নিসিদ্ধ পল্লীতে একটি রাত
নিসিদ্ধ পল্লীতে একটি রাত
নিসিদ্ধ পল্লীতে একটি রাত
( প্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্য )
কলমে - কৃষ্ণ ব্যানার্জী
আমরা জীবনের বহু ক্ষেত্রে বেশ কিছু ভুল নিয়ে পথ চলি। নিসিদ্ধ পল্লী নামটা শুনলেই আমাদের চোখ মুখের চেহারায় একটা পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। কেউ কেউ কপালে ভাঁজফেলে বলেন কত পরিবার এদের কবলে পড়ে ধংস হয়ে যাচ্ছে। কেউ বলেন পতিতাদের আবার জাত ধর্ম কি ওরা হলো বারোভাতারি মাল এর ওর বিছানা গরম করে পেট ভরে। আর একজন তাচ্ছিল্যের সাথে একটা মন গড়া গল্প জুড়ে দিয়ে বলল, ঐতো আমাদের পাশের পাড়ায় থাকতো, কোন এক সময় আমার বন্ধু ছিলো ওর বিয়েতেও আমি গিয়েছিলাম। কি সুন্দরী বৌ দাদা তার পারেও ওখানে যাওয়া আশা করে সংসারটা সম্পূর্ণ ম্যাস্ট হয়ে গেল। শুনেছি ওদের মধ্যে নাকি ডিভোর্স কেশ চলছে। আমার বৌতো বলেই দিয়েছে আমি যেন ওর আশেপাশেও না যাই। তারপর থেকে আমি ওর সাথে যোগাযোগ রাখিনা আমার পরিবার আছে আমার সন্তান আছে, আমি একটা সমাজে বসবাস করি সবকিছু নিয়েই চলতে হয় তাইনা।
সকলের মুখে ঐ জায়গাটার নাম শুনে খারাপটাই ভাবতাম। আমার ধারণা ছিলো ওখানকার মানুষেরা মন্দ। ওখানে যে মেয়েছেলে গুলো থাকে তারা সমাজে নষ্ট মেয়ে ছেলে তাই কোন কাজ পড়ে গেলেও ঐ অঞ্চলটিকে এড়িয়ে চলতে। তবে সেদিন রাতে যদি ঐ দূর্ঘটনাটা আমার সাথে না ঘটতো তাহলে হয়তো আজও আমি পতিতাদের নিয়ে আরো পাঁচজনের মতোই ভাবতাম। আমি ভাবতাম ওরা নিজেদের কাজ মেটানোর তাগিদে যা কিছু করতে পারে কিন্তু সেই রাতে আমার ভুলটা ভেঙে গেল। আপনাদের হয়তো মনে আছে একটা সময় ছিলো যখন কথায় কথায় বাংলা বন্ধ, ভারতবন্ধ চাকা জাম এই ধরনের প্রতিবাদ মূলক ঘটনা ঘটতেই থাকতো। তেমনই একদিন ঐ অঞ্চলের খুব কাছে একটা অফিসে আমার মিটিং সেট হলো সন্ধা আট্টার সময়। এক ঘন্টার মিটিং তারপর বেড়িয়ে ঐ অঞ্চলটি ক্রসকরে সামনের মোরথেকে গাড়ি সোজা শিয়ালদা তারপর ট্রেনে চেপে সোজা বাড়ি। স্টেশন থেকে পায়ে হেটে আমার বাড়ি দশ মিনিটের রাস্তা কিন্তু আমি যেখানে রয়েছি সেখানথেকে শিয়ালদহ ঘন্টা দেরেকের পথ। মিটিং শেষ হতে একটু দেরি হয়ে গেল। অফিসের ভিতরে থাকায় বাইরের পরিস্থিতি সম্বন্ধে কোন ধারণা হওয়া সম্ভব ছিলোনা।
অফিস থেকে বেড়াতে ঘড়ির দিকে নজর পড়তে দেখলাম দশটা বেজে পাঁচ। পাঁচমিনিট হেটে সামনের মোরটায় পৌঁছাতে পারলেই বাস পেয়ে যাবো। আজ বাড়ি ডুকতে একটু দেড়ি হয়ে যাবে। অফিস থেকে বেড়িয়ে আমার টিকি ওয়ালা সেল ফোনটা দিয়ে বাড়িতে একটা ফোন করে দিলাম। বাবা ফোনটা ধরেই বললেন কোথায় আছিল তুই আমি জানালাম সবটাই। বাবা বললেন ওনাদের গাড়ি থাকলে তোকে শিয়ালদহে নাবিয়ে দিতে বল হঠাৎ করেই চাক্কা বন্দ করেছে বাস আর ট্যাক্সি ড্রাইভাররা। কথা বলতে বলতে মোড়ের দিকে এগুচ্ছিলাম। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। রাস্তার ধারে কয়েকটি বিভিন্ন বয়সি মেয়ে নানান ধরনের উত্তেজিত করবার মতো পোষাক পড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের দিকে একনজর তাকিয়েই হন হন করে ফেলে আশা অফিসের দিকে ছুটলাম। কোন লাভ হলোনা বরঞ্চ সময় নষ্ট হলো কিছুটা। দারোয়ান দরজায় তালা লাগাচ্ছে। লোকটি বিহারী জিঙ্গাসা করলাম সাহাব নিকল গেয়া? বাঙালির হিন্দি যেমন হয় আরকি, লোকটি জবাব দিল আভি লিকল গেয়া সাহাব। মনে হলো কফিনের শেষ পেরেকটা কেউ আমার বুকে বসিয়ে দিল। ব্যাগে অনেকগুলো টাকা সকালে ব্যাঙ্কে জমা করতে হবে সবটাই অফিসের টাকা কোন অঘটন ঘোটলে ফিরিয়ে দেবার ক্ষমতা আমার নেই। হাটা পথটা ভালোনা মাঝে মাঝেই শোনা যায় ছিন্তাই টিন্তায় হয় সেখানে। আমি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এসে পড়লাম আবার সেই স্থানে যেখানে মেয়েগুলো দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি খেয়াল করে দেখলাম দু -একজন বদলে গিয়েছে। তারা হয়তো ক্রেতা পেয়ে গিয়েছিল।
একজন মধ্যবয়ষ্ক মহিলা আমাকে লক্ষ করছিলেন। তিনি হয়তো আমাকে দেখে কিছু উপলব্ধি করলেন। আমি ওনাকে আমার দিকে আসতে দেখে ভয়ে কিছুটা কুকড়ে গেলাম। আমার সামনে এসে বলল, তোমাকেতো আগে এই পাড়ায় দেখিনি, কি বেপার বলতো। সরাসরি তুমি আমার রক্ত জল হয়ে যাচ্ছে। সে আবার বলল দেখেতো মনে হচ্ছে ভদ্দ ঘরের ছেলে তা এতো রাতে এখানে কি দরকার। মনটাকে একটু শক্ত করে বললাম। প্রচন্ভ বিপদে পরে গিয়েছি বুঝতে পারছিনা কি করবো? কিসের বিপদ এখানে কোন বিপদ নেই ঘ্যান ঘ্যান না করে আসল কথাটা বলে ফেল দেখি। আমি সবটাই খুলে বললাম। মহিলাটি আমার কথা শুনে বললেন কাছে শ পাঁচেক টাকা হবে। আমার হৃদয়ের স্পন্দন যেন চারগুন বেড়ে গিয়েছে, আমি বললাম আমি ওরকম মানুষ নই। ভদ্রমহিলা বললেন সেতো তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমরা মানুষ চিনি। দেখো যদি টাকা না থাকে তাহলে আমাদের কোঠায় থাকতে দিতে পাড়ি কিন্তু এখানে তোমাদের ওখানকার অনেক লোক আসে দেখতে পেলে বদনাম হয়ে যাবে। পাঁচশ টাকা থাকলে বলো সামনে একটা হোটেল আছে কথা বলে দিচ্ছি ওর মধ্যেই ওরা খেতেও দিয়ে দেবে, মানে মানে রাতটা কাটিয়ে সকালে বেড়িয়ে যাবে বুঝলে। এবার যেনো একটু প্রাণ ফিরে পেলাম। একটু স্বাভাবিক হয়ে বললাম এই উপকারটুকু যদি করে দেন তাহলে আমার খুব উপকার হয়। ভদ্রমহিলা আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে ম্যানেজারকে বললেন লোকটা বিপদে পড়েছে, কাছে টাকা বেশি নেই পাঁচশ টাকা দিতে পারবে ওর মধ্যেই খাবার ব্যবস্তা করে দিস বুঝলি। মহিলার দাপট রয়েছে বেশ। লোকটি ওনার মুখের উপর কিছু বলার সাহস দেখালইনা, একটা চাবি আমাকে দিয়ে রুম নাম্বার বলে দিলো। ভদ্রমহিলা আমাকে বলল আর কোন ভয় নেই তুমি আমার মেহেমান আছো। এই বলে তিনি চলে যেতে যান আমি তাকে জিঙ্গাসা করি আপনার নামটা? তিনি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন যার যা ইচ্ছা সেই নামেই ডাকে কেউ বেশ্বা বলে কেউবা পতীতা আমরা হলাম নষ্ট মেয়েমানুষ আমাদের আবার নাম। আমি বললাম এদিকে এলে যদি আপনার সাথে দেখা করতে চাই তাহলে? একটু থেমে তিনি বললেন দেখা করতে হলে বলবে চম্পার সাথে দেখা করব অন্ধ থেকে পুলিশ তোমাকে আমার কাছে পৌঁছে দেবে। তারপর বলল এখন আমি চলি নইলে আমার ধান্দার খতি হয়ে যাবে, এই বলে ভদ্রমহিলা সেখান থেকে চলে গেলেন।
আমি একজন নষ্ট মেয়েকে ভদ্রমহিলা বলে সম্বধন করেছি কয়েকবার কারণ সেদিন আমার সব ভুল ভেঙে গিয়েছিল। আমিযদি সত্যিকারের ভদ্র কারো কাচ্ছে সাহায্য চাইতে যেতাম জানিনা তাহলে আদেও সেদিন রাতটা আমার কোথায় কাটতো? সেদিন আমি বুঝেছিলাম ওদের পেশাটা খারাপ হতে পারে তাবলে ওরাও যে খারাপ হবে তেমনটা নয়। আমরা কোনকিছু না জেনেই একজন মানুষকে কোথায় নিয়ে এসে ফেলি। সেদিন নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছিল…….।
🙏 সমাপ্ত 🙏
