Manik Goswami

Classics

4  

Manik Goswami

Classics

মন মাধুরী

মন মাধুরী

9 mins
307


মন মাধুরী 

মানিক চন্দ্র গোস্বামী


গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেলো। স্কুল খুলবে একমাস পরে। লম্বা ছুটি। প্রতি বছরই এই ছুটিটার অপেক্ষায় থাকি। এই একটা সময় যখন ছুটি কাটাতে মামার বাড়ি চলে যাওয়া যায়। কারণ তো সকলেরই জানা, মামার বাড়ি ভারী মজা, কিল চড় নাই। অনেকটা পথ। প্রথমে বেশ কিছুদূর কু ঝিক ঝিক রেলগাড়ি চড়ে যাওয়া। তারপর বাস। বাস থেকে নেমে গরুর গাড়ি অথবা নৌকোয় চড়ে যাওয়া। ছোটবেলায় তো বুঝতাম না, এখন বুঝি যে এই একটা মাস ছিল মায়েরও ছুটি। সারা বছর সংসারের খুঁটিনাটি সামলানোর পর এই একটা সময় যখন মা সংসারের জালটা নামিয়ে রেখে খোলা মনে, খুশি মনে বাপের বাড়ি যেতে পারতেন। এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না। মা চললেন, সাথে আমিও আছি। আনন্দে শরীর মন কেমন চনমনে হয়ে উঠেছে। আমার খুশির কারণ অবশ্য শুধু বেড়াতে যাচ্ছি বলে নয়, খুশি এই কারণেই যে অন্ততঃ একমাস তো লেখাপড়া থেকে অব্যাহতি। শুধু খেলা, হৈ হুল্লোড় করা আর দাদু দিদিমার আদর খেয়ে আসা।

ট্রেনে চড়ে বসতেই আমার যে কি আনন্দ হতে শুরু করলো সে তো আমি বলেও বোঝাতে পারবো না। খোলা জানালার ধারে আমি আমার বসার জায়গাটা ঠিকঠাক বেছে নিলাম। আমার একটা অদ্ভুত নেশা ছিল। প্রত্যেক স্টেশনের নাম আমাকে পড়তে হবে, আর সেটাকে মনেও রাখতে হবে যাতে ছুটির পরে ঘরে ফিরে এসে সবাইকে সেই নামগুলো যেন গড়গড়িয়ে বলে যেতে পারি। সমস্ত স্টেশনের নাম মনে রেখে, সেগুলো নিজের মনে আওড়াতে আওড়াতেই ট্রেন থেকে নামার সময় হয়ে গেলো। এরপরে বাস। রাস্তাটা পাকা, তবে চওড়া বেশি নয়। পাশাপাশি দুটো গাড়িও স্বচ্ছন্দ্যে যেতে পারে না। তখন কোনো একদিকের গাড়িকে রাস্তার একটু চওড়া অংশে দাঁড়িয়ে যেতে হয় অন্য গাড়িটাকে পাশ দেবার জন্য। বাস থেকে নেমে গরুর গাড়ি পাওয়া গেলো। গ্রামের কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে, আশেপাশের শুখনো জমিজমার পাশ ঘেঁষে গো যান ছুটতে থাকলো। শক্ত সামর্থ্য জোড়া বলদে গাড়িটাকে প্রায় ঝড়ের বেগে উড়িয়ে নিয়ে এসে সন্ধ্যের আগেই পৌঁছে দিলো আমার মামার বাড়ি। আমাদের দেখে দাদু দিদিমার বাঁধভাঙা খুশি। আমার খুশি তো আবার সবার থেকে বেশি। সারাদিনের এতটা যাত্রার ধকল নিমেষে ভুলে গিয়ে সবার সাথেই গড়গড়িয়ে গল্প করতে শুরু করে দিলাম।

গরমের সময়। গাছে গাছে আম ধরে আছে। বেশির ভাগ আমই এখন কাঁচা। দু'একটা গাছের আমে একটু একটু রং ধরতে শুরু করেছে। কাঁচা তো কি হয়েছে। নুন দিয়ে কাঁচা আম খেতে আমি খুব পছন্দ করি। ফলে, কাঁচা আম খেয়ে, পুকুরে মাছ ধরে, সাঁতার কেটে, মাঠে মাঠে দৌড়োদৌড়ি করে, কাঁচা রাস্তার ধুলো উড়িয়ে, ভালোই কাটতে থাকলো দিনগুলো। ভাবনাহীন, চিন্তাহীন দিন। লেখা পড়া শিকেয় তুলে,খুশির স্রোতে ভাসতে ভাসতে চলা। কোথা দিয়ে যে দিন গুলো কেটে যেতে থাকলো সেটা বুঝতেই পারলাম না। একটু ভুল বললাম, সেটা বুঝতে চাইলামই না। ধুলো ওড়া শুখনো দিনগুলো ভালোই কাটছিলো। হঠাৎ শুরু হলো বৃষ্টি। টানা তিন দিন অঝোর ধারায় বর্ষণ হয়ে গেলো। বর্ষা বুঝি এবার খুব তাড়াতাড়ি এসে গেলো বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য নিম্নচাপ থেকেও বৃষ্টি হতে পারে। সে যাই হোক, একনাগাড়ে বৃষ্টি তো হচ্ছেই। না পারছি বাইরে বেরোতে, না পারছি হাত-পা গুটিয়ে ঘরের মধ্যে চুপটি করে বসে থাকতে। অসহ্য লাগছে। রাস্তা, ঘাট, মাঠ, চাষের জমি, সব জলে থৈ থৈ। তারই মধ্যে কিষানেরা নেমে গেছে মাঠের কাজে। কাঁচা মাটির রাস্তায় বৃষ্টির জল পড়তেই তৈরী হয়েছে কাদা। তার ওপর দিয়ে অনবরত গরুর গাড়ির চলাচলে রাস্তার যা রূপ হয়েছে, এককথায় অবর্ণনীয়। হেঁটে সে রাস্তা দিয়ে এক পাও যাবার উপায় নেই। হাঁটু পর্যন্ত্য কাদায় ডুবে যাচ্ছে। কাদার মধ্যে থেকে এক পা বার করে নিয়ে আবার পা ফেলতেই ভরাডুবি। এইভাবে তো বেশিক্ষন লোকের চলাফেরা করা সম্ভব নয়। বৃষ্টিটা সামান্য একটু ধরতেই গ্রামের লোকেরা নেমে পড়লো রাস্তা সংস্কারে। বৃষ্টির জন্য শুখনো মাটি তো পাবার উপায় নেই। অগত্যা টুকরো টুকরো ইঁট জোগাড় করে রাস্তার একপাশ দিয়ে সাইকেল চলতে পারার মতো ইঁটের রাস্তা তৈরি করে নিলো। মুশকিল হলো আমাদের। ছুটি শেষ হয়ে এসেছে। এবার আমাদের ফিরতে হবে। কিন্তু রাস্তার যা হাল, পায়ে হেঁটে এতটা পথ পেরিয়ে বাস ধরা এক কথায় অসম্ভব। এতো কাদা যে গরুর গাড়িও চলতে পারবে না। নতুন তৈরী ইঁটের সরু রাস্তা ধরে বড়জোর পাঁচশো মিটার মতো যাওয়া যাবে। অগত্যা ঠিক করা হলো যে নৌকোতেই যাওয়া হবে। নদীর ঘাটটা বেশি দূরে নয়। রাস্তার ধার ঘেঁষে পাতা ইঁটের ওপর দিয়ে হেঁটে সহজেই ঘাটে পৌঁছে যাওয়া যাবে। এক মামা গিয়ে নৌকোর মাঝির সাথে কথা বলে ভাড়া ঠিক করে এলেন। কাল সকালেই আমরা নৌকো করে ফিরবো। অদ্ভুত একটা আনন্দ হলো মনে। নৌকোয় চড়ে যাত্রা। কেমন যেন উত্তেজনা অনুভব করছি মনের মধ্যে।

আমাদের নৌকো যাত্রা হলো শুরু। মাঝিকাকুর সাথে গল্প করতে করতেই আমরা এগোতে থাকলাম। মা বললেন,'বাব্বাঃ, কত বেড়েছে জল। তিনদিনের বৃষ্টিতেই এতো জল'। মাঝি কাকু বললেন,'বৃষ্টিটা হওয়াতে তাও তো একটু জল দেখতে পাচ্ছেন মা ঠাকরুন। এবারের গরমে যা হাল হয়েছিল, শুখিয়ে গিয়ে নিচের মাটিটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিলো। খটখটে শুখনো'।

- 'তাহলে, সেই সময় তোমরা মাছ ধরতে কি করে' ?

- 'হ্যাঁ, মা ঠাকরুন, আমরা তো মাছ ধরেই খাই। ওই যে নদীর মাঝে মাঝে বাঁশগুলো দেখছেন,ভালো করে দেখুন ওগুলোতে জাল বাঁধা আছে। এই তো বৃষ্টিটা শুরু হতেই জালটা বেঁধেছে'।

- 'সে তো এখন। কিন্তু গরমের সময়টা তোমরা জীবিকা উপার্জন করলে কি করে' ?

- 'মা ঠাকরুন, কত কষ্ট করে যে এই তিন চার মাস কাটিয়েছি, সেটা আপনাদের মতো শহরের লোকেরা কল্পনাও করতে পারবে না। ছোট ছোট জায়গায় যেখানে অল্প অল্প জল জমে রয়েছিল খুঁজে খুঁজে সেখান থেকে গেঁড়ি,গুগলি,কাঁকড়া এসব ধরেছি। কিছু নিজেরা খেয়েছি, আর বেশির ভাগটাই বিক্রি করে দিয়েছি। হাতে কিছু পয়সারও তো প্রয়োজন আছে। বর্ষা নামলে তো আমাদের তেমন অসুবিধে হয় না। মাছ ধরা যায় আবার নৌকোর ভাড়াও কিছু পেয়ে যাই। অনেক মহাজন আছে যারা চাল, ডাল, তেল, নুন সব কিছুই এই জলপথেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেবার জন্য বলে। ফলে কিছু পয়সাও উপার্জন করতে পারি। তাছাড়া সওয়ারিও পাওয়া যায় বেশ কিছু। কিন্তু গরম পড়লেই আমাদের কষ্ট। আসলে নদীর তো কোনো সংস্কার নেই। গরমে জল কমে আসলেই শুখনো খটখটে মাটি নদীর হাড় পাঁজরা বেরিয়ে আসার নিদর্শন দেয়। নাব্যতা কমে গেছে তো। তাই জলও বেশি থাকে না। একটু গরমেই শুখিয়ে যায়। আবার দেখুন, বৃষ্টিটা খুব বেশি হলেও মুশকিল। এই যে তিনদিন ধরে এমন বৃষ্টি হলো, যদি আরো দুটো দিন এইভাবে বৃষ্টিটা চলতো তাহলে আর দেখতে হতো না, নদী একেবারে উপচে পড়তো। এই যে নদীর দুপাশে এতো ঘর বাড়ি, গ্রাম, চাষের ক্ষেত দেখতে পাচ্ছেন, সব জলের নিচে চলে যেত। চার বছর আগেই এরকম ঘটনা ঘটেছিলো। সেবার এতো বৃষ্টি হয়েছিল যে দুকূল ছাপিয়ে জল ঢুকে গেছিলো গ্রামগুলোতে। কত লোকের বাড়ি, ঘর দোর ভেসে গিয়েছিলো সেই জলে। আমারও ঘরে জল ঢুকেছিলো। সব জায়গাটাই একেবারে জলে থৈ থৈ। সেবারে আবার আমার ঘরে মেয়ের দিকের নাতি হয়েছিল। কচি বয়েস। কত হবে, এই দেড়-দু মাস। ঘর ডুবে যাচ্ছে জলে। কি যে করি। এই নৌকোটাই তখন আমার খুব কাজে দিয়েছিলো। মেয়ে, নাতিকে নৌকোয় বসিয়ে, পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম মেয়ের শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশে। ওদের বাড়িটা একটু উঁচু জমিতে। জল অতটা উঠতে পারে না। তাই বাঁচোয়া। ওদের সেখানে পৌঁছে দিয়ে আমি ফিরে আসি আমার এই নৌকোতেই। সেবার প্রায় দিন পনেরো আমি একাই কাটিয়েছি আমার এই নৌকাটাকেই ঘর বানিয়ে, আমার চলার সঙ্গী মেনে নিয়ে'।

- 'তা, তোমাদের জীবনযাত্রা তো খুবই কষ্টকর। গরমেও কষ্ট, বর্ষাতেও কষ্ট। রোদেও কষ্ট আবার জলেও কষ্ট। নদীটার একটু সংস্কার করলে তো বর্ষায় এতো কষ্ট পেতে হয় না। তোমরা তোমাদের কষ্টের কথা কর্তা ব্যক্তিদের জানাওনি’? মা বলে উঠলেন।

- 'মা ঠাকরুন, আলাদা করে আর কি বলবো বলুন। সবাই তো দেখতে পাচ্ছে আমরা কিরকম অসুবিধার মধ্যে আছি। এতো বছর ধরে রাস্তাটাই তৈরী করে উঠতে পারলো না। এখনো বর্ষা হলেই এক হাঁটু কাদা ভেঙে যাতায়াত করতে হয়। রাস্তাই যখন ঠিকমতো বানিয়ে উঠতে পারলো না, তখন নদীর সংস্কারই বা করবে কিভাবে? তাও তো দেখুন, গরমে জল শুখিয়ে গেছিলো বলে কচুরিপানাগুলোও সব মরে গেছে। এই বর্ষা শুরু হলো, আবার ওরা জেগে উঠবে। শীতের সময় পুরো নদীর বুক জুড়ে পানায় ভরে যাবে। তখন নৌকা চালানোই কষ্টকর হয়ে পড়ে। দাঁড় বেয়ে তখন তো আর নৌকো চালানোই যায় না। বড় বাঁশ রাখতে হয় তখন নৌকোতে। সেই বাঁশের একপ্রান্ত জলে ডুবিয়ে মাটিতে চাপ দিয়ে নৌকোকে একপা দুপা করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়'।

মন দিয়ে মাঝি কাকুর কথা শুনতে শুনতে আমারও ইচ্ছে করলো যে এবার আমিও কিছু জিজ্ঞেস করি। তাই বলে বসলাম,'কাকু, তোমরা যে মাছ ধরো বলছো, সেটা কখন ধরো আর কিভাবেই বা ধরো'।

- 'খোকাবাবু, একটু আগেই বললাম যে ওই বাঁশগুলো, যেগুলো নদীর মধ্যে পোঁতা আছে, সন্ধ্যে নাগাদ আমরা ওই বাঁশগুলোর সাথে জাল বেঁধে দিয়ে আসি। সারারাত জালে যত মাছ ধরা পড়ে ভোরবেলায় আবার জাল সমেত সেই মাছগুলোকে নিয়ে আসি নৌকো করে। তারপর সেই মাছগুলোকে বিক্রি করে দিই। সকাল হতেই মাছ বিক্রেতারা এসে যায়। তারা মাছগুলো কিনে নিয়ে গিয়ে বাজার বা হাটে বিক্রি করে দেয়। এই ভাবেই তো আমরা দুটো পয়সা পাই, আমাদের সংসারটা চলে। আগে দিনকাল ভালো ছিল। লোকেদের মনে অন্যের ক্ষতি করবো বা শুধু নিজেই নেবো, এই ধরণের মনোভাব মোটেই ছিল না। সবার সাথে সবার সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। চুরি করে কিছু নেবার কথা লোকে চিন্তাই করতে পারতো না। এখন সব বদলে গেছে। লোকজন বড় অসৎ হয়ে পড়েছে। কি করে অন্যকে ফাঁকি দিয়ে, তাদের জিনিস চুরি করে নিজে বড়লোক হবে সে চিন্তাই করে চলেছে সর্বদা। তাই তো এখন আর মাছ ধরার জাল টাঙিয়ে রেখে এসেও নিশ্চিন্ত হতে পারিনা। গভীর রাতে চোরেরা এসে জাল খুলে সব মাছ চুরি করে নিয়ে যাবে। মানুষের মানসিকতা পাল্টে গেছে, লোভ বেড়ে গেছে। মনের মধ্যে শুধু নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করার বিভিন্ন ফন্দি এঁটে চলেছে। সেই কারণেই, এই যে নদীর দুপাশে যত গ্রাম দেখছো, সব গ্রামের মাঝিরা মিলে রাতেও পাহারা দেবার ব্যবস্থা করেছি। প্রতি রাতে চার-পাঁচ জনের এক একটা দল রাত জেগে পাহারায় থাকে। দেখুন তো মা ঠাকরুন, মানুষের এই চুরি করার নেশা বন্ধ করার জন্য আমরা এখন রাতেও ভালো করে ঘুমোতে পারি না, কি যে দিনকাল পড়লো।

- 'তোমরা প্রশাসনকে জানাওনি কেন। এভাবে তো বছরের বছর চলতে পারে না। সারাদিন এইভাবে পরিশ্রম করবে, রাতেও ঘুম নেই, ঘুমিয়েও শান্তি নেই, সে ক্ষেত্রে প্রশাসনকে না জানালে তো তোমাদের এই অস্থিরতা কাটাতে পারবে না। প্রশাসন যদি সাহায্য করে তবে রাস্তা ঘাট তৈরী হয়ে যাবে, নদীরও সংস্কার হবে'।

- 'না গো মা ঠাকরুন। প্রশাসনকে জানানো হয়েছে অনেক বার। কোনো আবেদনেই কেউ সাড়া দেয় না। সবাই নিজের আখের গোছাতেই ব্যস্ত। আমাদের জন্য চিন্তা করে তারা তাদের অমূল্য সময় নষ্ট করবে কেন? আমাদের মতো দিন আনি দিন খাই লোকেদের জন্য তাদের কোনো সহানুভূতিও নেই, আবার আমাদের কষ্ট লাঘব করার মতো মানসিকতাও তাদের নেই। জীবনের প্রতি পদক্ষেপেই আমাদের এইভাবে যুদ্ধ করেই বাঁচতে হবে'।

- 'তোমাদের এই কষ্টের কথা শুনে মনটা সত্যিই বড় খারাপ হয়ে গেলো। আমরা তো শুধু সহানুভূতিই দেখাতে পারি। তোমাদের কষ্ট দূর করে দেবার কোনো ক্ষমতাই আমাদের নেই। যাই হোক, তোমার সাথে গল্প করে অনেক কিছু জানতে পারলাম। গল্পে গল্পে তো আমরা পৌঁছেই গেলাম। তুমি কত ভাড়া নেবে আমি জানিনা। তবে, আমি যে টাকাটা তোমায় দিচ্ছি, তাতে আশা করি তুমি তোমার ভাড়ার টাকাটা পেয়ে যাবে। তোমাদের সমস্যার সমাধান তো আমি করতে পারবো না, তবুও দুদিন যদি ভালোভাবে থাকতে পারো সেই চেষ্টাটাই করলাম। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না'।

- 'মা ঠাকরুন, এতো টাকা তো আমার নৌকো ভাড়া নয়। আমাকে আমার ভাড়ার টাকাটাই দিন। তার চেয়ে বরং এখান থেকে আমি আমার নৌকোর ভাড়া বাবদ একশো টাকা নিয়ে নিচ্ছি, বাকি টাকাটা আপনি রেখে দিন। এতো টাকা আমি নিতে পারবো না। জানতে পারলে সবাই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করবে। বলবে, আমি আমাদের কষ্টের গল্প শুনিয়ে আপনাদের সহানুভূতি আদায় করেছি। মা ঠাকরুন, আমাকে অপরাধী করবেন না। এতো টাকা আমি নিতে পারবো না’।

- 'আরে বাবা, এসব কি বলছো কি? অপরাধী কেন হবে ? আমি তো তোমাকে দিচ্ছি। কেউ কিচ্ছু বলবে না। তুমি এটা রেখে দাও। বাচ্চাদের দু তিন দিন একটু ভালোমন্দ কিছু খাইয়ে দিও। তাতেই আমরা খুব আনন্দ পাবো। এখন চলি, আবার দেখা হবে'। 

আমি অবাক হয়ে দুজনের কথাবার্তা শুনছিলাম। খুব ভালো বুঝতে পারিনি সে সময়। আজ বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি আমি সেদিন দুজন সত্যিকারের মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। আজকালকার যুগে এরকম নির্মল এবং উদার মনের মানুষ আর দেখতেই পাওয়া যায় না। অতীত এখনও কিছু সুখস্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে, যেগুলো মনের গভীরেও নাড়া দিয়ে যায়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics