লকডাউনের রোজনামচা ২০
লকডাউনের রোজনামচা ২০


ডিয়ার ডায়েরি, ১৩ই এপ্রিল, ২০২০... লকডাউনের বিংশতিতম দিনে "আমাদের পারিবারিক চৈত্র সংক্রান্তির পার্বণ"
- আজ চৈত্র সংক্রান্তির দিন। আমাদের পরিবারের একটি বিশেষ দিন বিশেষ ভাবে পালিত হয়। এই দিনটার অনেক স্মৃতিমেদুরতা পরতে পরতে আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। যেহেতু বছরের শেষদিন তাই একটু অন্যরকম... পরেরদিনই নতুন আরেকটা বছর যাতে খুব সুন্দরভাবে শুরু হয় তার একটা আগাম মহড়া চলতো বাড়িতে। বিয়ের পরে নতুন বাড়ি, নতুন পরিবেশ, নতুন পরিবার... তাই নিয়মও নতুন। সেগুলোতেও অভ্যস্ত হলাম ধীরেধীরে। তবে যখন শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে সম্পূর্ণ নিজের সংসার হলো তখন মায়ের পালন করা বাপেরবাড়ির নিয়মগুলোও দিব্যি এসে সুন্দর করে জায়গা করে নিলো আমার নতুন সংসারে। এখন আমি চৈত্র সংক্রান্তি সেভাবেই কাটাই... এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি... শুধু লকডাউনের কারণে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যেই এই উদযাপনকে বেঁধে রাখতে হয়েছে। চৈত্র সংক্রান্তির দিনটা শুরু কাঁচের গ্লাসে করে নুন-চিনি-লেবুর শরবত দিয়ে। এরপর এটা রোজই চলবে গোটাটা গরমকাল ভর।
তারপর কাঁচের প্লেটে করে দু'তিন রকম ফল কেটে খুব পরিপাটি করে সাজিয়ে সঙ্গে একটু দই চিঁড়ে গুড় খেয়ে প্রাতঃরাশ। আজ এই বিশেষ দিনে বাড়িতে অত মিষ্টি বা দোকান থেকে কিনে আনা চটজলদি খাবার দিয়ে খাওয়া দাওয়ার চল নেই। প্রাথমিক পর্যায়ের খাওয়া দাওয়া মিটলেই রাতের জন্য ময়দার লুচি, কালোজিরে দিয়ে সাদা আলু চচ্চড়ি, ছোলার ডাল আর সুজির হালুয়া বা মোহনভোগ নিজের হাতে তৈরী করে রাখা। আর মধ্যাহ্নভোজনের জন্য খুব সাধারণ খাবার যা রোজ রান্না হয়, সঙ্গে শুধু পাঁচ রকমের সবজির তৈরি পাঁচমিশালি পাঁচন রান্না হয়, নিরামিষ সম্পূর্ণ। আর যাই খাওয়া হোক না কেন, অবশ্যই শেষপাতে একটু পায়েস ঠিক করে খাওয়াতো মা।
আমিও তাই করি। কোনো আতিশয্য নেই তবে আন্তরিকতাটা থাকে ষোলো আনা। ঠাকুমা ঠাকুরদা যতদিন বেঁচে ছিলেন, বা চৈত্র সংক্রান্তির দিনে পিসিরা এলে খুব মজা হতো। আমরা ছোটরা ঘুরঘুর করতাম একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে, কারণ তখন অতিথি এলেই ঘটতো কিছু প্রাপ্তিযোগ। কখনো অতিথি হাতে করে লজেন্স বা টফি আনতেন, আবার কখনো মায়ের দেওয়া খাবার থেকেই সামান্য পরিমাণ হাতে ধরিয়ে দিতেন। আবার কেউ কেউ চলে যাবার সিকিটা আধুলিটাও হাতে ধরাতেন। সম্মতির জন্য মায়ের মুখের দিকে তাকালে শুনতাম মায়ের মুখে, "নাও, বড়রা কিছু দিলে নিতে হয়।" বেশ মনে আছে মুখে "আবার এসো" বলার সাথে সাথেই মনে মনেও বলতাম, "হে ঠাকুর, আবার যেন আসে, আর দুটো আধুলি পেলেই পাঁচ টাকা পুরো হবে আমার, হে ঠাকুর!"
কী সুখের ছিলো সেসব দিন। আজকাল হয়তো ঠিক এইভাবে চৈত্র সংক্রান্তি পালিত হয় না বাড়িতে, তবে অবশ্যই পরিবারের সকলের জন্যই সামান্য কিছু হলেও নতুন কিছু জামাকাপড় কেনাকাটা করি। এই প্রথমবার যতি পড়লো পারিবারিক নিয়মে চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপনে। তবুও এই নিয়মভঙ্গ তো বৃহৎ স্বার্থে... গোটা পৃথিবীর সকলের জন্য। আশা রাখি রাত পোহালে নতুন বছরের প্রথম দিন সকলের মনে নতুন আশার প্রলেপ দিক। আমার দেশবাসী সবাই, সমস্ত বিশ্ববাসী ভালো থাকুক। এই অতিমারীর কালো করাল ছায়া সরে যাক পৃথিবী থেকে।