লে পাঙ্গা
লে পাঙ্গা
বড্ড হিংসে হয়, বুঝলেন। বড্ড হিংসে হয়।
আমার গার্লফ্রেন্ড! এক্ষুনি ফোন করবে। ফোন করে কি বলবে! “গুড মর্নিং সুইট হার্ট! জানো তো সুইট হার্ট, আজ আমাদের পাশের কদম গাছটায় দুটো বাহারি লেজের অনামী পাখির মধুর কলতানে আমার ঘুম ভাঙল। কি সুন্দর সকালটা…” ! পাখির বর্ণনা, সকালের বর্ণনা, চলতে থাকে। বলছিলাম না হিংসে হয়। এইসব বর্ণনা শুনে হিংসে হয়। আরো বলি! চন্দন, আমার ক্লাস মেট ! যেই কলেজ যাব, অমনি ওর মোবাইল ফোনটায় নানান রকম এলার্মটোন শোনাবে। ঘুঘু পাখির ডাক, চড়াই পাখির ডাক, কলিং বেলের শব্দ, রবীন্দ্র সংগীত। কত ধরণের শব্দ, সেই শব্দের মাধুর্য রসিয়ে রসিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে আমাকে বলবে। হুমম, সেই মাধুর্যের সুমধুর বর্ণনা শুনে মনে হয় দেই ধরে ঘা কতক! রাগে গা পিত্তি জ্বলে যায় একেবারে।
আমার যখন ঘুম ভাঙে আমি নিজেকে আবিষ্কার করি আমার বালিশের নীচে। পাশবালিসটা হেডফোনের মত মাথার উপর দিয়ে দু কানে জড়ানো। আমার অবচেতন মন ঘুমের মধ্যে আমার কানদুটোকে বাঁচানোর জন্য বালিশ, পাশবালিশ গুলোকে বর্মের মত ব্যবহার করেছে। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। শব্দের যা জোর, তাকে রোখার ক্ষমতা এই বালিশ, পাশবালিশের নেই।
তাও ওভাবেই মটকা মেরে পড়ে থাকি। ঘুম থেকে উঠলে ঝামেলা বাড়বে বই কমবে না। ঘরের ভিতর মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে চোখদুটো বন্ধ করলাম।
- বাবু ওঠ! মল্লিকা আমায় কিরকম অপমান করছে, দেখবি চল খালি।
আমি আমার স্বরটাকে আধো আধো করে জোর করে স্বরের মধ্যে ঘুমটাকে টেনে এনে জবাব দিলাম
- ঘুমাচ্ছি তো!
রক্ষা হল না। মায়ের গলার শব্দ তখন মনে হয় একশ ডেসিবেলের কাছাকাছি।
- সে তো ঘুমাবেই। গ্যান্ডে পিণ্ডে গিলবে আর ঘুমাবে। আর ওদিকে পাশের বাড়ির লোক মাকে অপমান করবে। বাবাও গামছা কাঁধে স্নানে চলে যাবে! আর ছেলেও ঘুমাবে! এই তো দিনকাল পড়ল!
মল্লিকা আন্টি আমাদের পাশের বাড়ি থাকে। রোজ সকালে মা আর মল্লিকা আন্টির মধ্যে তুমুল ঝগড়াঝাটি হয়, যেটা শুনে ঘুম ভাঙে আমার। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত – কোনো কালেই সেই ঝগড়ার আঁচ এক ফোটা কমে না। আর ঝগড়ার বিষয়! নানাবিধ বিষয়। এই যেমন আজকের বিষয় ছিল মল্লিকা আন্টি গাছে জল দেবার পর বাড়তি জলটুকু ছাদ থেকে নিচে ফেলেছে। সেই জলের ছিটা লেগে আমাদের বাড়ির রং নাকি উঠে যাবে। এই নিয়ে পনেরো মিনিট ধরে চলল! কেউ কাউকে এক ইঞ্চিও জমি ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়।
গত শনিবার! মল্লিকা আন্টির বাড়িতে কোনো বাসন হাত ফস্কে পড়ে গেছিল। মা তখন ব্যালকনিতে ছিল। ব্যাস! মা এক হাঁক পাড়ল
- মল্লিকা! ও মল্লিকা!
- দিদি!
- বলি, সকালবেলা কি শুরু করেছ! ঘরের মধ্যে বাসন-কোসনের ঝনঝন শব্দ করছ! আমার ছেলের ঘুম ভেঙে যাবে তো! হ্যাঁ, তোমাদেরই তো ভালো..
মাকে তারপর কে বোঝায়! মা, মল্লিকা আন্টির বাসন ফেলার শব্দে নয় গো, তোমাদের চেঁচামেচিতে আমার কেন গোটা পাড়ার ঘুম ভাঙল! সেই বোঝানোর সাধ্যি কারোর নেই। যেই বোঝাতে গেলাম সেদিন, অমনি কি বলল জানেন!
- সেই তো, যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর!
গত পরশুর এপিসোড বলি! মা ছাদে শাড়ি মেলতে গেছে। মল্লিকা আন্টিও তখন ছাদে গাছে জল দিচ্ছে। বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ মল্লিকা আণ্টি বলল
- দিদি, আমার গাছগুলোকে মেরে ফেলার ভালোই প্ল্যান করেছ বল!
- মানেটা কি? কি বলতে চাইছ ?
- কেন না বোঝার ভান করছ দিদি? যা করছ সব তো বুঝেই করছ!
- স্পষ্ট করে বল
- এমন ভাবে শাড়ি গুলো মেলছ, উত্তর পশ্চিম দিক থেকে হাওয়া দিলে শাড়ি গুলো উড়বে। তখন আমার গাছগুলো রোদ্দুর না পেয়ে মরে যাবে। কি ভেবেছো কি তুমি! তুমি একাই বুদ্ধিমান!...
কোনো কোনো ঝগড়ায় যুক্তি থাকে না। শুধু ঝগড়া করবার জন্যই ঝগড়া করে মা-রা। পরে ভাবলে অবশ্য হাসিও পায়! কিন্তু যখন কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যায় তখন যে কিরকম মারাত্মক বিশ্রী একটা অনুভূতি হয়, সেটা আর নতুন করে কি বলব!
যাই হোক, সময় অতিবাহিত হয়ে এক সপ্তাহ পার হল। সকালবেলা বেশ সুন্দর স্বপ্ন দেখছি। পুব দিকের জানলা দিয়ে রোদ্দুর ঢুকছে। অবচেতন মনটা প্রত্যাশা করে রয়েছে এই বুঝি ঝগড়া শুরু হবে। কিন্তু বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার! ঝগড়া হল না। বরং দেখি মা চা এনেছে।
- ওঠ রে। এই নে, চা এনেছি। বাবাও দেখি চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে চা খাচ্ছে।
আমি ঘুম থেকে উঠতেই বাবা ভুরু নাচিয়ে, ঠোঁট উল্টিয়ে এমন অপ্রত্যাশিত সকালের আগমনের কারণ বাবাও যে বুঝছে না, সেটাই বোঝালো আর কি।
হাতমুখ ধুইয়ে ব্রেকফাস্টের টেবিলে মাকে জিজ্ঞেস করলাম
- মা, আজ সকাল থেকে মল্লিকা আন্টির গলার আওয়াজ পাচ্ছি না। ঘুরতে ফুরতে গেছে নাকি ওরা!
- মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি! বাব্বা!!
বাবা ইশারায় চুপ করতে বলতে চুপ করে গেলাম। ঝগড়া ছাড়া এরম সকাল খুবই কম জোটে কপালে। কি দরকার! আজ আর এসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। কথা ঘোরানোর জন্যই মাকে বললাম
- একটু ডিম ভেজে দেবে মা? ওমলেট খেতে ইচ্ছে করছে।
- হুমম, বোস। ভেজে আনছি।
পরদিনও একই ব্যাপার। কোনো কথা কাটাকাটি নেই, ঝগড়া নেই। সুন্দর মনোরম একটা সকাল। কলেজ বেরোব, মা ডাকল
- শোন,
- হুমম গো মা।
- পারলে একটু খোঁজ নিয়ে দেখিস তো মল্লিকাদের সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। দু তিনদিন গলার আওয়াজ পাচ্ছি না।
আমি এক চোখ মেরে বললাম
- কাল কেউ একজন আমায় বললো আমার কাছে নাকি মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। এখন তো দেখছি একজনের ছেলের চেয়ে প্রতিবেশীর দরদ বেশি।
- আঃ! খোঁজখবর রাখতে হয় প্রতিবেশীদের। আরেকটু বড় হ, বুঝবি।
আমি হেসে বললাম
- আচ্ছা।
পাড়ার স্পন্দনদার কাছ থেকে মল্লিকাদির হাজব্যান্ডের নাম্বারটা নিলাম কলেজ যাবার সময়। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরতেই মা জিজ্ঞেস করল
- কিরে! খবর নিলি? সব ঠিকঠাক আছে?
- কাকুর ফোননম্বর এনেছি। এখুনি ফোন করব।
- হুমম। তাড়াতাড়ি করে খবরটা নিস।
হিসেব মেলে না, জানেন তো! বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় দুজনের মধ্যে কিরকম দ্বন্দ্ব! একজন উত্তর মেরুতে থাকলে আরেকজন দক্ষিণ মেরুতে থাকে। কিন্তু ভেতর ভেতর দুজনে খুব ভালো বন্ধু। তাই তো দুদিন খবর না পেয়েই মায়ের মন খারাপ। মল্লিকা আন্টিও মাকে খুব ভালোবাসে। কিছু স্পেশাল রান্না করলেই মায়ের জন্য কিছুটা তুলে রেখে দেয়। তারপর আমাকে দিয়ে টিফিন ক্যারিয়ার করে পাঠিয়ে দেয় আমি যখন কলেজ থেকে ফিরি। মা-ও কখনো খালি টিফিন ক্যারিয়ার পাঠায় না। মল্লিকা আন্টির পছন্দের কোনো খাবার ভর্তি করে পাঠিয়ে দেয়। খাবার পেয়ে দুজনের মুখেই অনাবিল হাসি ফুটে ওঠে। সেই হাসি দেখে কে বলবে, সকাল হলেই সাপে নেউলে অবস্থা হবে আবার!
ফোন করলাম তপন কাকুকে মানে মল্লিকা আন্টির হাজব্যান্ডকে।
- হ্যালো
- হ্যালো, আমি শুভ বলছি। অনেকদিন তোমাদের পাত্তা নেই। তাই ফোন করলাম। তোমরা কোথায় আছো? কেমন আছো?
- শুভ, তাড়াহুড়োতে জানানো হয়নি তোমাদের। মল্লিকার শরীরটা পরশুদিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎই খারাপ হয়। তো ওকে হসপিটালে এডমিট করতে হয়েছে।
বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠল।
- বলো কি গো?
আমার কথা থামিয়ে তপন কাকু বললেন
- শুভ, একটা কাজ করবে? মল্লিকার ইমেডিয়েটলি বি পজিটিভ ব্লাড লাগবে। একটু দেখবে গো! যদি তোমার কোনো বন্ধু বান্ধব থাকে!
- দেখছি, তুমি চিন্তা কোরো না।
- রাখি এখন। হুমম!
এমনটা সত্যিই আশা করিনি। তপন কাকুর কথাগুলো যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত শোনালো। মাকে কী করে জানাব! মা তো শুনে খুব ভেঙে পড়বে। আর ব্লাড টা! ফেসবুকে দেই বরং। মাথা কাজ করছে না। কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম হঠাৎ করেই।
না, সোশ্যাল মিডিয়ায় চাইতে হয়নি, মায়েরই ‘বি পজিটিভ’ ব্লাড। মা শুধু রক্তই দেয়নি, বারবার হসপিটালে গিয়ে তপন কাকুর পাশে থেকে মল্লিকা আন্টিকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে আজ বাড়িও ফিরিয়ে এনেছে। খুব খুশি আজ আমরা সবাই। মনটা খুব হালকা হয়ে গেছে হঠাৎ করেই। কিছু দিন খুব চিন্তায় দিন কাটছিল। কব্জি ডুবিয়ে মাংস খেয়ে ঘুম লাগালাম। কদিন ঘুমটাও হয়নি ভালো করে।
ভালো ঘুম আর হলো কই! ঘুম থেকে উঠে আবার যে কে সেই, তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি।
- বাড়ি ফিরে এসেছ! সেটা গোটা পাড়াকে জানাতে হবে বুঝি?
- মানেটা কি? কি বলতে চাইছ দিদি?
- এই যে কি সব রাঁধছ, শুঁটকি মাছের মত গন্ধ বেরোচ্ছে তো! পাড়ায় টেকা দায় হয়ে পড়ছে তো!
মল্লিকা আন্টিও খুন্তি নিয়েই ব্যালকনিতে এসে হাজির হল
- তোমার পয়সায় কিছু কিনেও আনি নি। তোমার শ্বশুরের পয়সায় রান্নাও করছি না। যা করছি আমার বরের পয়সায় করছি।
- মুখ সামলে মল্লিকা…
শুরু হল অন্তহীন ঝগড়া! ঝগড়া দেখে কে বলবে মল্লিকা আন্টি যাই রাঁধুক না কেন সেটা তো টিফিন ক্যারিয়ার করে আমাদের বাড়িতেই আসবে আর মা-ও ঢাকনাটা অবধি চেটে চেটে সাবার করবে।