লোকালয়ের লক্ষ্মী
লোকালয়ের লক্ষ্মী
গোলাপি হাতে মুঠো মুঠো ধানের শীষ নিয়ে আজ ঘরে ঘরে মা এলেন লক্ষ্মী বর নিয়ে...!
ছেলেবেলায় যখন দেখতাম লক্ষ্মী পুজোর সকালে,নাড়ু, মুড়ি,খৈ,মোয়া সহ নানাদ ছাপের সন্দেশ বানাতে মায়ের একা একা ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা, তখন এক ছুটে কোনমতে গা ভিজিয়ে বসে পরতাম মায়ের পাশে...! এভাবে আস্তে আস্তে লক্ষ্মী পুজোর ভারটা আমার উপরই চড়ে গেলো..! ঠাকুর ঘরের মেঝে জুড়ে গোবিন্দভোগ চালের গুড়োতে জল মিশিয়ে নানান ধরনের আল্পনা, বাড়ির কোনে কোনে মা লক্ষ্মীর পায়ে চিহ্ন, আর তার পাশে ধানের ছড়া এঁকে এঁকে বাড়ি ভরে ফেলতাম..!
তারপর ঠিক ঠাকুর কর্তার মতো ভাব নিয়ে বসে যেতাম মায়ের পুজোয়..! ছেলেবেলার লক্ষ্মী পাঁচালীর এখনো মুখস্ত হয়ে আছে প্রায় পুরোটাই..
"লক্ষ্মী দেবীর বামে হেলি বসে নারায়ণ
করিতেছে নানা কথা সুখে আলাপণ,
হেন কালে বীণা হাতে আসে মুনিবর,
হরিগণ গানে মাতি হইলো বিভোর"....!
সেই সময়টা আমার ছেলেবেলার অন্যতম মধুরতম স্মৃতি, মা আমার পাশে মাথায় আঁচল টেনে করজোড়ে উলুধ্বনি দিতেন, আর বাবা ঠিক পাশেই বসে মন দিয়ে শুনতেন আমার লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ, আর মাঝে মাঝে উচ্চারণের ভুল ধরিয়ে দিতেন....!
তখন ঠিক লক্ষ্মী নারায়ণের এই মধুর আলাপের কথা ঠিক তেমনটা বুঝতাম না..! একটা সময় পাঁচালীর লক্ষ্মী নারায়ণের সেই মধুরতম আলাপনা পড়ে পড়ে মনে পড়তো আমার বাবা মায়ের কথা, আমি ভাবতাম উনারাই তো বাস্তবে দৃশ্যমান আমার আসল লক্ষ্মী নারায়ণ.. তাই পুজোর শেষেই উনাদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতাম..!
দিন যায়, বছর যায়, বয়স এগিয়ে চলে, সংসার নামক লোভনীয় খেলায় একসময় আমিও মজতে শুরু করি...!
কিন্তু আজকের বাস্তবতাটা কেন যেন মনে হয় শুধুমাত্রই সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি পোষ্ট করার মধ্যেই তৃপ্ত ! এখন এই সভ্যতার এই স্বর্ণযুগে বাঙালী সংস্কৃতির সেই বাঁধন আর পাই কোথায়........!!!
নারীর মাতৃত্ব যখন অহংকারে পরিনত হয়, তখন সেই মাতৃত্ব তার গৌরব হারায়...!
সন্তান জন্ম দিয়ে যে গর্ভধারিণী মনে করেন, যে সেই সন্তান তার ইচ্ছের দাস, সেই নারী ভবিষ্যৎ শুধুই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধা বাস..! একটি শিশু একটি পরিবারের সকলের সুখ হয়ে পৃথিবীতে আসে, কেবল জন্মদানের অহংকারে সেই শিশুর প্রতি সকলের ভালোবাসাকে যে নারী মনে করেন তার গর্ভধারণ ও প্রতিপালনের কাছে অতি সামান্য,
সে নারী কখনো মাতা হতে পারেন না,
সে মাতা কখনো নারী হতে পারেন না....!!
আমার প্রিয় পাঠকরা হয়তো ভাবছেন, লক্ষ্মী পুজোয় আবার এসব কথা কেন বাপু....??
হাহা, কি করবো মনটা সেই নারদ মুনির মতো হয়ে গেছে আজকাল..! যে সামাজিক পারিবারিক বাঙালির জীবন দেখে আমি অভ্যস্ত, সেই সংস্কৃতির কোমা দশা দেখলে মুখে খৈ ফোঁটে বৈকি...!
সময় বড় নীরব ঘাতক, প্রতিক্রিয়ায় সে যেমন রানী বানায়, আবার সে ভিখারিনীও বানায়...!
পৃথিবীর প্রকৃত মানুষরা কখনোই তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেন না, তবে সেই মানুষেরা যদি ঘুরে দাঁড়ায় তবে পায়ের নিচের মাটি কেঁপে ওঠে..!
কারণ এই পৃথিবীতে নিরবতার চাইতে বড় কোন প্রতিশোধ নেই...!
আজকের এই আধুনিক চিড়িয়াখানায় ঢোকার জন্য নারীদের একটি বিশাল অংশ ভয়ংকর এক চোরাবালিতে আটকে যাচ্ছে ক্রমাগত, এটা খুব বড় বিপদ সংকেত আমাদের চারপাশের পরিবার ভিত্তিক সমাজের জন্য..!
বাঙালী পরিবারের নারীরা আজ লক্ষ্মীর পাঠ পড়ে না, পুরুষেরা নারায়ণের মতো তাদের স্ত্রীকে সম্মান দিতে লজ্জা পায়...."
আমাদের মনে রাখা উচিৎ, সৃষ্টির ধারায়, নারী ও পুরুষ ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবীতে তার মানব জন্ম গ্রহণ করেন, কিন্তু সেই বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করে বিপরীত বৈশিষ্ট্যকে মাত্রাতিরিক্ত গ্রহণ করতে গেলে, পরিবার ও সমাজের স্বাভাবিক ভারসাম্য ধ্বংস হয়, আর এতে কেবল বিকলাঙ্গ ভবিষ্যতের আগমনী সুর শোনা যায়..!
শুভ হোক সকলের...