Susmita Goswami

Horror

4.3  

Susmita Goswami

Horror

নলি কাটা

নলি কাটা

12 mins
8.2K


লেখায় : সুস্মিতা গোস্বামী। 

২৫ বছর আগের ঘটনা হঠাৎ করে মনে পড়ে যায়। 

তখন টিফিন শেষের ঘন্টা পড়েছে আর স্কুলে তিনতলার বাথরুম থেকে হুড়মুড়, দুরদার করে নেমে এলো তিনটে মেয়ে। তাদের মুখে ভয়ের ছাপ। বর্দির কাছে কালবিলম্ব না করে চলে যায়। তাদের হাঁফাতে ও এমন অস্বাভাবিক ভয় দেখে বর্দি বলেন - *কি হয়েছে তোমাদের? এমন হাঁফাচ্ছ কেন?* 

--- *বর্দি তিনতলার টয়লেটে.......* 

 *---আঃ কি হলো, থামলে কেন* , *টয়লেটে কি?* খুব বিরক্তির সাথে বলেন বর্দি। 

--- *টয়লেটে ক্লাস টুয়েলভের মেয়ে অমৃতার লাশ পড়ে।* 

চমকে ওঠেন বর্দি। 

 *---কি বলছ কি? চলো শিগগির।* 

চারজন মিলে ছুটতে ছুটতে তিনতলার টয়লেটে যায়। বর্দি হকচকিয়ে দেখেন দরজা ভেজানো আর মেঝেতে পড়ে আছে কমার্সের অমৃতা। গলার নলি কাটা অবস্থায়, রক্তে ভরে গেছে সারা দেয়াল আর মেঝেটা। বর্দি আর তিনটি মেয়ে এখনও বিশ্বাসই করতে পারছে না যে স্কুলে কিনা একটা খুন হলো, তাও গোপনে। 

পুলিশ কে ফোন করে সব জানানো হয়। এরপর পোস্ট মর্টেম করেও পাওয়া যায় না খুনের রহস্য। নলি কাটা ধৃতের হাতের ছাপ ফরেন্সিক বিজ্ঞান বা গোয়েন্দা বিভাগ ও তার কুকুরও ধরতে পারে নি।

তবে কে খুন করেছে অমৃতা কে? 

    ****************

কেটে গেল পরপর ২৫ টা বছর । খুন হওয়ার পর আস্তে আস্তে স্কুল টা ফাঁকা হয়ে যায়। এখন কেবল একটা তিনতলা পোড়োবাড়ির রূপ ধারণ করেছে। যে এককালে একটা জলজ্যান্ত, কলরবে মুখরিত স্কুল ছিল, সেই তাকেই স্কুল ভাবতে সকলে বহুবার ভাবে, অবিশ্বাস করে। 

লতাপাতা ,মাকড়শা, ঝুলের অলৌকিক অলংকরণে সে এক ভীষণ চেহারা স্কুলটার।

বহু গুজব ছড়ানোর ফলে এলাকাটাও প্রায় জনশূন্য হয়ে গেছে। আর কারোর স্কুলটার কথা মনে নেই তাও গুজব ছড়িয়েছে যে রাতে নাকি অদ্ভুত ভৌতিক কান্ড ঘটে তিনতলা জুড়ে। 

তা একদিন নাইট ডিউটি পড়েছে অনিকেতের , গাড়ি ড্রাইভ করে তাকে এই জনশূন্য এলাকা ও স্কুলটার পাশ দিয়েই যেতে হবে। তাকে বাধা দেয় অনেকেই, কিন্তু অনিকেত নিরুপায়।ঐ রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। সবে জয়েন্ট করেই যদি অফিস লেট করে তবে মোটা টাকার চাকরি টা তার চলে যাবে। গাড়ি ছোটাল সবার সব কথা উপেক্ষা করে। 

অনেকক্ষণ চালাতে চালাতে এল সকলের কাছে ভয়ের জায়গা। অনিকেত দেখে বেশ নিঝুম এলাকা, নিস্তব্ধ রাত। কোনো ভয়ের কিছু নেই। তাচ্ছিল্য হেসে বলে - *হুঁ ! কী ভীতু রে বাবা! এত নিঝুম জায়গা, যে ঘুম এসে যাচ্ছে* ।

গাড়ি চালাতে চালাতে গান গাইছে অনিকেত। কিন্তু গান গাইতে গাইতে তার মনে হলো যে তার গানে কী বিশ্রী হাসি দিয়ে কে যেন তাল দিচ্ছে সমানে। 

অনিকেত গান থামাল আর তাল টাও থেমে গেল , আশ্চর্য! 

' *মনের ভুল* ' বলে ওঠে অনিকেত। সে এবার গান টান না গেয়ে একটা কার্টুন চালালো ফোনে। 

TOM and JERRY.  

বেশ কিছুক্ষণ হতে হতে সে খেয়াল করে যে ,সে জনহীন এলাকায় এতক্ষণ ধরে এত স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে কিন্তু বারবার একই জায়গায় গাড়ি চলে আসছে কি করে? গাড়ি কে সে এগোতে চাইলেও, গাড়ি যেন মাঠ টা ছেড়ে কিছুতেই যাচ্ছে না। 

এ তো মহা বিপদে পড়ল ।

ইতিমধ্যে সে দশবার স্কুলটা কে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যাওয়া সত্বেও দেখল। এই ঘটনা কেও পাত্তা না দিয়ে 'টম অ্যান্ড জেরি' শুনছে হঠাৎ করেই তার মিউজিকটা পাল্টে এলো --

" *নলি কাটতে গেলে কি পদ্ধতি লাগে সেটা এখন দেখাচ্ছি* ।"

অনিকেত ফোনের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। সে দেখে টম জেরির ঘাড়টা শক্ত করে একটা সুতীক্ষ্ণ ব্লেড দিয়ে চিরে দিল জেরির গলার নলি। আর টমের চোখ কার্টুন সুলভ নয়, লাল রক্তের ডিমের মাঝে সাদা মণি , আর মুখে পৈশাচিক আনন্দের হাসি। 

জেরি একটা আর্তনাদ করে মারা গেলে টম ভাসাভাসা গলায় বলে - *কী সুন্দর লাগে নলি কাটতে, যদি আরও কারোর কাটতে পারতাম* ..... 

বলতে বলতে টম জেরি কে যেই ব্লেড দিয়ে মারল সেই রক্তাক্ত ব্লেড নিয়ে ফোন থেকে হাত বার করে অনিকেতের দিকে এগিয়ে গেল। 

ছুটে বেড়িয়ে এলো অনিকেত গাড়ি থেকে। এসব কি সত্যিই বিশ্বাস যোগ্য? সে তো ভুল দেখছে না। তাহলে? 

এত ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে সে ছোটে ফোন, গাড়ি ফেলে। 

এবার একটু ভয় হয়েছে অনিকেতের। তার মানে কি সত্যিই জায়গাটায় অতৃপ্ত আত্মা আছে? 

নাঃ প্রাণ থাকতে আর ঐ গাড়িতে ফেরা নয়। সে হাঁফাতে হাঁফাতে এক জায়গায় দাঁড়ায়। ঘড়িতে দেখে রাত ন'টা। হঠাৎ আবার তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে হাড় হিম করা ঠান্ডা নিঃশ্বাস বয়ে গেল। 

চমকে ও ভয়ার্ত হয়ে পেছনে তাকাতেই দেখে কেমন একটা আবছা ছায়ামূর্তি মার্কা লোক দাঁড়িয়ে। 

অনিকেত মনে সাহস এনে বলে -- *কে? কে আপনি?* 

লোকটা ভাসাভাসা গলায় হেসে উত্তর দেয় -- *আপনিই বা কে যে রাতবিরেতে এখানে এসেছেন?* 

-- *আমি এই পথেই আমার নতুন* *অফিস যাচ্ছিলাম* । বলে অনিকেত। 

-- *তা আপনার প্রাণ বড় না কাজ বড় হ্যাঁ? জানেন এটা কী* জায়গা? 

 *--জানি কিন্তু...* 

অনিকেত আর বলতে পারে না। কারণ তখনই লোকটার চোখ দপ্ করে জ্বলে ওঠে আর সে লক্ষ্য করে লোকটার হাতে একটা শুকনো রক্ত লাগানো ব্লেড। সে সতর্ক হয়ে যায় ভয়েতেও ।সে আবার কোনোরকমে জিজ্ঞেস করে -- *আপনি বললেন না তো আপনি কে?* 

-- *আমি আর কে হব? আমি বরং আপনাকে অফিসে পৌঁছে দিই ।* 

অনিকেত ভাবে যদি কোনোভাবে অফিসে 

যাওয়া যায় তবে এ যাত্রায় রক্ষে। কিন্তু লোকটা কে বিশ্বাস করতে পারে না সে। লোকটা কি সত্যিই তাকে অফিসে দেবে নাকি অন্য কোথাও? ছ্যাঁত করে উঠলো একটা জিনিস দেখে। সে দেখে তার সামনে লোক টা নেই , লোকটা আছে তিনতলার ছাদে। 

এ কি? এ এ কী করে সম্ভব? বলে ওঠে সে। লোকটা কিছুক্ষণ এদিক ওদিক পায়চারি করে অদৃশ্য হয়ে যায়। 

হঠাৎ গাড়ির দিকে টানে তাকে। সে গাড়ির কাছে যেতে যেতে ভাবল আজ অফিস যাওয়া আর হলো না। গাড়িতে এসে দেখে গাড়ি অক্ষত। গাড়ির দরজা খুলতেই ছিটকে যায় অনিকেত। 

গাড়িতে শোয়ানো এক বহু বছরের সাংঘাতিক পচা, গলা মেয়ের মৃতদেহ। আর তার কী অসহ্য দূর্গন্ধ! সে চোখ বোজে তীব্র ঘৃণায় । কিন্তু চোখ বুজেও বুঝতে পারল মৃতদেহ টা যেন ধীরে ধীরে উঠে বসছে। 

অনিকেত বলে - *কে আপনি* ?  

কোনো উত্তর নেই। মৃতদেহ নিস্পলক, নিস্পন্দ। সে শুনতে পেল একটা নলি কাটা হাসি, কুকুরের অশুভ কান্না। কয়েকটা বাদুড় উড়ে গেল তার কানের পাশ দিয়ে। বাতাসে এক পচা, দুর্বিষহ দুর্গন্ধ ।

মৃতদেহ এতক্ষণে উঠে বসছে ধীরে ধীরে। অনিকেত যথা সম্ভব সাহস রাখছে মনে। সে জোড়গলায় বলে-- *কে আপনি? আমার গাড়িতে কেন আপনি বসে আছেন ? কি চান আপনি?* 

হাড় কাঁপানো এক বিভৎস হাসি নিস্পলক মৃতদেহ হেসে ওঠে এবার। আর অনিকেতের হাতে উড়ে আসে একটা কাগজ। তাতে রক্ত দিয়ে লম্বা করে লেখা একটি নামের লিস্ট। শেষের নাম টা ছিল তার। চমকে উঠে সে বলে -- *এটি কী?* 

-- *কেন যারা যারা মারা গেছে এবং মারা যাবে তাদের* *নামের তালিকা।* ভাসাভাসা গলায় হেসে বলে মৃতদেহ। 

অনিকেত বারবার এর অর্থ জানতে চায়, কিন্তু কোনো উত্তর পায় না সে। বরং সে দেখে বাদুড় গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। কি একটা যেন পায়ে কামড়ে ধরেছে । পা তুলে দেখতেই দেখে মাত্র একটা দাঁত আকৃতি বিশিষ্ট প্রাণী রক্ত শুষে নিচ্ছে হু হু করে। বহু চেষ্টা করেও পারে না ছাড়াতে। এদিকে লিস্ট পড়ছে --

 *প্রতাপ ।* 

 *মেঘনা ।* 

 *দীপা।* 

 *সুরমা।* 

 *পীযূষ।* 

 *শিবা।* 

 *কুহেলি।* 

 *দেব।* 

 *অমল।* 

 *জিনিয়া।* 

 *রহমান।* 

 *দেবদূত।* 

 *অমৃতা।* 

 *অনিকেত ।* 

এই শেষের নামটির নীচে রক্ত। অনিকেত লিস্টটি কুটি কুটি করে ছিঁড়তে যাবে তখন তার মনে হলো পায়ে কামড়ানো দাঁতটার স্থান, বলা ভালো অবশ করার স্থান ঊরু। মৃতদেহ আবার বিশ্রী পৈশাচিক হাসি হেসে ওঠে। অনিকেতের ফোন বেজে ওঠে। ফোন তো গাড়ি তে আর সে গাড়ির বাইরে কিন্তু তাও ফোন যেন কে ওকে করে দিল।অনিকেত আর পারছে না এত ভৌতিক ঝড় সামলাতে। 

সে শুনল ফোনে বলছে -- *নলি কাটব আপনার, আপনি কাটবেন আরেকজনের। চলতে থাকবে নলি কাটার অদ্ভুত হত্যা লীলার রহস্য ও পাশবিকতা । কেউ পারবে না এর সমাধান। হাঃ হাঃ হাঃ* *হাঃ হাঃ।* ফোন অবিশ্বাস্য ভাবে ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেল এই সাংঘাতিক হাসিতে। আর ফোন ভাঙতেই বেরিয়ে এল সেই ব্লেড, যার জন্য তার এমন ভয়াবহ দশা। গাড়িতে যেন দুটো আত্মা। একজন পেছনের সিটে আর একজন ফোনটা জুড়ে। স্কুলের দিকে চাইতেই 

সে দেখল তিনতলার ছাদে ঠিক এগারো টা অশরীরী ঘরে বেড়াচ্ছে , অপেক্ষা করছে কোনো নতুন বন্ধুর । তাহলে তার গাড়িতে দেবদূত আর অমৃতা। 

অনিকেত দীর্ঘশ্বাস ফেলে,তার যেন কোনো পিছুটান নেই। এই প্রেতাত্মাদের সাথে যেন সে এক হয়ে গেছে। এতবার বাঁচার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়ার জন্য নাকি কোনো অজানা, অচেনা জগতের টানে তার চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করে টপটপ করে। এতকিছু ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার গলায় ফস্ করে বসে গেল একটা ধারালো ব্লেড। পোঁচ দিল অনিকেতের নাম যত নম্বরে ছিল অর্থাৎ চোদ্দো বার। 

পরদিন কিছু স্থানীয় লোক ঐ স্থানের পাশ দিয়ে যেতেই সন্দেহের আঁচ পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ এবারেও খুঁজে পায় পঁচিশ বছর আগে অমীমাংসিত খুন হওয়া মৃতদেহের মত এমনই এক মৃতদেহ, একটি বছর চব্বিশের যুবকের।

আর এবারেও অদ্ভুত খুন! এবং এখানেও খুনি ধরতে ব্যর্থ হল সকলে।

এই খুনের ফলে দমকা বাতাসের মতো সকলের মনে পড়ে গেল গত পঁচিশ বছর আগে ঘটা সেই অমীমাংসিত ও রহস্যময় খুনের কথা। 

কে করে চলেছে খুন? কীভাবেই বা করছে? আর কেনই বা করছে? 

তদন্ত পুরোপুরি বন্ধ হলো না। এর বিহিত চাই। যেই হোক না কেন, তাকে কঠিন শাস্তি পেতেই হবে। 

       -------------------------------

পুরো খবর টা হস্টেলের লনে বসে ফোনে শুনছিল ঋতুজা। 

 *কি সাংঘাতিক!* বলে ওঠে সে। ও ভাবে ডিটেকটিভ টিম, পুলিশ সুপার বা অ্যাস্ট্রলজার কেউই কিছু পারছে অবশ্য দুঃসাহসিকতা এখনই দেখাচ্ছেন না। যাই হোক, যে কজন চিরুনি তল্লাশি করেছেন তারা কিছুতেই কিছু ধরতে পারছেন না। তাহলে কি এমন আছে সেখানে? অত বড় পরিত্যক্ত স্কুলটা তে কি কিছু আছে? অমৃতা কে টয়লেটে খুন করল নাকি খুন করে টয়লেটে মৃতদেহটি ফেলে দিয়েছে ? ঋতুজা পায়চারি করতে করতে ভাবল এই সব প্রশ্নের উত্তর। রাতের খাবারএল, খেয়ে শুয়ে পড়ল। তখন মাঝরাত। ঋতুজা কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না তবে কেউ যেন তার ঘরে পায়চারি করছে এবং সেই শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেছে। ধড়মড় করে উঠে লাইট অন করতেই শব্দ গেল বদলে। ব্লেড ঘষার শব্দ। ঋতুজা আরও অবাক হয়ে চেয়ে দেখে হস্টেলে যে নতুন চাকুরে যুবক অনিকেত এসেছে, সে একটা বেশ ধারালো ব্লেড নিয়ে তার ধার পরখ করছে কেবল । ঋতুজা কে কোন অজানা এক ভয় যেন ঘিরে ধরল। আর এই ভয়ের বশেই সে এক অলৌকিক ও অসম্ভব উপলব্ধির সামিল হয়। 

একজন যুক্তিবাদী, শিক্ষিতা মেয়ে হয়েও সে এটাকে মিরাকল মনে করে না, ভাবে ব্যাখ্যাতীত বাস্তব। 

তার মন ভাবে , খুনের নথিপত্র অনুযায়ী সর্বশেষ ও সম্প্রতি খুন যে হয়েছে সে অনিকেত আর এই মূহুর্তে যে তার সামনে দাঁড়িয়ে ব্লেডের ধার দেখছে সেও অনিকেত। একই নাম হওয়া টা যে স্বাভাবিক একটা ব্যাপার তা ঋতুজা সেই মুহূর্ত টা তে ভুলে গেছিল। কিন্তু দুটো ঘটনার চরিত্রের নাম এক হলেও ঋতুজা জানে না দুটো ঘটনার ক্ষেত্রে হত্যা দ্রব্যটাও ব্লেড। জানবেই বা কি করে রহস্য তো উদ্ধার হয়নি যে ব্লেডের পোঁচে সব খুন হয়েছে। পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগ এটুকুই জানে যে নলি টা সকল মৃতদেহের একই রকম ভাবে কাটা ছিল । কোনো অস্ত্র বা অস্ত্র হলেও সেটা কি তা ঋতুজা কেন, কেউই ধরতে পারছে না। ব্লেডের কথা সুতরাং সকলের কাছেই অজ্ঞাত। 

ঋতুজা বলে -- *এত রাতে ব্লেড নিয়ে কি দেখছেন?* 

অনিকেত হাসে। অদ্ভুতের পর অদ্ভুত। গতকাল এসেছে এই ছেলেটা, আর এই দু'দিনেই কেমন আশ্চর্য পরিচয় দিচ্ছে নিজের। 

অনিকেতের হাসি টা বেরিয়ে এল হাওয়ার মত বেরিয়ে এল। কলারের বোতামে গলাটা ঢাকা , তাও ঋতুজা খেয়াল করল ছেলেটার গলায় কেমন অনেকবার করে ঘষার কিছু দাগ। সে প্রশ্ন করে - *ওটা কীসের দাগ অনিকেত বাবু* ? 

---- *ও কিচ্ছু না।* 

হেসে উত্তর দেয় অনিকেত। 

এবারও উত্তর টা কেমন ভাসাভাসা। ঋতুজা আর সন্দেহ করে না ওকে। শুধু বলে-- *আপনি ঘুমোননি কেন* ? 

---- *আসলে রাত জাগা স্বভাব তো । ঘুম এ জীবনে রাত্রে আর আসবে না । আচ্ছা ঋতুজা, যদি আপনার ঐ নলিটার ওপর পনেরো টা পোঁচ পড়ে তাহলে কি হবে বলুন তো?* 

কথাটা শুনে ঋতুজা চমকে ওঠে। সে ভাবে তাহলে কি এই ছেলেটা তাকে রাতে খুন করবে বলে না ঘুমিয়ে' রাত স্বভাব' বলল ? আর সেই জন্যই রাতে তার ঘরে পায়চারি করছিল, কিন্তু তাকে এ খুন করবেই বা কেন? উফ! এসব কি হচ্ছে। 

ঋতুজা তাকে সন্দেহ না করলেও, সন্দেহ ঋতুজা কে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আর তাই এক অজানা বিপদের আভাস পেয়ে সে নিজেকে প্রবল ভাবে সতর্ক রাখে। কিন্তু অনিকেত কিছুই করে না। বরং সে বলে সে ঋতুজা কে এই দু'দিনেই খুব ভালোবেসে ফেলেছে। 

সন্দেহ যখন হচ্ছে তখন সন্দেহভাজন ব্যক্তির কোনো কথাতেই ঋতুজা অসতর্ক হবে না।ঋতুজার মুখে বিচলিত ভাব দেখে অনিকেত হেসে বলে -- *আপনি আমায় খুনী ভাবছেন কি করে আর আপনাকে আমি* 

 *খুনই বা করব কেন বলুন?* 

এই কথা শুনে ঋতুজার ভয় ও সন্দেহ একলাফে অনেক গুণ বেড়ে গেল। তাও সে অনঢ়। তার কেন মনে হচ্ছে এই চৌদ্দ জনের অস্বাভাবিক খুনে যেন এই অনিকেত ছেলেটি জড়িয়ে। নির্বাক, চিন্তিত ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী ঋতুজা এই অনিকেতের অস্বাভাবিকতার রহস্য উন্মোচন করবে বলে অজ্ঞানের ভান করে শুয়ে পড়ে মেঝেতে চোখ আধবোজা করে। ও দেখতে চায় অনিকেত কি করে। 

এবারেই ঘটল সবচেয়ে ভৌতিক ঘটনা টা। 

ঋতুজা দেখছে অনিকেত কে, আধবোজা চোখে। 

হঠাৎ দেখে অনিকেতের দু'টো চোখের মণি নেই। 

আর গায়ের চামড়া সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। এবার গায়ের মাংস সরে যেতেই ঋতুজা দম আটকে ফেলে দেখল অনিকেতের নলির কাছটা। 

প্রায় কয়েকবার পোঁচ নলির ওপর, পরপর অথবা একই জায়গায়। 

অনিকেত কি মানুষ নয়? প্রেতাত্মা?

আর নয়, ঋতুজা লাফ মেরে উঠল এগিয়ে আসা অনিকেতের ওপর। ভূত আর মানুষের লড়াই। 

অনিকেতের হাতে ব্লেড, যেটা দিয়ে সে ঋতুজার নলি কাটবে ।

সে অতৃপ্ত আত্মাদের মধ্যে সবচেয়ে নবীন। এবং প্রবীণ হবার জন্য ঋতুজার গলায় বসাতে গিয়েও বসাতে পারল না। 

প্রবল বিক্রমে ঋতুজা ভূতের ব্লেডটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে জানালার বাইরে । আর জানালার বাইরে পড়তেই সারা হস্টেল জুড়ে যেন এক ঝড় উঠল। ভূমিকম্প হলো। শোনা গেল অনেক প্রেতাত্মাদের হাসি। 

ব্লেডের ধাতব শব্দ

আর সেই ভয়ঙ্কর স্লোগান, " " *নলি কাটতে গেলে কি পদ্ধতি* *লাগে সেটা এখন* 

 *দেখাচ্ছি"।* 

সে এক ভয়াবহ মুহূর্তে আরও এক ভয়াবহ দৃশ্য। 

ঋতুজা দেখল তার ঘরের চালটা যেন একটা গলা। আর তাতে প্রেতাত্মা অনিকেত নখ দিয়ে চিরে দিল আর ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল চাল থেকে ঋতুজার ওপর। 

এতক্ষণে এত ঘটনার পর ঋতুজা পুরোপুরি বুঝে যায় , ঐ চৌদ্দ খুনের সাথে খুনী হিসেবে এই অনিকেত জড়িয়ে নয়, এ নিজেই চৌদ্দ নম্বর মৃত ।

আর কোনো নতুন অনিকেত বা মৃত অনিকেত বলেও আলাদা কিছু নেই। দুজনেই সর্বাগ্রে এক। 

অনেক লড়াইয়ের পর প্রেত ব্যর্থ হয়। তবুও সে ক্ষিপ্ত স্বরে বলে -- *তোমায় মরতে হবে ঋতুজা। যেমন আমায় মরতে* *হয়েছে অকালে।* আবার একবার পৈশাচিক হাসি হাসে অনিকেত। 

এত ভৌতিক ঘটনা ঋতুজার জীবনে প্রথম। 

বা রক্তে স্নান করাও। 

সে দৃঢ় অথচ ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বলে -- *কে আপনি* ? *কেন এসেছেন* *এখানে?* *মানুষের স্থানে আপনি প্রেত হয়ে কেন এসেছেন বলুন বলছি* ! 

প্রেত অনিকেতের কাছে চৌদ্দজন কে খুন করার ব্লেড টা নেই। তাই সে আরও ক্ষিপ্ত। সে কি একটা খুঁজতে খুঁজতে মিলিয়ে গেল ধোঁয়ার মত। আর রেখে গেল একটা চিঠি ----

" *ঋতুজা, আপনাকে নলি কেটে মারার দায়িত্ব ছিল আমার* *আর আমাকে মেরেছে গত ২৫ বছর আগে খুন হওয়া স্টুডেন্ট অমৃতা। আপনি শেষ* *হলে আরও একজন কে আপনি নিজে বেছে নিয়ে হত্যা করতেন। কিন্তু সেটা হলো না। কারণ আমি ভূল করে ফেলেছি। মানুষ ছদ্মবেশে থেকে আপনাকে মারতে আমার বিবেকে বেধেছে। বলা ভালো আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি।* 

 *কিন্তু তবুও আমি প্রেত আর বিশ্বাসঘাতক প্রেত। আপনাকে তাই বলি এই চিরন্তন* *মৃত্যুর অজানা রহস্য।* 

 *যে* *স্কুলে অমৃতা খুন হয় সেই স্কুলের মাটিতে পোঁতা আছে সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি* *কোনো কিছু অন্যায়, অপরাধ না করা সত্ত্বেও কিছু খুনীর ব্লেডে গলা চিরে নিহত হয়েছিলেন* *তার মৃতদেহ। যাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম স্কুল মাঠে। যাই* *হোক সেই মৃত ব্যক্তি প্রতিশোধের নেশায় তাকে যে ব্লেডে খুন করা হয় তা নিয়ে অতৃপ্ত আত্মা হয়ে* *খোঁজে তার খুনীদের।* 

 *কিন্তু বহুবার খোঁজার পরেও যখন খুনী দের পায় না তখন রেগে গিয়ে ঐ ব্লেডটা দিয়েই নলি কেটে মেরে ফেলে ঐ অঞ্চলের এক সৎ দোকানদার প্রতাপ* *মালিক কে। শুরু হলো বিচার না পাওয়া অপরাধী রূপ নির্দোষীর মনের রাগ নেভানো , একের পর এক* *ভৌতিক প্রতিশোধের খুন।* 

 *একসময় স্কুল হলো ঐ মাঠের ওপর, যেখানে বারোটা* *নিরপরাধ মানুষ নির্বিচারে খুন হয়ে অন্য কোনো নিরপরাধ কে কেবল মাত্র প্রতিশোধের বশে হত্যা করেছে তাদের সকলের মৃতদেহ।* 

 *আর একদিন অমৃতা একা হাতমুখ ধুতে গিয়ে জানালা দিয়ে আসা দেবদূতের আত্মার ব্লেডে তেরোটা পোঁচ খেয়ে মৃত্যুর কোলে* *ঢলে পড়ে।* 

 *যে* *মরবে সে যতনম্বরে থাকবে ততবারই পোঁচ পড়বে তার গলায়।* 

 *অমৃতা হত্যার দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর ছিল আমার পালা* । *আমিও মরলাম চৌদ্দবার ব্লেডের পোঁচে নৃশংস ভাবে। হয়ত আমিও ভালো ছিলাম জানেন* , *তাই ভালো আত্মার হাতেই আমি শেষ হলাম। লিস্ট টা তে আমার নামের নীচে যে রক্ত ছিল* *সেটা ততদিনই ছিল যতদিন আপনাকে আমি খুঁজে পাই নি। কিন্তু আর আপনাকে শেষ করা* হলো না । *আপনি ব্লেডের অস্তিত্ব ধ্বংস করেছেন । আর আমিও আমার সঙ্গীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা* *করে জানিয়ে গেলাম সবকিছু। "* 

চোখে জল এলো ঋতুজার । হৃৎপিন্ড ঠকঠক করে কাঁপছে। মাথা ঘুরে পড়ে গেল চিঠি টা হাতে নিয়ে। 

পরদিন সকালে হস্টেল ম্যানেজার ঋতুজার ঘরের দরজা অনেকবার নক করা, ডাকাডাকি করা সত্বেও কোনো সাড়া পেলেন না তখন দরজা ভেঙ্গে সে এক ভয়ানক দৃশ্য দেখেন। 

সারা ঘর রক্তে ভরে গেছে। অনিকেতের মৃতদেহ তখন তাড়াহুড়োর চোটে কেউ খেয়াল করে না কারণ ঋতুজা তখনও জীবিত। তাকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। 

নাঃ অনিকেতের মৃত্যু নিয়ে একশ শতাংশ প্রমাণিত সে গলায় জ্যাকেটের ফিতে শক্ত করে কলার সমেত বেঁধেছিল এবং খুলতে ব্যর্থ হয়ে শ্বাস আটকে মৃত্যু বরণ করেছে। 

কিন্তু সব স্বাভাবিক হওয়ার পর ঋতুজার কথা কেউ বিশ্বাস করল না। 

এমন কি চিঠিটাও পড়ল না কেউ। 

বহুবার চেষ্টা করেও সে এই গোটা ঘটনাটার সত্যতা প্রমাণ করতে পারে নি। 

কেন? মানুষ এত অবিশ্বাস কেন করছে তাকে?

মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। সে চিঠিটা কে যত্ন করে রেখে দিল নিজের কাছে। 

কেউ না বিশ্বাস করলেও সে বিশ্বাস করে, সে জানে এটাই সত্য।  

একাকীত্ব গ্রাস করছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে চমকে ওঠে সে। 

একি! তার গলায় এটা কিসের দাগ? 

ঋতুজা নিজের নাম বলে কিন্তু হাওয়ার মত ভেসে যায় সেটা। ঠিক যেমন নলি কাটা আত্মার হয়।  

তাহলে কি অনিকেত তাকে খুন করেছে? 

কীভাবে, কখন করল? 

সে তো জানে না । আর সে বেঁচেই বা আছে কি করে? 

আর তাই কি সে ভূতের চিঠি বিশ্বাস করছে আর সে ভূত বলে মানুষ তাকে অবিশ্বাস করছে। 

হায়! সারাজীবনের প্রশ্ন থেকে গেল যে ঋতুজা জীবিত নাকি মৃত? 

     

   **** সমাপ্ত ****


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror