STORYMIRROR

Sougat Rana Kabiyal

Inspirational

3  

Sougat Rana Kabiyal

Inspirational

আলোর কারিগর

আলোর কারিগর

6 mins
722


দৃশ্যপট এক---


যাদব মাষ্টার হেঁটে যাচ্ছেন সবুজ শিশু ধানের কাঁচা পথ ধরে ধরে ! দুপুরের খাবারের জন্য সকাল সকাল মা পই-পই করে বলে দিয়েছেন, 

"আজ কিন্তু হাট বার, ফেরার সময় অবশ্যই তেল- নুন- মাছ আনতে ভুলিস না যেন বাবা"..! কাল রাত থেকেই ঘুম ছিলো না চোখে রূপনগর হাই স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক যাদব বাবুর ! পরশু থেকে ভাঙা রেডিওটার জল-মরচে ধরা এন্টেনা এদিক ওদিক করে আকাশবাণী ধরে রেখেছেন সারাক্ষণ ! 

এবার দেশ ভাগটা বোধহয় আর আটকানো গেলো না...!

মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ চমকে ওঠেন মাষ্টার বাবু, 

"ধর্মের এই সীমানা, দেশটাকে ধ্বংসের ঠিক কোন সিমান্তে নিয়ে যায়, কে জানে? " 

গাঁয়ে, যাদব মাষ্টারের বরাবরই আধুনিক স্পষ্টভাষী হিসেবে বদনাম-সুনাম দুটোই আছে ! মাইলের পর মাইল কাঁচা মাটিতে হেঁটে দূর দূর গাঁ থেকে ছাত্র ধরে আনতে হয় ! প্রথম প্রথম স্কুলে ছাত্র ছাত্রির বেশ চাপ ছিলো ! বিয়াল্লিশ মন্বন্তর এর পর দেশে সেই যে অভাব শুরু হলো, তার পর থেকে গাঁয়ের লোকজন স্কুলের চাইতে জমির কাজেই নিজের সন্তানের ভালো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে ! হঠাৎ যাদব মাষ্টারের কপালে ঘাম ফুঁটে ওঠে, এরকম চলতে থাকলে এখন আশে পাশের দশ গাঁয়ের ভালো ভালো ছাত্রগুলোকে বিনে পয়সা বাড়ি গিয়েও পড়ানো মুশকিল হয়ে যাবে ! এবছর ম্যট্রিকুলেশনে দুটো ছেলে আর একটি মেয়ের কথা ভেবে আত্মসুখে মাষ্টার বাবুর চোখ হঠাৎ চকচক করে ওঠে..! ওরা একটু যত্ন পেলে খুব ভালো করতে পারবে..! কিন্তু, কিন্তু, এমনটা চললে তো, ক্ষিদের জ্বালায় ছেলে-মেয়েগুলোকে আর পড়তে দেবে না ওদের বাপ- মায়েরা..! দু-মুঠো ভাতের জন্য ওদের কাছে একটি কাগুজে সনদপত্রের চাইতে এখন সারাবেলার মহাজনদের জমির বর্গা খেটে দুবেলা খাবার জোগাড় করাটা বেশী গুরুত্বপূর্ণ..! 

 হঠাৎ কি মনে হলো, মাষ্টার বাবু তার সাদা শার্টের বুক পকেটে হাত দিলেন..! তারপর,তারপর, আচমকা দ্রুত চলা পা দুটো থামিয়ে দিয়ে প্যান্টের পকেটগুলোর এদিক ওদিজ অস্থির হয়ে খুঁজতে লাগলেন কি যেন...! টাকাটা বোধহয় চশমাটা বের করতে গিয়ে পড়ে গেছে...! মাসের এই মাঝ সময়ে এটাই ছিলো সম্বল, আবার স্কুলের বেতন পেতে পেতে সেই পরের মাসের শেষ..! এই টাকা থেকে বাজার করে এই সপ্তাহটা মাকে সামাল দেয়া যেতো, আর তার সাথে সাথে রুপ পাড়ার ছেলেটার জন্য কয়েক দিস্তা কাগজও হয়ে যেত..! ছেলেটা লুকিয়ে লুকিয়ে কলা পাতায় অঙ্ক করে এবার ডিসটিংকশন পেয়েছে ক্লাসে, কটা কাগজ হলে, ছেলেটা ঠিক এবার জেলায় একটা হইচই ফেলে দিতে পারতো..! মাষ্টার বাবুর তরুণ শরীরটা হঠাৎ যেন কেমন অবশ হয়ে এলো, দ্রুত ছুটে চলা রুপনগরের হাই স্কুলের মানুষ তৈরীর কারিগর, ক্লান্ত হয়ে ঝাপসা চোখে শিশু ধানের মাঝের লাল কাঁদা মাটিতে বসে পড়লো....! মাথার উপর তখন জ্বলজ্বল করে ফুটছে জৈষ্ঠ্যমাসের প্রখর রোদের নীল আকাশ........!


