মা নাকি স্ত্রী?
মা নাকি স্ত্রী?
লেখায় : সুস্মিতা গোস্বামী।
মা নাকি স্ত্রী --- কে আগে ?
দুজনেই তো নারী, দুজনেই তো কোনো
একজন পুরুষের গোটা জীবনের অর্ধেক অংশ হিসেবে সঙ্গী, দুজনের মধ্যেই তো মা প্রথমে স্ত্রী হয়েছিল এবং স্ত্রীও পরবর্তীতে মা হবে, অর্থাৎ কালক্রমে মা ও স্ত্রী দুজনেই দুজনের স্থানে এসেছিল বা আসবে। দুজনেরই জীবনে একজন পুরুষ, মায়ের কাছে ছেলে হিসেবে আর স্ত্রীয়ের কাছে স্বামী হিসেবে । মা ও স্ত্রী দুজনেই নিজেদের প্রাণপাত করে ভালো রাখে তাদের ছেলে বা স্বামী কে। দুজনেই নারী আর এই দুজনের মধ্যে যে কোনো একজনকে রাখলে সেই পুরুষের গোটা জীবনের প্রতিটা মুহুর্ত কাটানোই বিষয় হয়ে উঠবে;
তবুও, হ্যাঁ হ্যাঁ তবুও, তবুও কেন বলা হয় আগে মা তারপর স্ত্রী? কেন বলা হয় মা তোকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে ভূমিষ্ঠ করেছে কিন্তু বৌ তো এই সেদিনের! কেন প্রত্যেক শ্বাশুড়ি মায়ের দাবি যে তার ছেলে যেন তার প্রতি বেশি খেয়াল রাখে, আগ্ৰহ দেখায়। সেই ছেলেটা তো অপরদিকে একজনের স্বামীও, তা স্বামী হয়ে সে স্ত্রীয়ের ভালোমন্দের নজর রাখলে, কেন সেই স্বামী কে বলা হয় বৌ পাগল বা বৌ এর গোলাম বা স্ত্রৈণ পুরুষ?
উল্টো দিকে কেন কোনো ছেলেকে শুনতে হয় যে সে মায়ের আঁচলে বাঁধা ভেড়া? কেন তাকে তার স্ত্রী অভিযোগ করে শ্বাশুড়ি মায়ের প্রতি নজর দেওয়ার বিপক্ষে? কেন বলা হয় বিয়ের আগে পর্যন্ত মা তারপর বৌ প্রধান? কেন এই শ্বাশুড়ি আর বৌমা এই দুটো শব্দ সম্পর্ক কে দূরে করতে করতে আলোকবর্ষ দূরত্বের করে তোলে? কেন শ্বাশুড়ি আর বৌমার জায়গায় মা আর মেয়ে হয় না কেন?
প্রশ্ন আমার এই সমাজের কাছে অনেক কিছুই। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে, সমাজ তো নিজে থেকে তৈরি হয়নি আমরাই তৈরি করেছি। ঠিক হলেও আমরা আর ভুল হলেও আমরাই। তবে আক্ষেপের বিষয় এটাই যে, আমরা ঠিক হিসেবে সমাজটাকে খুব কম ই গড়তে পেরেছি নতুবা অশিক্ষার প্রতিফলন হিসেবে আজ এইরকম সমাজের মুখদর্শন করতে হতো না!
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বা ইবনে সিনা 'মা বড় নাকি স্ত্রী বড়' প্রশ্নের উত্তর খুঁজে খুঁজে জীবনটা পার করে দিলেন, তখন পৃথিবী কতটাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষতা থেকে পিছিয়ে থাকতো!
অজ্ঞ হোক বিজ্ঞ মানুষ , নিজেদের মন মস্তিষ্কের আকস্মিক বিকৃতি তে উদ্ভট চিন্তাধারা সাজিয়ে অদ্ভুত ও অযৌক্তিক উত্তর বার করাই আজকের সমাজের ট্র্যাজেডি!
আচ্ছা এবার আসল কথায় আসি, মা ও স্ত্রীয়ের মধ্যে কে বড়? নানা লোকে নানা ধরনের মন্তব্য করে উঠবে ভিন্ন চিন্তাধারা দিয়ে। কেউ বলবে, মা বড়। কেউ বলবে, বৌ বড় আবার কেউ বলবে, মা মায়ের জায়গায় আর বৌ বৌএর জায়গায়, দুজনেই অর্ধেক জীবনযুক্তা নারী তাই দুজনেই নিজ নিজ স্থানে সমান বড়, সমান গুরুত্বের।
মা আপনাকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে ভূমিষ্ঠ করেছেন মানলাম কিন্তু স্ত্রী আপনার সাথে তার নিজের মা , বাবা কে ছেড়ে আসে আপনার সাথে আপনার বাড়িতে নিখরচায় আপনার ও আপনার পরিবারের সেবা আর দাসীবৃত্তি করতে। হ্যাঁ সেবা আর দাসীবৃত্তিই বলব, কারণ যতোই আমরা জোর গলায় চেঁচিয়ে বলি আদতে আমি আপনি সবাই জানি যে অনেক বৌএর অবস্থান তার শ্বশুরবাড়ির কাছে এখনো অনেক খারাপ, অমানুষিক নির্যাতন বন্ধ হয়নি এখনো।
এবার আপনি হয়ত বলতে পারেন যে মা জন্ম না দিলে আপনি আসতেন কি ভাবে আর আপনি না এলে বৌ আসত কি করে? অবশ্যই কথাটা ঠিক, যুক্তিযুক্ত কিন্তু এটাও তো ঠিক যখন আপনি পরিণত যুবক হয়েও বৌ আনেন নি তখন আপনার মাই বলে, ঘরে একটা বৌ আনতে। আর বৌ আসার আগে পর্যন্ত মায়ের দায়িত্ব থাকে, বৌ আসলে মায়ের বিশ্রাম। কিন্তু তবুও কোথাও যেন এই কথাটা ফাঁক রেখে দেয়। যখন আপনি ছোট ছিলেন তখন আপনার মা ছিল, আপনার মা ছিল আপনার কাছে সব, তখন বৌ ছিল না তাই বৌ সম্পর্কে অতটা ভাবতে হয়নি কিন্তু যখন বৌ আসে বাড়িতে তখনো আপনি যদি ঠিক একই রকম কাজ করেন তাহলে কি এটা অন্য একটা মেয়ের প্রতি অবিচার নয়? পরিষ্কার মন, মস্তিষ্কে ভাবুন আমি কি বলতে চাইছি।
আপনার মাও তো আপনার বাবার স্ত্রী।
জীবনে কারো মায়ের বা স্ত্রীর কতটা ভূমিকা সেটার উপর এই উত্তর নির্ভর করে। আবার আপনি কোন বিষয় নিয়ে বলছেন, তার উপরেও নির্ভর করে।
আমাদের জীবনে এই দুটো ভূমিকা কিন্তু আলাদা জায়গায় এবং জীবনের আলাদা পর্যায়ে; এই কথাটা একজন মেয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
আপনাকে পালন করতে যেমন আপনার মা অপরিহার্য তেমনি আপনার স্ত্রীর আপনার সন্তানপালনে তার ভূমিকাও অপরিহার্য। সেক্ষেত্রে আপনার মায়ের ভূমিকা পরিহার্য না হলেও অপরিহার্য নয়।
এরকম আরো উদাহরণ দেওয়া যায়। তবে উত্তর আর দীর্ঘ করতে চাই না। জীবনে সামগ্রিকভাবে কে বড় এই তুলনা অবান্তর যেহেতু পরিস্থিতি, ব্যাক্তিত্ব আর বিষয় অনুযায়ী কখনো মা অগ্রগণ্য, কখনো স্ত্রী।
মা কে দেখতে গিয়ে অনেকেই স্ত্রী কে অবহেলা করে, স্ত্রীয়ের অভিযোগ, অসুবিধা কে অনেক পুরুষ ই গুরুত্ব দেননা তার মায়ের কথা শুনে উল্টোদিকে এর বিপরীত ঘটনাও ঘটে অর্থাৎ বৌ এর দিকে অতিরিক্ত নজর দিতে গিয়ে বৃদ্ধাবাস করায় বৃদ্ধা মা। মা যেমন আপনার গর্ভধারিণী তেমন আপনার স্ত্রীও তো আপনার জীবনসঙ্গিনী। এক জন কে বাদ দিয়ে অপরজন শূণ্য আপনার জীবনে এটা জেনেও সমাজের দেখাদেখি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি আপনি আজও কেন পাল্টাননি? প্রত্যেক শ্বাশুড়ি মা যদি বৌমা কে নিজের মেয়ে আর বৌমা যদি প্রত্যেক শ্বাশুড়ি মা কে নিজের মা বলে ভাবে, আমার মতে সত্যিই আর এত সমস্যা হয় না। শুধু কথার কথা আর ফাঁপা প্রতিশ্রুতি দিয়ে কি হবে যদি কাজের বেলাতেই মানুষ অপারক হয়? স্ত্রীয়ের জন্য যেমন নিজের জন্মদায়ীনি মায়ের প্রতি অবিচার করাটা অন্যায় ঠিক তেমনই মায়ের জন্য স্ত্রী কে অবিশ্বাস, স্ত্রী কে অবহেলা করাও সমান অন্যায়। মনে রাখবেন, একজন সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীই থাকে। আপনার প্রথম সফলতার পেছনে আপনার মা ছিলেন আর শেষ জীবন পর্যন্ত সফলতাতেও সেই কোনো এক নারীই থাকবে যে আপনার স্ত্রী। দুজনকেই সমান সম্মান, সমান গুরুত্ব ও সমান অধিকার দেওয়া উচিত। একে অপরের ভুল দেখে ঘন ঘন অভিযোগ এনে অশান্তি মনোমালিন্য ডাকার থেকে আপনিই সঠিক ভাবে বিচার করে মা কে মায়ের ভুল আর স্ত্রী কে স্ত্রীয়ের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন। কারণ মা যেমন তার নাড়ি, তার রক্তের অধিকারে আপনার ভালোবাসার কাঙাল ঠিক একই ভাবে অন্য বাড়ি থেকে সব ফেলে রেখে আসা ঐ মেয়েটাও তার স্বামীর কাছে ভালোবাসাই আশা করে। দৃষ্টিভঙ্গি বদলালেই তো দেশটা এগোবে। বিচার বিশ্লেষণ আরো উন্নত মস্তিষ্কে যুক্তি উপস্থাপন করে করতে হবে।
আর সবচেয়ে বড় কথা, এই বিষয়টা সম্পর্কে অবগত হওয়া সত্ত্বেও অনেক মানুষ মিছিমিছি ঝামেলা সৃষ্টি করার জন্য আরো ফেণিয়ে দেয় এই ব্যাপারটা কে। সেইসব উস্কানি মূলক মানুষ স্ত্রী ও পুরূষ উভয়কেই বলছি, আপনারা সবাই আপনাদের কাজ চালিয়ে যেতেই পারেন কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন একদিন নিজেই আপনি বুঝবেন যে এককালে আপনি আপনার অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ করে কত মানুষের কাছে হাসির পাত্রী বা পাত্র হয়েছেন !
অদ্ভুত মানুষের কাছে অদ্ভুত প্রশ্ন তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমন ধরণের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চাইতে, এমন প্রশ্নের জন্ম বা সৃষ্টির কারণ আমাদের অনুসন্ধান করা উচিত। যখন সমাজে বড়-ছোট, উঁচু-নিচু মাত্রায় মানুষের বিচারের মাত্রা বেড়ে যায় তখনই এমন প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে বলে বিশ্বাস আমার। কোথায় সৌরজগতের অন্যগ্রহে বসবাস করতে পারবো কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য মানুষের জন্ম হয়েছে, সেখানে মা বড় নাকি স্ত্রী বড় ধাঁধায় পড়ে থাকে মানব সমাজের বিশাল একটা অংশ।
"মা বড় নাকি স্ত্রী বড় " প্রশ্নের চাইতে সাম্য ভিত্তিক সমাজে প্রতিটি মানুষই সমান, প্রত্যেক মানুষই একই মাত্রার সেটা ভাবতে শেখাই আসল মানুষের কাজ বলে মনে হয়।
সবশেষে একটাই কথা, মা বা স্ত্রী যতোই যাই করুক, যে যার নিজ স্থানে থেকে, নিজ দায়িত্বে থেকে , আলাদা অর্থে অপরিহার্য, আলাদা অর্থে দুজনেই সমান, দুজনেই বড়।
