❤Susmita Goswami❤

Tragedy Inspirational Others

3  

❤Susmita Goswami❤

Tragedy Inspirational Others

সমাজবিরোধী!

সমাজবিরোধী!

21 mins
196


লেখায় : সুস্মিতা গোস্বামী।

তোর এত বড় সাহস তুই আমার মেয়ের গয়না চুরি করেছিস , বলে খুব জোরে একটা চড় বসিয়ে দেয় চক্রবর্তী গৃহিণী তার চাকর সতেরো বছরের ছেলে সৌরভের উপর। 

চুপচাপ চড় খেয়ে যায় ছেলেটি। চোখে রাগ, মনে ক্ষোভ আর হৃদয়ে ঘৃণা এই সমাজের মানুষের প্রতি! 

কি রে, চুপ করে রইলি, বল আমার মেয়ের গয়না কোথায়? 

আমি জানি না বলে সৌরভ। 

আবার মুখে মুখে কথা! যেমন মা চোর, তেমন ছেলেও ! 

খবরদার! আমাকে যা বলবেন বলুন আমার মা তুলে কথা বললে আমি কিন্তু ছেড়ে দেবো না আপনাকে! কুপিত হয়ে বলে ওঠে ছেলেটা। 

ওমা! আমার ই খাবি, আমার ই পরবি আবার আমার উপর চোপা! চলে যা বাড়ি ছেড়ে, কাল থেকে তোর মুখ যেন আমি না দেখি। আর আমার হারটা আমি যদি না পাই তাহলে দেখ তোর অবস্থা কি করি আমি!! 

এই বলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় । বড়লোকেদের রক্তে কি শুধু গরীবদের প্রতি অসম্মান ই আছে। তাদের ভগবান অঢেল টাকাই দিয়েছেন, মনুষ্যত্ব দেননি! সে আজ গরীব বলে বিনা অপরাধে চুরির বদনাম পেল কিন্তু যদি সে বড়লোক হতো তাহলে সে স্বভাবে যদি চোরও হতো তাও তাকে লোকে সাধু সাধু করত!! তার আজ কোনো ক্ষমতা নেই বলেই অনেক কিছু চাইতেও বলতে পারল না বরং সহ্যের সীমা অতিক্রম করে শুনে গেল। গরীবদের কি শুধু ঢোঁক গিলে গিলেই মরতে হয়, তারা কি কখনো উগরাতে পারে না?  

ক্ষুণ্ণ মনে বাড়ি এসে শুয়ে পড়ে সে, কিছু ভালো লাগছে না তার। 


সৌরভ, তোর পড়াশোনা কি আদৌ হবে আর?? গরীবের অত পড়াশোনা করতে নেই । 

তোর বাবা আর কত কষ্ট করবে, পরিশ্রম করবে, তোর বাবারও তো বয়স হয়েছে তাই না!! 

তোর মাকেও দেখ, কত কষ্ট করছে, কত লোকের কাছে কথা শুনছে, গঞ্জনা, বঞ্চনা ইত্যাদি শুনছে!

তার উপর তোর একটা বোন আছে, তার কথাও তো ভাবতে হবে তোকেই! 

তবুও তুই কি আরো পড়তে চাস, বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখছিস!! কি হবে এসব স্বপ্ন দেখে, যা পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে কোনো কাজ দেখ, নেশা কর , গায়ে জোর পাবি। দেখ তোর বন্ধুদের, তোর বয়সেরই! অথচ কত টাকা রোজগার করছে, টাকা ওড়াচ্ছে, কত লোকবল ওদের এখন আর তুই খালি পন্ডিত হবি পড়াশোনা করে, যত্তসব!!! মুখে আগুন লাগুক তোর অমন পান্ডিত্যে! এখন শুধু টাকা বুঝলি!! চারদিকের গুঞ্জন আর গঞ্জনা। আর পারছে না সৌরভের হৃদয়।  


ঘুমটা ভেঙ্গে গেল দেখল গভীর রাত। সৌরভ স্বপ্ন দেখছিল। অবশ্য এখন স্বপ্ন আর বাস্তবে ফারাক নেই। এই ব্যর্থ কথাগুলো সে বাস্তব ও স্বপ্ন দুটোতেই দেখছে, শুনছে। অথচ তার স্বপ্ন ও বাস্তব এক হওয়ার কথা ছিল সাফল্যে, ব্যর্থতায় নয়। কিন্তু কপাল কি তার!!! 

সৌরভ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার কিছু আর ভালো লাগছে না, লাগেও না। ভাড়া বাড়িতে থাকে। পড়াশোনায় অসম্ভব ভালো ছেলে, মেধাবী ছেলে সে। কিন্তু পেটে ভাত না থাকলে কি আর পড়া হয়? সবাই মনে হয় ঠিকই বলে , সত্যিই মনে হয় গরীবদের পড়াশোনা করতে নেই, তাদের শুধু উঞ্ছবৃত্তি করতে হয়, লড়াই করতে হয় সামান্য খাবার আর একটু ভাল থাকার আশায়। কবি জয় গোস্বামীর সেই প্রখ্যাত বাস্তবমুখী কবিতা "নুন" ; আমাদের শুকনো ভাতে লবণের ব্যবস্থা হোক ! সুখ নয়, শান্তি চাই একটু। কি করবে এখন সে, এখন অসহায় মানুষের পাশে থাকার মতো কেউ থাকে না তেমন সৌরভের পাশেও কেউ নেই। 

 

পরদিন। বাড়ির লোক জানত না যে চক্রবর্তী বাড়ির কাজটা তার চলে গেছে বিনা দোষে খারাপ অপবাদ পেয়ে এরপর সে ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফিরে আসে আর মা তাকে বলে , কিছু একটা কর বাবা, এভাবে তো আর চলা যায় না। বাড়ি ভাড়ার টাকা, বাবার ওষুধ, তোর পড়াশোনা আর সংসার এসব নিয়ে তো আর পেরে উঠছি !!

সৌরভ চুপ করে থাকে, সে তার কাজ হারিয়েছে তাও মিথ্যে অপবাদ পেয়ে তা সে মা কে বলবে কি করে; আর এই মুহূর্তে কি কাজই বা পাবে আর কেই বা দেবে তাকে কাজ! এর আগে যেই কাজটা করছিল সেইটা তার জন্য অনেক কঠিন হলেও সবথেকে ঝুঁকি ছিল তার প্রাণ নিয়ে। সে বাঁচার জন্য কাজ ছেড়েছে তা নয় , পরিবারকে বাঁচানোর জন্য কাজটা ছেড়েছে। সে মরে গেলে পরিবার টা যে শেষ হয়ে যাবে, একটা প্রাণের বিনিময়ে আরো তিনটে প্রাণ জেনেশুনে অচিরে শেষ হবে, না না তা হয় না।  

আগের বার সৌরভের দূর্ঘটনা হয়েছিলো খুব বড় সড় । জীবনটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। ছোট থেকে দারিদ্রতার সাথে লড়াই করতে গিয়ে তার এতটা অসহায় মনে হয়নি যতোটা আজ হচ্ছে। নিজের আত্মীয় স্বজন সকলকে আর চিনে উঠতে পারে না সৌরভ। সুখের সময়ের পায়রা এরা!! 

দুপুরে খেতে ইচ্ছে করছে না সৌরভের। না খেয়েই শুয়ে পড়ল। ছোট বোন টা তার পাশে এসে বলে, দাদা, এত মন খারাপ করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। 

বোনের কথা শুনে মনটা একটু হালকা হয় সৌরভের। বড় ছোট্ট তার বোনটা, একেবারে পিচ্চি আদরের মিষ্টি বোন। ক্লাস ফাইভে পড়ছে এখন, দাদাই পড়াশোনা করিয়ে এসেছে ছোট থেকে, এখনো পড়ায় দাদাই। বোনের নামটা বড় সুন্দর, সৃষ্টি। দাদা আদর করে সুতো বলে ডাকে। বোনকে কাছে নিয়ে বলে, তাই যেন হয় বোন, তোর কথাই যেন সত্যি হয়। 

হ্যাঁ দাদা, তুই পারবি আমি জানি। বোন হেসে বলে। 

বোনের কপালে চুমু দেয় সৌরভ আর ভাবে বোনটা তার এত্ত ছোট আছে যে সমাজ, বাস্তবটার কাঠিন্য বোনের কোমল মনটাকে এখনো ছুঁতে পারেনি। থাক ছুঁতে পারার দরকার নেই, ছুঁলেই তো ওর মুখ দিয়ে এই সরল, নিষ্পাপ আশীর্বচন আর বের হবে না । ও এমনটাই থাকুক। মনটা মাঝে মাঝে মোঁচড় দিয়ে উঠছে চক্রবর্তী গৃহিণীর তিক্ত কথাগুলো মনে পড়তেই । শেষমেষ তার মতো সৎ, নির্লোভী ছেলেকে চোর শুনতে হলো, কিন্তু গয়নাটা তো ও নেয়নি, কোথায় গেল তাহলে? ও ফেরত দেবেই বা কি করে? যদি চক্রবর্তী বাবু তাদের এই ভাড়াবাড়িতে এসে রটায় তাহলে তো এখানেও কেউ তাদের থাকতে দেবে না, সবাই ভুলটাকেই ঠিক ভেবে পূজো করবে কারণ চক্রবর্তীদের স্টেটাস আছে, বিরাট বড়লোক কিন্তু সৌরভদের কি আছে! 

সে ভাবতে থাকে কি করবে, এত চাপ আর নিতে পারছে না ছেলেটা। সমাজ তাকে এত যন্ত্রণা দিচ্ছে তাহলে কি এই চিত্রিত সমাজের বিরোধিতা করা সমাজবিরোধী তাকে....... 

না না এসব কি ভাবছে সে! নিজেকে সামলে নেয় কোনোরকমে। ভয়ঙ্কর মানসিক চাপ তাকে এইসব ভাবাচ্ছে। সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাও আছে তার। এত খারাপ লাগার মধ্যেও কিছু ভালো ঘটনা মনে করে হাসে সৌরভ। সে ক্লাসের প্রথম তিনজনের মধ্যে বরাবর থাকে, সভ্য, ভদ্র, সৎ ছেলে বলে স্যার, ম্যাডামরা তাকে অনেক ভালোবাসেন, পড়াশোনাতে তাঁরা সাহায্যও করেন সৌরভকে। সৌরভের এলাকাতেও সৌরভ ও সৃষ্টি খুব ভালো ছেলেমেয়ে সকলের কাছে। ছেলে রান্না করতে পারে , সমস্ত কাজ পারে ঘরের, সাঁতার কাটা, গাছে চড়া, ঘুড়ি ওড়ানো এমনকি ধানক্ষেতের কাজেও দক্ষ সে। একদম পরিণত যুবকের মতো দায়িত্ববোধ তার। আর এই সুখের সংসারটাই তাদের ভেঙে ছারখার হয়ে গেল একটা ঝড়ে। বাবার শরীর ভালো নেই আর বাবার সামান্য কাজটাও নেই। জমিজমা যা কিছু ছিল সব একটু আধটু বিক্রি করতে হয়েছে কারণ এই অভাবের কারনে অনেক ধার হয়ে গেছে। কি করে সব শোধ হবে,বাড়ি ভাড়া কি করে দেবে, কি করে সব ঠিক হবে, কি করে বোন আর সৌরভ নিজে পড়াশোনা করতে পারবে? আবার সেই দুশ্চিন্তা তাড়া করে তাকে। দু ঘন্টা চুপচাপ মন দিয়ে পড়তে বসে দুপুরেই। বোন ঘুমিয়ে পড়েছে তার কোলেই ।

পরীক্ষায় সবার চেয়ে ভালো করতে হবে এটাই তার উপর সব স্যার এর চাওয়া, বিশ্বাস আর সৌরভ তা পারবে। কিন্তু পড়ায় মন বসাতে চেয়েও পারছে না। মাথায় চিন্তা, পেটে খিদে নিয়ে কি পড়াশোনা হয়? পড়তে পড়তে সৌরভ ভাবে কত বড় বড় স্কলারশিপ এর উদ্যোক্তারা বলেন, তারা পড়াশোনায় পাশে আছেন কিন্তু কেউ জীবনধারণে পাশে আছেন এটা বলে না কেন? বা যদি গরীব ছেলে কাজ করতে যায় কোনো বাড়িতে সেখানেও তাকে বিনা দোষে দোষী সাব্যস্ত করা হয় কেন, কেন তখন গরীবদের পাশে দাঁড়িয়ে কেউ বলে না, সব মানুষ এক নয়। ও অন্যায় করেনি, ওর কোনো দোষ নেই। কেন মানুষের মতো সম্মান তো দুরের কথা, মানুষ বলেই ভাবে না দরিদ্রদের? কোন যুগে বাস করছে সে, যেখানে মঙ্গলযান বর্তমান, যেখানে চন্দ্রযান - 1, 2 বর্তমান , যেখানে কম্পিউটার, সোশাল নেটওয়ার্কের মতো মানুষ ইঁদুর দৌড়ে উন্নতির শিখরে ছুটছে। হুম, ইঁদুর দৌড়ই বটে, তাই কে কাকে মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে কারোর হুঁশ নেই। মানুষ শব্দের অর্থটাই আজ ধুলোর মিশে গেছে, না মানবিকতা আছে না কোনো মানুষ হুঁশিয়ার। সমাজ শুধু বড় বড় বক্তৃতা দিতে পারে, ভাষণ দিতে পারে, শাসনব্যবস্থা শুধু ক্ষমতাহীন লোকেদের উপর শাসন করতে পারে, ক্ষমতাশালীদের উপর পারে না। আজ যার টাকা আছে সে বড় অপরাধী হলেও গোটা বিশ্ব তার পক্ষে। কিন্তু অপরাধী!! সব অপরাধী কি স্বভাবে অপরাধী? অভাবে কি কেউ অপরাধী হয় না? এই যে সে নিজেই যেমন অভাবী বলে বিনা অপরাধেও অপরাধী হয়ে গেল তাহলে সে যদি সত্যি সত্যি অপরাধ করে তখনও তো তাকে সবাই অপরাধী বলবে। আর সে গরীব বলে অপরাধ করলেও অপরাধী, না করলেও তাই। বড়লোকের কি কোনো অপরাধ নেই? অনেক অপরাধ আছে কিন্তু তাদের অপরাধ গুলো কালো টাকা দিয়ে ঢাকা। হয়ত তাদের মধ্যেও কেউ কেউ সৌরভের মতোই একজন অভাবী, সাধারণ ছেলে ছিল কিন্তু সমাজ তাকে যেদিন মিথ্যে মিথ্যে চোর বানালো , তারপর থেকেই সে সত্যি সত্যি চুরির সাথে যুক্ত হয়ে গেল আর সমাজ তাকে তকমা দিল "সমাজবিরোধী!" সমাজের বিরোধিতা করে যে মানুষ। কিন্তু অদ্ভুতভাবে, সেই মানুষটির তৈরিটাও হয় সেই শিক্ষিতের মুখোশ পরা সমাজের হাত ধরেই।  

এমন অনেক কিছু ভাবে সৌরভ। দেখে চারিদিকের অবক্ষয়। দেখে সমাজের অবক্ষয়, রাজ্যের অবক্ষয়, দেশের অবক্ষয়। গোটা মানবজাতির অবক্ষয়। কাউকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করলেই সে যেমন ধীরে ধীরে শ্রেষ্ঠত্ব হারানোর কাজে লিপ্ত হয় নির্ভীক অহংকারে, মানুষেরও হয়েছে সেই দশা। 

চক্রবর্তীদের হারটা পরে নিজেরাই পায়। কিন্তু তারা ক্ষমা চায়নি সৌরভের কাছে। সৌরভ আশাও করে না এসব। মনের মধ্যে প্রবল ঘৃণা জন্মাচ্ছে এইসমস্ত মানুষগুলোর প্রতি যারা একটা সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের এক তুড়িতে বিনা দোষেও সাংঘাতিক অপরাধী বানিয়ে দেয়। যেসমস্ত উঁচুতলার মানুষরা গরীব মানুষদের পিষছে, মারছে, তাদের রক্তের গন্ধে শকুনের মতো করে তাদের সবার গলা কেটে হত্যা করতে ইচ্ছে করে সৌরভের। রাগ হয় নিজের উপর, পড়াশোনা শিখছে কি জন্য, যেখানে পড়াশোনাই মানুষ তৈরি করতে অপারক। যেখানে শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হয়ে অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত, সেখানে কীসের জন্য পড়াশোনা? হতে পারে সে নিজে মানুষ হতে পেরেছে কিন্তু তার পাশের জন হতে পারেনি বা হতে দেয়নি মানুষ হতে! টাকার জন্যে যেখানে পড়াশোনা শেষ হয়ে যায়, টাকার জন্য যেখানে শিক্ষা মাথা নত করে সেখানে কীসের পড়াশোনা? পড়াশোনা শেখা, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত লোক বেকার বা ভিখারী আর অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে রয়েছে তবুও টাকার জাহাজে ভাসা লোকজন নেতা মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সরকারী চাকরিজীবী, ব্যক্তি! মাথার শিরা গুলো টনটন করছে ব্যথায়। তাদের মতো মানুষদের জীবন নিয়ে মানুষ বাজী খেলবে না কেন, যেখানে স্বয়ং ঈশ্বরই বাজী খেলছেন! ঈশ্বর মৃত প্রতিমূর্তি হয়ে গেছে এখন। সব পরীক্ষা গরীবদের কেন দিতে হয় ! 

মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেল যে চক্রবর্তী বাড়ির কাজটা তার ছেলের আর নেই। কেন জানতে চাওয়া তে সৌরভ অন্য একটা কথা বলে ঘুরিয়ে দেয়। স্কুলের জন্য তৈরি হয়। সাইকেল করে বোনকে আর নিজেকে স্কুলে পৌঁছে দেয়। 

পড়াশোনার মাঝে থাকলে সব দুঃখ দারিদ্রতা ভুলে যায় সৌরভ। Honesty is the best Policy কথাটা আজ যেন মুখ লুকায় লজ্জায় । টিফিন টাইমে কিছু বন্ধুরা দূর এলাকায় নানারকম কাজের অফার করে সৌরভকে। সৌরভ সব শোনে। বলে, দেখ বেশি দূরে আমি যাবো না, মা আর বোনকে ছেড়ে। তাই একটু কাছাকাছি এলাকা হলে ভালো হয়। 

অমনি দু'জন বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে, গুরু তুমি যদি এখনো নেকাপড়া নিয়ে ভালো ছেলে হয়ে থাকো, তাহলে তোমার পরিবারের উন্নতি জীবনেও হবে না! 

কি বলতে চাইছিস! 

কি আর বলবো, বলতে চাইছি যে এবার পড়াশোনায় ডুব মারো, লাটে তোলো। পেটে খিদে আর পড়াশোনা দেখাচ্ছে! শোন যা বলছি, আমাদের দেখ, এখনি একটা বাইক কেনার মতো ক্ষমতা রাখি। আর একটু মদ টদ পেটে ঢাল। অত সাধুপুরুষ হয়ে জঙ্গলে থাকা যায়, এই বাস্তব সমাজটায় নয়। এখন শুধু আকাশে বাতাসে টাকা আর টাকা। আর টাকা কামাতে সবাই যত নীচে নামতে হয় তত নীচে নামতেই রাজি। আরে ভাই, এখন লেখাপড়া করে কেউ বড় হয় না, যার টাকা আছে তার হাতেই সবকিছু, ওসব লেখাপড়া সব ফালতু, কিসসু হয় না ওতে! যা বললাম একটু ভেবে দেখিস। 

সৌরভের মন বিদ্রোহ করে ওঠে। চারিদিকে সে এই একই কথা শুনছে। সবাই কি আসল বিবেক হারিয়ে ফেলেছে! সামান্য অর্থ রোজগার করতে করতে বিপুল অর্থের নেশা গরীব ছেলেমেয়েদের খারাপ পথে পাঠাতেও দ্বিধা করেনি। জেলের সমস্ত অপরাধীই অপরাধী স্বভাবে বশবর্তী হয়ে নয় বরং কেউ কেউ পরিবারের যন্ত্রণা আর শিক্ষিত সমাজের ইন্ধনে অপরাধী হয়ে উঠেছে। সমাজের শিক্ষিত ও ধনী শ্রেণীই কি তৈরি করে সমাজবিরোধী? না না সব মানুষ তো এক নয়। সব বড়লোক তো এক নয় আবার সব গরীবও এক নয়। কিন্তু ভালো মানুষ কোথায়, তারাও কি নিজেদের চোখ, কান বন্ধ করে নিয়েছে সমাজের অবক্ষয় দেখবে না বলে, কিন্তু কেন প্রতিবাদ নেই? কেন একটা গরীব ছেলে একটু শান্তিতে বাঁচতে পারে না ঝুরি ঝুরি প্রতিশ্রুতি, সাহায্যের ভীড়ে? কেন একটা গরীব মেয়েকে পরিবার নিজেদের বোঝা কমাতে "বড়লোক শ্বশুরবাড়ি" নামক যৌনপল্লী তে মৃত্যুর মুখে হাসি মুখে পাঠিয়ে দেয়? কেন এত লড়াই এই সমস্ত নিরস্ত্র মানুষদের করতে হয়? সৌরভের 

বুক ফেটে যায়, চোখ দিয়ে জল আসে চেয়েও আসছে না। ছেলেদের তো আবার কাঁদা বারণ! 

ঘৃণিত সমাজকে উপেক্ষা নাকি ঘৃণিত সমাজ তাকে উপেক্ষা করে সমাজবিরোধী তৈরি করবে? 

অবশ্য এইরকম পাপী সমাজের বিরুদ্ধে থাকাই উচিত। কারণ সমাজবিরোধী মানে তো সমাজের বিরূদ্ধে, সামাজিকতার বিরুদ্ধে। 

কিন্তু যেখানে সমাজের চিত্রেই অসামাজিকতা, সেখানে নতুন করে তো সমাজবিরোধী তৈরি হওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। বরং এই বর্তমান সমাজের বিরোধিতা যে এখনো করে, কোনো অন্যায়, কোন ঘুষ এবং নিজের মৃত্যুর সম্ভাবনা কে ভয় না পেয়ে, সেই তো প্রকৃত মানুষ, প্রকৃত সামাজিক জীব। ভালো সমাজের বিরুদ্ধেও যেমন সমাজবিরোধী আছে খারাপ সমাজের বিরুদ্ধেও সমাজবিরোধী আছে। প্রথমটা নিজ স্বভাবে আর দ্বিতীয় টা সমাজকর্তৃক।

এরপর চলে পরপর কয়েকটা বছর অমানুষিক লড়াই। জীবন তাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। চারদিকে ছুটেছে কাজের জন্য, অনেক পরিশ্রম, অনেক অধ্যবসায়, অনেক প্রত্যাখ্যান, অনেক অপবাদ, নিন্দা, অনেক দ্বিধা, অনেক ঠকে যাওয়া, অনেক ঝুঁকি আর অনেক অনেক অনেক ব্যর্থতার পর অবশেষে একটা গন্তব্যে পৌঁছায় সৌরভ। গন্তব্য টা একবাক্যে লেখা হয়ত আমার জন্য সোজা কিন্তু এই সোজা লেখাটা তাকে বাস্তবায়িত করতে অনেক অনেক অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে, অনেক ধৈর্য্য ধরতে হয়েছে, অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে, অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে অনেক নোংরা প্রস্তাব, বোনকে নিয়ে অনেক নোংরা আবদার পেয়েছিল বিরাট বড় পদের কাজের পরিবর্তে। কিন্তু সৌরভ যে সমাজবিরোধী । সে প্রশ্রয় দেয়নি এই কথাকে। মার খেয়েছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে, সমাজের উঁচু তলার লোকেদের আসল অবস্থান বুঝিয়ে দিতে। সে মানেনি কারোর প্ররোচনা, প্রলোভন। সে তার সত্যের রাজত্বে অনেক বাধাপ্রাপ্ত হয়েও রাজা হয়েছে। সে তো এই মিথ্যের সমাজের বিরোধী এক সত্যদীপ্ত যুবক। সেও যে একপ্রকার সমাজবিরোধী ! 

সফল না হলে ব্যর্থতার গল্প কেউ শোনে না তেমনটাই হয়েছিল সৌরভের জীবনেও। সমাজের প্রতি তার বেপরোয়া গুন্ডামো কে ভয় করত মিথ্যাচারী রা। যেইসব মিথ্যাচারী সৌরভের মতো ছেলেমেয়েদের সত্যের বিরুদ্ধে থাকা সমাজবিরোধী তৈরি করে। কিন্তু সৌরভ আরেক জাতের গুন্ডা, সে মিথ্যের বিরুদ্ধে থাকা সফল সমাজবিরোধী এবং সে সমাজের মিথ্যে প্রতিশ্রুতির আড়ালে থাকা অবক্ষয় ও অবক্ষয়িত মানুষদের কেও সমাজবিরোধী হিসেবে তৈরি করবে। যেদিন সমাজ থেকে সব অন্যায় শেষ হবে সেদিন হয়ত এই সমাজবিরোধী শব্দটাই তৈরি হবে না। মানুষ ঠিক না হলে, সমাজ ঠিক হবে কি করে?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy