Sucharita Das

Tragedy Classics Inspirational

3  

Sucharita Das

Tragedy Classics Inspirational

কেন এই বিভেদ?

কেন এই বিভেদ?

5 mins
521


"ও মা ভাই হলে কি নাম রাখবে ভাইয়ের?" ছোট্ট পিংকি র কৌতুহলী প্রশ্ন মায়ের কাছে।

আর মায়ের জবাব "খুব ভালো একটা নাম দেব তোর ভাইয়ের , আমি ভেবে রেখেছি"।

আবার মায়ের দিকে তাকিয়ে পিংকির প্রশ্ন,"আর আমার একটা বোন হলে তার নাম আমি দেব মা।" 

সঙ্গে সঙ্গে অনিমা মেয়েকে ধমক দিয়ে বললো, "চুপ কর তো।বোন হবে না।তোর ভাই ই হবে।"

মায়ের ধমক খেয়ে পিংকি চুপ করে গেল। আর কোনো কথা না বলে ঠামির কাছে গিয়ে নালিশ করলো ,তার বোন হবে বলাতে মা তাকে অনেক বকেছে। 

অনিমার এখন উঠতে বসতে একটাই কথা সবার কাছে , ছেলের এই নাম রাখবো, ছেলের জন্য এই কিনবো।এক এক সময় বিকাশ মানে ওর স্বামী বিরক্ত হয়ে ওকে বলে, "কি সবসময় ছেলে হবে, ছেলে হবে করছো বলোতো।যদি মেয়েও হয়, তাহলেই বা অসুবিধা কোথায়। একটা সুস্থ সন্তান কামনা করো ঈশ্বরের কাছে অনিমা, তা সে ছেলে হোক বা মেয়ে।" কিন্তু অনিমার সেই এক জিদ ছেলে ই হবে ওর।


দেখতে দেখতে ডেলিভারির ডেট এসে গেলো। একটা ফুটফুটে মেয়ে র জন্ম দিলো অনিমা। নিজের ছেলে হবার শখ পূর্ণ না হওয়াতে রীতিমতো কান্নাকাটি করেছিল সে। সবাই যখন ওকে বলেছে,"দেখো দেখো কি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে তোমার।কোল আলো করা মেয়ে হয়েছে"। অনিমা ম্লান মুখে বলেছে, হ্যাঁ দেখেছি, কিন্তু ছেলে তো হয়নি।" আজকের যুগে ওর এই মানসিকতায় আত্মীয়রা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। অবশ্য তাতে অনিমার কিছু যায় আসে না। 



 এরপর মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে শুরু হয়েছিল অনিমার শখ পূরণের নিত্য নতুন পথ আবিষ্কার। বিকাশকে বলে দিয়েছিল আগেই ,সে যেন বাচ্ছার প্রত্যেকটি জামাকাপড় ছেলের ই নিয়ে আসে। ওইটুকু বাচ্চার আবার ছেলে আর মেয়ে।বিকাশ তাই এনে দিয়েছিল , যেমনটি অনিমা বলেছিল। ছোট্ট পিংকি তো ভীষণ খুশি ডল পুতুলের মতো বোনকে পেয়ে। সে তো মনে মনে চাইছিল তার একটা ছোট্ট ফুটফুটে বোন ই আসুক। সারাদিনে সে সময় পেলেই বোনের কাছে এসে তাকে আদর করে। আদর করে সে বোনের নাম রাখে রিংকি।



সময় বহমান, কখন যে দুই বোন বড়ো হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি তারা। পিংকির   কোমর ছাপানো চুল, আর রিংকির মায়ের শখ পূরণের সাজ, ছোট্ট করে ছাঁটা চুল। পিংকির রংবেরঙের নানারকম মেয়েদের পোশাক, আর রিংকি র ছেলেদের মতো জামাকাপড়। তাকে কোনোদিন মা পড়তেই দিলো না দিদির মতো জামাকাপড়।অথচ রিংকি র কতো শখ ,সেও দিদির মতো সাজবে। ঠামি তো সেদিন বলেছিল রিংকি কে,"তোর এই দুর্গা ঠাকুরের মতো রূপ, অথচ তোর মা তোকে ছেলে সাজিয়েই রেখে দিলো সবসময়। রিংকির খুব কষ্ট হয় , যখন মা সবাইকে বলে , "রিংকি আমার ছেলে হলে ভালো হতো"।

কেন ও মেয়ে হয়েছে বলে ওর মায়ের ওকে নিয়ে এতো অভিযোগ সেটাই ও বুঝতে পারে না। কেন ওর মা গর্ব করে সবাইকে বলে না যে আমার দুই মেয়ে, আমি খুব খুশি। স্কুলের সময়টুকু শুধু রিংকি স্কুল ড্রেসটা মেয়েদের মতো পড়ে। সেই উপায় থাকলে ,ওর মা সেখানেও ছেলে সাজিয়েই পাঠাতো হয়তো। স্কুল থেকে বাড়ি, আত্মীয় স্বজন থেকে বন্ধু বান্ধব সবাই ওকে বলে,তুই হওয়াতে তোর মা খুশি হয়নি। তোর মা তো ছেলে চেয়েছিল একটা। ওর মায়ের এই মানসিকতা র জন্য রি়ংকি ভেতরে ভেতরে অসম্ভব কষ্ট পেতে থাকে।।রিংকি এটাই বুঝতে পারে না ওর মেয়ে হওয়াতে ,ওর মায়ের এতো কষ্ট কেন।



রিংকি যখন ঋতুমতী হলো,ঠামি মাকে বলে দিয়েছিল , "এবার মেয়েটাকে একটা মেয়ের মতো বাঁচতে দাও বৌমা।তোমার এই অদ্ভুত ইচ্ছার বলি আর ওকে হতে দেব না আমি। ওর চুল ওইভাবে তুমি আর কাটাবে না। " রিংকি আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনেছিল ঠামি আর মায়ের কথোপকথন। এরপর অবশ্য অনিমা আর জোর করেনি রি়ংকি কে নিজের ইচ্ছানুযায়ী সাজতে। কয়েক মাসের মধ্যেই রিংকি যেন পাল্টে গিয়েছিল। কিন্তু ও এটা লক্ষ্য করেছে, ওর এই পরিবর্তনটা ওর মা ঠিক মেনে নিতে পারছেনা। মা যেন কেমন মনমরা হয়ে থাকে। কথাও কম বলে ওর সঙ্গে। রাত্রি বেলা দিদিকে জানতে চেয়েছিল রিংকি,"দিদি মা আমাকে ছেলের রূপে কেন দেখতে চায় বলতো? মেয়ে হিসাবে কেন দেখতে চায়না। কিন্তু আমি তো মায়ের মেয়ে হয়ে মায়ের পাশে থেকে মাকে দেখিয়ে দিতে চাই দিদি, যে আমি ও মায়ের ছেলের থেকে কোনো অংশে কম না। " পিংকি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকে। কারণ সে জানে এর কোনো উত্তর তার কাছে নেই। কারণ সে ছোটবেলা থেকে তার মাকে দেখে এসেছে এই ভাবেই বোনকে ছেলে হিসাবে ভাবতে।



ইদানিং অনিমার আর এক নতুন অভ্যাস শুরু হয়েছে, কথায় কথায় রিংকি কে বলছে ,"তুই ছেলে হয়ে কেন এলি না আমার কাছে।" রিংকির খুব খারাপ লাগে এই কথায়। তার মায়ের কাছে এতো জরুরি একটা ছেলের উপস্থিতি, যে তার মা তার এই পৃথিবীতে আসা টাকেই মেনে নিতে পারছে না এখনো। সেদিন রিংকি টিউশন ক্লাস থেকে ফিরছিল, কয়েকটি ছেলে তাকে একটু বিরক্ত করছিলো, সেই কথাটাই সে ঘরে এসে তার বাবা, মা, দিদি সবাইকে বলছিলো। সঙ্গে সঙ্গে অনিমার মন্তব্য,"ওইজন্যই তো বলি তোকে তুই ছেলে কেন হলিনা। তাহলে তো এইসব ঘটনাই ঘটতো না তোর সঙ্গে।"

মায়ের কথায় রিংকি অবাক চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। এখানেও মায়ের ছেলে হওয়া নিয়ে মন্তব্য। রিংকি আর নিতে পারছে না ব্যবহার গুলো। দিনের পর দিন ,বছরের পর বছর শুধুমাত্র ছেলে হয়ে ও এই পৃথিবীতে আসেনি বলে,ওর জন্মদাত্রী মা ওকে এইভাবে তাচ্ছিল্য করে গেছে। পরদিন সকাল থেকে রিংকি খুব মনমরা হয়ে ছিলো। রাত্রি বেলা দিদির পাশে শুয়ে দিদিকে বলেছিলো,"দিদি তুই আমাকে তোর বোন বলে কতো ভালোবাসিস, অথচ মা তার মেয়ে হিসাবে আমাকে চায় না রে দিদি।" পিংকি বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে ওকে ঘুমিয়ে পড়তে বলে।



সকালে পিংকি ঘুম থেকে উঠে রিংকি কে রোজকার মত উঠতে বলে। কিন্তু রিংকি ওঠে না। গা তার বরফের মতো ঠান্ডা। ভয়ে চিৎকার করে পিংকি তার বাবাকে ডাকে।সবাই এসে দেখে, রিংকির মুঠো করা হাতে একটা চিঠি।আর পাশে ঠামির কড়া ঘুমের ওষুধের শিশি খালি অবস্থায় পড়ে আছে। কারুর বুঝতে বাকি থাকে না কি করেছে রিংকি। রিংকির হাত থেকে চিঠি টা নিয়ে পিংকি পড়ে শোনায়-----

মা,

তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ,যে আমি তোমার ছেলে হয়ে এসে এ জন্মে তোমার ইচ্ছা পূরণ করতে পারিনি। আসলে তুমি তো কখনও তোমার রিংকি কে তোমার সন্তান হিসাবে দেখতে চাওনি। দেখতে চেয়েছো ছেলে হিসাবে আলাদা ভাবে। জানো তো মা, সেদিন মিস স্কুলে বলছিলো, একটা মায়ের কাছে তার সন্তান সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মা তুমি তো আমাকে যেদিন থেকে তোমার কোলে মেয়ে হয়ে জন্মেছি, সেদিন থেকেই চাও নি। বাবা, ঠামি, আর দিদি কিন্তু আমাকে মেয়ে হিসাবেই দেখতে চেয়েছে। কিন্তু মা, একটা মেয়ের কাছে তার মায়ের ভালোবাসা টা কতো দরকার তার বেড়ে ওঠার জন্য সেটা হয়তো তুমি বুঝতে পারোনি তোমার ছেলের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা র জন্য। দিদিকে বলবে, আমি তার মতো দিদি সব জন্মে পেতে চাই।আর মা, দুঃখ করো না তুমি যেন আমি চলে যাচ্ছি বলে, আমি আবার আসবো তোমার কাছে ফিরে। তবে এবার আর মেয়ে হয়ে নয় মাগো তোমার কোলে তোমার ছেলে হয়ে। ভালো থেকো মা।

                          রিংকি


পি়ংকি আর নিজেকে সামলাতে পারে না। বাবাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললো। অনিমা পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখে ওর শাশুড়ি ওকে বললো," বৌমা এখন আর ওইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে। মেয়েটা যখন ছিলো তাকে একদিনের জন্য মেয়ে বলে কাছে টেনে নাও নি। ছেলের প্রতি এতো মোহ তোমার যে, একজন মা হিসাবে সন্তানের ভালোবাসাটাই বুঝতে পারলে না তুমি। এর থেকে দুর্ভাগ্য কোনো মায়ের হয় কি? যেদিন তোমার মতো প্রত্যেকটি মানুষ, প্রত্যেকটি মা, বাবা ছেলে মেয়ের বিভাজন না করে, তাদের কন্যা সন্তানকে নিয়েও গর্ব করে বলতে পারবে, আমি কন্যা সন্তানের গর্বিত জননী ।সেই দিন ই তোমার মতো মানুষদের প্রকৃত অর্থে জ্ঞান চক্ষু খুলবে হয়তো"।


Rate this content
Log in