খেজুর গুড়
খেজুর গুড়
খেজুর গুড়
দুখিরামের গাড়ী নেই । কিন্তু হাড় জিরজিরে এক
জোড়া গরু আছে । তাই দিয়ে সে কোন মতে বিঘে
দুই জমি ভাগ চাষ করে । কিন্তু এখন চাষের অবস্থা
খুবই খারাপ । একেতো বৃষ্টি হয় না। হলেও সময়ে হয় না । যদিও হয় পর্যাপ্ত হয় না । এরপর আছে সূর্যের উর্দ্ধমুখী তাপ । তাপ তো দিনে দিনে বাড়ছে।
এরপর হয়তো ফলনের মুখে এমন বৃষ্টি হলো - ধান সব জলের তলায় । যেমন এ ব্ছর হলো । সামান্য চাষ । তাই নিয়ে দুখিরমের দিন গুজরান । এবছর
ধান আর ঘরে ঢোকাতে হয় নি । যা টেনেটুনে ঘরে
এনেছিল দুখিরাম । তার থেকে মালিক কে ভাগ দিয়ে কতো টুকুই বা থাকে । নেহাত ওরা স্বামী, স্ত্রী
আর বড় ছেলেটা , এই তিনজন মিলে গায়ে গতরে
খাটে । তাই কোনো রকমে চলে যাচ্ছে । তবে দুখিরামের আরো ধান্দা আছে । যেমন ও বাঁশের
ঝুড়ি , ধামা , কুলো তৈরী করতে পারে । ঢাকও বাজাতে পারে । দুর্গা পূজা , কালী পূজায় ঢাক বাজায় আর একটা কাজ ও ভালোই করতে পারে ।
সেটা হলো গুড় তৈরী । সেটাও কিন্তু ভাটার মুখে ।
প্রকৃতি যা ছবি নিজের তৈরী করেছে তাতে করে
মানুষের বেঁচে থাকাটাই একটা বিরাট সমস্যা ।
কালী পূজাটা পার হলেই যখন শীত শীত ভাবটা গায়ে লাগে তখন থেকেই ওর কাজ শুরু হয়ে যায় ।
খেজুর গুড় তৈরির সরঞ্জাম ওর সবই আছে । নেই
শুধু খেজুর গাছ । গোটা গাঁয়ে কতো খেজুর গাছ ছিলো- পৌষ ,মাঘ দুটো মাস ও গুড় তৈরি করতো ।
গুড় বিক্রি করতো । ভালোই রোজগার হতো । কিন্তু
খেজুর গাছ গুলো যেন উধাও হয়ে গেলো--অবাক !
গাঁয়ের শেষে তাল পুকুরের পাড়ে পাঁচ ছটা খেজুর
গাছ । মন্ডলদের চালতা বাগানে গোটা চারেক । এদিক ওদিক করে আরো আট দশ টা । সকালে চাছা। বিকেলে হাঁড়ি টাঙানো । আবার পরের দিন
ভোর হতেই সে গুলোকে নামিয়ে আনা । তারপর ডেকে ফুটানো । আজ দু ব্ছর সেটাও বন্ধ ।
তাই দুখিরাম দিনু খুড়োর গাড়িটা এক দিনের জন্য
চেয়ে নিল । ওর হাড় জিরজিরে গরু গুলো জুতে
গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো । উদ্দেশ্য একটাই --
যেখানে ও খেজুর গাছ দেখতে পাবে সেখানেই ও
মহল বানাবে । অন্তত দশ পনেরো টা পেলেই হবে ।
ওর যন্ত্রপাতি , একটা কাপড়ের পুটলীতে কিছুটা
মুড়ি , পেঁয়াজ, লঙ্কা আর একটা হাঁড়িতে জল নিয়ে
বেরিয়ে পড়লো ওরা বাপ ছেলে । বৌকে বলে গেলো -- সে যেন ভাত রান্না করে রাখে । ওদের
ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে ।
পাশাপাশি গ্রাম গুলো চার পাঁচ ক্রোশের মধ্যেই ।
মাঝখানে একটা জোড় মতো আছে । সারা ব্ছরই
জল থাকে । সেই জলে কিছু চাষও হয় ।
দুখিরাম গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । আর এদিক
ওদিক তাকাচ্ছে । খেজুর গাছ যে একেবারে দেখতে পাচ্ছে না এমন নয় । তবে ঐ দু একটা ।
দুপুর গড়িয়ে গেলো । খেজুর গাছের দেখা মিললো
না। আর দু একটা গ্রাম ঘুরে বাঁকা পথে ওরা বাড়ি
ফিরে যাবে এটাই ঠিক করলো ওরা ।
কাঁসাই এর ক্যানেল থেকে একটা শাখা নদী দুটো গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে । বরষা ছাড়া জল
থাকে না । বলির ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে
ওরা পার হয়ে গেলো । ওপারের রাস্তাটা পাকা হয়েছে । দু একটা নতুন দোকানও হয়েছে ।
একটা দোকান খোলা দেখে দুখিরাম বিড়ি কিনতে
গেলো । ছেলেটা বললে , 'বাবা একটু জল খাবো ।
দেখো না গুড় আছে কি না ।'
গুড় জিজ্ঞাসা করতেই দোকানদার বললে , 'হ্যা আছে । একশো টাকা কিলো । '
দুখিরাম বললে , একটা শাল পাতার ঠোঙায় পাঁচ
টাকার দাওয়ও । ছেলেটা জল খেতে চাইছে ।শুধু জল..টা ...'
দোকানদার হাতায় করে একটু গুড় দুখিরামকে
দিল । দুখিরাম এবং ওর ছেলে ঐ গুড় দিয়ে জল
খেলো একটু । গুড় কিন্তু দুখিরামের ভালো লাগলো
না । সে জিজ্ঞাসা করলো , এটা খেজুর গুড় ?
দোকানদার বললে -- খাটি খেজুর গুড় ।
দুখিরাম কপাল চাপড়াতে লাগলো । মনে মনে ভাবলে হায় রে এটা যদি খেজুর গুড় হয় তাহলে
আমি যেটা বিক্রি করি সেটা কি ?
সূর্য অস্ত যাবার সময় ওরা ঘরের পানে চলতে লাগলো । পথে দেখলে একজন কাঁধে বাঁক নিয়ে
দু খানা হাড়ি ঝুলিয়ে চলেছে । দুখিরাম ওকে জিজ্ঞাসা করলে , ' ও ভাই কোথায় মহল দিয়েছ ?
লোকটা বললে --আমিও তোমার মতো খেজুর গাছ
খুঁজতে বেরিয়েছি ।
দুখিরাম আর ওর ছেলে সন্ধ্যা বেলায় ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে এলো । গিন্নি বললে -- কিছু ব্যবস্থা হলো ? দুখিরাম বললে না । হলো না ।
---আর মহল হবে না । শীতও বেশি পড়ে নি । আর
খেজুর গাছেরও আকাল । গিন্নি বললে -- যাও টপ
করে চান টা করে এসো । ভাত বেড়ে দিচ্ছি ।
.................................................................
