গল্পটা শুনেছ কি?
গল্পটা শুনেছ কি?
সালটা ২০০৪-৫ এর মতো হবে, আমি তখন বেলঘরিয়ার একটি মেস বাড়িতে থাকতাম ! যতটা মনে পড়ে, সে সময় একটি জনপ্রিয় রেডিও চ্যানেলে রোজ রাত ১১ টার পরে একটি লাইভ বিষয় ভিত্তিক আলোচনা ও গানের অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হতো ! আমি অনেকটা নেশাগ্রস্ত হয়ে শুনতাম প্রতিরাতে সেই প্রোগ্রামটি ! ভালো লাগতো প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন বিষয় ভিত্তিক আলোচনা, এবং সেই আলোচনায় শ্রোতাদের সরাসরি অংশগ্রহণ ফোনের মাধ্যমে..! তো, একদিন রাতে উপস্থাপিকা বেশ গম্ভীর কণ্ঠ নিয়ে বললেন, " আমাদের আজকের বিষয় হচ্ছে নারী নির্যাতন "..!
তারপর ধীরে ধীরে অনুষ্ঠানে সমাজের ভয়ংকরতম এই ব্যাপারটা নিয়ে আলোকপাত ও একটু পর পর ফোনে শ্রোতা নারীদের কান্না ভেজা ভারী কন্ঠ সেদিন যেন আমাদের সমাজের বর্বরতার একটি ভয়ংকরতম অথচ পরিচিত রুপ তুলে ধরছিলো ! সেদিনের সেই আলোকপাতে অনেক নারী নিজের নাম পরিচয় গোপন করে বলে গেলেন, একজন মানুষের জীবনে পারিবারিক নিগ্রহ কতোটা ভয়াবহ রুপ নিতে পারে ! যাই হোক, অনুষ্ঠানের শেষে উপস্থাপক বেদনাতুর কন্ঠে ঘোষণা করলেন, "আজ আমরা আমাদের সমাজে নারীদের ব্যক্তিগত অনেক কষ্টের কথা জানলাম, যা কিনা আমাদের কারোরই জীবনে কাম্য নয় ! শ্রোতা বন্ধুদের জন্য আগামীকাল আমাদের বিষয় থাকলো, "পুরুষ নির্যাতন "...!"
এই শুনে তার সহকর্মী উপস্থাপিকা অতি দুঃখের মধ্যেও উচ্চস্বরে হেসে বলে উঠলেন, "এটাও কি কোন বিষয় হতে পারে নাকি?"
সহকর্মীর কথা শুনে উপস্থাপকও হেসে উত্তর দিলেন, "দেখা যাক, আগামীকাল আমরা রাত জাগা কতোটা পুরুষের কান্না শুনতে পাই.."!
এর পরদিন, অনুষ্ঠানটি একটি সুন্দর গান দিয়ে শুরু হলো, আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে কান পেতে রইলাম রেডিও তরঙ্গে ! তারপর, রাত যতোই এগুতে লাগলো, ততোই অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে সম্প্রচারিত গানের সংখ্যা কমে গিয়ে একের পর এক ফোন কল আসতে লাগলো বাংলার নানান প্রান্ত থেকে !
সেদিনের অনুষ্ঠান শেষে অনুষ্ঠানটির উপস্থাপিকা তার ভেজা ভেজা কন্ঠে পুরুষ নির্যাতন নিয়ে তার আগের দিনের ব্যাঙ্গাত্মক কথার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন,
" আজকে আমার কিছু বলার নেই, সবাই সুস্থ হয়ে বাঁচুন, এই প্রত্যাশায় আজকের অনুষ্ঠান থেকে আমরা বিদায় নিচ্ছি, শুভ রাত্রি "....!
সেদিনের সেই অনুষ্ঠানের রাত জাগা লক্ষ শ্রোতার মধ্যেও সদ্য তরুণ আমিও সাক্ষী হয়ে ছিলাম ! রাত নিঝুমে চুপ করে শুনলাম, আমাদের সমাজের প্রতিষ্ঠিত পুরুষদের তাদের পারিবারিক জীবনে তাদের জীবন সাথীদের এবং তাদের পরিবারের দ্বারা মানষিক আর শারিরীক নির্যাতনের কথা!
একের পর এক ফোন কলে নাম পরিচয় লুকিয়ে অপর প্রান্তের চোখ ভেজা কিছু মানুষের কথা, যারা সামাজিক সম্মানের ভয়ে সবকিছু মেনে নিয়েও শেষ রক্ষাটুকুও করতে পারছেন না! জানলাম, মানুষের সহনশীলতার, ভদ্রতার, ভালোবাসার, বিশ্বাসের কতোটা অপব্যবহার হতে পারে সেই অজানা কথা...!
অথচ এই মানুষগুলোকেই আমরা দিনের আলোয় শহরের ভিড়ে তথাকথিত ডমিনেটেড সিংহ -পুরুষ বলেই ভেবে থাকি....!
কিন্তু, বিধাতার সৃষ্টির কিছু ধারা চিরন্তন ! সেই ধারায় নারী হচ্ছে ধরিত্রী ! সে সকল কিছু ধারণ করতে পারে, সুখ,দুঃখ,প্রেম,অপ্রেম,রুদ্র, মায়া,সহনশীলতা,জ্ঞান, প্রত্যয়,মানবিকতা ........., আরও অনেক কিছুই যা কিনা মানুষের মনুষ্যত্বের বিজ্ঞাপনে প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য.... !
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো কি ? সৃষ্টিতে, পুরুষদের চাইতে মননশীলতায় সৃষ্টিগত ভাবেই নারী সবসময় শ্রেষ্ঠ, আর যে শ্রেষ্ঠ, তার অবদান বরাবরই স্পষ্টভাবে প্রয়োজনীয় এই সমাজব্যবস্থায়... !
আসলে মানুষের যখন মানবিক বৈকল্য আসে, তখন সে যেই হোক, নারী কিংবা পুরুষ, সেই মানষিক বৈকল্য এক ভয়াবহ তরঙ্গ হয়ে আছড়ে পড়ে আমাদের সভ্যতার এই সুখী সমাজের শিরায় শিরায় !
আজ সমাজের বুকে নারীদের অসহায় নাম দিয়ে দিয়ে
আমরা নিজেদের অজান্তে কিছু কিছু নারীদের এতোটাই ভয়ংকর করে তুলি যে, সে নারী না পারে নিজের নারীত্বের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে, না পারে তার পার্শ্ববর্তী সত্যিকারে নির্যাতিত নারীদের মুখপাত্র হয়ে সমাজের মুখোমুখি হতে...!
আধুনিক পোষাকেই যদি বদলে যেতো মানুষের মনের অন্ধকার জগৎ, তবে আজকের সমাজে নারীদের প্রতি করুণা করে বাহবা নেয়ার সাহস করতো না কোন তথাকথিত বিজ্ঞ পুরুষ...!
পরিশেষে, এইটুকু চাওয়া, আমাদের বাংলা অনেক সম্বৃদ্ধ মননশীল একটি জাতি সত্তা, এই সত্তাটিকে পরিশুদ্ধ ভাবে টিকিয়ে রাখতে গেলে নারী পুরুষের একে অপরের প্রতিযোগিতা নয়, হাতে হাত রেখে পারস্পরিক সম্মানজনক অবস্থান আজ খুব বেশী করে প্রয়োজন...!
শুভ হোক সকলের...