বিদেশে প্রথম চিঠি
বিদেশে প্রথম চিঠি
নেদারল্যান্ড
২৫-শে জানুয়ারী ১৯৯২
পূজনীয় বাবা,আমি ভালোভাবে পৌঁছে গেছি । ফ্লাইট যথাসময়ে পৌঁছেছে । কোন অসুবিধেই হয়নি ।
বাবা তোমার কি মনে আছে, প্রথম যেদিন আমি হোস্টেলে থেকে পড়ার জন্য কলকাতা গেলাম, তখন তুমি কত ভয় পেয়েছিলে ? আর আজ, সেই তুমি কত সাহস নিয়ে তোমার সেই মেয়েকে একা বিদেশ পাঠাতে পেরেছ ! মা অবশ্য এজন্য তোমাকে যথাযোগ্য সাহস দিয়েছে জানি । তবুও আমার মনে হচ্ছে, মেয়েকে বড় করার জন্য তুমি যেভাবে মুখ বুজে বিরহ ব্যথা বুক চেপে রেখেছ তা আমি ছাড়া বোধহয় আর কেউ জানবে না ।
সেবার আমাকে নূতন স্কুলে ও হোস্টেলে ভর্তি করার আগে তুমি ও মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলে। তারপর সব দেখেশুনে সবার সাথে কথা বলে সব সুব্যবস্থা করে তবেই আমাকে পরে বাসে তুলে দিয়েছিলে দ্বিতীয় বারে । বাবা, আমার আজও মনে আছে, আমাকে বাসে তুলে দিয়ে তুমি ড্রাইভারকে বলে দিয়েছিলে আমাকে কখন কোথায় নামাতে হবে । এমনকি আমার সীটের পাশের লোকটিকে পর্যন্ত
বিরক্ত করে বলে দিয়েছিলে, আমাকে যেন পুরো রাস্তা দেখে । সে লোকটা খুব পাজী ছিল, পুরো রাস্তা আ
মার মুখের দিকে তাকিয়েই ছিল । আর কারণে অকারণে আমাকে বিরক্ত করেছিল । যখন বাধা দিতে গেছিলাম, তখন আমাকে তোমার সাবধান বানী ও দেখাশোনার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল । এ সব কথা আমি হোস্টেলে পৌঁছেই আমার রাগ দেখিয়ে চিঠি দিয়ে তোমাদের জানিয়েছিলাম । সে সব নিশ্চয় তোমাদের মনে আছে । তাই না বাবা ? সেই জন্যই কি তাহলে এবার আমাকে এত সহজে তোমরা একা বিদেশে ছেড়ে দেওয়ার সাহস দেখিয়েছ ? নাকি ফ্লাইটের পাইলটের দেখা বা প্রতিবেশী সহযাত্রীর খোঁজ হাতের নাগালের বাইরে থাকায় সব চুপ করে সহ্য করেছ ? জানি না । তবে তোমরা যে কোন ভুল করনি তা বলতে পারি । এখানে পৌঁছাতে আমার কোন অসুবিধেই হয়নি।
জান বাবা, আমার পাশের যাত্রী ছেলেটি যে বিমানে ছিল সেও ভাগ্যক্রমে আমাস্ট্রাড্রামের একই কলেজ মানে ডেলফট ইউনির্ভাসসিটিতে পড়তে এসেছে । আমার ওর সাথে পরিচয় হয়ে ও কথা বলে খুব ভালো লেগেছে । ওই আমাকে পুরো জার্নিটা যথাযোগ্য সঙ্গ দিয়েছে আর সাহায্য করেছে । কত গল্প করেছে । ওর নাম নির্মল । সত্যিই ও ওর নামের মতোই নির্মল । কক্ষনো আমাকে অশোভন কথা বা সীমার বাইরে কথা বলে উত্যক্ত করেনি । বরং উপযুক্ত শ্রদ্ধা জানিয়ে এয়ারপোর্টে গাড়ি ধরিয়ে দিয়েছে । আমাকে ওর ফোন নম্বর দিয়ে বলে দিয়েছে কক্ষনো কোন দরকার হলে আমি যেন ওর সাহায্য নিই । না বাবা, ভয় পেয়ো না, আমি কক্ষনো বিপদে পড়ব না । আমি হোস্টেলে পৌঁছেই তোমাদের এই চিঠি লিখছি ।
হোস্টেলের সব ব্যবস্থাই ভালো । সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট এসে কথা বলে গেছে । এরই মধ্যে হোস্টেলের এক- দুজন বোর্ডারের সাথে আমার পরিচয়ও হয়ে গেছে । তাদের একজনের কাছ থেকে এনভেলপ নিয়েই তো আমি এ চিঠি লিখছি । আমাদের বাড়ীর সামনেই একটা পোস্টবক্স আছে দেখলাম । ভালোই হল, রোজ তোমাদের একটা করে চিঠি লিখব আর ওখানে ফেলে দেব ।
তোমরা মন খারাপ করবে না । আমি ভালো আছি । বিদেশ হতে আমার এই প্রথম চিঠিটা আমি আজই পোষ্ট করতে চাই । তাই এখন আর কিছু লিখছি না । সময় নেই। কাল আবার যখন তোমাদের চিঠি লিখব তখন আমার বিদেশ আগমন সম্বন্ধে সবকিছু গুছিয়ে লিখব । এখন আর না ।
সবাই ভালো থেকো ।
ইতি-
তোমাদের স্নেহধন্যা দুহিতা ও গ্রামের লড়াকু লক্ষ্মীপ্রিয়া।