লকডাউনের রোজনামচা ১৭
লকডাউনের রোজনামচা ১৭
ডিয়ার ডায়েরি, ১০ই এপ্রিল, ২০২০... লকডাউনের সপ্তদশ দিনে "অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা"
আমাদের শহরের বাইরের দিকে একটি নার্সারি আছে... মূলতঃ ফুল ও ফুল ফলের চারাগাছ তৈরি করে এবং সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে দিনে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে সেসব বিক্রি করে। মরশুমের সময় আম বা কাঁঠাল এবং সারা বছরই কলা ও ডাব বিক্রি করে সাইকেল ভ্যানে চাপিয়ে ঘুরে ঘুরে। মধ্যবয়সী স্বামী স্ত্রী মিলেই চাষবাস ও ফলানো জিনিসপত্র বিক্রি করে একসাথে বেরিয়ে। আবার ওরা স্টেশন বাজারেও বসে পসরা নিয়ে। বর্তমানে লকডাউনের জন্য কদিন ওদের আসতে দেখিনি পসরা সাজিয়ে। আজ সকালে সাতটা নাগাদ দেখি ওরা স্বামী স্ত্রী আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে ভ্যানে করে পসরা সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চলতি পথে যেটুকু দেখতে পেলাম... লাউ, কুমড়ো, পেঁপে, কাঁচকলা আর কিছু শাকপাতা রয়েছে।
পাড়ায় না দাঁড়িয়ে ওরা চলে গেলো। আমাদের গলিরাস্তাটা ওদের দিক থেকে মূল শহরে ঢোকার শর্টকাট। কি জানি, হয়তো অন্য পাড়ায় যাচ্ছে। তারপর নিজের ঘরের সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আর খেয়াল ছিলো না। এখন কদিন খবরের কাগজ আসছে, তবে খানিকটা দেরীতে। নটা নাগাদ খবরের কাগজ আসছে... সেই সময়ে ওপরে আমাদের ব্যালকনি থেকে নীচ পর্যন্ত দড়ি ঝোলানো থাকে। এলোমেলো হাওয়ায় দড়িটি উড়ে নীচের ফ্ল্যাটের গ্রিলে জড়িয়ে গেছে... নীচ থেকে হাত পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আজ খবরের কাগজওয়ালা দাদা ওপরে এসেছিলো কাগজ দিতে। বেলের আওয়াজে দরজা খুলে কারণটা জিজ্ঞেস করলাম দেরী কেন আজ এতো... ঘড়িতে তখন প্রায় দশটা। ওনার বক্তব্য শুনে হাঁ হয়ে গেলাম। ঐ নার্সারির মালিক স্বামী স্ত্রী সবজির ভ্যান নিয়ে রেশন দোকানের সামনে "ফ্রি সবজি বাজার" বসিয়েছে। কদিন ধরে রোজই নাকি বসাচ্ছে। এখন বাজার তো পড়তি, বেশিক্ষণ বাজারে কেউ বসছে না পুলিশের নির্দেশে। তাই ওরা বাজারে রোজ বসছে না, ঘুরেও খুব একটা বিক্রির অনুমতি দেয়নি পুলিশ।
তাহলে বাড়তি এতো শাকসবজি কি হবে? ওরা তাই বুদ্ধি খাটিয়ে রেশন নিতে আসা গরীব মানুষ এবং অন্যান্য দুঃস্থ প্রান্তিক মানুষগুলো বিনা পয়সায় নিয়ে যাচ্ছে সবজি ওদের ভ্যান থেকে। খবরের কাগজওয়ালা দাদার ওখানেই একটু দেরি হয়েছে সবজি নিতে গিয়ে। লাইন পড়েছিলো লম্বা। পুলিশই লাইন কন্ট্রোল করেছে। হতবাক হলাম স্বল্প শিক্ষিত ও খেটে খাওয়া দুজন মানুষের সৎকাজের এমন সুন্দর সংকল্প দেখে। নিজেদের ব্যবসা করার পরের উদ্বৃত্ত শাক সবজি ক্ষেতে বা ঘরে ফেলে রেখে নষ্ট না করে বিলিয়ে দিচ্ছে অভাবী মানুষদের। কজন পারে একক প্রচেষ্টায় এমন দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প নিতে? শ্রদ্ধায় মাথা আমার আপনিই নত হলো। সর্বমঙ্গলময় ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি ওরা যেন শারীরিক ভাবে সুস্থ থেকে মানুষের প্রয়োজনের সময় এভাবেই পাশে দাঁড়াতে পারে।