Sayantani Palmal

Classics

5.0  

Sayantani Palmal

Classics

মেয়েটি

মেয়েটি

7 mins
453



মহানগর কলকাতার দিগন্ত রেখায় ভীড় করে থাকা হাজারটা বহুতলের মধ্যে “ জীবন রেখা” আবাসনের বিশেষ কোনও বিশেষত্ব নেই। কল্লোলীনির বুকে তথাকথিত শিক্ষিত,রুচিশীল স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের একটুকু বাসা এই “ জীবন রেখা।” জীবন এখানে বয়ে যায় এক ছন্দে। এখানকার বাসিন্দাদের দৈনন্দিন জীবন চর্চায় বিশেষ কোনও নতুনত্ব নেই। চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী,শিক্ষার্থী, গৃহবধূ সবাই নিজের নিজের কর্মজগতে অথবা সংসারে ব্যস্ত। এহেন নিস্তরঙ্গ জীবন রেখার সরলরৈখিক জীবনে হঠাৎ করেই ই.সি.জি মেশিনের গ্রাফের মত কম্পন শুরু হয়েছে বিগত কিছুদিন ধরে আর সেই কম্পন জীবন রেখার অধিবাসীরা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন। থোড়বড়ি খাড়া, খাড়াবড়ি থোড় বঙ্গজীবনে মাঝে মাঝে এমন আনন্দ পেলে আম বাঙালী নর-নারীর মনে বেশ খানিক আমো     আজ সকাল থেকেই “ জীবন রেখা” আবাসন চত্বর সরগরম। অবশ্য সরগরম কথাটা বোধহয় ব্যবহার করা ঠিক হলো না কারণ যা হচ্ছে সেটা হলো একটি মেয়েকে নিয়ে ফিসফিসিয়ে রসালো চর্চা । রবিবার বলে সবার কাছে সময় এবং সুযোগ দুটোই আছে। গিন্নীদের দেখা হলেও চোখ টেপাটিপি করে, “ কি গো শুনেছ কাল রাতে বোস দা কি দেখেছেন?” আর কর্তারাও, “ পাঁচ নম্বরের কেচ্ছাটা শুনেছেন নাকি?” এই জাতীয় কথাবার্তা চালাচ্ছেন। এইসব গরম গরম রসসিক্ত আলোচনার মূল কারণ মাত্র দিন আটেক আগে এই আবাসনের বাসিন্দা হয়ে এসেছে আর এসেই এই আবাসনে একটা হিল্লোল তুলে দিয়েছে অথচ এখন পর্যন্ত তার নামটাও সকলের অজানা। দুধে আলতা গায়ের রং আর সুন্দর মুখশ্রী নিয়ে আঠাশ থেকে আশি আবাসনের অনেক পুরুষেরই দীর্ঘশ্বাসের উৎস হয়েছে সে যদিও নিজেদের অর্ধাঙ্গিনীদের কাছে তাঁরা একনিষ্ঠ পতির মত বলে থাকেন, “ ওহ, মেয়েটা খুব ফর্সা বুঝি? আসলে ভালো করে তাকাই নি    


 আবাসনের অনেকেই মেয়েটির জন্য নিজেদের ফেলুদা, ব্যোমকেশ গোত্রে উন্নীত করে ফেলেছে। ফোর্থ ফ্লোরের পাঁচ নম্বর ফ্ল্যাটটা মেদিনীপুরের এক ভদ্রলোকের । পয়সাওয়ালা লোক তাই কলকাতায় একটা আস্তানা বানিয়ে রেখেছেন। মাঝে মধ্যে দরকারে আসেন। কারুর সাথে তেমন আলাপ নেই। মেয়েটি গত একসপ্তাহ যাবৎ ওই ফ্ল্যাটে থাকছে। বিবাহিতা হওয়ার যেসব চিন্হ বাঙালি মেয়েরা বহন করে সেসব কিছু নেই দেখে নব্য গোয়েন্দারা ধারণা করেছেন যে মেয়েটি অবিবাহিতা তারওপর পোশাক-আশাকেও মেয়েটি যথেষ্ট আধুনিকা। মেয়েটির ফ্ল্যাটে দুটি ছেলে ছাড়া আজ পর্যন্ত অন্য কাউকে চোখে পড়েনি। মেয়েটি মাঝে মাঝেই বেরিয়ে যায় । ফেরে যখন সাথে ছেলে দুটির কেউ না কেউ থাকে। কখনও বা একলা ফিরলেও পরে রাতে দুজনের যে কোনও একজন ছেলে চলে আসে। মেয়েটি বা ছেলে দুটির কেউ এই আবাসনের কারুর সাথে আলাপ করা তো দূর অস্ত কাউকে কথা বলার সুযোগটুকুও দেয় না। চুপচাপ গম্ভীর ভাবে থাকে সকলেই। স্বভাব কৌতূহলী বঙ্গ নরনারীরা তাই “ জীবন রেখা”য় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা মেয়েটির সম্পর্কে নিজেরাই তদন্তভার তুলে নিয়েছে। আবাসনের মিস মার্পল পঞ্চাশোর্ধ মিসেস দাস গতকাল বিকেলে তাঁর তদন্তের ফলস্বরূপ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে মেয়েটি একটি কলগার্ল এবং ছেলে দুটি ওর বাঁধা খদ্দের। গতকাল রাতে মিস্টার বোসের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার ফলে মিসেস দাসের এই অভূতপূর্ব আবিষ্কারটি পেটেন্ট লাভ করেছে। মিস্টার বোসের ব্যালকনি থেকে মেয়েটির ফ্ল্যাটের ব্যালকনি দেখা যায়। কাল রাত এগারোটা নাগাদ মাটন বিরিয়ানি খেয়ে বায়ুর প্রকোপ হওয়ায় মিস্টার বোস মুক্ত বাতাসে অস্বস্তি কাটানোর জন্য একটু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আকাশের চাঁদ-তারা দেখতে দেখতে ওই চোখের কোনাটা দিয়ে একটু পাঁচ নম্বরের ব্যালকনিতে নজর পড়ে গিয়েছিল। তারপর কি দেখলেন তার পুঙ্খনাপুঙ্খ বর্ণনা দিচ্ছেন উত্তেজিত জনতার সামনে, “ বুঝলে ঘোষাল, কাল আবার একটা নতুন ছেলে আমদানি করেছে। মেয়েটা মনে হয় ওই রকেট টকেট কিছু খেয়েছিল। ছেলেটাকে দেখেই বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল তারপর উফফ কি বলব ভাই তোমাকে ওই আজকালকার ছেলেরা বলে বাংলার শিক্ষক বিনোদবাবুর আবার একটু ভালো বাংলায় কথা বলার অভ্যেস। তিনি সব শুনে বললেন, “ ব্যালকনিতে রতি ক্রিয়া । এই হলো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সংস্কৃতি!“ আরে ছাড়ুন তো মশাই সংস্কৃতি। বোস দা ফ্রিতে খাজুরাহ দর্শন করে ফেললেন আর আমরা ফাঁক পড়ে গেলাম।” খিক খিক করে হেসে বললেন মনোহর বাবু। এঁদের সাথে সাথেই “ জীবন রেখা”য় রায় দম্পতি , ঘোষ দম্পতির মত কিছু অর্বাচীন মানুষও বাস করেন যাঁরা এমন বিনোদন মূলক আলাপ-আলোচনার তাল ভঙ্গ করে দেন। এই এখন যেমন রায়বাবু ভ্রু কুঁচকে বললেন, “ বোস দা এই বয়সেও আপনার চোখের জ্যোতি খুব ভালো বলতে হবে রাতের অন্ধকারে এত কিছু দেখতে পেয়ে গেলেন! আমি তো পাশের ব্যালকনিতে মনোজের সাথে কথা বলার সময়ও মনোজকে ভালো করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। মেয়েটি নিশ্চই আলো জ্বালিয়ে এসব ক“ তুমি কি বলতে চাইছ হে পরিস্কার করে বল?” বোস বাবু উত্তেজিত।

“ আরে ছাড়ুন না বোস দা আমাদের আবাসনের অনেকেরই মেয়েটাকে সীতা আর সাবিত্রীর ককটেল মনে হয়। যতসব ন্যাকামি। আপনি তো নিজের চোখে দেখেছেন নাকি? কে কি বলল তাতে আপনার কি?” বোস বাবুকে প্রবোধ দেন মিত্রবাববোস বাবু মনে মনে বেশ প্রশান্তি লাভ করলেন। চিরকালই বাসে-ট্রেনে মেয়েদের গা ঘেঁষে বসে- দাঁড়িয়ে , তাদের পারফিউমের সুঘ্রাণ নিয়ে, কখনও কখনও সুযোগ বুঝে বিশেষ জায়গায় কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে তুরীয় সুখ অনুভব করেন তিনি। এখন আবার বয়স হওয়ায় ভারী সুবিধা হয়েছে। কেউ সন্দেহ করার অবকাশটুকুও পায় না। সেদিন কারেন্ট চলে যাওয়ায় লিফট বন্ধ ছিল আর কেয়ারটেকার ছোকরাটা জেনারেটর চালাতেও দেরি করছিল বলে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন একই সাথে মেয়েটিও নামছিল । এমন সুবর্ণ সুযোগ কি তাঁর মত পাকা খেলোয়াড় নষ্ট করতে পারে? কায়দা করে হোঁচট খেয়ে পড়লেন গায়ে। হাতটা একদম নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। উফফ কি নরম! কিন্তু মেয়েটা এমন বদমাইশ সরাসরি চোখ পাকিয়ে বলে দিল যে তিনি নাকি ইচ্ছে করে ওর গায়ে পড়েছেন! আরে বুঝতেও যদি পেরে থাকিস সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে একটু সম্মান দিবি না! সোজাসুজি বলে দিল, “ পারভার্ট কোথাকার! নাতনির বয়সী মেয়ের গায়ে পড়তে লজ্জা করে না?” ভাগ্যিস ভর দুপুরে ঘটনাটা ঘটেছিল। বেশির ভাগ বাসিন্দা কর্মক্ষেত্রে ছিল আর বাকিরা আয়েশি ভাত ঘুম দিচ্ছিল তাই কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারে নি। সেদিনের ঘটনার বেশ জোরদার প্রতিশোধ নেওয়া গেছে। মহীন বোসকে পারভার্ট বলা! এবার দেখ তোকে কেমন বেশ্যা বানিয়ে ছাড়লাম। গতরাতে একটু উঁকি-ঝুঁকি মারার সময় দেখলেন মেয়েটা একলা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরে একটা ছেলে এল। অন্ধকারে মুখ দেখা না গেলেও উচ্চতা দেখেই বুঝলেন নতুন ছেলে। মেয়েটা আলতো করে ছেলেটার বুকে মাথা রাখলো। ব্যস এটুকুই বাকিটা এব    কবিগুরুর জন্মদিন উপলক্ষে ছুটি সবার। আবাসনের বাসিন্দারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই পবিত্র দিনে পাঁচ নম্বরের মেয়েটিকে বিতাড়ন করে তাঁরা নিজেদের সভ্যতা সংস্কৃতি রক্ষা করবেন। যদিও কিছু বাসিন্দার এসবে আপত্তি আছে কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় নগন্য তাই কে আর তাদের পাত্তা দেয়। সেক্রেটারি হিসেবে মনীশবাবু ফোন করে রাকেশ বিশ্বাস মানে ওই ফ্ল্যাটের মালিককে আসতে বলতেই উনি জানান যে কাকতলীয় ভাবে উনি আজই কলকাতায় আসছেন। মিটিং হলে সবাই অপেক্ষা করছে। একটু আগেই রাকেশ বাবুর গাড়িটা ঢুকেছে। রাকেশবাবু হলে ঢোকার সাথে সাথেই গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। ঘোষবাবু এগিয়ে এলেন। এসবে তাঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল। বাকিরা বাড়াবাড়ি করছে বলেই তাঁর মনে হচ্ছে। আজ মেয়েটির জায়গায় একটা ছেলে থাকলে কি এরা এইসব করত? বারবার এই প্রশ্নটা খোঁচা দিচ্ছে ঘোষ বাবুকে কিন্তু তিনি নিরুপায় তাই যেটুকু তাঁর সাধ্য অর্থাৎ রাকেশ বাবুর সামনে ভদ্রভাবে প্রসঙ্গটা উত্থাপন করা সে“ বলছি কি রাকেশ বাবু আপনার ফ্ল্যাটে হঠাৎ করেই কয়েকজন এসে থাকছে। আমাদের সাথে আপনার বেশি আলাপ না থাকলেও আপনার স্ত্রী, পুত্ৰ, কন্যাকে আমরা চিনি কিন্তু এরা সম্পূর্ণ অপরিচিত আর কারুর সাথে মেলামেশাও করে না তাই বুঝতেই তো পারছেন আজকাল চারদিকে….।”রাকেশ বাবু হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ ওহ বুঝেছি আপনাদের সমস্যা। চিন্তার কিছু নেই। যে মেয়েটি আছে সে হলো আমার বৌমা, ভাইপোর বউ আর …. ।”

“ আরে দাঁড়ান মশাই বৌমা বলছেন অথচ বিবাহিত হওয়ার কোনও চিন্হই নেই মেয়েটার! আমার বৌমা তো লন্ডনে থাকে তাও এক চিলতে সিঁদুর হলেও পরে। বাঙালি সংস্কার বলে কথা।” টিপ্পনী কাটলেন বোস গিন্নী। এই সুযোগে ছেলে বিদেশে থাকে সেটাও শোনান হয়ে গরাকেশ বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “ আমাকে কথাটা শেষ করতে দিলে বোধহয় ভালো হয়“ হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি বলুন।” ঘোষ বাবু বললেন।

“ আমরা বাঙালি খ্রিস্টান পরিবার। আমার দাদু 1930 সালে খৃস্টান ধর্ম নেন। তাই রেবেকা 

কেন সিঁদুর পরে না আশা করি আর বলতে হবে না। আমার ভাইপো আর বৌমা দুজনেই সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। মেলবোর্নে থাকে। রেবেকা বেশি দিন ছুটি পেয়েছিল বলে আগেই দেশে এসেছিল। ও আসার কয়েকদিন পরেই ওর বাবা-মায়ের একটা মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনা হয়। এখন কলকাতার একটা নার্সিং হোমে ভর্তি আছেন। সেই কারণেই রেবেকা, ওর দাদা আর ওর খুড়তুতো ভাই এখানে এসে আছে। রবিন মানে আমার ভাইপো কাল সন্ধ্যের ফ্লাইটে নেমেছে। ওদের নিয়ে আপনাদের চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। সবাই আমার নিজসারা ঘরে মৃদু একটা ফিসফিসানি শুরু হলো। ঘোষ বাবু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন সেই সাথে একটা গ্লানি বোধও হল। মেয়েদের সম্বন্ধে আমাদের সমাজ এমন খড়গহস্ত কেন? শুধু সুন্দরী আর আধুনিকা বলে একটা বিপদগ্রস্ত মেয়ে সম্পর্কে দুনিয়ার সবচেয়ে জঘন্য আলোচনাগুলো হয়ে গেল। তার স্বামী এমনকি তার নিজের দাদা,ভাই তারাও তার খদ্দেরের তকমা পেয়ে গেল? কবে এই সমাজ মেয়েদের প্রতিটি পদক্ষেপকে আতস কাঁচের তলায় পর্যবেক্ষণ করা ছাড়বে কে জানে। মহীন বোস মনে মনে ভাবলেন, “ যাস শালা ওই ছোকরাটা ওর স্বামী!” ফিসফিসানি, গুঞ্জন চলতে চলতেই রাকেশ বাবুর ছেলে ঝড়ের বেগে ঢুকলো, “ বাবা নার্সিং হোম থেকে ফোন এসেছিল বৌদির বাবা মারা গেছেন। মায়ের কন্ডিশনও খুব খারাপ। তুমি তাড়াতাড়ি কথা   মেয়েটির মাও বাঁচেন নি। “ জীবন রেখা”য় ঝড় তোলা মেয়েটি কেঁদে কেঁদে ফোলা চোখ-মুখ নিয়ে স্বামীর হাত ধরে এখান থেকে চলে গেল। পেছনে ফেলে গেল অনেক গুজব, অনেক অজানা অপমান। জীবন রেখার জীবন যাত্রা আবার পূর্ববৎ শান্ত নদীর মত বয়ে চলল। আবার হয়ত কোনও দিন কেউ এসে ঢেউ তুলবে সেখানে।      


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics