মামদোবাজি
মামদোবাজি
উফফ এই খটকাইটাকে নিয়ে আর পারা গেল না, ওর জন্য পটকাইয়ের হয়েছে যত জ্বালা। খটকাই এদিক সেদিক পালাবে আর মা পটকাইকে পাঠাবেন তাকে খুঁজে আনতে! রাগে গজগজ করতে করতে নোনতাদের বাড়িতে ঢুকলো পটকাই।
"ও বাবা, নোনতাদের বাড়িতে তো আজ দেখছি সব দুস্টুদের আড্ডা জমেছে!" বিড়বিড় করতে করতে খটকাইয়ের মাথায় একটা চাঁটি মারল পটকাই। বিরক্ত মুখে একবার পেছন ঘুরে পটকাইকে দেখে নিল খটকাই কিন্তু পাত্তা দিলোনা ঠিক। অবাক পটকাই কিছু হয়তো বলতে যাচ্ছিল খটকাইকে, কিন্তু তার আগেই ওর নজরে পড়ল সেটার দিকে। একটা নরম তুলতুলে জিনিস খাটের ওপর শোয়ানো, ছোটো ছোটো হাত পা গুলো নাড়ছে অনবরত, গাল দুটো আপেলের মত লাল। কুতকুতে চোখ দুটো দিয়ে দেখছে এদিক সেদিক, মুখে তার অগাধ বিস্ময়। খটকাই ওর গলায় সুড়সুড়ি দিয়ে দিতেই খিলখিল করে হেসে উঠল সে। পাশ থেকে নোনতাদের বাড়ির কেউ একজন বলে উঠল, "দেখো দেখো আজ থাকতে থাকতে নিজেই কেমন খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে।"
মহিলার কথা শুনে হাসি পেয়ে গেল পটকাইয়ের। এবার সেও দুস্টুমি করে বাচ্চাটার পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে দিল আর তাতে আবার বাচ্চাটা খিলখিলি করে হেসে উঠল। ভারী পুলক হল পটকাইয়ের, আহা কি সুন্দর জিনিস! সে নোনতাকে জিজ্ঞেস করল, "এটা কে রে?"
নোনতা ফিসফিস করে জবাব দিলো, "আমার কুচুন বোনু, ওর নাম চিনি। আমার মাসির মেয়ে।"
নোনতার কথা শুনে মাথা নেড়ে পটকাই বসে পড়ল খটকাইয়ের পাশে, দিয়ে মনের সুখে খেলতে লাগল চিনির সঙ্গে। এভাবে কতটা সময় যে পার হয়ে গেল খেয়ালই করলোনা দুই ভাই। আচমকা কাঁধের ওপর শক্ত কিছু চেপে বসতেই সম্বিৎ ফিরল দুজনের। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে সাক্ষাৎ মা দাঁড়িয়ে পেছনে, মায়ের চোখে যেন আগুনের গোলা, মুখটা টোম্যাটোর মত লাল। একটা করে ঢোঁক গিলল দুইভাই, "মা…!"
"তবে রে বদমাইশ দুটো সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা, পড়তে বসতে হবে না তোদের? দাঁড়া তোদের বাবাকে বলে শহরের পাঠশালায় ভর্তি করতে হবে দেখছি, নাহলে তোরা সোজা হবিনা। চল বাড়ি চলে এক্ষুণি।"
ভোরবেলায় সেই সবে ঘুমটা ধরেছিল দুইভাইয়ের, এমন সময় কে যেন কান্নাভেজা গলায় ডেকে উঠল ওদের। দুই ভাই ভ্রু কুঁচকে নীচের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল নোনতাকে। দু'চোখ আর নাক দিয়ে তার জল গড়াচ্ছে অবিরাম।
"কিরে নোনতা কাঁদছিস কেন?" একসঙ্গে জিজ্ঞেস করে উঠল দুই ভাই।
"খটকাই পটকাই বাঁচা আমাকে, সর্বনাশ হয়ে গেছে!"
"সকাল সকাল কি সর্বনাশ হল রে?"
"চিনি বোনুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।"
"বলিস কি!" একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল দুই ভাই।
নোনতা কান্না জড়ানো গলায় বলল, "হ্যাঁ রে। কাল রাতে তো মাসির সঙ্গে শুয়েছিল কিন্তু আজ সকালে ঘুম ভাঙতে মাসি দেখে ও নেই পাশে। আমরা তারপর গোটা বাড়ি খুঁজেছি কোত্থাও নেই…"
"এতো সাংঘাতিক কান্ড!" বলল পটকাই।
নোনতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, "সেই জন্যই তো তোদের কাছে এলাম প্লিজ আমাকে হেল্প কর। আমার বোনুকে খুঁজে দে।"
"কিন্তু আমরা কি করে খুঁজবো!" চিন্তিত মুখে বলল খটকাই।
"এমন বলিস না খটকাই, তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড!"
"সে তো জানি কিন্তু সমস্যা যে অন্য।"
"কি সমস্যা রে?"
"আসলে কাল বাড়ি ফিরতে দেরি করেছিলাম বলে মা আজ আমাদের বুড়ো বটের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে, আজ আমরা কোত্থাও বেরোতে পারব না।" জানাল পটকাই। আর সঙ্গে সঙ্গে ভ্যাঁ করে আরও জোরে কেঁদে উঠল নোনতা।
"আহা কাঁদিস না, দাঁড়া দেখছি কি করা যায়।
মা… ও মা…" মাকে ডেকে উঠল খটকাই। ওদের মা সেই সবে দুস্টু দুটোকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ঘুমোতে গিয়েছিলেন, আবার ওদের ডাক শুনে তড়িঘড়ি উঠলেন, "কি হল? আর যাই বলো বাঁধন খুলতে বলবে না কিন্তু।"
"মা প্লিজ খুলে দাও আমাদের। আজ আমাদের যাওয়া খুব দরকার।" বলল পটকাই।
মা বললেন, "এ কথা তো রোজই বলো।"
"না মা প্লিজ, আজ খুলে দাও। আর কোনোদিনও বলবো না।" কাতর গলায় অনুরোধ করল খটকাই।
"খুলে দেওয়ার শর্ত তো তোমরা জানো, তাতে রাজি আছো কি?"
মায়ের কথায় ঢোঁক গিলল দুইভাই। তারপর কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে খটকাই বলল, "রাজি।" পটকাই অবাক চোখে তাকাল ওর দিকে কিন্তু মুখে কিছুই বলল না।
মা বাঁধন খুলে দিতে গাছ থেকে নেমে পড়ল দুই ভাই। নোনতা ওদের কাছে জানতে চাইল, "কি শর্ত রে?"
"মা বলেছিল আজ যদি আমরা বাড়ির থেকে বেরোই তাহলে আমাদের শহরের পাঠশালায় ভর্তি করে দেবে।" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পটকাই। খটকাই বলল, "এখন এসব কথা থাক, আগে চল চিনিকে খুঁজি।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ চল চল…"
চিনির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটল তিন বন্ধু।
খুঁজতে খুঁজতে ওরা দনাইয়ের পাড়ে পৌঁছে গেল। সেখানে ওদের ডাক হাঁক করতে দেখে জল থেকে মুখ তুলল সেই রাক্ষুসে বোয়াল, "আরে তোমরা যে, কি ব্যাপার?"
"ওহ বোয়াল দাদা তুমি! ভালো আছো?" জিজ্ঞেস করল খটকাই। বোয়াল কোনো জবাব দেওয়ার আগেই নোনতা বলে উঠল, "বোয়াল দাদা পরে কথা বলবো। এখন আমরা খুব ব্যস্ত।"
"আরে হয়েছেটা কি বলো না।" জিজ্ঞেস করল বোয়াল।
"আমার বোনুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা সকাল থেকে।" কাঁদো কাঁদো গলায় জানাল নোনতা।
"সেকি!" অবাক হয়ে গেল বোয়াল, "তোমার বোনুটি দেখতে কেমন?"
"এইটুকু পুঁচকে, ছোটো ছোটো হাত পা।" বলল খটকাই; পটকাই সঙ্গে যোগ করল, "তুলতুলে কমলা লেবুর মত গাল, লিচুর মত ঠোঁট, গোলগোল দুটো চোখ…"
"আরে আরে দাঁড়াও দাঁড়াও… আমার কিছু একটা মনে পড়ছে।" গম্ভীর গলায় বলল বোয়াল। ওরা তিনজন উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, "কিগো… কি গো?"
"আজ সকালে মামদো মশাই যখন এদিক দিকে যাচ্ছিল তখন তার হাতে এরকমই কিছু একটা দেখেছিলাম যেনো!"
"কি বলছো কি তুমি বোয়াল দাদা!" অবাক হয়ে গেল নোনতা।
"হ্যাঁ গো যা দেখেছি তাই বললাম, তোমরা একবার গিয়ে দেখতে পারো।"
"কিন্তু তাকে পাবো কোথায় বোয়াল দাদা?" জানতে চাইল নোনতা, কিন্তু বোয়াল বলল, "সেটা তো আমি জানিনা।"
"আমি বোধহয় জানি।" ওরা তিনজন ঘুরল খটকাইয়ের দিকে। সে ওদের দেখে একটা বোকার মত হাসি হেসে বলল, "একবার মা রেগে গিয়েছিল বলে ঘুরতে ঘুরতে আমি ঐ ওই দিকে চলে গিয়েছিলাম। ওদিকে অনেকগুলো তালগাছ আছে, তারই কোনোটাতে থাকে মামদো।"
"উফফ খটকাই জীবনে প্রথমবার তোর এই বাড়ি পালানো স্বভাবের জন্য তোর ওপর রাগ হচ্ছে না। চল আমাদের ওখানে নিয়ে চল।" খটকাইয়ের পিঠ চাপড়ে দিয়ে কথাগুলো বলল পটকাই।
খটকাই যত সহজে জায়গাটার কথা বলেছিল সেখানে পৌঁছানো কিন্তু মোটেও তত সহজ ছিলোনা। একটা বড় পুকুর, অনেক মেঠো পথ পেরোতে তবে গিয়ে ওরা দেখতে পেল সেই তালগাছের সারির।
নোনতা তো সেখানে পৌঁছে রীতিমতো হাঁপাতে লাগল। পটকাই বলল, "নোনতা এখানে বিশ্রাম নে, খটকাই ওর সঙ্গে থাক। আমি ওপরে গিয়ে দেখে আসছি কি ব্যাপার।"
এই বলে নোনতা হুশ করে উড়ে তালগাছগুলোর মাথার ওপর পৌঁছে গেল। কিন্তু এর মধ্যে মামদোর বাড়ি কোনটা! এখন তো ভুতদের ঘুমানোর সময়, যার তার বাড়িতে গিয়ে ডাকাডাকি করলে আবার তারা রেগে গিয়ে কেলেঙ্কারি কান্ড করবে। কোনটায় যাই…! পটকাই উঁকি ঝুঁকি মারতে মারতে আচমকা খোনা গলায় একটা গান ভেসে এলো ওর কানে---
"পিঠে হল তাল কা
খানা মেরা রোজ কা
না মুঝকো কোয়ি দেখা
না মুঝকো কোয়ি টোকা…"
এমন গান শুনে চোখ একেবারে কপালে উঠে গেল পটকাইয়ের। সে শব্দ শুনে শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখলো একটা রোগা লম্বা গোছের ভূত কচু পাতায় কি যেন নিয়ে বসে বসে খাচ্ছে আর অমন গান করছে।
"এই যে শুনছেন…" পটকাইয়ের ডাকে ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল ভূতটা, কিন্তু পরক্ষণেই কচু পাতায় মোড়া জিনিসগুলো বুকের মধ্যে চেপে ধরে সে বলল, "খবরদার! একটাও পিঠে দেবো না বলে দিলাম।"
"পিঠে!"
"হুঁ… আমি বলে ভোর রাতে কত কষ্ট করে এগুলো চুরি করে এনেছি।"
"আরে না না… আমার পিঠে চাইনা।"
"তাহলে কি চাই এখানে?"
"বলছি আপনার নাম কি মামদো?"
"আ মোলো যা, আমি মামদো হতে যাবো কোন দুঃখে! ও ব্যাটা মহা দুষ্ট।"
"তাহলে আপনি…"
"আমি তালঢ্যাঙা ভূত।"
"ওহ আচ্ছা আচ্ছা, বলছি মামদো মশাই কোনদিকে থাকে বলতে পারেন?"
"মামদো আবার মশাই! হাঃ হাঃ হাঃ… যা বাম দিক থেকে ওই তিন নম্বর গাছটায় থাকে সে।"
"আচ্ছা। থ্যাঙ্কু।"
তালঢ্যাঙা ভূতের কথা মতো নির্দিষ্ট তালগাছটার সামনে এলো পটকাই। কাউকে দেখা যাচ্ছেনা আশেপাশে। সে হাঁক পাড়ল, "মামদো মশাই বাড়ি আছেন?" উত্তর দিলো না কেউ। আরও দু তিনবার ডাকার পর সড়সড় একটা শব্দ হল গাছে, তারপর একটা তাগড়াই চেহারার ভূত বেরিয়ে এলো বাইরে। পটকাইকে দেখতে পেয়ে বাজখাঁই গলায় বলে উঠল, "কি চাই?"
"আপনি মামদো মশাই?"
"হুমম।"
"বলছি আজ সকালে আপনি আমার বন্ধুর কুচু বোনকে ধরে এনেছেন?"
"বন্ধুর বোন! না না আমি কাউকে আনিনি।"
"কিন্তু বোয়াল দাদা যে বলল…"
"কে কি বলল জানিনা। এখন যাও, ঘুমের সময় ডিস্টার্ব কোরো না আর।"
"আরে শুনুন.." পটকাই কথাটা সম্পূর্ণ করার আগেই মামদোর বাড়ি থেকে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে এলো। চমকে উঠল পটকাই, "ওটা কে কাঁদছে?"
"কেউ না। আমার ছানাদের পুতুল ওটা।"
"আমাকে একবার পুতুলটা দেখাবেন?"
"নানা ওসব হবে না। যাও এখন।"
"আমি না দেখে তো যাবো না।" এতক্ষণে গর্জে উঠল পটকাই। আর মামদোও চোখ পাকিয়ে বলল, "তবে রে বদমাইশ!" এই বলে সে পটকাইয়ের মাথায় এমন চাঁটি মারল যে পটকাই সোজা এসে পড়ল নীচে। ওকে ওভাবে নীচে পড়তে দেখে চমকে গেল খটকাই আর নোনতা। দুজনে একসঙ্গে বলে উঠল, "কিরে কি হয়েছে?"
"আমি নিশ্চিত চিনি বোনু ওই মামদোরই বাড়িতে আছে কিন্তু আমাকে তো ঘরের ভেতর যেতেই দিলো না।"
এই বলে ওপরে ওঠার পর থেকে কি কি হয়েছে সব বলে গেল পটকাই। সব টুকু শুনে ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল নোনতা, "এবার কি হবে!"
"আহা নোনতা তুই কাঁদিস না, আমরা আছি তো। ঠিক একটা উপায় বাতলাবো।" এই বলে নোনতার কাঁধে হাত রেখে ওকে সান্ত্বনা দিল খটকাই। তারপর পটকাইয়ের দিকে ঘুরে বলল, "আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে…"
খটকাইয়ের প্ল্যানমাফিক মামদোর বাড়ির সামনে গিয়ে আবার ডাকহাঁক শুরু করল পটকাই। মামদো তো এবার আরও রেগে গিয়ে বেরিয়ে এলো বাইরে, "আবার কি চাই রে? মাথায় চাঁটি খাবি নাকি?"
"ভেতরে কে কাঁদছে আমাকে দেখতে দাও, নয়তো ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটিয়ে বসবো।" দৃঢ় গলায় বলল পটকাই। ওর কথা শুনে মামদো তো একেবারে রেগে তেলেবেগুন হয়ে উঠল, "তবে রে পুঁচকে ভুত আমাকে হুমকি দিচ্ছিস!" এই বলে সে পটকাইয়ের মাথায় জোরে একটা চাঁটি মারল আবার। পটকাই ধাঁ করে গিয়ে পড়ল নীচে। রাগে গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকে মামদোর তো চক্ষু চড়ক গাছ। দেখে পটকাই বহাল তবিয়তে বসে রয়েছে তার ঘরে, "ত… তুই? তুই কি করে ঢুকলি?"
"ম্যাজিক। বলেছিলাম না, আমাকে ঢুকতে দাও নয়তো ভয়ংকর কান্ড করব।"
"তুই তো মহা বিচ্ছু দেখছি। কিন্তু আমাকে অতো সহজে ভয় দেখাতে পারবিনা, আমি হলাম গিয়ে মামদো ভুত।"
এই বলে মামদো পটকাইকে ধরে বাইরে এনে ছুঁড়ে ফেলল নীচে তারপর হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকেই আবার ভিরমি খেলো, "তুই আবার! কিন্তু কি করে?"
"হেঁ হেঁ ডোন্ট আন্ডার এস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ এ ছানা ভুতুম।"
"কি?"
"ও তুমি বুঝবে না। এটা একটা খুব ভালো কথা, আমার যে বন্ধুর বোনকে ধরে এনেছো সেই বন্ধু শিখিয়েছিল।"
"আচ্ছা বেশ আর বড় বড় কথা বলতে হবেনা, তুই এখন আমার ঘর থেকে যা দেখি। আমি এখন ঘুমাবো।"
"সে তুমি যত খুশি ঘুমাও, কিন্তু চিনি বোনুকে না নিয়ে আমি কোত্থাও যাবো না। বোনু… এই বোনু…" এই বলতে বলতে পটকাই দেখতে পেলো মামদো ভুতের ছানারা চিনি বোনুর হাত পা ধরে টানাটানি করছে আর চিনি বোনু টুয়া টুয়া করে কাঁদছে। এমন দৃশ্য দেখে মাথাটা ভারী গরম হয়ে গেল পটকাইয়ের। সে সাঁ করে গিয়ে মামদোর ছানাদের কাছ থেকে কাড়িয়ে নিতে গেল চিনি বোনুকে, কিন্তু তার আগেই মামদো ওর ঘাড়টা খপ করে ধরে বাইরে নিয়ে এসে সোজা ছুঁড়ে ফেলল নীচে। দিয়ে নিজের মনেই বলল, "এবার যা জোরে ছুঁড়েছি আর ব্যাটা ভয়ে উঠবে না।"
কিন্তু ও কি কান্ড! ছানাগুলো সব কাঁদছে কেন! তড়িঘড়ি ঘরে ফিরে গিয়ে মামদো দেখলো পাজি ভূতটা পুতুলটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তাই তো ছানাগুলো অমন ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার করছে। এবার কিন্তু মামদোর মত জাহাঁবাজ ভুতও একটু ঘাবড়ে গেল। অজান্তেই কেঁপে উঠল তার গলাটা, "এ… এটা কি করে সম্ভব! তুই এতো তাড়াতাড়ি উঠে এলি কি করে! আমি যে তোকে ওতো জোরে ধাক্কা মেরে ফেললাম!"
"হাঃ হাঃ হাঃ ওই টুকুনি ধাক্কাতে আমার কি হবে শুনি! আমি তো শুনেছিলাম তোমার নাকি খুব ক্ষমতা মামদো কাকা, এই তোমার ক্ষমতার নমুনা!"
মনে মনে বেশ ঘাবড়ে গেলেও সেটা মুখে প্রকাশ না করে মামদো বলল, "আমাকে রাগাস না, আমি রেগে গেলে কিন্তু ভয়ানক হয়ে যাই।"
"হাঃ হাঃ হাঃ আর আমি রেগে গেলে কি করতে পারি জানো!"
"কি করবি তুই পুঁচকে ভুত?"
"দনাইয়ের ওপারে গিয়ে আমার নাম বোলো সব সব ভুতদের। শুনবে আমি কি করতে পারি। জটাধরের মত ভয়ানক তান্ত্রিকের হাত থেকে শ'য়ে শ'য়ে ভুতকে মুক্ত করেছিলাম আমি। আমার জন্য দেশ ছেড়ে পালিয়েছে জটাধর। কিন্তু তোমার কান্ড কারখানা দেখে মনে হচ্ছে জটাধর তান্ত্রিককে আবার ডাকতে হবে তোমায় বন্দি করার জন্য।"
জটাধর তান্ত্রিক… !!! নামটা শুনেই মামদোর মনে পড়ে গেল ওর মামাতো ভাই হুমদোকে ওই নামেই কে যেন বন্দি করে রেখেছিল একটা কাঁচের বোতলে, খুব কষ্ট দিত সে। তারপর একজন ওদের বোতল থেকে মুক্ত করে। এই তাহলে সেই যে হুমদোদের মুক্ত করেছিল! এতক্ষণে গলার স্বর একটু নরম হল মামদোর। সে মিহি গলায় বলল, "আহা ভাইপো রাগ করছো কেন! বলছি শোনো না আমার ছানারা তো তোমার ভাই হয়। ওদের এমন কাঁদতে দিতে পারো তুমি?"
"আপনি নিজের ছানাদের কষ্টের কথা ভাবছেন আর এদিকে এই ছোট্ট ছানাটার মা যে কেঁদে কূল পাচ্ছেন না।"
"ওরা তো মানুষ, ওদের চিন্তা আমরা কেন করব!"
"মানুষ তো কি হয়েছে? মানুষের মা কি মা নয়, মানুষদের ছানা কি ছানা নয়?"
"সে মানুষ যাই পারে হোক, তাতে আমাদের কি?"
"আমরা ভুত আর মানুষ কি নিজেদের মত করে শান্তিতে থাকতে পারিনা? আপনার মত কিছু ভুতের জন্যই মানুষ আর ভুতের সম্পর্ক খারাপ হয়। আপনারা শুধু নিজেদের জন্য ভাবেন, মিলেমিশে থাকতে জানেন না।"
"মানুষরা আমাদের যে পছন্দ করে না তার বেলা?"
"অন্যের সমালোচনা না করে আগে নিজেরা ভালো হলে হয় না? আমার এক মানুষ বন্ধুর মায়ের মুখে শুনেছি ওদের একটা কথা তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন! আগে নিজে ভালো হলে তবেই না অন্যের থেকে ভালো আশা করব।"
"বুঝলাম।"
"বুঝলেই ভালো কাকা। আশা করি আপনি আর এরকম অন্যায় কাজ করবেন না, আমি চললাম।"
এই বলে পটকাই(আসলে কিন্তু খটকাই) চিনিকে নিয়ে নেমে এলো নীচে। বোনুকে পেয়ে তো নোনতার আনন্দ আর ধরেই না। সে বোনুকে চুমু খেয়ে খেয়ে একাকার কান্ড করল। তারপর খটকাই পটকাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "তোদের কি বলে যে ধন্যবাদ দেব জানিনা।"
"ধুরর বন্ধুদের আবার ধন্যবাদ দেয় নাকি! তবে সত্যিই খটকাইয়ের আইডিয়াটা কিন্তু দারুণ ছিল। আমরা দু'ভাই পালা করে করে গেলাম আর মামদো ভাবল একজনই যাচ্ছে। হাঃ হাঃ…"
বলে উঠল পটকাই।
নোনতা বলল, "কিন্তু তুইও যা করলি পটকাই তার তুলনা হয়না। মামদো এতো জোরে তোকে ছুঁড়ে ফেলল আর তুই তাও হাসছিস এখনও! ব্যাথা করছে না?"
"একটু একটু করছে, তবে বন্ধুর জন্য এটুকু ব্যাথা কিচ্ছু না।
নে তাড়াতাড়ি বাড়ি চল এবার, সবাই চিন্তায় আছে।"
এই বলে চিনি বোনুকে নিয়ে ওরা গান করতে করতে চলতে লাগল মনের আনন্দে,
"ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে…."