      ---দৃশ্যপট দুই--


 সকাল থেকেই তনুশ্রীর হাত-পায়ের তালু গলগল করে ঘেমে যাচ্ছে ! ব্যপারটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, মেয়েবেলা থেকেই তনুশ্রীর কোন গভীর ভয় হলে এরকমটা হয়, তখন অকারণে গলা শুকিয়ে আসে, বুক ধড়ফড় করে, মাঝে মাঝে শরীর কেঁপে ওঠে ! তিন বোন আর এক ভাইয়ের সংসারে তনুশ্রীর জীবনটা বেশির ভাগ সময় ছিলো চুপ করে মেনে নেয়ার আর মানিয়ে নেয়ার ! বাবার সমস্তটা জুড়ে ভাই, তাই আজ এই পাহাড়ের দেশে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম-ফিল পর্যন্ত আসতে যতোটা না ঘরে সংগ্রাম করতে হয়েছে ঠিক ততোটাই করতে হয়েছে বাইরের জগতে ! ক্লাস নাইনে যখন ভালো নোটের ভরসা পেয়ে বাবার বন্ধু, চ্যাটার্জি কাকুর বাড়ি গিয়ে মাঝ দুপুরের বন্ধ দরজায় দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে কেঁদে কোনমতে একছুটে বাইরে বেড়িয়ে, নামী স্কুলের প্রিন্সিপাল উত্তম চ্যাটার্জির পাহাড়ের খাঁজের বোনা প্রাসাদ বাড়ি থেকে লাল মাটির ঢাল বেয়ে মোড়ের বাজার অব্দি যাওয়াটাকে সেদিন মনে হয়েছিলো পৃথিবীর সবচাইতে কঠিন কাজ...! আজ আবার সেই কঠিনতম অভিজ্ঞতার ভয়ে শীতাতপ ঘরেও হুঁহুঁহুঁ করে ঘার বেয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো তনুশ্রী মজুমদারের !


 পরশু রাতে হোষ্টেলের ঘরে নিবেদিতা এসে অনেক কিছু বুঝিয়ে গেছে ! এখন আর সে সময় নেই, নিজেকে স্যারের কাছে প্রেজেন্টবল করে তুলে ধরতে হবে ! নিবেদিতা নিজের জিন্স আর হাতা কাটা কালো টপসটা দিয়ে গেছে, এতে নাকি অনে

ক আকর্ষণীয়া লাগবে যে কাওকেই ! এমনিতেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক আনন্দ সান্যালের চোখ সবসময় ক্লাসের মেয়েদের মেধার চাইতে তাদের আকর্ষণীয় শরীরের দিকেই বেশি যায় ! যে মেয়েরা তার মন বুঝে চলতে পারে, তাদের কিছুই আটকায় না, আর তা না হলে প্রতি বছর প্রায় অর্ধেকের বেশি ছাত্রী, হতাশ হয়ে একসময় নিজের প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে বাবা মার লক্ষী মেয়ে হয়ে বিয়ের পিড়িতে বসে যায় কোন সরকারি চাকুরে ছেলের কাছে ! আজকাল পাহাড়ে বাঙ্গালীদের বেশ চিন্তায় থাকতে হয় দেশের এন-আরসি নামের জটিল অঙ্কে ! অথচ তনুশ্রী ছেলেবেলা থেকেই স্থানীয় ছেলেমেয়েদের মতোই বড় হয়েছে, তাই তনুশ্রীর যতোটা না বাঙালিয়ানা পছন্দ, তার থেকে ঢের বেশি এখানকার মাটির মানুষদের সঙ্গ সংস্কৃতি পছন্দ... !


 নবদ্বীপ, সকাল সকাল হোষ্টেলের দরজায় অটো নিয়ে দাঁড়িয়েছিল ! ছেলেটা আজকাল চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে টিউশন করেই নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাইছে ! কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে এক বন্ধুর দিদির বিয়েতে প্রথম পরিচয় ! তারপর হঠাৎ হঠাৎ কলেজ থেকে একসাথে বাড়ি ফেরা, এ কথা সে কথায় বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা ! তনুশ্রীর মাঝে মাঝে একটু অবাকই লাগে, নবদ্বীপ কেন যে ওকে এতো পছন্দ করে, ও ঠিক বুঝতে পারে না ? নবদ্বীপ, খুব মেধাবী স্টুডেন্ট ছেলেবেলা থেকেই, ওদের পাড়ায় ভালো টিউশন টিচার হিসেবেও ভালো নাম আছে ওর ! নবদ্বীপের একটা বিষয় তনুশ্রীর খুব ভালো লাগে, নবদ্বীপ পাহাড়ের একটি বস্তিতে রোজ সকালে খোলা আকাশের নিচে একটা সাদা বোর্ডের উপর চকে আঁকিবুঁকি করে পাহাড়ি অভাবি শিশুগুলোকে অক্ষর বিদ্যা শেখায় ! নবদ্বীপ ঠিক এই সময়ের ছেলেগুলোর মতো নয়, ও অন্যরকম, একজন শিক্ষককে ঠিক যেমনটি হতে হয়, মমতাময় পিতার মতো... !

 

তনুশ্রী মজুমদার......??? 


একজন মাঝবয়সী নারীর কন্ঠে নিজের ডাক শুনে তনুশ্রীর ভাবনায় হঠাৎ ছেদ পড়লো ! উনি ঈশারায় জানালেন এবার

স্যার ডাকছেন ! তনুশ্রী ছটফট করে নিজের হাতে কোনমতে চুল-জামা ঠিকঠাক করে স্যারের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো ! আজ যাই হোক, এই পরীক্ষাটায় উৎরাতেই হবে ! বাবার পেনশনের টাকায় আর চলছে না...!


রুমে ঢুকতেই মিষ্টি একটা গন্ধ তনুশ্রীর মনটা ভালো করে দিলো ! টিপটপ করে গোছানো ঘরটাতে মিঃ সান্যাল মুখে একটা মিষ্টি হাসি নিয়ে তনুশ্রীর দিকে আপাদমস্তক চোখ বোলালেন ! সামনের একটা চেয়ার দেখিয়ে বসতে ইশারা করলেন ! তনুশ্রীর হাত পায়ের ঘামটা কেন জানি হঠাৎ বেড়ে গেলো, কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইলটা এগিয়ে দিলেন স্যারের দিকে ! মিঃ সান্যাল ফাইলটার দিকে একপলক তাকিয়েই আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন তনুশ্রীর মুখে ! " তুমি তো বেশ মিষ্টি দেখতে একটি মেয়ে, তোমার ফিউচার অনেক ব্রাইট ", বলেই মিঃ সান্যাল তার চেয়ায় ছেড়ে উঠে এসে তনুশ্রীর পেছনে দাঁড়িয়ে আচমকা তনুশ্রীর কাঁধে হাত রেখে মৃদু চাপ দিলেন..! স্যারের গায়ের থেকে তীব্র একটা মিষ্টি গন্ধ তনুশ্রীর গা গুলিয়ে দিলো ! তনুশ্রী শক্ত হয়ে বসে থাকার চেষ্টা আপ্রাণ করলো, কিন্তু.......! 


প্রায় আধঘন্টা পর পাহাড়ের লাল মাটির ভেজা রাস্তা ধরে তনুশ্রী মৃদু পায়ে চায়ের দোকানটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, দূর থেকে নবদ্বীপের হাসিখুশি মুখটা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে ! পাহাড়ের গা ঘেঁষে বিস্তীর্ণ সবুজের বুকে নানান ধরনের পাহাড়ি ফুলের উপর দিয়ে ধবধবে নীল আকাশ ! হাসিমুখে এগিয়ে আসা নবদ্বীপের দিকে জোড় করে তনুশ্রীও হাসিমুখে তাকানোর চেষ্টা করেও কেন জানিনা কিছুতেই তা করতে পারছিলো না ! বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে রিটায়ার্ড বাবার মুখটা, আর মায়ের সেই "অলক্ষী" বলে ডাকটা...!


আচমকা সামনে থেকে নবদ্বীপ এসে তনুশ্রী কাঁধে হাত রাখতেই, তনুশ্রী চমকে ছেলেটার চোখে চোখ রাখলো ! নবদ্বীপ হেসে দিয়ে তনুশ্রীর ভেজা হাতটা নিজের হাতে নিয়ে শক্ত করে ধরে বলে উঠলো, " ব্যাপার না, তনু, একটা এম-ফিল না হলে মানুষ মরে যায় না..,জীবনের আরও অনেক পথ থাকে...! তুই আর আমি মিলে একদিন আমাদের স্কুলটাকেই দেখবি আস্ত একটি বিশ্ববিদ্যালয় করে দেবো..হাহা...!"

তনুশ্রী তখনও অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পাহাড়ি এই তরুনের চোখে..! মুখে হাসি ফুটে ওঠে, মনের কোনে কেও যেন ফিসফিস করে বলে ওঠে " জাতির মেরুদণ্ডটা ঠিক ঠিক এই নবদ্বীপরা আবার শক্ত করে নেবে..ঠিক সেই সে দিনের মতো"....!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational