মন ভেঙেছে?
মন ভেঙেছে?


বুকের ওপর একটা জগদ্দল পাথরের বোঝা নিয়ে ঘুমটা ভাঙলো অনিকেতের। মাথা থেকে শুরু করে চোখের পাতা দুটোও ভারী হয়ে আছে।
ডিংডং…
কলিংবেলটা বাজছে। এর জেরেই ঘুম ভেঙেছে নির্ঘাত। ঘড়িতে এখন কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা সাতাশ। হোক গে… সময়ে কি যায় আসে! আজ অফিসও কামাই করেছে না জানিয়ে।
ডিং ডং…
উফফ! এই সাত সকালে কার কাজকর্ম নেই যে এসে অনিকেতকে জ্বালাচ্ছে! নাহ সাত সকাল অবশ্য আর নেই। বিছানা থেকে নামতে যেতেই পেটটা পাক দিয়ে উঠল। দৌড়ে গিয়ে বাথরুমে ঢুকে কমোডের ঢাকাটা খুলে মুখ বাড়িয়ে দিল অনিকেত… ভদকার সঙ্গে পটেটো চিপস।
ডিং ডং..
আশ্চর্য কার আজকাল সময় এতো সস্তা! এতোক্ষণেও যায়নি যে এসেছে। তোয়ালে দিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে দরজার দিকে এগিয়ে গেল অনিকেত। দরজা খুলতেই যাকে দেখতে পেলো তাকে অনিকেত চেনেনা। বয়স আন্দাজ পঁচিশ ছাব্বিশ হবে, পরনে গাঢ় নীল রঙের ইস্ত্রি করা শার্ট আর কালো প্যান্ট। ফর্সা চেহারায় পোশাকটা মানিয়েছে বেশ। কাঁধে একটা ছোট্ট কালো রঙের অফিস ব্যাগ।
"আমার কোনো ইনসিওরেন্স কেনার প্রয়োজন নেই, আপনি আসতে পারেন।"
"আপনি ভুল করছেন স্যার, কোনো ইনসিওরেন্স কোম্পানি থেকে আমি আসিনি।"
ছেলেটার ব্যাগটার দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে অনিকেত বলল, "আমি সেলস ম্যানদের থেকে কিছু কিনিনা। আপনি আসুন।"
"আপনি আবারও ভুল করছেন স্যার, আমি কিছু বেচতে আসিনি।"
"তবে?"
"আমি কিছু কিনতে এসেছি আপনার থেকে।"
"আমি কোনো ব্যবসা করিনা, আপনি ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন।"
ছেলেটার মুখের ওপর দরজাটা লাগাতে গেল অনিকেত, ছেলেটা হাত বাড়িয়ে আটকে দিল, "আমার কথাটা একবার শুনুন স্যার, মাত্র পাঁচ মিনিট দিন আমায়। এরপরেও যদি আপনার আগ্রহ না লাগে তাহলে আমি চলে যাবো।"
"শুনুন আমার…"
"মাথার যন্ত্রনা করছে স্যার?"
"ত… তুমি কি করে জানলে?" খানিক অবাক হল অনিকেত।
"আন্দাজ করলাম আপনার মুখ দেখে।"
"বাহ্… তাহলে এবার আসুন।"
"স্যার যদি বলি আপনার মাথা ধরা সারানোর চেষ্টা করতে পারি আমি।"
"ওহ তো তাহলে মাথা ধরার বাম বিক্রি করো তুমি।"
খুক করে একবার হাসলো ছেলেটা, "স্যার আমি তো আগেই বলেছি আমি কিছু বেচি না, কিনি।"
"কিন্তু আমার কাছে বেচবার মত কিছু নেই। তুমি আর আমার মাথা ধরিও না।"
"আছে স্যার, আছে। শুধু আপনি টের পাচ্ছেন না। বাড়িতে রদ্দি জমলে যেমন রদ্দি ওয়ালাকে বিক্রি করে দিতে হয়, তেমন শরীরে রদ্দি জমলে সেটাও বিক্রি করে দিতে হয়।"
"কি?"
"নমস্কার স্যার। আমি বিনায়ক দাশগুপ্ত। মানুষের ভাঙা মন কেনাই আমার কাজ।"
"কি! কি কেনা বললে?"
"ভাঙা মন।"
"ফ… বাহ্ এটা কি কিডনি পাচারের মত হার্ট পাচারের কোনো চক্র নাকি?"
&n
bsp;"প্রথমত স্যার এখানে পাচার কথাটি অপ্রাসঙ্গিক কারণ আমরা সেলারের কনসেন্ট ছাড়া কোনো কাজ করিনা।
দ্বিতীয়ত, স্যার মন হৃদয়ে থাকেনা। তাই হৃদয় বা বৃক্ক এসব নিয়ে আমাদের কোনো কাজ নেই। মন থাকে মস্তিষ্কে। আমাদের কাজ তাই আপনার মস্তিস্ক নিয়ে।
তৃতীয়ত, আপনার ভাঙা মন যদি আমরা নিয়ে নিই তাহলে লাভ তো আপনারও। আপনি আগের মতোই আনন্দচ্ছল জীবন কাটাতে পারবেন।"
"এটা কি কোনো সাইকোলজিক্যাল থেরাপি?"
"এসব কথা আমরা ভেতরে গিয়ে আলোচনা করতে পারি স্যার। এখানে দাঁড়িয়ে এসব কথা আলোচনা করা ঠিক না।"
ছেলেটার গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যে দরজাটা ভালো করে খুলে সরে দাঁড়ায় অনিকেত। ছেলেটা ভেতরে ঢুকতে যেতেই আচমকা বাধা দেয় সে, "কিন্তু তুমি কি করে জানলে আমার মন ভেঙেছে?"
"কাল রয়্যালসের বারে রাত সাড়ে এগারোটা অবধি…"
"তুমি কি আমায় ফলো করছিলে?"
"ঠিক তা নয় স্যার, এটা আমাদের কাজের অংশ, এমন মানুষদের খুঁজে বের করা যাদের...ভেতরে চলুন স্যার। সব বুঝিয়ে বলছি।"
ছেলেটা ঘরে ঢুকে যেতেই দরজাটা লাগায় অনিকেত। মাথাটায় মনে হয় কয়েক কেজির বালির বস্তা চাপানো রয়েছে। কালকের হ্যাং ওভার এখনও কাটেনি!
ছেলেটা সৌজন্যের অপেক্ষা না করে নিজেই বসে পড়েছে একটা সোফায়। কাঁধের ব্যাগটা খুলে একটা ফাইল আর পেন বের করে রাখে সামনের সেন্টার টেবিলটায়।
★★★★★
"কি ভাবছেন স্যার?"
"কিছু না। অনিকেত বসুর খবর কি?"
"আপাতত সে তার স্ত্রীর কাছে যাচ্ছে। বদলা নিতে..."
"কি!"
"আপনি তার ভাঙা মন সারিয়ে দিলেও মনের মধ্যে জমে থাকা রাগটা হয়তো প্রশমিত করতে পারেননি।"
"ইম্পসিবল…! ওর শরীরে এখন আমার জেনারেট করা অনুভূতি ছাড়া কিচ্ছু থাকতে পারেনা। ওর মাথার মধ্যকার প্রোগ্রামে আমি ওর পাস্ট মেমোরি কিছু রাখলেও ফিলিংসগুলো পুরো আমার কন্ট্রোলে।"
"আর ইউ শিওর স্যার? আপনার এক্সপেরিমেন্ট নিখুঁত?"
"হুহ… আমার এক্সপেরিমেন্ট কতটা নিখুঁত হতে পারে তার প্রথম নিদর্শন তো আমার সামনে বসে বিনায়ক। এবার আমার তৈরি 'হিউ-রোব'রা বাইরের সমাজে কিভাবে রেসপন্স করে সেইটা দেখার পালা। কিন্তু…"
"আর ইউ শিওর আপনার এক্সপেরিমেন্ট সফল?"
"বিনায়ক তোমার গলাটা ওরকম লাগছে কেন? একি ছ… ছুরি নিয়ে কি করবে…! নামাও বলছি।"
"স্যার"
"কি?"
"আপনার মনটা ভেঙে গেছে স্যার এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হতে দেখে?"
"ম… মানে! কি বলছো কি তুমি?"
"বলুন না স্যার আপনার মনটা ভেঙে গেছে?"
"বিনায়ক…! সরো বলছি, ছুরি সরাও..."
"বেচবেন স্যার ভাঙা মনটা? বেচবেন আমায়?"