কেনা বউ 🍁
কেনা বউ 🍁
#ছোটোগল্পের পাতায়
শ্রেয়ার জ্বরটা বাড়ছে । অনিন্দ্যের বুকে বিড়ালছানার মতো লেপ্টে আছে শ্রেয়া । অনিন্দ্যের বুকে মাথা রেখে বাইরের দৃশ্য দেখে যাচ্ছে আর ভাবছে
কিছু ঘন্টা আগের কথা…! বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে পুতুলের মত সাজিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে শ্রেয়াকে। এ নিয়ে তিনবার। যেটি শ্রেয়ার মোটেও পছন্দ নয়।
এটা কেমন কথা ! মেয়েদের দেখতে আসবে ছেলেরা আর তার সামনে মোমের পুতুলের মত সেজেগুজে বসে থাকতে হবে মেয়েদের । তারপর ছেলের, ছেলের বাড়ির পছন্দ হলে বিয়ের কথা আগাবে, নয়তো রিজেক্ট করে দেবে । এতে ওই মেয়েটির মনে কি প্রভাব পড়ে! তা কি কেউ ভেবে দেখেছে কখনও? হয়ত না। দেখলে কোনো মা তার মেয়েকে এভাবে সাজিয়ে- গুজিয়ে আসনে বসাতো না। আর শ্রেয়ার তো ফুটো কপাল । মা নেই ।
আছে সৎ মা, যে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে পান চিবুচ্ছে।ছেলেপক্ষ নানান রকম প্রশ্ন করে চলেছেন শ্রেয়াকে। শ্রেয়া চুপ করে বসে। কি আর করবে সে? বাবার বয়সি লোককে তার সৎ-মা ঠিক করে দিয়েছে। সব কথা পাকা করে ফেললো তার সৎ-মা আন্নাকালী। বাবা ভানু চুপটি করে এক কোণে বসে চা খাচ্ছেন। শ্রেয়ার দিক যেন কারো কোনো খেয়ালই নেই। আর এই দেখতে আসা লোকটি দাঁত কেলিয়ে হেসে যাচ্ছে। কি নির্লজ্জ মানুষ! চক্ষু লজ্জা বলতে কিছু নেই? নিজের মেয়ের বয়সি মেয়েকে বউ করতে এসেছে! শ্রেয়ার রাগে দুঃখে বুক ফেটে কান্না আসছে আর সইতে না পরে ছুটে ভেতরে চলে যায় আর কাঁদতে থাকে। কি পোড়া কপাল তার! নিজের বাপও আজ মেয়ের মতামত জানতে চাইলো না? যেখানে একদিন সব কিছু শ্রেয়ার পছন্দেই হতো আর আজ..! ভাবতে পারছেনা আর। তখনি ফোন আসে অনিন্দ্যর।
তখন শুধু শ্রেয়া বলেছিল,,
—-বিয়ে করবে আমায়? অনিন্দ্যও যেন তাইই চাইছিল..! তার মন নেচে উঠলো। এতো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! কবে থেকে শ্রেয়াকে বিয়ের কথা সে জানাচ্ছিল। কিন্তু শ্রেয়া রাজি হতো না। আজতো সবকিছু বেশ চমৎকার হয়ে গেল। একমুহুর্ত দেরী না করে সাথে সাথে বললো,—- "তা আবার বলতে? বলো কবে কখন?"
—" কাল বিয়ে করবো আমরা। আজ আমাকে নিয়ে যাবে?"
—-"ঠিক আছে রাতে তৈরি থেকো।" অনিন্দ্য তার কথা রেখেছে । বন্দী খাঁচা থেকে তাকে মুক্ত করেছে।
এখন শ্রেয়াকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে। শ্রেয়ার বুক ধুকপুক, ধুকপুক করছে। হয়তো বিয়ের আগে প্রতিটি মেয়েরই করে। অনিন্দ্য আর শ্রেয়া ভিতরে ঢুকলো।
উকিলের কাছে সব ডকুমেন্ট দিয়ে দিলো। উকিল বাবু শ্রেয়ার দিকে একটি কাগজ এগিয়ে দিলেন সাইন করার জন্য। সাইন করতে গিয়ে শ্রেয়ার বার বার হাত কাঁপতে লাগলো। চোখ দিয়ে জল পড়ছে। হয়তো এমনই হয় সবার। কতো অদ্ভুত ব্যাপার! এই একটি কাগজে সাইন করার সাথে সাথে তার পুরোটা জীবন হয়ে যাবে অনিন্দ্য-র নামে..! মেয়েদের ভাগ্য বিয়ের আগে বাবার নামে, বিয়ের পর বরের নামে ।
হঠাৎই যেন চিন্তায় পড়ে গেলো শ্রেয়া , অনিন্দ্য কি বিয়ের পর ঠিক এমনি তাকে ভালবাসবে? মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন এসে জমা হচ্ছে শ্রেয়ার মনে..!! ঠিক তখনই অনিন্দ্য হালকা ঠেলা দিয়ে বললো,
—-"কি হলো কি শ্রেয়া! তাড়াতাড়ি করো । আরো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে বিয়ের জন্যে । শ্রেয়া চোখের জল মুছে মাথা নাড়িয়ে সাইন করে দেয়। আজ থেকে সে হয়ে যায় মিসেস শ্রেয়া অনিন্দ্য রায় …! ছোটো শ্বাস ফেলে শ্রেয়া। জানা নেই কেন কি যেন একটা মনের মাঝে খচখচ করছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই। অথচ যা সে ভাবে ভেবেছিল সবই তো ঠিক সেই ভাবে হচ্ছে। হয়তো সবই তার মনের ভুল..!
অনিন্দ্য শ্রেয়াকে একটি বাংলো বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়ি দেখে শ্রেয়া শকড্ । এত বড়ো বাড়ি।
—"এটা তোমার বাড়ি?"
অনিন্দ্য আমতা আমতা করে বলে , "না , আমার এক পরিচিত বড়ো ভাইয়ের বাড়ী। কিন্তু এখন তিনি আপাতত আউট অফ টাউন। আর চাবি আমার কাছে , তাই নিয়ে আসলাম তোমাকে।"
শ্রেয়া উত্তর দিল,—"ও..! তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠে,—-তোমার বাড়িতে কবে যাবো ?"
অনিন্দ্য কিছুটা থতমত হয়ে ওঠে। তারপর নিজেকে সামলিয়ে বলল, " বাড়ীতে তো জানানো হয় নি। সব ঠিকঠাক হোক, নিয়ে যাবো।"
শ্রেয়াও আর কিছু বলল না। বড়ো ক্লান্ত সে সত্যি। অনিন্দ্য শ্রেয়াকে একটি ঘরে নিয়ে বসালো আর বললো ,—-" তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি বাইরের থেকে খাবার আর তোমার মেডিসিন নিয়ে আসছি। দেখি, (শ্রেয়ার কপালে হাত দিয়ে) জ্বরটা এখনো আছে দেখছি ।"
শ্রেয়া অনিন্দ্যের হাত সরিয়ে তার দু-হাতের মাঝে রেখে বললো,—" আমি ঠিক আছি । চিন্তা করো না। তুমি পাশে থাকলে আমি সুস্থ্ হয়ে যাবো।"
"—এতটা ভালবাসো আমায়? যদি কখনো তোমাকে ধোঁকা দেই ,তখন কি করবে?! "
এমন কথায় শ্রেয়ার চোখে মুহুর্তেই জল চলে আসে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে ,—" এমন কখনো করো না, আমি নিজেকে শেষ করে দেব।"
অনিন্দ্যের খারাপ লাগলো। শ্রেয়ার চোখের জল মুছে দিয়ে, কপালে , ঠোঁটে ছোটো চুমু এঁকে দেয়। বলে ,
—"ধুর পাগলি কাঁদে না। আমি আছি তোমার পাশে। এখন রেস্ট নাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।" বলে চলে যায়।
কেন জানি অনিন্দ্য চলে যাওয়াতে, শ্রেয়ার খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে, ও আর ফিরবেই না…! আবার বাজে চিন্তা ভেবে এ সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ওয়াশরুমের দিক পা বাড়ায় শ্রেয়া। ফ্রেশ হয়ে এসে খাটে বসে। ঘরটির চারিদিক চোখ বুলায় সে, মনে হচ্ছে যার ঘর এটি, সে লোকটি অতি রুচিশীল, সম্পন্ন, পরিষ্কার ও গোছানো।
এসব দেখতে দেখতে বুঝতে পারে যে, শরীর আর চলছে না। আজ কত দিন শান্তির ঘুম হয়নি। এখন যেন চোখে সারা রাজ্যের ঘুম এসে জড়ো হচ্ছে। তাকিয়ে থাকা দায়। শ্রেয়া বসে থাকতে না পরে এবার গা এলিয়ে দিল বিছানায়। মুহুর্তেই ঘুমের রাজ্য পাড়ি দেয় সে…!
ঘুমের মাঝে হঠাৎ কারোও ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে ঘুমটা ভেঙ্গে যায় শ্রেয়ার। চোখ খুলতেই অন্য কাউকে তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখা অবস্থায় পেয়ে সজোরে ধাক্কা মারে।লোকটি বিছানা থেকে ছিটকে নিচে পড়ে । শ্রেয়া ততক্ষণে নিজের শরীরের কাপড় ঠিক করে চেঁচাতে লাগলো,
—–"আপনি কে? কে আপনি এখানে ? এই মুহুর্তে আমার স্বামীর থাকার কথা…! আপনি কে ?? আর আপনার সাহস হয় কিভাবে আমাকে ছোঁয়ার…!" লোকটির রাগ উঠে যায় , কিন্তু নিজেকে শান্ত রেখে সে উঠে বসে। শ্রেয়ার কাছে এসে দুগাল চেপে ধরে বলে,—"আরিয়ান খানকে ধাক্কা দেওয়ার সাহস কোথায় পেলি তুই…! আর এখন থেকে আমিই তোর স্বামী…! এমন আর কখনো করলে তোর জন্য খুব একটা ভাল হবে না বুঝে নিস্…!"
শ্রেয়া আরিয়ানের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে —"মিথ্যা বলছেন আপনি…! আমার অনিন্দ্য কই..! ও আমার স্বামী, ভালবেসে বিয়ে করেছি আমরা। আর আপনি বলছেন আমার স্বামী…! শুনুন , কোনো ফালতু কথা শুনতে রাজি নই আমি।"
এই বলে শ্রেয়া আরিয়ানের কলার টেনে ধরে ,—"কি করেছেন আমার স্বামীর সাথে বলুন, বলুন বলছি ?" বলে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় ওনার গালে, আরিয়ানের সাথে সাথে কপালের রগ দাঁড়িয়ে যায়, চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। সেও শ্রেয়ার গালে ঠাস করে চড় মারে।
তার চুলের মুঠি ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে হিসহিস করে বলে,–"তোর সেই স্বামী বিক্রি করে দিয়েছে তোকে আমার কাছে , তুই হচ্ছিস আমার কেনা-বউ বুঝলি…! আজ থেকে আমি তোর স্বামী তুই…! মাথায় ঢুকিয়ে নে..! বলে খাটের উপর এক ধাক্কা দিয়ে শ্রেয়াকে ফেলে বের হয়ে যায় আরিয়ান..! রাগে গা জ্বলছে তার…জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে সব …!"
যেখানে তার বাপ-মা তাকে ফুলের টোকা পর্যন্ত দেয় নি কোনো দিন ! সেখানে এই মেয়ে তাকে চড় মেরে দিয়েছে…! হজম করতে পারছে না সে…! রাগে মাথা ব্যাথা করছে আরিয়ানের....।
এদিকে শ্রেয়া বিছানায় বসে কেঁদে যাচ্ছে। কি হয়ে গেল তার…! তিন বছরের ভালবাসার জন্য ঘর ছেড়ে পালিয়ে ছিল সে…! আর সেই মানুষটি তাকে বিক্রি করে দিল…! এ জীবন সে আর রাখবে না..! অন্যের কেনা বউ হয়ে থাকার চেয়ে, মরে যাওয়া যে ভালো।
সে চোখ মুছে দাঁড়িয়ে ফ্যানের দিক তাকালো। এক টানে শাড়িটা শরীর থেকে খুলে ফ্যানের সাথে জুড়ে নিজের গলায় বেঁধে ঝুলে পড়লো…!!
কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর সব শান্ত হয়ে গেল। তবে কি এখানেই শেষ হয়ে গেলো শ্রেয়ার জীবন…? নাকি আবার নতুন কিছু অপেক্ষা করছে তার জন্য ……..! পরের জীবন যদি কোথাও কিছু থেকে থাকে, তবে তার জন্য অপেক্ষা করবে শ্রেয়া....।
(কলমে-পিয়ালী)
