Sukdeb Chattopadhyay

Classics

5.0  

Sukdeb Chattopadhyay

Classics

কুঁড়েঘর থেকে রাজমহল

কুঁড়েঘর থেকে রাজমহল

9 mins
903


আজ থেকে প্রায় পৌনে তিনশ বছর আগের কথা। যেখানে এখ কোলকাতার বিমানবন্দর ঠিক সেই অঞ্চলেই ছিল একটা ছোট গ্রাম, নাম রেকজানি। এখন ওখানে লোকে লোকারণ্য, তখন কিন্তু ওই সব এলাকায় জন বসতি খুব কম ছিল। কম বললেও কম বলা হবে, চারিদিকে ছিল জঙ্গল আর তার মাঝে অনেক দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এক একটা ছোট ছোট গ্রাম। গ্রাম ছাড়িয়ে একটু দূরে ঘন জঙ্গলে জন্তু জানোয়ারের পাশাপাশি ছিল দুর্ধর্ষ সব ডাকাতদের আস্তানা। ওই ডাকাতেরা খুব নিষ্ঠুর ছিল। সামান্য জিনিসের জন্যেও মানুষকে মেরে ফেলতে ওদের হাত কাঁপত না। তাই সন্ধ্যের পরে লোকজন সচরাচর গ্রামের বাইরে পা রাখত না। এমনই এক বিপদসংকুল গ্রাম ‘রেকজানি’র একধারে ছিল বলরাম দে’র কুটির। বলরাম গ্রামের একেবারে বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাত, ওই এখনকার প্রাইমারী স্কুলের মত আর কি। এভাবে যা আয় হত তাতে ওর আর ওর বৌ এর অতি কষ্টে দিন কাটত। দারিদ্র, জন্তু-জানোয়ার, ডাকাত, সব কিছুর মাঝেই চলছিল তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। ভালয় মন্দয় একরকম কাটছিল। কিন্তু শুরু হল এক নতুন উৎপাত। মারাঠা তস্কর ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে বাংলার গ্রামে গ্রামে তখন চলছে অত্যাচার আর লুঠপাট। এই ডাকাতদের বলা হত বর্গী। বর্গীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে বলরাম বাধ্য হল ভিটে ছেড়ে পালাতে। কিছু দরকারি জিনিসপত্র আর দু এক দিনের মত খাবার পোঁটলায় বেঁধে রওনা হল কোলকাতার দিকে। ওই সময় বলরামের বৌ ছিল আসন্ন প্রসবা। বেশ খানিকটা হাঁটার পর ওর বৌ মাটিতে বসে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করল। বলরাম শুধল—কিগো খুব কষ্ট হচ্ছে?

মহিলা তখন উত্তর দেওয়ার অবস্থায় নেই। চারিদিকে ধু ধু প্রান্তর। ত্রিসীমানায় কেউ কোথাও নেই। বলারাম কি করবে ভেবে না পেয়ে কেবল ভগবানকে ডাকতে থাকল। অত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বলরামের বৌ জন্ম দিল তার প্রথম সন্তানকে আর কপালজোরে সে বেঁচেও রইল। অত কষ্টের মধ্যেও তাদের সে কি আনন্দ। শরীরটা একটু সামলাতে তারা বাচ্চা নিয়ে আবার এগোতে থাকল কোলকাতার দিকে। কোলকাতার ধারে একটা ঝুপড়ীর মধ্যে শুরু হল তাদের নতুন সংসার। এদিক ওদিক টুকটাক কাজ করে কোনরকমে দু মুঠো অন্নের সংস্থান হয়। 

একদিন বলরাম বৌকে জিজ্ঞেস করে—হ্যাঁগো। ছেলের কি নাম রাখবে?

--আমি মুখ্যসুখ্যু মানুষ, ও তুমিই ঠিক কর।

--ও আমাদের ঘরের দুলাল, ভাবছি দুলাল নামটাই ভাল। আর ভগবান ওকে রক্ষা করেছেন তাই তেনার একটা নাম সাথে জোড়া থাকলে অনেক বিপদ কেটে যাবে। ছেলের নাম হোক রামদুলাল।

বলরাম ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে বলল, “কিরে, নাম পছন্দ হয়েছে?’।

অভাবের সংসারেও আনন্দ ছিল, ভালবাসা ছিল। কিন্তু এই সামান্য সুখও দীর্ঘস্থায়ী হল না। একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই বলরামের বৌ বেশ কিছুদিন রোগ ভোগের পর মারা গেল। দুই শিশুকে নিয়ে বলরাম কোনরকমে জীবন কাটায়। এইভাবে আরো কয়েকটা বছর কাটার পর ছেলে আর মেয়েকে অনাথ করে হঠাৎই বলরাম শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। এক প্রতিবেশী দিশেহারা বাচ্চা দুটোকে নিয়ে গেল তাদের দাদুর বাড়ি।

--দাদু, আমাকে আর বোনকে তোমাদের কাছে থাকতে দেবে?

নাতির কাতর আবেদনে রামসুন্দরের খুব কষ্ট হল। কিন্তু তাদের অবস্থাও ত সঙ্গিন। রামসুন্দর ভিক্ষা করে আর তার বৌ বাজারে গিয়ে চাল কোটে, এতে নিজেদেরই চলে না বাচ্চা দুটোর মুখে কি দেবে! কত্তাকে চিন্তা করতে দেখে রামসুন্দরের গিন্নি নাতি আর নাতনিকে কাছে টেনে নিয়ে বলল—কি অত ভাবছ? আমরা না রাখলে ওরা কোথায় যাবে? ওদের কে দেখবে?

--তা নয় বৌ, ভাবছি বাচ্চা দুটোকে কি খেতে দেব!

--আমাদের যেদিন যা জুটবে তাই ভাগ করে খাব। 

আর কথা চলে না। শিশু রামদুলাল আর তার বোনের ঠাঁই হল দাদু রামসুন্দর বিশ্বাসের চালাঘরে। কিছদিন পর রামদুলালের দিদিমা ধনী ব্যবসায়ি মদন মোহন দত্তর বাড়িতে রান্নার কাজ পেল। বাঁধা মাইনে পেত সাথে বাড়ির গিন্নিমায়েদের দয়ায় ভালমন্দ খাবারও পেত। সেগুলো বাড়িতে নিয়ে এসে সকলে মিলে খেত।

কয়েক মাস বাদে দিদিমা একদিন নাতিকে সাথে করে মনিবের বাড়িতে নিয়ে গেল ।

রাঁধুনির সাথে বাচ্চাকে দেখে দত্ত মশাই শুধলেন— সঙ্গে এটি কে?

--আজ্ঞে এ আমার নাতি। মা বাপ মরা বড় দুঃখী ছেলে। এখন আমার কাছেই থাকে....এনেছি যদি একটা... মহিলা সবিস্তারে দুঃখের কথা বলে নিজের একান্ত ইচ্ছেটা মনিবকে জানাল।  

সব শোনার পর দত্ত মশাই বাচ্চাটিকে জিজ্ঞেস করলেন—হ্যাঁ রে বাবা, এ বাড়িতে আমাদের কাছে এসে থাকতে পারবি?

দুলাল ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিল, পারবে।  

মদন মোহন দয়ালু মানুষ, বাচ্চাটাকে নিজের বাড়িতে রেখে দিলেন। কেবল ভরণ পোষণই নয়, গৃহ শিক্ষক এর কাছে রামদুলালের লেখাপড়া শেখারও বন্দোবস্ত করে দিলেন। কাজের মধ্যে বাড়িতে টুকটাক ফরমাস খাটা। খাওয়া পরার আর কোন অভাব না থাকায় রামদুলাল মন দিয়ে লেখাপড়া করতে লাগল। ধীরে ধীরে বাংলা পড়তে আর লিখতে শিখে গেল। এরপর কাজ চলা গোছের ইংরাজিটাও শিখে ফেলল। আরো কয়েক বছর পরে নিজের চেষ্টায় হিসেবপত্র রাখার কাজকর্মও অনেকটা আয়ত্ত করে নিল। কথাটা মনিবের কানে যেতে বললেন—ছোকরাকে একবার ডাক ত দেখি!

রামদুলাল ভয়ে ভয়ে মনিবের কাছে গিয়ে বলল—হুজুর আমায় তলব করেছেন?

--দুলাল, আমি যা শুনলুম তা কি সত্যি?

রামদুলাল আরো ভয় পেয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল—হুজুর, আমি কোন ভুল করে থাকলে মাফ করে দেবেন।

মনিব অভয় দিয়ে জানতে চাইলেন—তুমি নাকি হিসেবের খাতাপত্র রাখার কাজ পার! 

--আজ্ঞে তেমন একটা না তবে অল্প স্বল্প পারি।

--বেশ ওতেই হবে। শোন, আমি সরকার মশাইকে বলে দিচ্ছি তুমি কাল আমার অফিসে গিয়ে ওনার সাথে দেখা করবে। তোমার কাজ হবে আমার ব্যবসার বিলগুলো আদায় করা। কাজকর্ম সরকার মশাই তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবে। মাস গেলে পাঁচ টাকা মাইনে পাবে। তবে কাজটা কিন্তু পরিশ্রমের, পারবে তো?   

--আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব হুজুর। আমার একটা নিবেদন আছে হুজুর। 

--কি নিবেদন শুনি!

--হুজুর যদি একদিনের জন্য বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দেন।

--বাড়ির জন্য মন কেমন করছে বুঝি! করাটাই স্বাভাবিক। ঠিক আছে যাও তবে বেশি দিন থাকলে চলবে না। ফিরে এসেই কাজ শুরু করতে হবে।

দুলালের আনন্দ আর ধরে না। সেদিন বাড়ি গিয়ে সকলকে খবরটা জানিয়ে বলল—দাদু, তোমাদের আর কোন কষ্ট আমি হতে দেব না।

রামসুন্দর নাতিকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কাঁদতে থাকল। সকলে মিলে সেদিন খুব মজা করেছিল। তবে মনিবকে দেওয়া কথা রেখেছিল, ঠিক একদিন বাদেই ফিরে এসে যোগ দিল তার চাকরিতে।

সরকার মশাই ওকে দেখে একটু চিন্তিত হয়ে বললেন—তুই তো দেখছি নেহাতই ছেলেমানুষ, এ কাজ কি পারবি!

দু চার দিন কাজ দেখার পরে সরকার মশাইয়ের সব চিন্তা দূর হয়ে যায়। যত দিন যায় ততই প্রকাশ পেতে থাকে তার কর্মদক্ষতা। কঠোর পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা দিয়ে সকলের মন জয় করে নিল। বেশ কিছুকাল বাদে আবার একদিন ডাক পড়ল কত্তামশাইয়ের দরবারে। না জানি কি ভুল হয়েছে ভেবে মাথা নিচু করে সদ্য যুবক দুলাল মনিবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“তোমার ব্যাপারে অনেক খবরই শুনতে পাই। নিজে একবার যাচাই করার জন্যে ক’দিন আগে অফিসে গিয়েছিলুম। তুমি তখন অফিসে ছিলে না। দেখলুম যা কানে এসেছে তা ষোল আনা ঠিক”,  হেঁয়ালি করে কথাগুলো বলে মদন মোহন আগন্তুকের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।  

দুলাল অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে বলল—হুজুর জ্ঞানত কোন অপরাধ করেছি বলে মনে পড়ছে না। অসাবধানে যদি কোন অন্যায় করে থাকি তবে ক্ষমা করবেন।

দত্ত মশাই হেসে দুলালকে কাছে ডেকে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন—তোমার কাজে আমি খুব খুশি। এখন বড় হয়েছ তাই আরো বড় কাজের দায়িত্ব তোমাকে দিতে চাই। এখন থেকে তুমি জাহাজের কাজকর্ম দেখাশোনা করবে। দায়িত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছি তাই মাইনেও বাড়িয়ে দশ টাকা করে দিলাম। তবে বাপু খাওয়া দাওয়াটা ঠিকমত কোরো নয়ত শরীর টিকবেনাকো। 

দুলাল নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। দেবতুল্য মানুষটাকে প্রণাম করে ফিরে এল। বিল সরকার দুলাল হয়ে গেল জাহাজ সরকার। দাদুকে দেওয়া কথা দুলাল রেখেছিল। নাতির কল্যাণে তাদের অভাব অনটন আর ছিল না।

জাহাজের কাজকর্ম দেখার দায়িত্ব পাওয়ার পর দুলালকে প্রায়ই ডায়মন্ড হারবার অঞ্চলে যেতে হত। ওইখানেই বিদেশী জাহাজগুলো নোঙর করত। যাতায়াত করতে করতে পরিচয় হত অসংখ্য বিদেশী বণিক আর নাবিকদের সাথে। তাদের কাছ থেকে পেত বকশিস আর নানা উপহার। ধীরে ধীরে জাহাজের সব রকম কাজকর্মে বেশ হাত পাকিয়ে ফেলল।

একদিন দত্ত মশাই দুলালের হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বললেন- এটা সাবধানে রাখ। কালকে জাহাজ ঘাটায় গিয়ে টুল্লোহ অ্যান্ড কোং র নিলামের থেকে কিছু জিনিস কিনবে। কি কিনতে হবে সেই ফর্দটা সরকার মশাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে নাও।

দুলাল ফর্দ নিয়ে চলল জাহাজ ঘাটায় নিলামে ডাক পাড়তে। কিন্তু ও পৌঁছোবার আগেই জিনিসগুলি বিক্রি হয়ে যায়। হতাশ হয়ে ফিরেই আসছিল কিন্তু এর পরেই শুরু হয় একটা আধ ডোবা জাহাজের নিলাম। দুলাল তার বরাদ্দ টাকার মধ্যেই দাম জানায়। আর কেউ বিডার না থাকায় দুলাল ওই জাহাজটা পেয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে এক ইংরেজ দুলালের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা বেশি দিয়ে জাহাজটা কিনতে চায়। দুলাল তৎক্ষণাৎ তা বিক্রি করে ফিরে এসে মনিবকে সব ঘটনা জানিয়ে পুরো টাকাটা তাঁর হাতে তুলে দেয়।

দুলালের উপস্থিত বুদ্ধি আর সততায় মুগ্ধ হয়ে মনিব পুরো টাকাটা ওকে ফেরত দিয়ে বলে— তোমার সততায় আমি খুব খুশি হয়েছি। এ টাকা তোমার। তুমি নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে উপার্জন করেছ। তোমায় অনুমতি দিলাম, এই টাকা দিয়ে তুমি স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু কর। আশীর্বাদ করি তুমি সফল হও।

এই বিশাল পুঁজি আর তীক্ষ্ণ ব্যবসায়িক বুদ্ধিই রামদুলালের জীবনে এনে দিল এক অবিশ্বাস্য উত্তরণ। এর পরে আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। অতি পরিচিত জাহাজের লাইনেই শুরু হল তার স্বাধীন ব্যবসা। ফারগুসন কোম্পানির বেনিয়ান এজেন্ট হওয়ার সাথে চলল অন্যান্য ব্যবসায়ীদের সাথে স্বাধীন ভাবে কাজকর্ম। তাঁর অসামান্য দক্ষতা আর বুদ্ধিমত্তার কারণে খুব অল্প সময়েই বিদেশী ব্যবসায়ীদের কাছে যুবক রামদুলালের পরিচিতি আর চাহিদা আকাশচুম্বী হয়ে উঠল। কোলকাতা বন্দরে আসা সব জাহাজই রামদুলাকে তাদের মুৎসুদ্দি বা স্থানীয় প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত করে। কিছুকাল পরে চালু করল নিজস্ব ক্লিয়ারিং ও ফরোয়ার্ডিং এজেন্সি।  অ্যামেরিকান বণিকদের সাথে পারস্পরিক সংযোগ তার ব্যবসায় এনে দেয় বিরাট সাফল্য। ধীরে ধীরে দুলাল নিজেই কিনে ফেলে বেশ কয়েকটা জাহাজ, যা পণ্য সম্ভার নিয়ে পাড়ি দিত নানা দেশে। আমেরিকানরা রামদুলালের সাথে কাজ করে এতই তুষ্ট হয়েছিল যে তাদের একটা জাহাজের নাম দিয়েছিল “রামদুলাল দে”। জাহাজের ব্যবসার সাথে সাথে ফাটকাতেও দুলালের প্রচুর অর্থ উপার্জন হচ্ছিল। অবশ্য হবে নাই বা কেন, মানুষটার ব্যবসা শুরুই তো ফাটকার টাকায়। ক্রমে ক্রমে কপর্দকহীন রামদুলাল হয়ে উঠল কোলকাতার শ্রেষ্ঠ ধনপতি। 

ইতিমধ্যে বিডন স্ট্রিটে তৈরি হয়েছে অনেক জায়গা নিয়ে পেল্লাই একটা বাড়ি। দাদু আর দিদিমাকে সেখানে রেখেছে রাজসুখে। আছে আরো অনেক আশ্রিত। ধুমধাম করে বোনের বিয়েও দিয়েছে। কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফেরার পর দুলাল রোজ দাদু দিদিমার কাছে কিছুটা সময় কাটায়, ছোটবেলার মত একটু আদর খায়। একদিন গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দিদা বলল, “ব্যবসাপাতি অনেক হয়েছে, এবার একটু সংসারে মন দাও দিকিনি”।

--তোমরা ত আছ, আমি আর সংসার কি দেখব!

--ওরে পাগল তোর বিয়ের কথা বলছি। বৌ বাচ্চাই যদি না থাকে তবে এত রোজগার করে কি হবে! কে ভোগ করবে?

দিদিমাই দেখে শুনে নাতির জন্য টুকটুকে দেখে বৌ ঘরে আনল। মেয়ের নাম দুর্গামণি। শান্ত লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে। দিদিমাও খুশি, দুলালও খুশি। দিদিমার দুশ্চিন্তা দূর করে সম্পত্তি ভোগ করার লোকেরাও একে একে ঘরে এল। আশুতোষ আর প্রমথনাথ, দুলালের দুই ছেলেকে নিয়ে তখন ভরা সংসার। এদেরকেই কালের দিনে মানুষ চিনবে ছাতুবাবু আর লাটুবাবু নামে।

বিপুল ঐশ্বর্যের অধীশ্বর হয়েও দুলালের জীবনযাত্রা ছিল অতি সাধারণ। পরনে ধুতি ও বেনিয়ান, কাঁধে চাদর আর মাথায় পাগড়ি। নিজে অনেক কষ্ট করে বড় হয়েছে তাই কারো দুঃখ কষ্ট দেখলেই তাকে সাহায্য করত। কত মানুষ যে দুলালের দয়ায় খেয়ে পরে বাঁচত তার ইয়ত্তা নেই। কেবল অর্থ নয় নানান সমাজ সেবামূলক কাজের জন্য রামদুলাল সে যুগের মানুষের কাছে হয়ে উঠেছিল একজন অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় রামদুলালের কাছ থেকেই এসেছিল সব থেকে বেশি সাহায্য।

ব্যবসার প্রথম দিকে রোজগারপাতি যখন ভালই হচ্ছে, দুলাল ভাবল একটা দুর্গা পুজা করলে হয় না! যেমন ভাবা তেমনি কাজ, ধুমধাম করে শুরু হল দুর্গা পুজা। দুলালের সন্তান ছাতুবাবু আর লাটুবাবুর নামে বিখ্যাত হয়ে সেই পুজা আজও নীলকণ্ঠ পাখী উড়িয়ে প্রতি বছর হয়।

প্রতি মাসের মত সেবারেও দুলাল প্রচুর ফল, মিষ্টি, ইত্যাদি নিয়ে দেখা করতে গেছে কত্তা মশাইয়ের সাথে। মদন দত্তের শরীর ভেঙে গেছে, সারাদিন শুয়ে বসেই থাকেন। দুলাল গিয়ে পায়ে হাত দিতেই মনটা খুশিতে ভরে গেল।

--দুলাল, এস বাবা বস। এত কি সব আন বল ত!

--হুজুরের জন্যে একটু ফল মিষ্টি এনেছি।

--বয়েস হয়েছে, শরীরে নানা জ্বালা যন্ত্রণা। তোমাকে দেখলে শরীরটা জুড়িয়ে যায়। তা ব্যবসা কেমন চলছে?

--হুজুরের দয়ায় চলছে একরকম।

গল্প করতে করতে বেলা গড়িয়ে যায়। দুলাল প্রণাম করে বলে –হুজুর এবার আসি।

মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে মদন দত্ত দুলালের দিকে একটা খাম এগিয়ে দিলেন। কোটিপতি দুলাল মাথায় ঠেকিয়ে খামটা ব্যাগে ভরে নিল। ওর মধ্যে আছে একটা দশ টাকার নোট, দুলালের প্রথম জীবনের মাইনে। দুলাল তা নিয়মিত হাত পেতে নেয়, মানুষটার প্রতি তার কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধা জানাতে। চরম বৈভবেও দুলাল কখনো ভোলেনি তার অতীতকে, চিরকাল থেকেছে মাটির কাছাকাছি, অসহায়ের পাশাপাশি। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics