নিদারুন
নিদারুন


নিদারুন
(✍️ কলমে - সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী)
**********************************
আজকের মূল কাহিনীতে প্রবেশের আগে এই কাহিনীর পাত্র পাত্রীদের সাথে পরিচয় পর্বটি সেরে নেওয়া যাক।
কাহিনীর প্রধান চরিত্রে অরুণাভ মিত্র, বিপত্নীক ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর। রজতাভ অরুণাভবাবুর বড় ছেলে, আইপিএস অফিসার, তার স্ত্রী সুস্মিতা কলেজে পড়ায় এবং তাদের একমাত্র মেয়ে রক্তিমাভা ক্লাস সেভেনে। অরুণাভবাবুর ছোট ছেলে স্বর্ণাভ, সে আর্কিটেক্ট, তার নিজের একটি ফার্ম আছে, তার স্ত্রী নবনী ব্যাঙ্কে চাকরি করে এবং তাদের আড়াই বছরের শিশুপুত্র অগ্নিভ এখনো স্কুলে যেতে শুরু করে নি। বাড়ীতে যৌথ পরিবারের রান্নাবান্নার জন্য সবিতা, অন্যান্য কাজের জন্য রেশমী আর বাগান ও বাজারহাট সামলানোর জন্য আছে শংকর। দুটি পোষ্যও আছে, গোল্ডেন রিট্রিভার টম আর কাবলী বেড়াল জেরী।
রাজধানী শহরের উপকণ্ঠে সম্পন্ন বসতি লাহিড়ী বাগানে অরুণাভ মিত্রের বাগান ঘেরা তিনতলা বাড়ী। অরুণাভবাবুর স্ত্রী নিজের পছন্দ মতো বাড়ী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তৈরী করিয়েছেন। ছোট ছেলে স্বর্ণাভর সাথে মায়ের ভারী ভাব ছিলো, স্কুল শিক্ষিকা মা আর ক্লাস টেনে পড়া স্বর্ণাভর প্ল্যানেই এতবড় নজরকাড়া বাড়ীটি তরতরিয়ে তৈরী হয়ে গেলো এবং নির্ধারিত হয়ে গেলো স্বর্ণাভ আর্কিটেকচার নিয়েই পড়বে। স্বর্ণাভ যখন শিবপুরে সেকেণ্ড ইয়ারে আর রজতাভ আইপিএস ট্রেনিং পর্বে, তখন অরুণাভবাবুর স্ত্রী মমতা ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেলেন। ভদ্রমহিলা অত্যন্ত সুবিবেচক ও দূরদর্শী হওয়ার ফলে, অরুণাভবাবুর সংসার মুখ থুবড়ে পড়ে নি, যে নিয়মে মমতাদেবীর সংসার বাঁধা ছিল সেই নিয়মেই মসৃণ গতিতে এগিয়ে চললো।
অনেক বছর হোলো অরুণাভবাবু অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে তবে কাজের জগৎ থেকে নয়। নিয়মিত ছাত্র ছাত্রী, লেখালেখি, আর দুই নাতি নাতনি নিয়ে তিনি সদাব্যস্ত। এছাড়া সকাল বিকাল পোষ্য দুটিকে নিয়ে লেকপার্কে একটু হাঁটতে যান, তাঁর এসময়কার সঙ্গী দু'বেলাই শংকর এবং বিকেলে নাতি অগ্নিভ রোজই হলেও, ছুটিছাটার দিনে নাতনি রক্তিমাভাও। অরুণাভবাবু আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই পোষাকি নাম আর ডাকনাম আলাদা রাখার ঘোর বিরোধী, তাই তাঁদের পরিবারের সকলের একটাই নাম, ঘরে বাইরে।
অগ্নিভ বাবার মতো চুপচাপ প্রকৃতির, রক্তিমাভা আবার ছোট্ট থেকেই খুব হৈচৈ করতে ভালোবাসে।
কাজেই ছুটির দিনগুলিতে ছাড়া অরুণাভবাবুর বাড়ি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একদম চুপচাপ নিরিবিলি। মুখে কম কথা বললেও অগ্নিভ কিন্তু একা একাই সারা বাড়িময় খেলে বেড়ায় ঘুম খাওয়া দাওয়ার সময়টুকু বাদ দিলে। অরুণাভবাবু অত্যন্ত খোলামনের মানুষ, সারাজীবনের নীতি তাঁর উদারতা ..... সন্তানদের উপর কিছু চাপিয়ে দিয়ে নয়, নিজের নিজের ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং পছন্দ ও ক্ষমতার উপর নির্ভর করেই সন্তানকে বড় করায় তিনি বিশ্বাসী এবং নিজেদের দুই সন্তানকে বড় করে তুলতে নিজের স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রীর সাথে তাঁর কখনো মতবিরোধ ঘটে নি। পুত্ররা তো বটেই এমনকি পুত্রবধূরাও তাঁর এই আদর্শ ও মতবাদকে সম্মান করে। তাই তাঁর নাতি নাতনি খেলাধুলা, গল্পের বই পড়া, বাগান করা, গান শোনা, ঘোরা-বেড়ানো ইত্যাদিতে যথেষ্ট উৎসাহ পেয়ে থাকে পরিবারের সকলের কাছ থেকেই।
বেশ চলছিলো দিন এভাবেই, কিন্তু কদিন ধরেই নাতি অগ্নিভর আবদার সেও দিদির মতো স্কুলে যাবে। বাড়িতে এই নিয়ে অনেক আলাপ আলোচনা চললো, নাতনি রক্তিমাভা স্কুলে গেছে বয়স চারবছর পার করার পর, আর তাদের বাবারা ছয়বছর পূর্ণ করার পরে। একটি আড়াই বছরের শিশুর আবদারের ওপর ভরসা করে তাকে স্কুলে ভর্তি করার একেবারেই বিপক্ষে তার মা নবনী। স্বর্ণাভ তার স্বভাবসঙ্গত মৃদুভাষে জানিয়ে দিলো, বাড়ির সকলে মিলে যা সিদ্ধান্ত নেবে তার সাথেই সে একমত। রজতাভর কাজের বাইরে খুব বিশেষ সময় নেই আলোচনার, তাই সেও বাড়ির অন্যান্যদের সাথে একমত বলেই জানিয়ে দিলো। তাহলে রইলো বাকী দুই পুত্রবধূ, কিন্তু তারাও দোটানায়, সারাক্ষণ হয়তো অগ্নিভর একা একা থাকতে ভালো লাগে না, তাই সে স্কুলে যেতে চায়। আবার এও ভাবলো দু-চারদিন স্কুলে গিয়েই হয়তো আর যেতে চাইবে না, উল্টে স্কুল সম্পর্কে ভীতিও জন্মাতে পারে, বহু শিশুরই এই পরিণতি হয়। সুস্মিতা আর নবনীও শেষমেশ সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব পুরোপুরি অরুণাভবাবুর উপরেই ছেড়ে দিলো। এখন অরুণাভবাবু পড়েছেন মহাফাঁপড়ে, স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার পর কোনো বিপরীত প্রতিক্রিয়া শিশু অগ্নিভর মনে তৈরী হলে অরুণাভবাবু নিজেকে ক্ষমা করতে পারবেন না। আবার শিশু অগ্নিভর আধোবোলের আবদারে সামিল হতেও ক্ষীণ ইচ্ছা মনের কোণে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। যাইহোক ফাইনাল সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে তিনি ঠিক করলেন স্বল্পবাক অগ্নিভর কাছ থেকে খেলার ছলে জানতে হবে কেন সে স্কুলে যেতে চায়?
দুপুরের খাওয়ার পরে অগ্নিভ দাদুর পাশটিতে শুয়ে গল্প শুনে ঘুমোয়, তবে গল্পের বিষয়বস্তু-চরিত্র বা ঘটনাক্রম নিয়ে কখনো সখনো চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকলেও মুখে কোনো কথা বলে না।
অরুণাভবাবু সেদিন মনগড়া একটি গল্প শেষ করে অগ্নিভর কাছে জানতে চাইলেন সে কেন স্কুলে যেতে চায়, অগ্নিভ পাশ ফিরে বললো, "ওই তো ও বলেছে।" অরুণাভবাবু নাতির কথার ম
াথামুন্ডু কিছুই বুঝলেন না। সে তো ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু অরুণাভবাবুর বিশ্রাম মাথায় উঠলো, ওটা কে হতে পারে কিছুতেই উদ্ধার করতে পারলেন না। অগ্নিভর সাথে আবার কথা বলতে হবে, কাউকে কিছু বলার আগে। বিকেলে নাতিকে নিয়ে লেকপার্কে গিয়ে অরুণাভবাবু আবার নাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, "ও কে? ওর নাম কি?" অগ্নিভর সংক্ষিপ্ত উত্তর, "জানি না"। মহা ফ্যাসাদে পড়া গেলো তো! অগ্নিভ খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে টম জেরী আর শংকরের সাথে ছুটোছুটি করে খেলছে। অরুণাভবাবু রীতিমতো চিন্তান্বিত। অগ্নিভর এই 'ও রহস্য' ভেদ না করা পর্যন্ত তিনি একেবারেই স্বস্তি পাচ্ছেন না।
পরদিন দুপুরে আবার গল্প শেষ করে অরুণাভবাবু নাতিকে জিজ্ঞাসা করলেন, "ও কোথায় থাকে?" যা উত্তর পেলেন তার জন্য তিনি একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। অগ্নিভর উত্তর, "ছাদে।" অরুণাভবাবু এবার হকচকিয়ে গেলেন। এত ছোট শিশু তো মিথ্যে বলে না, তাহলে তাঁর বলা গল্পের কাল্পনিক জগতের কারুর কথা বলছে কি? বিকেলে তুমুল বৃষ্টিতে আর পার্কে যাওয়া হোলো না। নাতনি বৃষ্টির জন্য জ্যামে আটকা পড়েছে, পুত্রবধূদেরও ফেরার সময় হয় নি, পুত্ররা তো অনেকটা রাতেই ফেরে, সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করলেন অগ্নিভ আশেপাশে নেই। নাম ধরে দুবার ডাকতেই অগ্নিভ সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে নেমে এলো। অগ্নিভ আপনমনে খেলছে। অরুণাভবাবু দোতলার বারান্দা থেকে দেখলেন, রক্তিমাভা স্কুলের পুলকার থেকে নামছে। তাঁর দুশ্চিন্তা খানিক কমলো। এবার একটু চা খেয়ে লেখালেখি নিয়ে বসবেন, দুদিন অগ্নিভর বিষয়ে ভাবতে গিয়ে অরুণাভবাবু নিজের কাজে মনঃসংযোগ করতে পারেন নি।
নাতনি একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছে, দুই বৌমাই ফিরেছে, ওদের সাথে বসে সান্ধ্য চা-পানের পর অরুণাভবাবু নিজের ঘরে কাজের টেবিলে লেখা নিয়ে বসলেন। খসখস আওয়াজে চোখ তুলে দেখলেন, অগ্নিভ রক্তিমাভার পুরনো একটা খাতা আর পেন্সিল নিয়ে, দাদুর বিছানায় বসে খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে। মনে মনে একচোট হাসলেন অরুণাভবাবু, আসলে তাঁর বাড়ির এই লেখাপড়ার পরিবেশটিই হয়তো নাতির শিশুমনকে লেখাপড়ার প্রতি আকৃষ্ট করেছে। তিনি আবার লেখায় মনোনিবেশ করলেন। অগ্নিভ আপনমনে খাতায় পেন্সিল দিয়ে আঁকিবুঁকি কাটছে।
অগ্নিভর খাওয়ার সময় হয়েছে, নবনী ওকে নীচে নিয়ে গেছে খাওয়াতে। তাঁদেরও রাতের খাবার দেওয়া হচ্ছে রেশমী জানিয়ে গেলো। অরুণাভবাবুরা এই রাতের খাওয়াটাই সবাই একসাথে বসে করেন সবাই মিলে, এমনকি কাজের লোকেরাও, স্ত্রী মমতার তৈরী করে যাওয়া নিয়ম মেনে। টুকরো কথাবার্তা আলাপচারিতায় খাওয়া শেষে যে যার ঘরে, বৃষ্টি ভেজা ঠান্ডা আবহাওয়ায় অরুণাভবাবু বিছানার ওপর থেকে নাতির খাতা পেন্সিল যত্ন করে সরিয়ে নিয়ে টেবিলে রেখে আলো নিভিয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন, এবং শীতল বাতাসে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েও পড়লেন।
সকালে লেকপার্ক থেকে হেঁটে ফিরে, সকালের চা-জলখাবার খেয়ে, খবরের কাগজ উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে, শংকরের টুকিটাকি হিসেবপত্র মিলিয়ে দেখে নিয়ে, অরুণাভবাবু আগের দিনের বাকী থাকা লেখালেখির কাজ নিয়ে বসলেন। কাজ শুরু করার আগে অরুণাভবাবুর নজর পড়লো নাতির খাতায়। একটা একটা করে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দেখলেন প্রথম কটা পাতায় নাতনি অঙ্ক কষেছে, তারপর থেকে অগ্নিভর হিজিবিজি শুরু, ব্যাঁকাত্যাড়া বাংলা ইংরেজী অক্ষর-সংখ্যা... কিন্তু অগ্নিভর তো এখনো অক্ষর পরিচয়ই হয় নি... লেখা তো সেখানে দূর অস্ত। আর এই লেখা ওকে শেখালই বা কে? আরও কটা পাতা উল্টিয়ে অরুণাভবাবু অবাক... সুন্দর গোটাগোটা করে বাংলা ইংরেজীতে লেখা অগ্নিভ মিত্র।
অরুণাভবাবু নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে অগ্নিভর খোঁজে ছাদের দিকে চললেন, সিঁড়ির মুখে আসতেই শুনতে পেলেন অগ্নিভ কচিগলায় কলকল করে দু'দিন আগে দাদুর কাছে শোনা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গল্পটা আপনমনে আওড়াচ্ছে। অরুণাভবাবু গলা তুলে নাতিকে ডাকতেই সে একছুটে এসে দাদুকে জড়িয়ে ধরলো। তিনি নাতিকে কোলে তুলে আদর করে জিজ্ঞাসা করলেন, তাকে কে লিখতে শেখাল? ছোট্ট তর্জনীটা তুলে ছাদের দিকে দেখিয়ে বললো,"ও।" এবার তো দেখতেই হচ্ছে, ছাদে কে ও? অরুণাভবাবু অগ্নিভকে কোলে নিয়েই ছাদে উঠলেন, টব ভর্তি গাছপালা ছাড়া আর কিছুই নেই,কেউ কোথাও নেই। অগ্নিভ দাদুর কোল থেকে নেমে পড়ে একটা গাছ দেখিয়ে বললো, "এখানে ও থাকে, ওর নাম ঠাম্মা।" নিজেকে সামলে নিয়ে অরুণাভবাবু দেখলেন মমতার নিজের হাতে লাগানো কাগজী লেবুর গাছটা তাঁর মাথা ছাড়িয়েছে। আর দীর্ঘশ্বাসের সাথে তাঁর মনে পড়লো ছেলেদের স্কুলে ভর্তি না করলেও দু-আড়াই বছর বয়স থেকেই নিজেই পড়তে লিখতে শিখিয়েছিলেন তো স্কুল শিক্ষিকা মমতা! সত্যিই মমতার মতো কর্তব্যপরায়ন স্ত্রী নিদারুন ভাগ্যবলেই তো তিনি পেয়েছিলেন!
তবে কি সত্যিই মমতা এখনো আগলে রেখেছে তার অতি সাধের সংসার? নাকি অরুণাভবাবুই একান্ত অবচেতনে সম্পূর্ণভাবে স্ত্রীর প্রতি নির্ভরশীলতার অভ্যাসটাই ত্যাগ করতে পারেন নি? নাকি নিছক এক সাধারণ অনুভূতিপ্রবণতা? তাহলে কী আধ্যাত্মিকতাবাদ বলে কিছু হয় না? প্রফেসর অরুণাভ মিত্র অনুসন্ধিৎসু হলেন। জীবন কেবলই কী মায়ার বন্ধনেই আবদ্ধ? মৃত্যুর পরও কী কিছু অস্তিত্ব বাকী থেকে যায়? শ্রীমদ্ভগবদগীতার বাণী কী তবে কেবলই এক পুস্তকাকারে শ্লোকের সাহিত্যরসসমৃদ্ধ সমন্বয়? অনেক প্রশ্ন, এর নিদারুন উত্তরই বা কোথায় কীভাবে?