃখজনক । জানলাম, উনার ছেলেমেয়েরা কেউ বুড়ো বাবাকে খেতে দেয় না ।

খবরটা আমাদের খুব ব্যথা দিয়েছিল । কিছুদিন পর, আমাদের প্রধান শিক্ষকমহাশয় অমিয়বাবু একদিন নিজে চলে গেলেন আমাদের সংগ্রহের কিছু টাকা উনার হাতে তুলে দিতে ।

কিন্তু উনি ফিরে এসে যা বললেন তা খুবই হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী । উনি বললেন, আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে। বড়মাষ্টমশাই আর এ জগতে নেই !

আমরা সবাই সে খবর শুনে কান্নায় আছড়ে পড়লাম ।

এমনিতেই প্রাণের স্কুল ছেড়ে তাঁর অবস্থা জলের মাছ ডাঙায় হয়েছিল, তারপর দুঃস্থ অবস্থায় খাদ্যাভাব ও নিজের ছেলেমেয়েদের বঞ্চনাতে তিনি এমনই আঘাত পেয়েছিলেন যে মৃত্যু তাঁকে শান্তি দিতে অচিরেই তার কোলে নিয়ে নিল ।


খবরটা শুনে সেদিনই ঠিক করেছিলাম, আমি বড় হবই আর বড় হয়ে বড়মাষ্টমশাইয়ের বড় কাহিনী অবশ্যই একদিন লিখে হলেও সবার সামনে তুলে ধরব । তবে আমারও অনেক দেরি হয়ে গেল ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics