STORYMIRROR

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Classics Fantasy Inspirational

3  

পূর্নব্রত ভট্টাচার্য্য

Classics Fantasy Inspirational

মাস্টার মশাই

মাস্টার মশাই

7 mins
256

আজ অংশুমান অনেক বড় লেখক হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় আজ তাকে অতিথি করে ডাকা হয় সংবর্দনা দেওয়ার জন্য। আজ অংশুমানের কবিতা আর গল্পের পাঠক সংখ্যা গোটা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। বই প্রেমীদের কাছে এখন সে হলো অন্যতম আইডল। এই কিছু দিন আগে অংশুমানের নতুন উপন্যাস " হৃদয়ের অন্তরালে " বইটি দেজ প্রকাশনা থেকে প্রকাশ পেয়েছে। আজ ১৫ দিনের মধ্যে সেই বইয়ের ৫ টি এডিশন হয়েছে ,

তাই আজ এই সফলতার উপলক্ষেই অংশুমান কে অনন্ত্রন জানানো হয়েছে দেজ পত্রিকার আয়োজিত অনুষ্ঠানে। যথারীতি অংশুমান সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়, তার সাথে আরও বেশ কিছু অতিথি এবং এর সাথে সেখানে সেই সব ট্রাস্ট গুলোর ছাত্র ছাত্রী ও তাদের কর্ণ ধাররাও উপস্থিত ছিল।এই ট্রাস্ট গুলোতে দেজ পত্রিকার প্রকাশিত বইয়ের লভ্যাংশের এক অংশ অনুদান দেওয়া হয় এই ছাত্র ছাত্রীদের পড়াশোনার জন্য।আজকের এই দিন টা ছিল আমাদের সবার প্রিয় শিক্ষক দিবস। আর অনুষ্ঠানে অনেক মান্য গণ্য মানুষরা এসেছিলেন। সবাই কে একে একে বরণ করা হয়। আর সেই ছোট ছোট ছাত্র ছাত্রীদের হাতেই বরণ বরণ করা হয় সকল অথিতিদের। আর বরণ করার পর সবাই কে কিছু বক্তিতা দেওয়ার জন্য বলা হয়। আর এই বক্তিতার পর সকল অতিথিকেই ওই ছোট ছাত্র ছাত্রীদের সাথে এক প্রশ্ন উত্তর পর্বের জন্য অনুরোধ করা হয়। যেখানে সেই ছাত্র ছাত্রীরা প্রত্যেক অতিথিদের কিছু প্রশ্ন করবে আর সেই প্রশ্নের শিক্ষণীয় উত্তর দেবেন অতিথিরা।


তারপর প্রতি অতিহিকে বোরন করার পর ৫ থেকে ১০ মিনিট চলে সেই প্রশ্ন উত্তর পর্ব । আর সেই ছোট ছোট ছাত্র ছাত্রীরা নানান প্রশ্ন করতে থাকে সেই অথিতিদের। আর সবাই এই প্রশ্ন উত্তর পর্বটাকে উপভোগ ও করছিলো। তারপর অংশুমান কে বরণ করা হয় এবং অংশুমান কেও সেই প্রশ্ন ধারার মুখে পড়তে হলো। কিন্তু অংশুমান কে এক ছাত্রী এমন এক প্রশ্ন করে , যে প্রশ্ন অন্য কোনো অতিথিকে করা হয়নি। আর সব থেকে বড় কথা সেখানে সব ছাত্র ছাত্রী সকল অতিথি কে একাধিক প্রশ্ন করলেও। এক ছাত্রী কিন্তু শুরু থেকেই সেখানে চুপ করে বসে ছিল। সে কাউ কেও কোনো প্রশ্ন করেনি। অংশুমান ও বসে বসে সেটা লক্ষ করছিলো আর মনে মনে ভাবছিলো কেন ওই মেয়েটি একা চুপ করে বসে আছে। সেই মেয়েটির দিকে লক্ষ রাখার আরও একটা কারণ হলো যে। ওই মেয়ে টিও অংশুমানের দিকে তাকিয়েই বসে ছিল এক ভাবে। মনে হচ্ছিলো যেন ওই মেয়েটি অংশুমান কে কিছু বলতে চায় , যেন সে অংশুমান কে চেনে। যখন অংশুমান কে বরণের পর তার হাতে মাইক দেওয়া হয়। তখন থেকেই যেন সেই মেয়েটি নড়ে চরে বসে। একে একে সব ছাত্র ছাত্রী প্রশ্ন করে অংশুমান কে , কিন্তু ওই মেয়েটি চুপ করে বসে থাকে । অংশুমান ভেবেছিলো যে ওই মেয়েটি কোনো প্রশ্ন করবে হয়তো অংশুমান কে। তারপর যখন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক প্রশ্ন করেন আর কেউ কি কোনো প্রশ্ন করবে ? তখন সেই একা বসে থাকা মেয়েটি আস্তে আস্তে হাত তোলে। বছর তরো কি চোদ্দ বয়স হবে তার , অংশুমান ও তখন মধুর ও স্নেহ মাখানো কণ্ঠে বলে মেয়েটি কে বোলো কি প্রশ্ন করবে তুমি। সবাই কে চমকে দিয়ে সেই মেয়েটি অংশুমান কে পর পর ৩ টি প্রশ্ন এক সাথেকরে। প্রশ্ন গুলি হলো


আপনাকে কবিতা ও গল্প লিখতে অনুপ্রেরণা কে দিয়েছেন ?

আপনার এই সাফল্যের জন্য আপনি কাকে কার কাছে কৃতজ্ঞ ?


আপনার এই সাফল্যের জীবনের পথ চলার পথিকৃৎ কে ?


এমন ৩ টি প্রশ্ন শুনে অংশুমান সহ সেখানে উপস্থিত সকলেই বেশ অবাক হয়ে যায়। কারণ সব ছাত্র ছাত্রীরা এতক্ষন পর্যন্ত সাধারণ প্রশ্ন করেছে। কিন্তু এমন ব্যাক্তিক্ত পূর্ণ ভাবে এই ধরণের প্রশ্ন কেও করেনি। অংশুমান এই প্রশ্ন শুনে খুবই অবাক হলো। অংশুমান বললো খুব গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্ন করেছো তুমি। সত্যি এই প্রশ্ন আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ কোনো দিনও করেনি। আর আমিও বলার সুযোগ পাইনি যে আমার আজকের এই লেখন হয়ে ওঠার পিছনের গল্পটা এর সেই মানুষটার কথা , যে মানুষটা না থাকলে হয়তো আমি আজ এই জায়গায় আস্তে পারতাম না । এই প্রশ্ন কেউ এতো দিন কেন করেনি তাকে এই কথাই এতো দিন মাঝে মাঝেই ভাবতো অংশুমান। কারণ যার অনুপ্রেরণায় আজ তার এতো দূর পথ চলা, সেই মানুষটার কথা তার পাঠকদের সবার জানা দরকার। তারপর ওই প্রশ্ন গুলির উত্তর দিতে গিয়ে কিছু ক্ষনের জন্য অতীতের দিনে হারিয়ে যায় অংশুমান। চকিতে চোখ খুলে অংশুমান দেখে যে সেই মেয়েটি উঠে একটু কাছে চলে এসেছে। আর মেয়েটি আবার বলে ওঠে অংশুমান কে উদ্দেশ করে " স্যার বলুন "। 


অংশুমান বলতে শুরু করে , তখন আমি হরিদেব পুর প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। সেখানে একদিন অংক পরীক্ষার দিন আমার সব অংক তাড়াতাড়ি কষা হয়ে যাওয়ার জন্য আমি বসে বসে প্রশ্ন পত্রের পিছনের দিকে একটা কবিতা লিখছিলাম।আমি কবিতা লিখতে ভালোবাসতাম খুব। ঠিক সেই সময় ওই পরীক্ষার রুমে গার্ড ছিলেন বাংলার স্যার অনিল বাবু। আমি বসে আছি দেখে তিনি আমার কাছে আসেন । আর আমাকে প্রশ্ন পত্রের পিছনে কিছু লিখছি দেখে , আমার কাছে এসে আমাকে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করেন। উনি জানতে চান যে আমি প্রশ্ন পত্রের পিছনে কি লিখছি । আমি ভয়ে চুপ থাকি , কারণ অনিল বাবু খুব রাগী ও গম্ভীর মানুষ ছিলেন সবাই ওনাকে ভয় পেয়ে চলতো।আমি চুপ করে আছি দেখে অনিল বাবু আমার হাত থেকে প্রশ্ন পত্রটা নিয়ে উল্টে দেখেন। সেখানে আমার লেখা কবিতা দেখতে পান এবং সেটা পড়েন পড়েন। আমি তখন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছি এই বুঝি কপালে মার্ জুটলো বলে। অনিল বাবু কবিতা টা আমার মুখের দিকে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে বলেন এই কবিতা টা তুমি লিখেছো। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম হ্যাঁ। উনি জানতে চাইলো কোথায় পড়েছো এই কবিতা ? আমি বলি কোথাও পড়িনি আমি নিজে লিখেছি মন থেকে। এই কথা শুনে অনিল বাবু একটু

ভুরু কুঁচকে বললেন তুমি নিজে লিখেছো ? আমি ভয় জড়ানো গলায় আবার বললাম হা। তখন অনিল বাবু হাসি মুখে বলেন খুব ভালো হয়েছে বাহ্ সুন্দর কবিতা লেখো তো তুমি। কিন্তু পরীক্ষার সময় কবিতা লিখছো কেন পরীক্ষার উত্তর কে লিখবে। আমি বলি স্যার আমার সব অংক কষা হয়ে গেছে। অনিল বাবু আমার খাতাটা নিয়ে দেখেন আমি সত্যি কথা বলছি কিনা।তারপর আমাকে অনিল বাবু বললেন আরও কবিতা আছে নাকি তোমার নিজের লেখা। আমি বললাম হ্যাঁ। তারপর অনিল বাবু বললেন কাল নিয়ে আসবে তো আমি পড়ব তোমার কবিত। আর বললেন তোমার এই প্রশ্ন পত্রের কবিতা খানা আমি আমার কাছে রাখলাম , এই বলে মুচকি হাসলেন উনি । তারপর থেকে অনিল বাবু আমার সাথে আলাদা ভাবে লাইব্রেরি তে সময় কাটাতেন , নানা বই পড়তে দিতেন। আমি কোনো নতুন কবিতা লিখলে সেটা সবাই কে পরে শোনাতেন। স্কুলে ম্যাগাজিন এ কবিতা ও গল্প লেখার জন্য আমাকে উৎসাহিত করতেন। আমাকে উনি বলতেন " ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমতা দিয়েছে বাবা একে কখনো নষ্ট হতে দিও না " তুমি লিখে যায় মন দিয়ে।


তারপর একদিন অনিল বাবুর ট্র্যান্সফার হয়ে যায় কোনো এক অন্য শহরে। তারপর থেকে আর দেখা হয়নি ওনার সাথে। শুধু একটাই কথা আজও মনে রেখেছি ওনার " ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমতা দিয়েছে বাবা একে তুমি কখনো নষ্ট হতে দিওনা "। 

এই কথা শেষ করে অংশুমান বলে সেই মেয়েটিকে , আমার এই লেখক হয়ে ওঠার পিছনে আমার অনুপ্রেরণা আমার শক্তি হলো আমার বাংলা শিক্ষক অনিল বাবু। আমি জানিনা আজ উনি কোথায় আছেন কেমন আছেন।কিন্তু আজও আমি ওনাকে খুব ভালোবাসি। আর এই ভেবে খুব কষ্ট পাই যে ওনার বলা কথা যে আমি রেখেছি সেটা আমি ওনার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারলাম না। আজ এই কুড়ি বছরে একটাও শিক্ষক দিবসে আমি অনেক প্রণাম করতে পারলাম না । এই বলে স্টেজের উপরেই বসে পরে অংশুমান আর তার চোখে থেকে জল ঝরে পরে। তখন সেই ছোট মেয়ে টি অংশুমানের কাছে গিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে । আপনি আপনার সেই মাস্টার মশাই কে যে আজও মনে রেখেছেন এতো শ্রদ্ধা করেন এই কথা জেনে আপনার মাস্টার মশাইও খুব আনন্দ পাবেন। হয়তো উনিও আপনার মতোই কেঁদে ফেলবে আপনাকে দেখে। তারপর ওই মেয়েটি বলে আপনার কি আপনার মাস্টার মশাইয়ের সাথে দেখা করতে চান।অংশুমান জল ভরা চোখে সেই ছোটো মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে তুমি জানো উনি কোথায় থাকেন , তুমি অনেক চেনো ?     মেয়েটি বলে হ্যাঁ আমি ওনাকে চিনি। কারণ ওনার মুখে আপনার অনেক প্রশংসা আর আপনার কবিতা ও গল্প শুনেই আমি বড়ো হয়েছি । উনি আপনাকে অনেক ভালোবাসেন , আপনার লেখা এমন কোনো বই নেই যেটা উনি পড়েননি। তারপর মেয়েটি অংশুমানের হাতে একটা কাগজ দেয় । অংশুমান কাজগ টা হাতে নিয়ে খুলে দেখে যে একটা পুরোনো অংকের প্রশ্ন পত্র । অংশুমান সেই প্রশ্ন পত্র টা উল্টে পিছনে দেখে যে সেই অংশুমানের ছোট বেলার পরীক্ষার রুমে বসে নিজের হাতে লেখা কবিতা।এই সেই প্রশ্ন পত্র যা অনিল বাবু নিকের কাছে বলেছিলেন যে এই প্রশ্ন পত্র আমি আমার কাছে রাখলাম। বুকের ভিতর টা কেমন যেন করে ওঠে অংশুমানের ,সেটা কেউ কে বোঝানোর মতো নয়। অংশুমান বলে সেই মেয়েটিকে তুমি আমাকে ওনার কাছে নিয়ে যেতে পারবে । মেয়েটি শান্ত গলায় বলে দেরি হয়ে গেছে অনেক। এক বছর আগে উনি মারা গেছেন। তবে উনি আপনাকে নিয়ে অনেক গর্ব করতেন। আপনিও যে ওনাকে মনে রেখেছেন , ওনার অনুপ্রেরণার মর্যাদা দিয়েছেন এই দেখেই উনি অনেক শান্তি পাবেন পরলোক থেকে। আমারও জানার খুব ইচ্ছা ছিল। এই যে উনি আপনাকে এতো ভালোবাসতেন এতো স্নেহ করতেন।  আপনিও কি ওনাকে মনে রেখেছেন। তাই আজ আপনাকে এই প্রশ্ন করেছিলাম। অংশুমান কেঁদে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে মাস্টার মশাই আমি কোনো দিনোও আপনাকে ভুলিনি আর কোনো দিনো ভুলবোনা। আপনি না থাকলে আমি আজ এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না। আজ এই শিক্ষক দিবসের দিনে আপনার কাছে সযত্নে রাখা এই প্রশ্ন পত্র আমার জীবনের সব থেকে বড় পাওনা সব থেকে বড় পুরস্কার সব থেকে বড় সম্পদ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics