নিমন্ত্রণ।
নিমন্ত্রণ।
বাদলের সাথে আমার পরিচয় প্রায় বছর পাঁচেক আগে বনগাঁ লোকালে। প্রথম দিকে সহযাত্রী ও ক্রমে আমার খুব কাছের বন্ধু হয়ে যায়। সপ্তাহে ছয় দিন অফিস যাওয়ার পথে হৈ-হুল্লোড় করতে করতে আসা যাওয়া করি। ওর আর আমার অফিস মাধ্যমগ্রামে। কয়েক ঘন্টার যাতায়াতের পথ কিভাবে যে তাড়াতাড়ি কেটে যায় মালুমই হয় না। ওর দেশের বাড়ি বনগাঁ, বছর আষ্টেক হল মৌলালিতে টু বেডরুমের ফ্ল্যাটে থাকে। আমি বালিগঞ্জে থাকি। সাউথের ট্রেন ধরে শিয়ালদা থেকে অফিসের জন্য একসাথে ট্রেনে চাপি।
মাস ছয়েক আগে একদিন অফিস যাওয়ার পথে সে তাঁর বোনের বিবাহের নিমন্ত্রনের কার্ড দিয়ে আমাকে ও আমাদের এক সহযাত্রী বাবলুদা কে নেমন্তন্ন করে। ঘটনাচক্রে বাদলের বোনের বিয়ের দিন বাবলুদার নিকট এক আত্মীয়র বিয়ে থাকায় তৎক্ষনাৎ সে ওই বিয়েতে উপস্থিত থাকতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। মুখটা বেজার করে আমার উদ্দেশ্যে বলে,......
"তোমাকে কিন্তু আসতেই হবে কমল".....আমি এক গাল হেসে ওই দিন অবশ্যই উপস্থিত থাকব বলে জানিয়ে দিলাম।
যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন ওই বিয়ের দিন আমি হয়েছিলাম তার রেশ এত মাস পরেও এখনো আমার মনের কোনো অজানা স্থান থেকে মাঝে মাঝে উকি দেয়। বিশেষ করে যখন কোন বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র হাতে পাই।
দিনটা ছিল ২৯শে পৌষ বৃস্পতিবার। বিকেলে অফিস থেকে বেরিয়ে একটা আর্জেন্ট কাজ মিটিয়ে রাত ৮ টার বনগাঁ লোকাল ধরি। মধ্যমগ্রাম থেকে বনগাঁ ট্রেনে প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। রাত সাড়ে নয়টায় বনগাঁ স্টেশন এ পৌঁছলাম। এর মধ্যে বাদলের তিন তিনবার ফোন রিসিভ করা হয়ে গেছে। স্ত্রীর ও একটু ওজর আপত্তি ছিল এত দূরে এই বিয়েতে আমার একলা যাওয়াতে। আমার তিন বছরের পুঁচকে ছেলেটাও বিয়েতে যাব শুনে তড়াক করে লাফিয়ে যাবে বলে বায়না করছিল। ওর জন্য এখন খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু কোন উপায়ান্ত ছিল না। বাজে ব্যাপার হয়ে যেত না গেলে, তাছাড়া আমি বিয়েতে উপস্থিত থাকবো বলে কথা দিয়েছিলাম।
বনগাঁ স্টেশনে পৌঁছে এক কাপ চা খেয়ে বেরোতে বেরোতে পৌনে দশটা বেজে গেল। কনকনে ঠান্ডা এদিকটায়। আমার ইম্পোর্টেড সৌখিন জ্যাকেটও এই ঠান্ডায় একেবারেই ফেল করে গেছে। মনে মনে ভাবছি মাফলার সাথে থাকলে বেশ ভালোই হোত। ইতিমধ্যে বাদলকে ও স্ত্রীকে ফোন করে বনগাঁ পৌঁছে যাওয়ার কথা জানিয়ে দিলাম। এত দেরি করে আসছি জেনে বাদল একটু রাগারাগী করল, কারন স্টেশন থেকে ওর বাড়ি রিক্সায় প্রায় পঁচিশ মিনিট। এবারে মনে হোল এভাবে দেরী করে বেরোনোটা মোটেই ঠিক হয়নি। সাথে বাবলুদা থাকলে খুব ভাল হত। যাই হোক স্টেশনের বাইরে থেকে একটা রিক্সা নিয়ে নিলাম। বেশ জমজমাট বনগাঁ স্টেশন চত্বর। এক মধ্যবয়স্ক রিক্সা চালককে বিয়েবাড়ির ঠিকানা বলতেই জানাল সেটা আধা ঘন্টার পথ। দুভাবে যাওয়া যায়। মেইন রাস্তা দিয়ে না গিয়ে ইট ভাটার মধ্যে দিয়ে গেলে প্রায় দশ মিনিট আগে পৌঁছনো যাবে, তাতে আমার কোনো অসুবিধে নেই তো? শীতের রাত, একেই দেরী হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি করে ফিরতে হবে। এসব সাত-পাঁচ ভেবে আমি রিক্সা চালকের কথায় রাজি হয়ে গেলাম।
বেশ খানিকটা যাওয়ার পর একটা বাঁক নিয়ে রিক্সা টা ইঁট ভাটার কাঁচা পথ ধরে এগোতে লাগল। হঠাৎই পরিবেশ টা কেমন বদলে যেতে শুরু করল। এদিকে জনবসতি কম। প্রথম দিকে দু একটা কাঁচা বাড়ির দেখা পেলেও এখন তেমন কিছুই চোখে পড়ছে না। রাস্তার দুপাশে চাঁদনী শীতল রাতে বাঁশবন, আম বন, তীক্ষ্ণ চাপা ঝি ঝি পোকার ডাক, জোনাকির পিট পিট আলো....... সে এক মায়াবী পরিবেশ তৈরী করেছে। শহরের ছেলে আমি, দুচোখ ভোরে সেঅদ্ভুত মায়াবী দৃশ্য দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম।
তাল কাটল হঠাৎই যখন রিক্সটির একটা চাকা ছোট পাথরের উপরে পরে বেশ ঝাকুনি দিয়ে থেমে গেল। কি হল জিজ্ঞেস করতেই চালক জানাল যে, ঝাকুনিতে রিক্সার চেন পরে গেছে। আমি ঘড়ি দেখলাম, দশ টা বাজতে পাঁচ। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে বাদল কে একটা ফোন করতে যাব, দেখি মোবাইলে কোন নেটওয়ার্ক নেই। চালকদাদা রিক্সার চেন ঠিক করে একটু এগোতেই রিক্সা টলো-মলো হয়ে ঝপাং করে ডানদিকে বসে পড়ল। ডান দিকের চাকা খুলে গেছে। গতি কম থাকায় বরাত কোন মতে বেঁচে গেছি। রিক্সা চালক মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে করুন সুরে বলল, " বাবু.....এক্সেল ভেঙে গেছে।" হাতে পায়ে ধুলো ঝেড়ে পেছনে গিয়ে দেখি তাঁর পায়ের গোড়ালি খানিকটা ছোড়ে গিয়েছে। ওই অবস্থায় সে হাত দেখিয়ে বলল , "বাবু........ প্রায় চলেই এসেছি একটু এগুলেই ভাটার খোলা গেট আর তার ডান দিকে মুন্সির অফিস। ওই অফিসের বা দিকে একটু এগোলেই পাকা রাস্তা। বাদিক ধরে যাবেন মিনিট খানেক। ওখানেই বিয়েবাড়ি। আমি অসহায়ের মত সব মন দিয়ে শুনলাম। নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছিল। কেন যে শর্ট কাট পথ ধরতে গেলাম। যাই হোক রিক্সা চালক কে কিছু টাকা বেশি দিয়ে তাঁর কথা মত এগোতে লাগলাম। পথে একজন কে সাইকেলে যেতে দেখে দাঁড় করালাম। তাঁকে বিয়েবাড়ির ঠিকানায় কিভাবে পৌঁছব জিজ্ঞেস করতে তিনিও ঠিক একই কথা বলায় মনে জোর পেলাম।
মিনিট তিনেক ওই মেঠো পথ ধরে হাটতে হাটতে ডানদিকে একটা ভাঙা লোহার গেট দেখতে পেলাম। ধীরে ধীরে আমি ওই ইটভাটার ভেতরে প্রবেশ করলাম। এদিকটা ফাঁকা বলে ঠান্ডা টা একটু বেশি। ভাটার পাচিলের দেওয়ালে একচালার অনেকগুলো ছোট ছোট ঘর। দুএকটি ঘরের থেকে লণ্ঠনের মৃদু আলো চোখে পড়ছে। সামনেই একটা ছোট পাকা অফিস ঘর। আমি ডান দিক ধরে এগোতে লাগলাম। কাঁচা ধূলো মাখা পথ, লাল মাটির ধুলোতে আমার জুতো চেনাই যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে সারিবদ্ধ ভাবে সাজানো ইটের লাট। বাদিকে প্রকান্ড চুল্লি। তার মুখথেকে হালকা হালকা ধোয়া বেরিয়ে বাতাসে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমি হেটেই চলেছি। মাঝে মধ্যে দূরে কোথাও সুর বেঁধে শেয়াল ডেকে উঠছে। মোবাইলটা বের করে একবার ফোন করার চেষ্টা করলাম, বিপ বিপ করে কেটে গেল। একটাও নেটওয়ার্ক টাওয়ার নেই।
বেশ খানিকটা চড়াই রাস্তায় হাটার পর মনে হল আমি ভুল রাস্তায় চলে এসেছি। ঘড়িতে তখন দশটা সতেরো। অর্থাৎ প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে ভুল রাস্তায় হাটছি। মনে মনে ভীত হয়ে পড়লাম। সাথে সাথেই পা চালিয়ে ফিরে যাব ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ কয়েকটা ছোট ছোট ছেলেমেয়ের খিল খিল হাসি কানে এল। আর সাথে দুর্বোধ্য ভাষায় কিসব যেন আমায় অভিযোগের সুরে বলার চেষ্টা করছে। এত রাতে এখানে বাচ্চারা কিভাবে এল!!! ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছি না। আবার সবাই চুপ। যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। আমি আমার বুকের ভেতরে ধড়াস ধড়াস শব্দটা পরিষ্কার শুনতে পারছি। সেই নিস্তব্ধতা ভেদ করে হঠাৎই কয়েকটা বাচ্ছার বুকফাটা কান্নার শব্দ আমাকে প্রায় পাগল করে তুলল। নিশ্চিৎ বিপদের আঁচ পেয়ে জীবন বাঁচাতে প্রানভয়ে উল্টো দিকে দৌড় দিলাম। খানিকটা দৌড়ানোর পর পায়ে নরম কিছুতে লেগে পিছলে পরে গেলাম। কোন মতে উঠে বসে হাতে ধরা মোবাইলের আলোতে দেখলাম ডান পায়ের কাছে অনেকটা চাপ চাপ রক্ত। আমি চমকে উঠলাম। মোবাইলের আলো একটু এদিক ওদিক ফেলতেই ভয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল। একটা পাঁচ -ছ বছরের মেয়ের রক্ত মাখা কাটা মাথা। হায় ভগবান, এ কি দেখছি আমি!! ওইটুকু বাচ্চা মেয়ের চোখের কোল বেয়ে তখনো বয়ে চলেছে অস্পষ্ট জলের ধারা। কষ্ট ও ভয় মাখানো সেই অনুভূতি প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কাটা মাথাটা ড্যাপ ড্যাপ করে আমার দিকে চেয়ে আছে ধুলোমাখা রুক্ষ চুলের ফাঁক থেকে। এরই মধ্যেই পেছন থেকে কয়েক জনের ওই ঢাল রাস্তা বরাবর আমার দিকে হেঁটে আসছে বলে মনে হল। ঘুরে দেখি ছ-জন মুণ্ডুহীন বালক বালিকা অন্ধ লোকের মত সামনে হাত বাড়িয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। দুর্বোধ্য ভাষায় বারংবার দুলাইনের একই কথা ভেসে আসছে ।
তাঁরা কি বলতে চাইছে , কেন বলতে চাইছে কিছুই বুঝতে পারছি না। তাদের ওই করুন আর্তনাদ আমার মস্তিষ্কের সমস্ত শিরা- উপশিরা ফেটে চৌচির করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। দুহাতে কান দুটো চেপে আমি ওখানেই বসে পড়লাম।তারপর আর কিছুই মনে নেই।
আমার ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে স্ত্রী বাদলকে ফোন করে জানায়। বাদল দলবল নিয়ে খুঁজতে বেরোয় । ভোরের দিকে ভাটার একজন সংকটজনক অবস্থায় উদ্ধার করেন। চোখ খুললাম পরদিন বিকেলে, স্থানীয় এক নার্সিংহোমে। দেখি বাদল সামনে দাঁড়িয়ে। স্ত্রী ও শ্বশুর মশাইও উপস্থিত। ধীরে ধীরে সমস্ত ঘটনা বলি। বাচ্চারা
যে দুটো দুর্বোধ্য লাইন বলছিল, সেটাও বললাম। বাদল শুনে বলল ,"এ তো সাঁওতালি ভাষা।" বাদল তৎক্ষনাৎ তাঁর পরিচিত একজনকে ডেকে পাঠায়। সে ওই লাইন দুটি শুনে তো আকাশ থেকে পরে। বাংলায় ওই সাঁওতালি ভাষার মানে ঠিক এই রকম ....
"কাকু,....মাকে বল, বাবাকে বল। রতন কিস্কু আমাদের মেরে ফেলেছ।"
রতন এলাকার একজন বয়স্ক সাঁওতালি গুণীন। তুক তাক করে নাকি রোগ সারায়। খুব একটা সুবিধার নয় সে। বছর দুয়েক ধরে পাঁচ-ছ টা সাঁওতালি বাচ্চা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পুলিশের কাছেও এলাকার চার টি সাঁওতালি বাচ্চা র নিখোঁজের কমপ্লেইন জমা পরে। ভাটার মালিক ও পুলিশের তৎপরতায় রতন গুনীন কে চাপ দিতেই সে অর্থের বিনিময়ের দেবতার নামে বলির কথা কবুল করে। যারা এই কাজ করিয়েছে তাদের নামও বলে। কিন্তু রতন গুণীন এটাকে খুন বলতে নারাজ, বুক ফুলিয়ে উঁচু গলায় জানায় সে সমাজের কল্যাণ করেছে। সে এটাও বলে দুজন মহিলা তাঁর অসুস্থ স্বামী ও তিন ছেলের কল্যাণের জন্য তাঁর বড় মেয়েকেও নিয়ে আসে উৎসর্গের জন্য। হত্যার পরে সে ভাটার চুল্লীতে ওই সব অসহায় বাচ্চারদেহ পুড়িয়ে ফেলত। সমস্ত কর্মকান্ড মুন্সীর মধস্ততায় ঘটতো। ওইদিনই দোষীদের পুলিশ পাকড়াও করে।
কুসংস্কারের এইরূপ অন্ধ বিস্বাস থেকে আমাদের সমাজ কবে মুক্তি পাবে কে জানে?