মেয়েটির একাদশী পালন
মেয়েটির একাদশী পালন
মেয়েটার শরীর আজ খুব খারাপ। শরীরে একদম বল শক্তি কিছু নেই, খুব দুর্বল।
এক পাও হেঁটে চলে বেরাতে পারছে না। মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে বারবার।
তার ওপর আজ একাদশী। সকাল সকাল স্নান সেরে সারাদিন পুজো পাঠ করতে হবে। পুজো শেষে একটা পাকা কলা, নারকেল আর গাছের বাতাবি লেবুর ফল প্রসাদ খেতে পাবে।
প্রথম প্রথম একাদশীর দিন ফল এনে দিতো। কিন্তু এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িতে যা থাকে তাই দিয়েই উপোস ভঙ্গ করতে হয়।
কখনও গাছের পেয়ারা,লেবু, নারকেল, পাকা কলা দিয়ে ফলাহার করতে হয়, কখনও আবার তার সঙ্গে এক ছটাক দুধে গুর আর সাবু দানা ভেজানো।
অনান্য দিনে ও তো এটা ওটা সবজি সিদ্ধ দিয়ে খেতে হয়। ভালো খাবার খাওয়ার কপাল তো কতো বছর আগেই চলে গেছে।
সেই যে বুড়ো মানুষটা সে তার বর ছিল। তার বয়স ছিল প্রায় তার দাদুর বয়সী।বিয়ে করে চলে গিয়েছিল। মাঝে দুবার এসেছিল তার আগের পক্ষের কয়েকটা বড় ছেলেদের নিয়ে। থেকে ছিল কয়েকটা দিন। বাড়ির সবাই কতো খাতির যত্ন,খাবারের এলাহি আয়োজন করেছিল।
তার সঙ্গে খুব বেশি দেখা হয়নি।পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছিল। বুড়ো লোকটিকে একদম পছন্দ ছিল না। অনেক বয়স,মাথায় চুল নেই,টেকো বুড়ো। কিন্তু তার ছেলেগুলো বেশ ভালো ছিল। ওদেরকে বেশ ভালো লেগেছিল।
অতো বড় ধেরে ছেলেরা তাকে মা বলে ডাকছিল। খুব লজ্জা লাগছিল তার।তাই তো সে দৌড়ে পুঁটিদের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। সেই শেষ দেখা। বিয়ের পর একবার মাত্র একদিনের জন্য বরের বাড়ি গিয়েছিল।
সেই বুড়ো বরের বুড়ি বউটা খুব দরজাল। তাকে একদম পছন্দ করতো না। তাকে রাতে রান্না ঘরে ঘুমাতে দিয়েছিল। ভালো করে খেতেও দেয়নি।
পরের দিন কাকাবাবু এসেছিল দেখা করতে, তার সঙ্গেই মেয়েটা চলে এসেছিল।আর কোন দিন শশুর ঘরে যায়নি।
মাস কয়েক পরে শুনেছিল তার বুড়ো বর মারা গেছে।সে মরেছে তো মরেছে তার কী তাতে,এটাই মেয়েটি সেই মুহূর্তে ভেবেছিল।
কিন্তু পরে সে হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে, সেই বুড়োটা তার জীবনে কী ছিল। বুড়ো চলে যাওয়ার পর তার গাঁ থেকে সব গয়না খুলে নিয়ে,সাদা থান কাপড় পড়িয়ে দেয়। তার মাছ মাংস ডিম খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু সিদ্ধ তরকারি দিয়ে খেতে হয়।এই ভাবেই বছর পাঁচেক কেটে গেলো।তাও যতোদিন তার বাবা বেঁচে ছিল,এটা ওটা লুকিয়ে লুকিয়ে এনে দিতো।মিষ্টি,সন্দেশ আরো কতো কী যা সে খেতে ভালোবাসতো।
এখন দাদা-বৌদিরা তাকে শুধু বাড়ির কাজের মেয়ে বানিয়ে রেখেছে। ঠিক মত খেতে পড়তে পায় না।
কিছু দিন আগে বড় বৌদির দাদা বেরাতে এসেছিল কোলকাতা থেকে। তিনি বড় বৌদিকে বলছিল মেজদি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহ প্রলচলন করেছে। তিনি নিজের ছেলেকে একটা বিধবা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে।
বড় বৌদি সব শুনে বলল,"ও সব কেতাবি কথা ছাড়।এক বার বর মরে গেলে কিসের বিয়ে।এই তো খাচ্ছে দাচ্ছে দাদাদের সংসারে দিব্যি আছে।এই থেকেও কী বেশি ভালো থাকা যায়।"
মেয়েটির খুব ইচ্ছা করে আবার অনেক গহনার সঙ্গে লাল শাড়ি পড়বে, মাথায় চওড়া করে সিঁদুর, হাতে শাঁখা পলা।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহ প্রলচলন করে বিধবা মেয়েদের অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তি দেবার চেষ্টা করলে কী হবে, এই সমাজ,এই পরিবার তো এতো সহজে বিধবা মেয়েদের দুর্বিষহ জীবন যাপন থেকে বের হতে দেবে না।