STORYMIRROR

Nikhil Mitra Thakur

Classics

4  

Nikhil Mitra Thakur

Classics

ননীবালা দেবী

ননীবালা দেবী

5 mins
553

ননীবালা দেবী 

পরাধীন ভারতের হাওড়া জেলার বালিতে থাকতেন সূর্যকান্ত বন্দোপাধ্যায় ও তার স্ত্রী গিরিবালা দেবী। ১৮৮৮ সালে তাদের একমাত্র কন্যার জন্ম হয়। নাম রাখা হয় ননীবালা,ননীবালা বন্দোপাধ্যায়। অল্প বয়সে সামান্য কিছু শিক্ষা লাভের ফলে তার দেশের প্রতি অনুরাগ জন্মায়। পরাধীন ভারতবর্ষে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা তাকে ব্যথিত করে তোলে। কিন্তু,সেই সময়ের সামাজিক রীতি মেনে মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৮৯৯ সালে ননীবালা দেবীর বিয়ে দেওয়া হয়। 

১৯০৪ সালে বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় তার স্বামী মারা যান। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি বাল্যবিধবা হলেন। মতান্তর হওয়ায় শশুর বাড়িতে তার জায়গা

হলো না। বিধবা অবস্থায় পিতৃগৃহে ফিরে আসেন। নিজ চেষ্টায় লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চাইলেও সমাজের নানা বাধায় তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়। আশ্রয় নিলেন আড়িয়াদহ মিশনে।

ভারতবর্ষে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত ইংরেজ শাসকের ভয়াবহ অত্যাচার ও নিপীড়ন চলছে। ফাঁসি, দীপান্তর,অত্যাচারে পাগল হয়ে যাওয়া,দালান্দা হাউসে নিয়ে গিয়ে চার্লস টেগার্টের তদারকিতে বীভৎস নীপিড়ন ভারতীয় ললাট লিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মলদ্বারে রুল ঢোকানো,কমোড থেকে মলমূত্র এনে মাথায় ঢেলে দেওয়া,সপ্তাহ ব্যাপী উপবাস করিয়ে পিছনে হাতকড়া অবস্থায় বন্দীকে দাঁড় করিয়ে রেখে লাথি ও রুল দিয়ে প্রহার করা ছিল টেগার্টের অত্যাচারের নূন্যতম রীতি।

এইরকম ভীতি উদ্রেক পরিস্থিতিতে কারো বিপ্লবী দলে নাম লেখানো সহজ কথা নয়। এইসময়ে ননীবালা দেবী বাল্য জীবনের সুপ্ত ইচ্ছা থেকে ভাতুষ্পুত্র অমরেন্দ্র চ্যাটার্জিকে ডেকে পাঠান। তার কাছে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা নেন। যুগান্তর সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। তার জীবনের অন্য এক অধ্যায় শুরু হয়। ননীবালা দেবী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত বিপ্লবীদের নানাভাবে সাহায্য করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখার্জির মৃত্যুর পর যদুগোপাল মুখার্জির নেতৃত্বে যুগান্তর দলের বিপ্লবীগণ তখন জার্মান থেকে অস্ত্রশস্ত্র আমদানি করে ভারত স্বাধীন করার জন্য চরম মারমুখী বিপ্লব শুরু করেছিল। বিদেশি অস্ত্রশস্ত্র আমদানির খবর পেয়ে ইংরেজ পুলিশ ১৯১৫ সালে কলকাতার "শ্রমজীবী সমবায়" নামে বিপ্লবীদের একটি প্রতিষ্ঠানে তল্লাশি চালায়। তল্লাশির সময় বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদার গ্রেপ্তার হন। কিন্তু তিনি তার হেফাজতে থাকা একটি 'মাউজার' পিস্তল কোথায় রেখে গেছেন তা বলে যেতে সময় পাননি। সাথে থাকা অমরেন্দ্র চ্যাটার্জি পালাতে সফল হন।

ননীবালা দেবীর বিপ্লবী কাজের শুরু হয় এই সময় থেকে। তিনি রিষড়ায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে বিপ্লবীদের থাকার ব্যবস্থা করেন। তিনি সুতো কেটে খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তাই গরীব ব্রাহ্মণ মহিলার প্রতি ইংরেজ পুলিশ বা অন্য কারো সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। তিনি সেই সুযোগের সৎব্যবহার করেন। বিপ্লবীরা তার আশ্রয়ে স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারতেন।

এই সময়ে তিনি বিপ্লবী রামচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী সেজে জেলে দেখা করতে যেতেন। তার জেলে দেখা করতে যাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মাউজার পিস্তল রামচন্দ্র কোথায় রেখে গিয়েছেন তার সন্ধান নিয়ে আসা। তাছাড়া বিপ্লবীদের নির্দেশ রামচন্দ্রের কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং রামচন্দ্রের কাছ থেকে খবরা খবর নিয়ে এসে বিপ্লবীদের দেওয়া।

এই সময়ের প্রেক্ষাপটে কোন একজন ব্রাহ্মণ বিধবা মহিলার শাখা সিঁদুর পড়ে অন্যের স্ত্রী সাজা মোটেও সহজ ব্যাপার ছিল না। এখান থেকেই ননীবালা দেবীর মানসিক দৃঢ়তা ও দেশকে স্বাধীন করার স্পৃহার সম্যক্ পরিচয় পাওয়া যায়। তাছাড়াও ননীবালা দেবী যে সময়ে বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলেন সেই সময় ইংরেজ পুলিশের অত্যাচার সমস্ত রকম মাত্রা ছাড়িয়ে গেছিল। এর থেকে তার সাহসের ও মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় মেলে।

কিছুদিনের মধ্যেই ইংরেজ পুলিশ জেনে যায় ননীবালা দেবী রামচন্দ্র মজুমদারের স্ত্রী নন। কিন্তু তখনও তিনিই যে রিষড়ার ননীবালা দেবী তা ইংরেজ পুলিশ জানতে পারেনি। তবুও কোনরকম ঝুঁকি না নিয়ে রিষড়া থেকে

চলে গিয়ে বিপ্লবীদের জন্য চন্দননগরে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। এখানে ভোলানাথ চ্যাটার্জির বড়পিসি ও

ননীবালা দেবী দুটি পৃথক বাড়ি ভাড়া নিয়ে বিপ্লবীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন।

কিছুদিনের মধ্যে ইংরেজ পুলিশ চন্দননগরেও বিপ্লবীদের খোঁজে তল্লাশি শুরু করে। তাই ননীবালা দেবীকে আর সেখানে রাখা বিপ্লবীরা নিরাপদ মনে করলেন না। ননীবালা দেবী বাল্য বন্ধুর দাদা প্রবোধ মিত্রের সাথে পেশোয়ারে চলে গেলেন। পেশোয়ারে যাওয়ার পনের দিনের মাথায় ননীবালা দেবী কলেরায় আক্রান্ত হলেন। তারপরের দিনে ইংরেজ পুলিশ খবর পেয়ে ননীবালা দেবীর সারা বাড়ি ঘিরে ফেলে। তাকে গ্রেফতার করে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হল পুলিশ লকাপে। তিনি সুস্থ হলে কয়েকদিন পর তাকে কাশীতে জেলে পাঠানো হয়।

কাশীর জেলে তাকে প্রতিদিন জেরা করতেন কাশীর ডেপুটি পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট জিতেন ব্যানার্জি। কিন্তু ননীবালা দেবীর কাছ থেকে কোন তথ্য বের করতে না পেরে তিনি উত্তরোত্তর নির্মম অত্যাচার করতে থাকেন। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন।

একদিন দুইজন জমাদারনী ননীবালা দেবীকে একটি আলাদা সেলে নিয়ে গিয়ে উলঙ্গ করে তার দেহের গুপ্তস্থানে লঙ্কা বাটা ঢুকিয়ে দেয়। ননীবালা দেবী চিৎকার করে সর্বশক্তি দিয়ে দুই জমাদারনীকে লাথি মারতে থাকেন। দুই জমাদারনী বেশিক্ষণ ধস্তাধস্তিতে পেরে না উঠে, জিতেন ব্যানার্জির কাছে ননীবালা দেবীকে নিয়ে আসে। শুরু হয় আবার জেরা-

- কী জানো বল?

- কিছু বলবো না।

- আরো শাস্তি পাবে তুমি।

- যত খুশি শাস্তি দেন, আমি বলব না।

- অমরেন্দ্র চ্যাটার্জি কোথায়?

- আমি বলবো না।

- শাস্তির কথা ভুলে গেলে, আরও কঠিন শাস্তি পাবে।

- যা খুশি করুন আমি বলবো না।

অত্যাচারী জিতেন ব্যানার্জি এরপর ননীবালা দেবীকে শাস্তি কুঠুরিতে রেখে জেরা পর্ব শুরু করে। কাশীর জেলে একটা ছোট্ট ঘর ছিল। সেটার একটাই দরজা ছিল। আলো বাতাস ঢোকার কোন ব্যবস্থা ছিল না। এটাকে বলা হতো শাস্তি কুঠুরি। এখানে পরপর তিন দিন আধঘন্টা ননীবালা দেবীকে ঢুকিয়ে রেখে বের করে নিয়ে এসে জেরা করা হতো। এত অত্যাচারের পরেও ননীবালা দেবীর কাছ থেকে কোন তথ্য বের করতে না পেরে অত্যাচারী বিশ্বাসঘাতক জিতেন ব্যানার্জি তৃতীয় দিনে প্রায় ৪৫ মিনিট ননীবালা দেবীকে ওই ঘরে রেখে দেয়। ননীবালা দেবী অক্সিজেনের অভাবে অচেতন হয়ে পড়েন। সেই অবস্থায় বের করে নিয়ে এসে জেরা করা হয়।

চূড়ান্ত অসফল হয়ে কাশীর ইংরেজ পুলিশ ননীবালা দেবীকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে স্থানাতড়িত করে দেয়। প্রেসিডেন্সি জেলে আসার পর ননীবালা দেবী খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেন। জেল কর্তৃপক্ষের বারবার অনুরোধে তিনি বলেন তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলে তবেই তিনি খাবেন।

ননীবালা দেবীকে প্রতিদিন সকাল ৯টার সময় ইলিসিয়াম রো তে গয়েন্দা অফিসে জেরা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে তাকে আইবি পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট মিস্টার গোল্ডি জেরা করতেন। একদিন মিস্টার গোল্ডি জেরা করতে গিয়ে ননীবালা দেবীকে বলেন-

- আপনাকে এখানেই থাকতে হবে। কি করলে খাবেন বলুন?

- যা চাইবো তাই করবেন?

- বলুন করব।

- আমাকে বাগবাজারে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের স্ত্রীর কাছে রেখে দিন তাহলেই খাবো।

- আপনি একটি দরখাস্ত লিখে দিন।

- ননীবালা দেবী সাথে সাথেই একটি দরখাস্ত লিখে মিস্টার গোল্ডির হাতে ধরিয়ে দেন।

- দরখাস্তটি নিয়ে মিস্টার গোল্ডি টুকরো টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে দেন।

- ক্ষিপ্ত হয়ে ননীবালা দেবী মিস্টার গোল্ডটি কে এক চড় মারেন। দ্বিতীয় চড় মারতে গেলে রক্ষীরা আটকে দেয়।

- ননীবালা দেবী বলতে থাকেন আমাদের দেশের মানুষের কি কোন সম্মান নেই? দরখাস্ত যখন ছিঁড়েই ফেলবেন তখন আমাকে লিখতে বললেন কেন?

এরপর ননীবালা দেবীকে ৩ নং রেগুলেশন অনুযায়ী স্ট্রেট প্রিজনার করে প্রেসিডেন্সি জেলে রেখে দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন প্রথম মহিলা স্টেট প্রিজনার।

প্রেসিডেন্সি জেলের মধ্যে দুড়কিবালা দেবীর সঙ্গে ননীবালা দেবীর পরিচয় হয়। ননীবালা দেবী যখন শোনেন দুড়কিবালাকে প্রতিদিন আধমন করে ডাল ভাঙতে হয় তখন তিনি জেলের মধ্যে অনশন শুরু করেন।

ম্যাজিস্ট্রেট এসে তাকে বলেন আপনাকে এখানেই থাকতে হবে। কি করলে খাবেন বলুন।

- আমার ইচ্ছা পূরণ হলে খাব।

- কি ইচ্ছা বলুন।

- আমার রান্নার জন্য এখানে একজন ব্রাহ্মণ কন্যা ও দুজন ঝি চাই।

- এখানে ব্রাহ্মণ কন্যা কোথায় পাবো?

- ওই তো দুড়কিবালা আছে ব্রাহ্মণ কন্যা।

- আচ্ছা তাই হবে‌।

এরপর থেকে দুড়কিবালা দেবীকে আর ভাল ভাঙতে হয় নি।

দীর্ঘ দুই বছর জেলে কাটানোর পর ১৯১৯ সালে তিনি ইংরেজ জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics