JAYDIP CHAKRABORTY

Classics

3  

JAYDIP CHAKRABORTY

Classics

খাঁচায় বন্দী মন

খাঁচায় বন্দী মন

11 mins
697


(১)

মেহেন্দি লাগানো হাত দুটো শূন্যে তুলে ঐশ্বর্যের সামনে হা করে দাঁড়ালো শ্রীতমা। ঐশ্বর্য ওর মুখে একটা লর্ড চমচম গুঁজে দিতে গিয়ে একফোঁটা দুধ ওর হাতে ফেলল।

·        পিসি-মনি, তুমি যে কি করো না। দিলে তো আমার মেহেন্দিটা নষ্ট করে।

তুই বরং আজ লিকুইডের ওপরেই থাক। ফ্রুট জুস, দুধ, কোল্ড ড্রিন্স এইসব। স্ট্র দিয়ে খাবি। মেহেন্দির কিস্যু হবে না। পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটে শ্রীতমার বাবা  অবিনাশ।

ভালো হবে না বলে দিচ্ছি ড্যাড। শ্রীতমার গলায় অভিমানের সুর।

নতুন বৌদির ডিজাইনার ব্রাইডাল ল্যাহেঙ্গাটা দেখেছিস? ঋশিতা বেশ এক্সসাইটেট।

ওগুলো এখন বেশী ঘাটাঘাটি কোরও না। ২ লাখ টাকার ওপরে দাম। রাত্রে ওরা পরলে দেখো।

অতো দামী ল্যাহেঙ্গা কখনো চোখে দেখিনি। রাত পর্যন্ত ধৈর্য ধরার সময় নেই। একবার দেখলে কিস্যু হবে না পিসি-মনি। ঐশ্বর্যর কথা শেষ হতে না হতেই শ্রীতমার উত্তর।

কোথায় আছেরে? চল দেখি গিয়ে। কৃষিকা, ঋশিতা ও শ্রীতমাকে নিয়ে ছুট লাগাল।

ওরা ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলে ঐশ্বর্যের নজর তাঁর দাদা অবিনাশের ওপর পড়ল। “দাদা তুই এসে ব্রেকফাস্ট করেছিস?

·        ঐ কাজটা সকালে এসেই সেরে নিয়েছি। তা তোদের বৌভাত ও ভাত-কাপড় পর্বটি কোথায় হচ্ছ

·         ধুর তোর ভাত-কাপড়? এই সব মান্ধাতা আমলের সব নিয়ম-কানন মেনে  কোনও লাভ আছে? অলিভিয়ার যত পাগলাম

·        বিদেশী মেমদের একটু ইন্ডিয়ান কালচারের উপর প্রেম থাকে। দেখলি না কেমন সাত পাকে ঘুরে, মালা বদল করে বিয়েটা সারল! তা ভাত-কাপড় দান হচ্ছে কোথায়? তোদের এই ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে, নাকি নলবন?

·         না, ওটা এই কমপ্লেক্সের কমিউনিটি হলে হবে। রিসেপসান হবে নলবনে।


·        তা তোর কর্তাটি কোথায়? ধনঞ্জয়কে তো দেখছি না।

·         ওর কি এসব দিকে ধ্যান দেবার সময় আছে? ওর যত চিন্তা ঐ রিসেপসান নিয়ে। গত সাতদিন ধরে তার প্রস্তুতি পর্ব চলেছে। ব্যস্ত শিডিউল থেকে সময় বার করে এক চেম্বার থেকে অন্য চেম্বার যাওয়ার পথে চাক্ষুষ তদারকিও করেছে ধনঞ্জয়।

·        বিশাল আয়োজন বুঝি?

·        বিশাল বলে বিশাল। বহু রথী-মহারথীদের হাজির করছে ও ঐ রিসেপসানে।

·        বারে, কলকাতার নামকরা সাইক্রিয়াটিস্ট ডাঃ ধনঞ্জয় বিশ্বাস বলে কথা। তা কে কে আসছে শুনি।

·         মন্ত্রী, এম.এল.এ, আই.পি.এস অফিসার থেকে শুরু করে টলিউডের ব্যস্ত নায়ক অভিজিৎ, কেউ বাদ নেই ওর লিস্টে।

·        শুধু বাদ আছে বাবার দেশের বাড়ির কয়েকজন প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, পুরনো মধ্যবিত্ত কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব আর.....

তুই চুপ করবি, ঘরে ঢুকেই মার কথায় ফোঁড়ন কাটতে শুরু করল। বিদেশে থেকেও পুরনো স্বভাবটা আর গেল না দেখছি।” সম্পূর্ণর কথাটা সম্পূর্ণ করতে দেয় নাঐশ্বর্য।

আচ্ছা সম্পূর্ণ, তোমার কি এ দেশের কোন কিছুই পছন্দ নয়? বৌ আনলে তাও বিদেশী!

উল্টোটা। ইন্ডিয়ান কালচার পছন্দের বলেই বিদেশীদের মধ্যেও এই কালচার ছড়িয়ে দিতে চাই। অবিনাশের হাল্কা ইয়ার্কিকে একটু সিরিয়াসলি নেয় সম্পূর্ণ।

দাদাভাই মাসী-মনি তোকে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে রেডি হয়ে কমিউনিটি হলে যেতে বলল। দৌড়ে ঘরে ঢুকে এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলল শ্রীতমা। 

এই তোর মা কোথায় রে? ঐশ্বর্যর প্রশ্ন।

মা নতুন বৌদিকে রেডি করছে। শাড়ি পরে বৌদিকে একঘর লাগছে দাদাভাই।

তোকে আর পাকামি মারতে হবে না। পাকা বুড়ি একটা।

না, আমি তো কচি খুকি! বউয়ের প্রশংসা শুনতে তো ভালোই লাগলো। পেটে খিদে মুখে লাজ রেখে লাভ কি?

·        এই তোদের ঝগড়া থামাবি? বাবাই, তুই আর দেরী না করে স্নানে যা। বৌভাত, লাঞ্চ সেরে তোদেরকে তো আবার পার্লারে যেতে হবে। আমি ছমাস আগে ঐ পার্লারে স্লট বুক করে রেখেছি। ওখানে বেশ সময় লাগবে। দেরী করলে রিসেপসান পার্টিতে সময় মত পৌঁছতে পারবি না।

মায়ের কথার কোনও উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল সম্পূর্ণ।

(২)


“সান্ধ্য নীড়” বৃদ্ধাশ্রম। আজ এখানের অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষরা এক মুহূর্ত অবসর পাচ্ছে না। আজ তারা ভীষণ ব্যস্ত। আশ্রমের লনে বাঁশের কাঠামোয় ত্রিপল টাঙিয়ে প্যান্ডেল করা হয়েছে। আর সেখানেই এই বয়স্ক মানুষরা বেঞ্চ, চেয়ার পেতে খাওয়ার জায়গা করছেন। আশ্রমের পাশে এক খণ্ড জায়গা বের করে রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুশান্ত বিশ্বাস নিজের বয়স কে পাত্তা না দিয়ে সমস্ত কাজটার তদারকি করছেন।

ওহে সুশান্ত, এতো সব আয়োজনের  কারণটা এবার তো বল। ধৈর্যের বাঁধকে তো আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। আশ্রমের এক বৃদ্ধের কৌতূহল চেপে রাখতে না পারার আত্ম সমর্পণ।

বলছি তো সময় হলেই সব জানতে পারবে। কথা বলতে বলতেই সুশান্ত বিশ্বাসের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। হ্যাঁ, তোমরা কোথায়? ও বেড়িয়ে পড়েছ? এদিকটা সব ঠিক আছে। একদম প্ল্যান মাফিকই কাজ হচ্ছে। এখন শুধু তোমাদের আসার অপেক্ষা। ঠিক আছে, রাখি তাহলে। সাবধানে এসো।

ফোন রেখেই সামনে তাকাল সুশান্ত। আশ্রমের দারোয়ান বাহাদুর দাঁড়িয়ে।

বাইরে কয়েকজন লোক আপনারখোঁজ করছেন মাষ্টার বাবু।

আরে বাইরে দাঁড়  করিয়ে রেখেছ কেন? ভেতরে আসতে বল। চল দেখছি। কথা বলতে বলতে গেটের দিকে এগোল সুশান্ত।

নির্মল, রজত। এসো, এসো ভেতরে এসো। আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

না, না কোন অসুবিধে হয় নি। বর্ধমান থেকে এক বাসে সল্ট-লেক, করুণাময়ী। আর সেখান থেকে অটোতে  আপনার এখানে। কিন্তু আপনার এরকম জরুরী তলবের হেতুটাইতো জানতে পারলাম না মাস্টারমশাই।

এত দূর থেকে এসেছ, রেস্ট নাও, খাওয়া-দাওয়া কর। সময়মত সব জানতে পারবে। কথা বলতে বলতে ওদের ভেতরে নিয়ে গেল সুশান্ত। একইভাবে আরও কয়েকজন অতিথিকে ওয়েলকাম জানাল সুশান্ত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এক সু-সজ্জিত মার্সিটিস সান্ধ্য নীড়ের সামনে এসে দাঁড়াল। সম্পূর্ণ ও অলিভিয়া গাড়ি থেকে নামল। গাড়ির আওয়াজেই সুশান্ত ও তাঁর সঙ্গী সাথী অতিথিরা গেটের সামনে এসে দাঁড়াল।

এসো দাদুভাই। ওয়েলকাম গ্র্যান্ড-সন-ইন-ল। তা আসার সময় কোনও অসুবিধায় পড়নি তো  দাদুভাই।

না, আমরা পার্লারের নামকরে বেড়িয়েছি। মা-ই তো তাড়া দিয়ে বের করলো।সম্পূর্ণর উত্তর। 

কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার এই দাদাই-এর হোমই, পার্লার হয়ে যাবে। 

কথা বলতে বলতে ওরা সুশান্তের ঘরে এসে বসল। 

আরে মিঠু পিসি, তুমি এসে গেছ! আমার বৌকে এখন তোমার হাতে ছেড়ে দিলাম। এমন ভাবে সাজাবে যে অস্ট্রেলিয়ার মেম যেন বাঙ্গালী নববধূ হয়ে যায়।সম্পূর্ণর কথায় অধিকারের সুর।

আমি কি আর আজকালকার পার্লারের মত সাজাতে জানি? আমার স্টাইলগুলো তো সব পুরনো হয়ে গেছে। তবে তোমার মার বৌভাতের দিন ওনাকে আমিই সাজিয়েছিলাম। মিঠুর কথা দিয়ে অনেকটা অভিমান গড়িয়ে পড়ল।

পুরনো স্টাইল-ই ভাল। ওল্ড ইজ গোল্ড। এইজন্যই তো পার্লার ছেঁড়ে তোমাকে দিয়ে আমার বৌকে সাজাচ্ছি।

দাদুভাই, আমাদের বোধহয় বাংলায় কথা বলা ঠিক হচ্ছে না। Olivia may feel uncomfortable with us. Let’s speak in english.

No, its OK Dadai. আমি বাংলা বুঝতে পারে।

বাঃ ওয়ান্ডার-ফুল। কিন্তু তোমরা আর দেরী না করে মেক-আপে বসে যাও।  It’s time-taking. মিঠু তোমরা পাশের ঘরে চলে যাও। ওঘরে তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করা আছে।

সুশান্তের কথামত মিঠু আর অলিভিয়া পাশের ঘরে চলে গেল।

·        দাদাই বেনারসিটা কেনা হয়েছে তো।

·         আরে হ্যাঁ, তোমার দাদাই-এর কথার নড়চড় হয় না। আর ওটা আমার তরফ থেকে নাত-বৌয়ের গিফট।   

·        কিন্তু সেরকম তো কথা ছিল না। ওটার দাম তো আমি দেব।

·        আর আমি খালি হাতে আমার নাত-বৌয়ের মুখ দেখবো, তাই কখনো হয়? আর আমার তো টাকা-পয়সা কম নেই যে এইটুকুর জন্য আমার নাতির কাছে হাত পাতব।

·        হ্যাঁ, সে কি আছে আমার জানা আছে। তোমার সঞ্চয় আর রিটায়ারমেন্টের সব টাকাই তো তুমি বাবার এক একটা ডিগ্রির পিছনে খরচ করে ফেলেছ।

·        কেন, আমার পেনশন আছে। তাছাড়া এখনো আমি ছাত্র পড়াই।

·        সে তো সমাজ সেবা। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।

·         না, কয়েকটা বড়লোকের ছেলেকেও পড়াই। তবে সে টাকারও বেশীর ভাগটাই গরীব বাচ্চাদের বই,খাতা কিনতেই খরচ হয়ে যায়।

·        দাদাই, তুমি ওকে গিফট দিতে চাও, দাও। আমি বাঁধা দেব না। তবে আজ তোমার জন্য আমাদের গ্রামের নির্মল কাকু, রজত কাকু থেকে শুরু করে আমদের অনেক আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হওয়া সম্ভব হচ্ছে। এটাই আমার কাছে একটা বড় গিফট। আসলে চাকরী সূত্রে অস্ট্রেলিয়ায় থাকি।  কালে-ভদ্রে ইন্ডিয়ায় আসি। তাই এখানে এলে সবার সাথে দেখা করারা জন্য মনটা হাঁসফাঁস করতে থাকে। 

·        সে তো শুধু তোমার নয়। আমার সাথেও তো ওদের অনেক দিন পরে দেখা হচ্ছে। তুমি আর দেরী না করে রেডি হয়ে নাও। লোকজন সব চলে আসবে। তোমাদের তো এদিকটা সেরে ঐ রিসেপসান পার্টিতেও যেতে হবে।

·         না, ঐদিকটা বাবা-মাই সামলাক। আমরা এইখানেই থাকবো।

·        সেকি হয় দাদুভাই! তোমাকে তো তোমার বাবা-মার সম্মানটাও দেখতে হবে। কত নিমন্ত্রিত অতিথি আসবে তোমাদের সাথে দেখা করতে।

·        ঠিক আছে আমরা যাব। তবে তোমাকেও আমাদের সাথে যেতে হবে।

·         আমি কি করে যাব দাদুভাই? আমাকে তো তোমার বাবা ইনভাইট-ই করে নি।

·        তোমাকে আবার কে ইনভাইট করবে? তুমি-ই তো সবাইকে ইনভাইট করছ। তোমার নামেই তো সব ইনভাইটেশন কার্ড ছাপা হয়েছে।

·        ঠিক আছে, তুমি বলছ আমি যাব। তবে রাতের খাওয়া-দাওয়াটা কিন্তু আমি এখানে এসেই সারবো। এই বয়সে তোমাদের ঐ ফরেনি আইটেম আমার পেটে সইবে না।

·        তুমি কিচ্ছু ভেবো না দাদাই। রাতে তোমার সাথে আমিও এখানে এসে ডিনারটা সারবো। চল আমরা তবে রেডি হয়ে নেই।  

·        হ্যাঁ, তাই চল।          

(৩)


নলবন সংলগ্ন এই উদ্যানটি আজ যেন চেনাই যাচ্ছে না। ইভেন্ট-ম্যানেজার বিশ্বকর্মা কর্মকারের পরিচালনা আর ডাঃ ধনঞ্জয় বিশ্বাসের প্রযোজনায়, এ যেন আজ আলো ঝলমল রাজপুরী। এর একদিক ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন রকম স্টল। মকটেল, ফুচকা, রোল, চিকেন পকরা, বেবি ক্রন, ফিস ফিঙ্গার কি নেই তাতে? উদ্যানের মাঝখানে একটি স্টেজ তৈরি হয়েছে, যেখানে অর্কেস্ট্রা ব্যান্ড  সহ শহরের নামকরা সঙ্গীত-শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করছেন। আর লনের বাকি জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে সাদা মখমল কাপড়ে ঢাকা বেশ কিছু গোল টেবিল। আর সেই প্রত্যেকটি টেবিল ঘিরে রয়েছে সাদা মখমল কাপড়ে ঢাকা গুটি কতক চেয়ার। তারই বেশ কিছু দখল করে অতিথিরা স্ন্যাক্স খেতে খেতে গান শুনছে। কেউ কেউ বা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত।

·        এলাহি ব্যাপার। আর হবে নাই বা কেন? ছেলে বিলেতে চাকরী করে। কথায় আছে না পয়সা থাকলে ভুতের বাপের শ্রাদ্ধ করা যায।

·          আমি যত দূর শুনেছি, স্যার, মানে ডাঃ ধনঞ্জয় বিশ্বাস তার ছেলের থেকে  একটি  পয়সাও নেন নি। আর তা নেওয়ার দরকার-ও নেই।

·        হ্যাঁ, বল কি? পাগলের ডাক্তারের এতো পয়সা?

·        আঙ্কেল, আপনার বোধহয় একটু ভুল হচ্ছে। উনি MBBS,MD in physiatrist, FIPS, FIAPP. স্নায়ু ও মনরোগ বিশেষজ্ঞ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দিনে সাত–আটটা চেম্বার করেন। প্রতি চেম্বারে ৫০ থেকে ৬০ জন পেসেন্ট দেখে।  ওনার ভিজিট ৬০০টাকা। তিন মাস আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না করলে ওনাকে পাওয়া যায় না।

·        ওরে বাবা। তা তুমি এতো সব জানলে কি করে?

·        আমি একজন মেডিক্যাল রিপ্রেনজেটিভ। সপ্তাহে দুবার মিট করি ওনাকে। আমাদের কোম্পানি বছরে বিশ লাখ টাকা খরচ করে ওনার পেছনে। আর শুধু  আমাদের কোম্পানিই নয়। এরকম পাঁচ-ছটা কোম্পানি আছে। আজ যে এখানে  টলিউডের সুপার স্টার অভিজিৎ আসছেন, সে আমাদের কোম্পানির পয়সায়।

·        ওরে বাবা! ওনার এতো পয়সা, খরচ করে কি করে? আমাদের তো কিছু দিতে পারে।

·         ওনার বাবা বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন। ওনাকেই কিছু দেন না। আর আপনাকে... তবে শুনেছি ওনার বাবাই নাকি ওনার থেকে কিছু নেন না। 

·        বড় বড় লোকদের সব বড় বড় ব্যাপার। আমাদের এসব ভেবে লাভ নেই। যাই আমি বরং কটা চিকেন পকরা নিয়ে আসি।

অতিথিরা অনেকেই এসে গেছেন। কিন্তু এখনো নায়ক-নায়িকার-ই পাত্তা নেই। ঐশ্বর্য ভীষণ টেন্স ও উত্তেজিত।

·        এতক্ষণ ধরে কোথায় কি করছে কে জানে? আত্মীয়-স্বজন সব চলে এসেছে। মান সম্মান আর রাখল না। ফোনটাও ধরছে  না।

ঐ পার্লারের ফোন নাম্বার নেই। ওখানে একবার ফোন করে দ্যাখ না।এক আত্মীয়ার সদুপদেশ।

·        ফোন করেছিলাম। ওখানে যায়-ই নি। কোথায় আছে একবার জানানোর প্রয়োজনও মনে করে না। অপদার্থের এক শেষ।

ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে ঐশ্বর্যর। ধনঞ্জয় বিশিষ্ট অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। তাঁর সকল ধ্যান সমাজ ও যুব কল্যাণ মন্ত্রী অধ্যাপক অনাথবন্ধু ঘোষের ওপর। উনি আসার পর এক মুহূর্তের জন্য ওনার সঙ্গ ছাড়া করছে না ধনঞ্জয়। উদ্দেশ্য ওনার একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে এবারের ইলেকশনের টিকিটটা যদি পাওয়া যায়। ওনারাও একটি গোল টেবিল দখল করেছেন। সঙ্গে রয়েছেন আই.পি.এস অফিসার নক্ষত্র মণ্ডল ও পুলিশ কমিশনার। বিশেষ অতিথিরা ফর্মাল কথাবার্তা চালিয়ে গেলেও ধনঞ্জয়ের চোখ প্রবেশ দরজার ওপর কড়া নজর রাখছে। মুখে প্রকাশ না করলেও ছেলেও ছেলে-বৌ-এর অপেক্ষায় মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। হঠাৎ সেই সু-সজ্জিত মার্সিটিসটিকে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়ালো ধনঞ্জয়।

ঐ তো আমার ছেলে, ছেলে-বৌ এসে গেছে।” সকলের নজর   গিয়ে পড়ল ঐ গাড়ির ওপর।

চলুন আমরা এগিয়ে গিয়ে ওদের মিট করি।” কথাটা বলে অনাথবন্ধু গাড়ির দিকে এগোল, আর বাকীরা তাকে অনুসরণ করলো।

সম্পূর্ণ গাড়ি থেকে নামল। ওদের দেরীর জন্য এমনিতেই সম্পূর্ণর ওপর রেগে ছিল ধনঞ্জয়। ধুতি পাঞ্জাবী পরা সাবেকী বর রূপী সম্পূর্ণকে দেখে সেই রাগের মাত্রা এক কদম বাড়ল। আর সেই রাগের মাত্রা সহ্যের গণ্ডি স্পর্শ করল, লাল বেনারসিতে মোরা অলিভিয়ার নববধূ রূপ দেখে। কিন্তু এখানেই  শেষ নয়। ধনঞ্জয়ের জন্য আরও চমক অপেক্ষা করছে। সম্পূর্ণ এবার গাড়ি থেকে তাঁর দাদাইকে হাত ধরে সযত্নে বের করলো।

এগুলো সব তাহলে বাবারই ষড়যন্ত্র! বাবার ওখানে গিয়েই এতোটা সময় নষ্ট করেছে সম্পূর্ণ। অফ ভগবান, এই লোকটার ইন্টারফেয়ারেন্স থেকে কি আমি কোনোদিন-ই বেরোতে পারবো না?” এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নিজের রাগকে প্রশমিত করার চেষ্টা করছে ধনঞ্জয়। আরে মাষ্টার-মশাই আপনি? এখানে?” কথাটা বলেই ঢিপ করে প্রণাম করল অনাথবন্ধু।

·        আজকের বর যে আমার নিজের নাতি। তা তুই অনাথ না?

·        চিনতে পেরেছেন তাহলে!

·        চিনবো না? তুই তো আমার কাছে প্রাইভেট টিউশান-ও পড়েছিস। বেশ মোটা হয়ে গেছিস।

·        হ্যাঁ, সে একটু হয়েছি। এবারে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। তাইতো বলি, এতক্ষণেও বর-কনের পাত্তা নেই কেন? ধনঞ্জয় দা, আপনি বাবাকে আনতে ছেলে, ছেলে-বৌকে পাঠিয়েছেন? এই না হলে মাস্টারমশাই-এর ছেলে!

আরেকটা জিনিষ লক্ষ করেছেন অনাথবন্ধু দা, স্যুট, বুট আর ল্যাহেঙ্গা, চোলীতে যে সময়ে সব বিয়ে বাড়ি ছেয়ে গেছে, সেখানে N.R.I বর আর বিদেশী কনের পরনে কেমন সাবেকী বর-কনের বেশ। বিদেশী কালচার বাঙ্গালীঐতিহ্যকে একটু-ও নষ্ট করতে পারেনি। নক্ষত্রের চোখে-মুখে প্রশংসার জোয়ার।

·        একদম ঠিক বলেছ নক্ষত্র। সত্যি মাস্টারমশাই, আপনি আপনার ছেলেকে একদম আপনার আদর্শেই বড় করেছেন।


কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল ওরা। ধনঞ্জয় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। একরাশ অপ্রত্যাশিত প্রশংসার ধাক্কায় তাঁর মনে আজ যে প্লাবন দেখা দিয়েছে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ধনঞ্জয়ের নেই। যে মানুষটি প্রতিদিন শত শত মানুষের মনের ভাষা পড়েন, সে মানুষটি আজ নিজের মনের ভাষাই বুঝতে পারছেন না। একটা একাকীত্বের চাঁদর জরিয়ে স্তম্ভের মত দাঁড়িয়ে রইল ধনঞ্জয়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics