বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা
বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা
আমার বন্ধু সুবোধ সক্কালবেলায় আমার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি আত্মহত্যা করব ।
ব্যাপারটা কি যদিও একটু আঁচ করতে পেরেছিলাম, তবুও জিজ্ঞেস করলাম, কেন ?
- তুই তো জানিস সুজাতাকে আমি কত ভালবাসি?
- হ্যাঁ, জানি। সুজাতাও তো তোকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে ?
- না । সবই অভিনয় ছিল এতদিন।
- মানে-।
- কালই সন্ধেবেলায়, অনেকদিন ওর লুকিয়ে থেকে আমার সাথে কথা না বলার পর, আমার যখন দেখা হল, আমি আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা পাড়লাম, আর ও কী বলল জানিস ?
- কী?
- আমি দূঃখিত সুবোধ। আমার মা-বাবার কথামতো আমি বিয়ে করব তন্ময়কে ।
- কথাটা শুনে তো আমার মাথায় বাজ পড়ল যেন। আমি বললাম, তাহলে কি আমাদের এতদিনের ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যাবে?
সুজাতা ধীরভাবে বলল, ভালোবাসা আলাদা আর বিয়ে আলাদা।
আচ্ছা বিনয় তুইই বল, এ কেমন কথা? ভালোলাগায় ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসাকে জিঁইয়ে জীবনের মজা নেওয়ার জন্যই বিয়ে। তাই নয় কি ?
- তুই সুজাতাকে আর একবার বুঝিয়ে বল। যদি ওর মত ফিরে আসে তোর প্রতি।
- না, তা আর হবে না। এই দেখ ওর বিয়ের কার্ড । তন্ময়কে বিয়ে করছে ও আর দশ দিন পরই। অসম্ভব! আমি ওকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। - বলেই সুবোধ পকেট থেকে একটা বিষের কৌটো বের করল। আমি তা ওর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলাম। ও কেবল কাঁদতে লাগল।
আমি বললাম, জানি লাভ ইজ ইমোশনাল। যে ভালোবাসে সেই জানে ভালোবাসাটা কী? বিয়োগ কতটা ব্যথার? আমার মতো অন্যের পক্ষে তা অনুভব করা খুবই শক্ত । তবুও বলছি সুবোধ, অবোধ হয়ে জ্ঞান হারাস না। আত্মহত্যা করা মানে তো তোরই পরাজয় ?
-হ্যাঁ, আমি আজ পরাজিত বিনয়। আমি ওকে ছাড়া কীভাবে বাঁচব বল?
- সুবোধ, আমি তোর বন্ধু। তুই যেমন সুজাতাকে ভালবেসে সততার পরিচয় দিচ্ছিস তেমনই আমিও আশা করি তোর ভালোবাসা আমার প্রতি নকল নয়?
এই কথাটা সুবোধকে কেমন যেন নাড়া দিল। ও বলল, না বিনয়, তুই আমার আর এক পরম বন্ধু। তুই তো জানিস আমি বন্ধুত্বের অমর্যাদা করতে পারি না? তাই তো আমি সুজাতাকে পেতে চাই?
-সু, আমি সুজাতাকে তোর ভালোবাসা বুঝিয়ে বলব। ও নিশ্চয় তোকেই বিয়ে করবে। দেখ ও হয়তো তোর ভালোবাসা এভাবে মিথ্যা কার্ড দেখিয়ে পরখ করতে চাইছে। কে জানে?
- তাহলে তো ভালো হয় ।
- এই পৃথিবীতে সব কিছুই ভালো। পজিটিভ চিন্তা নিয়ে বড় হওয়ার কথা ভাব। ভগবান তোকে যখন জন্ম দিয়েছে তখন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে তাঁর সৃষ্টিকে মূল্য দিতে এগিয়ে চল। তোর মধ্যে অনেক ভালো গুণ আছে। আর তার মধ্যে একটা হল কৃতজ্ঞতা ।
কথাগুলো সুবোধের ভালো লাগছিল মনে হয়। ও শুনছিল। ভগবানের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার কথাটা ওকে একটা অর্থবহুল ধাক্কা দিয়েছে বলে মনে হল। আমি সুযোগ বুঝে বন্ধুকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়ে আরও বলে চললাম।
সু, আমি তোর হিতাকাঙ্খী বন্ধু হয়েই বলছি, মনে করিস, ঈশ্বর আমাদের একা পাঠিয়েছে আর একা যেতে হবে। তোর মৃত্যুর সময় সুজাতা তোর সাথে মরবে না। তাহলে কেন এত ভালোবাসা? সুবোধ, সুবুদ্ধি রাখ। আর একটা কথা মনে রাখিস, তোর জীবনটা তোরই, অন্যের নয়। আগে নিজেকে ভালবাস, তারপর অন্যকে ভালবাসিস। যে নিজেকে ভালোবাসে না, সে অন্যকে কেমনে ভালোবাসে জানি না?
কথাগুলো মন্ত্রবৎ কাজ করছিল নিশ্চয়। সুবোধ কেমন যেন মনোবল ফিরে পেতে পেতে আরও চাঙ্গা হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, ও এবার মৃত্যুর এপারের কথাই ভাবছে। তবুও আমি ওকে আমার শেষ অস্ত্র হিসেবে বাঁচার শেষ মন্ত্রটা বললাম।
সুবোধ প্রাণের বন্ধু হিসেবে আমার শেষ অনুরোধ, মনে রাখিস, কোন একজনের জন্য জীবনটা শেষ হয়ে যেতে পারে না। কোন একজন ততটা সর্বশক্তিমান নয় কেবল ভগবান ছাড়া। একজনের দেওয়া প্রদত্ত জীবন অন্যজন কীভাবে ছিনিয়ে নিতে পারে? পারে না, যে তা করে সে নরাধম।
সুবোধ কাকে নরাধম ভাবল জানি না। নিজেকে না সুজাতাকে। তবে কেমন যেন নতুন জীবনের আশা নিয়ে, আমাকে প্রাণের বন্ধু ভেবে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
আর আমি একটা জীবন বাঁচাতে পেরেছি ভেবে আনন্দে নিষ্পাপ নিরীহ সুবোধকে বুকে টেনে নিয়ে কাঁদতে লাগলাম।
আমাদের বন্ধুত্ব একটা ভালোবাসাকে জয় করল ।