SHUBHAMOY MONDAL

Tragedy Thriller

2.5  

SHUBHAMOY MONDAL

Tragedy Thriller

কন্যাদান

কন্যাদান

4 mins
432



কন্যাদান

শুভময় মণ্ডল


আমার বয়স এখন প্রায় ত্রিশ। গায়ের রং চাপা, মুখশ্রীও খুব একটা ভালো নয়। হাই স্কুলে পড়ার সময়েই, আমার সহপাঠিনীদের প্রায় সবার তিন চারটে করে বয়ফ্রেণ্ড ছিল। ওরা বয়ফ্রেণ্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াতো, আর আমি আমার পুরো স্কুল এবং কলেজ জীবনেও একটা প্রপোজ পর্যন্ত পাইনি কারোর থেকে। তো, আমি তখনই বুঝেই গিয়েছিলাম - এমনি এমনিই কেউ আমায় বিয়ে করে, কোনোদিনিই তার বাড়ির বৌ সাজিয়ে নিয়ে যাবে না!

আমার বাবা ছিলেন শৈশবেই দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যাওয়া, এক সামান্য দর্জি - আমাদের বাড়ির অদূরেই এক মফস্বলের বাজারে, রাস্তার ধারে অস্থায়ী একটা ছিটে বেড়ার দোকান ঘর বানিয়ে, তিনি জামা কাপড় সেলাই করতেন।

দাদুর একটা আদ্যিকালের পুরানো সেলাই মেশিন ছিল। সেই মেশিন কাউকে এমনিতে দিতে চাইলেও হয়তো সে নেবে না, কিন্তু বাবার কাছে সেটাই ছিল পৈতৃক সূত্রে পাওয়া একমাত্র সম্পদ, আর তাঁর উপার্জনের অবলম্বন।

বাবার চোয়ালের একটা দিক ভাঙা আর ভোকাল কর্ডটাও আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায়, কথা বলতে তাঁর খুব কষ্ট হতো। তাই খুব জরুরী না হলে তাঁকে কথা বলতে শুনিনি বিশেষ। 

আমার বাবার হাতের কাজের কদর ছিল খুব, তাই পড়াশুনায় আমি কখনও বাধার সম্মুখীন হইনি। যতদূর পড়তে চেয়েছি, তিনি পড়িয়েছেন আমায়। আমি গ্র্যাজুয়েশন করে আর পড়িনি।

মাধ্যমিক দেবার পরই মা স্বর্গবাসী হলেন। স্কুল আর কলেজ দুটোই ঐ মফস্বলে হওয়ায়, আমিই ক্লাস করতে যাবার সময়, আমার আর বাবার খাবারটা রান্না করে নিয়ে যেতাম। দুপুরে দুই বাপ বেটিতে ঐ দোকানেই বসে খাওয়া দাওয়া করে নিতাম। রাতে বাবা ফিরলে, খাওয়া দাওয়ার পর বাবা শুয়ে পড়তো বারান্দায়, আর আমি ঘরে তক্তায় বসে পড়াশুনা করতাম। বিএ পাস করার পর, আর পড়ার ইচ্ছে করেনি - বাবার কথা ভেবেই।

একদিন বাবা দোকান থেকে ফিরে, রাতের খাওয়া দাওয়ার পর আমায় বললেন - তোর জন্য আজ একটা ছেলে দেখেছি রে মা। খুব বড় ঘরের ছেলে ছিল, যদিও এখন আর ওর বাড়ি ঘর জমি জমা কিছুই নেই, কিন্তু ছেলেটা ভালো, সৎ, কর্মকুশলীও। বাজারে একটা ছোট মুদিখানার দোকান দিয়ে শুরু করেছিল, আর গতমাসে একটা আস্ত দোকান ঘর কিনে নিয়েছে সুপার মার্কেটে, জানিস?

আমি বললাম - সেখানে তো তোমারও একটা দোকান কেনার কথা ছিল, তাই না? বাবা মুখ নিচু করে বললো - আর পয়সার জোগাড় করতে পারি নি মা। আমাকে ওরা দুমাসের শেষ সময় দিয়েছিলো - এর মধ্যে সব টাকা দিতে না পারলে দোকান আর পাবো না, অ্যাডভান্সের টাকাটাও ফেরত দেবে না বলে দিয়েছিল! 

সঞ্জয় বলে ঐ ছেলেটাও বুকিং এর সময় একটা দোকান চেয়েও পায়নি, সেটা জানতাম বলে ভাবলাম ওর সঙ্গে একবার কথা বলে দেখি। ও বললও যে বাকি টাকাটা এখনই দিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বুকিং আমার নামে থাকায়, দোকানটা ওর নামে রেজিস্ট্রী করা যাবে না - আমার নামেই করতে হবে!

অগত্যা আমিই প্রস্তাব দিলাম - ও যদি তোকে বিয়ে করে, তাহলে এমনিতেই আমার পর ও-ই তোর সূত্রে ঐ দোকানের মালিক হবে। চাইলে এখন থেকেই দোকানটা ও ব্যবহার করুক - মুদিখানার মালপত্র ভালো দোকান না রাখলে, কি ঠিক থাকে?

আমার জামা কাপড়ের কাজ - ঐ ছিটেবেড়ার ঘরে বসেই করে নেব আমি। তুই আর না করিস না মা, আগামী মাসের চোদ্দো তারিখে বিয়ের তারিখও ঠিক করে এসেছি। আমার আর কি বলার থাকতে পারতো - এতক্ষণ কথা বলায় দেখি বাবার গাল, গলা লাল হয়ে গেছে, চোখ থেকেও জল পড়ছে! তাই বললাম - তুমি যা বলবে তা-ই হবে বাবা। তুমি শুয়ে পড়, অনেক রাত হয়ে গেছে। 

আজ, আমার বিয়ে। সকালে বৃদ্ধির পর্ব মিটিয়ে সেই যে বাবা বেড়িয়েছেন, সন্ধ্যে পর্যন্ত আর ফিরলেন না! সারাদিন আমি একে ওকে জিগ্গেস করতে থাকলাম - আমার বাবা কোথায়? কে যেন বললো, বাবা দুপুরে এসে লুচি তরকারী খেয়ে, আমার মামাকেই নাকি কন্যাদান করতে বলে গেছেন। তাঁর নাকি শহর থেকে কি ভীষণ দরকারী একটা জিনিস কেনার আছে, ফিরতে রাত হয়ে যাবে।

যথারীতি আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হল, রাতের অতিথিরা সবাই খাওয়া দাওয়া করে চলে গেলেন। আমরা নবদম্পতি বাসরে বসে আছি, সঙ্গে আমার এক বান্ধবী আর ওর বর। গল্প গুজব, ঠাট্টা ইয়ার্কি চলছিল, কিন্তু আমার মাথায় শুধু বাবার কথাই ঘুরছিল।

এমন সময় আমার আর এক প্রতিবেশী বান্ধবী এসে, আমায় একটা ব্যাগ দিয়ে বললো - তোর বাবা লজ্জা পেল এখানে আসতে, তাই আমাকে বললো এই ব্যাগটা তোকে দিয়ে দিতে।

ওকে বললাম - তুই বাবাকে ডাক, আমি কথা বলবো। সেই সকাল থেকে বাবা কি খেল, না খেল কিছুই জানিনা। সে বললো - কাকু তো বললেন, তিনি খেয়ে নিয়েছেন। এখন বিশ্রাম করতে যাচ্ছেন, কাল সকালে এসে একবারে তোকে আশীর্বাদ করবেন। 

পরদিন খুব সকালে, তখনও দিনের আলো ফোটিনি ভালো করে, বাবা এসে ডাকলেন আমায়। বললেন - মা রে, তোকে এই বাড়ি থেকে বিদায় নিতে দেখতে পারবো না। তাই আমি তখন সামনে আসবো না, তুই মন খারাপ করিস না। তুই জানবি - তোর বাবা তোর কাছেই আছে সবসময়।

কালকের ব্যাগে দেখিস - তোর মায়েরই পছন্দ করা আশীর্বাদের একটা বাসন্তী রঙের জামদানী আছে, আর আমার আাশীর্বাদের একটা বিছা হার। তোর মায়ের খুব শখ ছিল এইদুটো দিয়ে তোকে আশীর্বাদ করার। আমি এখন আসি মা, তুমিও উঠে পড়, তৈরী হয়ে নাও। আমি ওদিকে যাই, কত কাজ পড়ে আছে - বলে বাবা চলে গেলেন।

আমরা বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে যখন সেই বাজার দিয়ে যাচ্ছি, দেখি বাবার দোকানের সামনে খুব ভিড়! আমরা গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে গেলাম দোকানে। 

ওঃ ভগবান, কি সাংঘাতিক দৃশ্য - বাবা মেঝেয় চিত হয়ে পড়ে রয়েছেন, কোমরের পাশে একটা সদ্য অপারেশনের ক্ষত থেকে বেড়িয়ে আসা রক্তের স্রোতে জায়গাটা ভেজা! 

বাবা মারা গেছেন গতকাল দুপুরেই, কিন্তু বাজারের লোকেরা আজই তাঁর দেহটা দেখতে পেয়ে ডাক্তার ডেকেছিলো, তিনিই এসে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন!




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy