STORYMIRROR

Sarajit Mondal

Classics

3  

Sarajit Mondal

Classics

বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃহৃদে

বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃহৃদে

4 mins
1.1K

- আ-রে! এই বাচ্চাটাকেই তো সেদিন--!—বলেই আমি নির্বাক হয়ে গেলাম ! তারপর ভয়ে অস্ফুটে বললাম, ওঃ! তাহলে কি এই জন্যই ওর মা-- !

না, ‘মা’ নামটা কোনমতেই এখানে প্রযোজ্য হতে পারে না ! একজন মা কখনোই এরকম হতেই পারে না ?


গল্পের শুরুতেই আমার একসাথে এতগুলো তাক্‌ লাগানো কথাবার্তা শুনে অনেকে হয়তো ভাববেন, বেশি পাঁয়তারা দেখিয়ে গল্প লিখতে বসেছি । কিন্তু আমি বলব, মোটেই তা নয় । আগে আমার বাকি কথাগুলো শুনুন, তারপর আমার কথা খারাপ বা গাঁজাখুরী মনে হলে, বলে রাখলাম, আমি আপনাদের সামনে নাককান মলা খাব ।

না, এবার বলতেই হয় । কিন্তু, তার আগে আর একটা কথা বলে রাখি, একথা আমার এক মাস আগেই বলা বা লেখা দরকার ছিল । একটু আধটু লিখতে পারি । তাহলে তবুও কেন আমি তা আগে বললাম না ? আসলে, মুম্বাইয়ের মতো ব্যস্ত শহরে আমার মতো ছা-পোষা মানুষের কাছে অফিস-ঘর সামলে সময় বের করা কঠিন । তবুও, আজ আমাকে এই ঘটনাটা নিয়ে লিখতেই হবে । আর নিজেকে দমিয়ে রাখা যাবে না । কোনমতেই না ।


গল্পের শুরুতে যে বাচ্চাটিকে দ্বিতীয়বার দেখে আমি আজ ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম, তাকে প্রথম, মাস-খানেক আগে মুম্বাইয়ের ‘সি-উড’ রেলস্টেশনে তার মায়ের সাথে লড়াই করতে দেখেছিলাম । বাঁচার লড়াই !

“লড়াই ! বাঁচার লড়াই! তাও আবার মা-এর সাথে !” –হ্যাঁ, আপনি এসব জানতে চাইছেন তো ?

-হ্যাঁ । আরে মশাই, গল্প লিখতে বসেছেন বলে কি একেবারে- সাঁওতাল পাড়ায় লবঙ্গ বিক্রি করতে বসেছেন নাকি ? যা খুশি বলবেন, আর আমরা তা মেনে নেব ? ভেবেছেন কী ?

- কিছু না। যা সত্য, যা নিজের চোখে দেখেছি, তাই বলছি । গল্প লিখছি না ।

- আচ্ছা বলুন । আর নাককান মলার কথাটাও মনে রাখবেন কিন্তু ?


আজ আমি বাচ্চাটিকে দেখলাম, বেলাপুর রেলস্টেশনে থালা রেখে ভিক্ষে করতে । জানি, অনেকে বলবেন, “এ আর এমন কী কথা ? ভারতের মতো গরিব দেশে সর্বত্রই শত-সহস্র বাচ্চা ছেলেমেয়ে ভিখ মাগে । বেঁচে থাকার জন্য । তার জন্য এত ঢাঁক-ঢোল পেটানোর কী আছে ভাই ?” - তাইতো ?

-আছে । কারণ, এক মাস আগে আমি যা দেখেছি, সেটা ছিল রীতিমতো লোমহর্ষক ব্যাপার !

দয়া করে আর তর্ক না করে আমার বাকি কথা শুনুন ।


মুম্বাইয়ের মতো বিশাল শহরে প্রত্যেকে এত ব্যস্ত থাকে যে, রাস্তায় কারোর পাশ দিয়ে তার বাবা পার হয়ে গেলেও তার ছেলে বা মেয়ের নজর পড়ে না, বাবার ওপর । হ্যাঁ, এতটাই ব্যস্ত মানুষ এই শহরে ।

আমিও সেইরকমই ব্যস্ত ছিলাম । দিনের শেষে একেবারে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে অফিস থেকে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছিলাম । সি-উড স্টেশনে আমাকে নামতে হল । কারণ, ওখানে অন্য ট্রেন ধরতে হবে । খারঘর আসার জন্য ।

আমি যেই ট্রেন থেকে নামলাম, অমনি আমার কানে কোথা থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের আর্তনাদ কান্না বা গোঙানি এসে আমাকে বিব্রত করতে লাগল । আমি সে কান্নায় কাতর হয়ে বিগলিত হৃদয়ে সে আর্তি অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে লাগলাম । আর একটু দূরেই দেখতে পেলাম, সে এক ভয়ানক দৃশ্য !! আমার মন হুহু করে কেঁদে উঠল । আমি পাগলের মতো সেদিকে ছুটে গেলাম । আমি সে মহিলাকে বাচ্চাটিকে অমনভাবে নৃশংস হয়ে মারার জন্য কিছু বলে বাধা দিতে গেলাম । মেয়েটি হিন্দিতে যা বলল তা হল, আমি আমার মেয়েকে শাসন করছি, তুমি বলার কে হে ?

আমি দ্বিগুণ চিৎকারে চেঁচিয়ে উঠলাম । তা বলে ওভাবে কেউ তার মেয়েকে মারে?! -হ্যাঁ, মারে । - বলেই সে উন্মত্ত মায়ের তাণ্ডব অত্যাচার এবার আরও হিংস্র হল । সে এবার, মেয়েটির পিঠে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে, ঠিক বলি দেওয়ার আগে যেমন ছাগলের সামনের পা দুটো পিছনদিকে মুড়ে ফেলে বলির আগেই প্রায় মেরে ফেলা হয়, ঠিক সেরকম করে বাচ্চাটির হাত দুটোকে পিছনে মটামট করে ঘুরিয়ে দিল । আর বাচ্চাটি, যন্ত্রণায় কাটা পাঁঠার মতো মা-মা করে গোঙাতে গোঙাতে ছটফট করতে লাগল ! সে দৃশ্য চোখে দেখা যায় না ।

অথচ, স্টেশনের কেউ সে দিকে ঘুরেও তাকালো না ? কেউ তাকে বাধা দিতে এগিয়েও এল না ? কেবল, কেউ কেউ বুঝে গেল, আমি মুম্বাই শহরে নতুন আমদানি হয়েছি ।

হ্যাঁ, এটা অবশ্য ঠিক। মাত্র কিছুদিন আগেই আমি মুম্বাই শহরের নতুন বাসিন্দা হয়েছি । কিন্তু, মুম্বাই তাবলে এরকম ! একটা দুধের বাচ্চাকে তার মা মেরে ফেলছে আর কেউ তাকাচ্ছে না ! কী আশ্চর্য ব্যাপার !

অবশ্য, পরক্ষণেই বুঝে গেলাম, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে ? যদি কারোর মা তার বাচ্চাকে মারে আর তা আবার এরকম নৃশংস ভাবে এবং সেটা যদি আশ্চর্যের না হয়, তাহলে তাকে বাধা দিতে যে কেউ এগিয়ে আসবে না, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, হতেই পারে । আর এ কথা বোঝামাত্রই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পিছু হটলাম । ভাবলাম, আমি ভদ্র লোক হয়ে অভদ্র লোকের সাথে, তাও আবার মেয়ে এবং ভিখেরির সাথে বোকার মতো লড়তে যাব কেন ? লোকে কী ভাববে ? একটা গেঁয়ো নির্বোধ তো ভাববেই । উল্টে কেউ যদি আমার এ বাধার পিছনে অন্য কিছু অর্থ খুঁজে পায়, তাহলে আর রক্ষে থাকবে না । তাই, পিছু হটতে হটতে হঠাৎ সটান চলমান ট্রেনের কামরায় উঠে পড়লাম ।


পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে একটা সিনেমার দৃশ্যের মতো মনে হয়েছিল । তবে মনের মধ্যে একটা যাতনা বা হৃদয়ের মধ্যে একটা মোচড় আমাকে বেশ কিছুদিন ভুগিয়েছিল । কারণ, আমি সে বাচ্চার বাঁচার জন্য সেই করুণ আর্তনাদ কান্না কান চাপা দিয়েও অনবরত শুনতে পেতাম ।


গত এক-দু’ মাস পার করে আমি যখন এসব কিছু ভুলে মুম্বাইয়ের সঠিক বাসিন্দা হতে চলেছিলাম, ঠিক তখুনি, আবার সেই কচি অসহায় বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে কেমন যেন ভিমরি খেয়ে আবার আহত হলাম !


দু-হাত ভাঙা বাচ্চাটিকে দেখলাম, অনেক লোকে ভালোই ভিক্ষে দিচ্ছে ।  


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics