কেলেঙ্কারির একশেষ
কেলেঙ্কারির একশেষ
উৎসব মানেই স্মৃতির সম্ভার। সেই সব স্মৃতিই একে অপরের থেকে অনন্য। তবুও আমার মানে তাতাইয়ের জীবনে এমন একটি উৎসবের স্মৃতি আছে যা কোনোদিনও ভোলার নয়। আজ সেই গল্পই শোনাবো আপনাদের।
◆◆◆◆◆◆◆
খবরটা শুনেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল তাতাই আর পিচাই। মিমি দিদির বিয়ের ঠিক হয়ে গিয়েছিল অনেকদিন আগেই কিন্তু বিভিন্ন কারণে দিনটা স্থির হচ্ছিল না। এতদিনে হল অবশেষে। মিমি দিদি বাবার জ্যেঠতুতো দাদার মেয়ে। একই শহরে দুই পরিবার থাকার সুবাদে সম্পর্কটা আরও কাছের হয়ে গেছে। তাই মিমি দিদির বিয়ের খবরে তাতাই আর পিচাই লাফাবে না তা কি হয়! তার ওপর এ তো ডবল ধামাকা---- সরস্বতী পুজোর পরের দিনই বিয়ে, মানে একেবারে জমজমাট ব্যাপার। কতদিন পর আবার সব আত্মীয় স্বজনরা একত্রিত হবেন। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সবার খোঁজ খবর থাকলেও গেট টুগেদারের মত আনন্দ আর আছে নাকি!!!!
★★★★★
বিয়ের আগের দিন অর্থাৎ সরস্বতী পুজোর দিনই মিমিদের বাড়ি জমজমাট। সব আত্মীয়দের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে,কেউ কেউ আগের দিনই এসে গেছেন। মাইকে একটানা সানাইয়ের সুর বেজে চলছে। বাড়ির সামনে দুটো কৃত্রিম গাছ দিয়ে মিমি দিদি আর জামাই বাবুর নাম লেখা। রনি দাদা, চিনি দিদি, পিকলু, নিমকিকে পেয়ে তো তাতাইরা তো আনন্দে আটখানা। তবে পিচাইয়ের মাঝে মাঝে রাগ উঠে যাচ্ছে একটু; যেই আসছে সেই ওকে কোলে তুলে হয় চুমু দিয়ে ওর গালে লিপস্টিকের দাগ লাগিয়ে দিচ্ছে আর নয়তো গালদুটো টিপে টিপে ফুলিয়ে দিচ্ছে একেবারে। পিচাইয়ের গালটা এই মুহূর্তে লাল হয়ে আছে, সেটা লিপস্টিকের দাগ নাকি ব্যাথায় লাল বলা মুশকিল। মাকে অভিযোগ জানাবে বলে কোথাও মাকে খুঁজে পেলোনা পিচাই, তাই অগত্যা দিদির কাছে গেল বলতে। কিন্তু দিদির কাছে গিয়ে একটু ঘাবড়ে গেল পিচাই, সে দেখলো দিদি কেমন উদাস হয়ে বসে বসে মিমি দিদির মেহেন্দি করা দেখছে। দিদির হাতে খোঁচা দিল পিচাই,
---- তোল কি হয়েতে লে?
---- তুই বুঝবি না।
---- বল না।
---- সবাই কি সুন্দর মেহেন্দি পরছে দেখ, কিন্তু আমি পরতে পারব না। স্কুলে বকবে।
---- থি থি হাতে ওলম দাগ কাটতে পাচ্চিছ না বলে তোল মন খালাপ!! থি নোংলা নোংলা…
---- ধুরর তুই কিছুই বুঝিস না।
পিচাই বোধহয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ঘরে ঢুকল পিকলু। সে তাতাইয়ের কানে কানে বলল,
---- এই তাতাই ঠাকুর দেখতে বেরোবি?
চমকে উঠে পিকলুর দিকে তাকাল তাতাই,
---- ধুরর আমাদের কেউ ছাড়বেই না একলা।
---- আরে রনি দাদাও যাবে। আর তুই দেখ না চিনি দিদিকে যদি ম্যানেজ করতে পারিস তাহলে কেউ আপত্তি করবে না।
---- কিন্তু চিনি দিদি তো এখন মিমি দিদির সঙ্গে ব্যস্ত সে কি যাবে?
---- তুই বলেই দেখ না।
তাতাই আশা করেনি চিনি দিদিকে বললেই এভাবে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাবে। আসলে চিনি দিদি বিয়ে বাড়ির জন্য একটা ঝকমকে শাড়ি কিনে এনেছে কিন্তু ম্যাচিং গয়না কেনার সময় পায়নি। তাই তাতাইদের সঙ্গে একটা শর্তে বেরোতে রাজি হয়েছে----তাতাইকে একটা গয়না দোকানের সন্ধান করে দিতে হবে চিনি দিদিকে।
মাকে মাঝে মাঝে একটা দোকানে ম্যাচিং গয়না কিনতে দেখেছে, তাই দোকানটা তাতাইয়ের চেনা। সে বলল,
---- তুমি চিন্তা কোরো না চিনি দিদি, আমি তোমাকে ঠিক দোকানে নিয়ে যাবো।
★★★★★
প্রথম প্যান্ডেলটায় ঢুকে তাতাইরা দেখলো সেই সবে পুজো শেষ হয়েছে সেখানে। ওরা ঠাকুরকে প্রণাম করে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল, তখন এক মহিলার প্রাসাদের থালা এনে বললেন,
---- একটু প্রসাদ খেয়ে যাও।
তাতাইরা সব একটু করে প্রসাদ তুলে নিয়ে প্যান্ডেল থেকে বেরোলো। অন্যরা খেয়াল করেনি কিন্তু পিচাই প্রসাদ খেতে খেতে জড়ানো গলায় বলে উঠল,
---- পিলু দাদা কোতায়?
---- সত্যিই তো পিকলু কোথায়? যাহ বাবা!
এই বলে রনি দাদা আবার ছুটল প্যান্ডেলের ভেতর। তাতাইরা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু রনি দাদাও যে গেল সে গেলোই, তার আর বেরোবার নাম নেই। চিনি দিদি অধৈর্য হয়ে বলল,
---- ভেতরে চল দেখে আসি ব্যাপারটা কি!
ভেতরে ঢুকেই তাতাইদের তো চক্ষু চড়কগাছ। তারা দেখল রনি একটা প্লেটে অনেকটা প্রসাদ নিয়ে বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে, আর পিকলু তো আরও এগিয়ে, সে প্রসাদ শেষ করে মকর খেতে বসেছে। এসব দেখেই তো চিনি দিদির মেজাজ গরম। সে রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
---- এই জন্য… এই জন্য আমি তোদের সঙ্গে আসতে চাইনা। নেহাৎ আমার একটা দরকার ছিল বলে এলাম। কোনো কান্ড জ্ঞান নেই তাদের…!
দেখা গেল চিনি দিদির কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া হল না রনি বা পিকলুর। তাতাইই ভয়ে ভয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল,
---- তুমি রাগ কোরো না চিনি দিদি। এখান থেকে বেরিয়ে সোজা তোমার জুয়েলারি কিনতে যাবো। এই পথেই পড়বে তো।
---- হুমম সেই ভালো, নাহলে আমি সোজা ফিরে গিয়ে বলবো তোরা কেউ আমার কথা শুনিসনি।
চিনি দিদির কথা শুনে পিচাই গম্ভীর মুখ করে বলে উঠল,
---- থি থি মিছি কথা বলতে নেই। তুমি না গরু জন…
---- গরু জন…!!!
চিনি দিদি ফ্যালফ্যাল করে তাকাল পিচাইয়ের দিকে। তাতাইয়ের পেট গুড়গুড় করে হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু অনেক কষ্টে সামলালো নিজেকে। এই সময় চিনি দিদিকে চটানো যাবে না।
★★★★★
প্রায় মিনিট কুড়ি হয়ে গেছে চিনি দিদি গয়নাই বেছে যাচ্ছে, আর তাকে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে নিমকি। তাতাইয়ের এইসব ভালো লাগে না, সে একটুক্ষণ পরেই দোকান থেকে বেরিয়ে চলে এলো। বাইরে রনি দাদা আর পিকলু নিজেদের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে কিসব আলোচনায় মেতেছিল। তাতাইকে দেখে পিকলু বলল,
---- কিরে কেনা হল?
ঘাড় নেড়ে না বলল তাতাই। রনি দাদা বলল,
---- উফফ মেয়েদের শপিং ভয়ানক জিনিস।
এই বলে ওরা আবার গল্প করতে লাগল নিজেদের মধ্যে। আজ সরস্বতী পুজো বলে রাস্তাঘাটে বেশ ভীড় হয়ে আছে--- মেয়েরা শাড়ি পরে আর ছেলেরা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়েছে ঠাকুর দেখতে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। চারিদিকে এতো রঙের বাহার দেখতে বেশ ভালো লাগছিল তাতাইয়ের। রাস্তার ওপ্রান্তেই আরেকটা বিয়ে বাড়ি হচ্ছে। গেটটায় এখনও নাম লেখার কাজ চলছে। সময় কাটাতে তাতাই বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল ওটা কনের বাড়ি না বরের বাড়ি। কিন্তু ওদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তাতাইয়ের হঠাৎ নজর গেল একজনের দিকে। কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে ওই বাড়িটার গেট পেরোচ্ছেন তিনি--- কাকলি ঠাকুমা।
কাকলি ঠাকুমা তাতাইদের এক জ্ঞাতি হন। ওদের গ্রামের বাড়ির পাশেই কাকলি ঠাকুমাদের বাড়ি। কিন্তু কাকলি ঠাকুমা এখানে কি করছেন! তার তো মিমি দিদির বিয়েতে আসার কথা। ওনার আরও কোনো বিয়ে বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে বলেও তো শোনা যায়নি। তাতাই রনি দাদাদের দিকে এগিয়ে এলো,
---- এই রনি দাদা, কাকলি ঠাকুমা…
---- কি করেছে?
---- এসেছে।
---- হ্যাঁ আসারই তো কথা।
---- আরে নারে, ওই বিয়ে বাড়িটার দিকে দেখ।
তাতাইয়ের কথা শুনে রনি আর পিকলু ঘুরে তাকাল সেদিকে, দুজনেরই চোখ ছোটো ছোটো হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
---- ওটা তো কাকলি দিদা!
চিৎকার করে উঠল পিকলু।
---- আরে সেটাই তো বলছি।
--- কাকলি দিদা মামার বাড়ি না গিয়ে এখানে কি করছে?
---- সেটা তো আমারও প্রশ্ন।
---- আরে বাবা এখানে এই নিয়ে গবেষণা না করে চল গিয়ে দেখি ব্যাপারটা। আমার কিন্তু গতিক সুবিধের ঠেকছে না।
গম্ভীর গলায় মন্তব্য করল রনি দাদা। তাতাই আর পিকলুও সায় দিলো ওদের সঙ্গে।
এরপর রনির কথা মতো রাস্তা পার করে ওরা চলে এলো বাড়িটার কাছে। বিয়েবাড়ি, কাজেই লোকজনের ভীড় লেগেই আছে। ওরা তার মধ্যেই দেখলো কাকলি ঠাকুমা ইতিউতি তাকাচ্ছেন। নতুন ধুতি পাঞ্জাবি পরা একজন বয়স্ক করে লোক কাপে চা বা কফি কিছু একটা খেতে খেতে বাইরে এলেন। তারপর কাকলি ঠাকুমাকে দেখতে পেয়ে লোকটা এক গাল হেসে জিজ্ঞেস করলেন, "এই এলেন?"
কাকলি ঠাকুমাও মিষ্টি হেসে বললেন, "হ্যাঁ, বাসটা দেরি করে দিলো অনেক।"
এদিকে পিকলু ফিসফিস করে তাতাইদের দিকে তাকিয়ে বলল, "লোকটা কি তবে কাকলি দিদাকে চেনে!"
"কে জানে কিছুই বুঝতে পারছিনা।"
---- আপনি তাহলে মেয়ের কে?
---- আমি মেয়ের ঠাকুমা হই।
---- আরে বাহ্ আর আমি নভেন্দু মানে ছেলের দাদু। আমাদের তো তাহলে দারুণ জমবে বলুন।
---- হাঃ হাঃ হাঃ সে আর বলতে!
---- কিন্তু আপনার কি এতো দেরি করে আসা ঠিক হল? নাতনির বিয়ে বলে কথা।
---- কি করব বলুন! আমার দুর্ভাগ্য...
---- আরে এই ভদ্রমহিলা কে?
তাতাইদের থেকে খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে মন্তব্যটা করল একটা কম বয়েসী ছেলে। তার পাশে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ফিসফিস করে বলল,
---- মনে হচ্ছে পাত্র পক্ষের কেউ হবে। পরে এসেছে। দেখেছিস না জামাইবাবুর ওই ছোটো দাদুর সঙ্গে গল্প করছে।
---- তাহলে ভেতরে গিয়ে ওনার জল খাবারের ব্যবস্থা কর তাড়াতাড়ি। এই দায়িত্বে তো তুইই আছিস।
---- হুঁ। গায়ে হলুদ দিতে কত লোক আসে! আমার আপ্যায়ন করতে করতে কোমর ধরে গেল।
---- চুপ চুপ। মাসি মেসো শুনলে খারাপ ভাববে।
---- হুমম। তুই থাক এখানে, আমি ওনাকে নিয়ে যাই ভেতরে।
এই বলে মেয়েটা এগিয়ে গেল কাকলি ঠাকুমার দিকে, তারপর বিগলিত কণ্ঠে বলল,
---- ভেতরে চলুন ঠাকুমা। একটু মিষ্টি জল খাবে।
---- হ্যাঁ হ্যাঁ… চলো চলো। তা তোমাকে তো ঠিক চিনলাম না মা!
---- আমি সোনা দির মাসতুতো বোন।
---- সোনা! ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ মিমিকে তো আমাদের বাবু আর বৌমা সোনা বলেই ডাকে।
বিড়বিড় করলেন ঠাকুমা।
---- হুম। চলুন ঠাকুমা।
এই বলে মেয়েটা কাকলি ঠাকুমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
---- কেসটা কি হল রনি দা! দিদা নিজেকে মেয়ের ঠাকুমা হিসেবে দাবি করছে, এদিকে মেয়ের মাসতুতো বোন আর ভাই বলছে দিদা নাকি পাত্র পক্ষ, অন্যদিকে আবার বরের দাদু দিদাকে চেনেই না… কি কনফিউজিং!
মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল পিকলু।
---- কিন্তু আমার আর কোনো কনফিউজন নেই রে পিকলু। কাকলি ঠাকুমা ভুল বাড়িতে এসে উঠেছে, ঠাকুমা এটাকে জ্যেঠুর বাড়ি ভাবছে।
বলল তাতাই। রনি ওকে সমর্থন করে বলল,
---- একদম তাই। আর ভুলটা আমাদেরই, আমরা যদি তখনই এসে ডাইরেক্ট ঠাকুমার সাথে কথা বলতাম তাহলে ব্যাপারটা এতদূর গড়াতোই না।
---- কিন্তু এখন কি করবি? ঠাকুমা তো মিষ্টি জল খেতে চলে গেল।
---- কিছু তো একটা করতেই হবে। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেলে ঠাকুমা খুব অপ্রস্তুতে পড়বেন।
---- সেটাই তো রে।
---- শোন, আমার কাছে একটা প্ল্যান আছে।
---- কি?
---- আমরা আলাদা আলাদা হয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যাই চল। বিয়ে বাড়িতে চট করে কেউ অতো খেয়াল করবে না। তারপর সুযোগ বুঝে যে কেউ একজন ঠাকুমার কাছে গিয়ে ঠাকুমাকে বের করে আনবো। বুঝলি?
---- ওকে বস।
পরিকল্পনা মতো ওরা আলাদা আলাদা করে ভেতরে ঢুকলো। তাতাইয়ের সঙ্গে রইল পিচাই। ভেতরে ঢুকেই তাতাই দেখতে পেল কাকলি ঠাকুমা এক প্লেট মিষ্টি নিয়ে একটা চেয়ারে বসে চারিদিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। রনি আগে ঢুকেছিল, সে এগিয়ে ঠাকুমার কাছে যেতেই ঠাকুমা হইহই করে উঠলেন,
---- আরে তাই তো বলি তোরা সব কোথায় একটা কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা কেন!
ঠাকুমাকে জল দিতেই বোধহয় এই ঘরটার ঢুকেছিল কনের সেই মাসতুতো বোন। ঠাকুমার কথাগুলো কানে যেতেই সে অবাক হয়ে রনির দিকে তাকাল, তারপর তার নজর পড়ল তাতাইয়ের দিকে। এই মুহূর্তে ঠিক কি করা উচিৎ বুঝতে না পেরে তাতাই ফস করে মেয়েটাকে জিজ্ঞাসা করে বসল,
---- ওয়াশ রুমটা কোন দিকে? একটু নিয়ে যাবেন?
---- হ্যাঁ, কিন্তু তুমি?
---- আমি নভেন্দু দার বোন।
তাতাই মনে মনে ভাবল ভাগ্যিস বরের দাদু এই নামটা উচ্চারণ করেছিল। মেয়েটার ভ্রু দুটো এখনও কুঁচকে আছে। সে সন্দিগ্ধ গলায় বলল,
---- সরি তোমাকে তো আসতে দেখিনি তখন!
---- আমি আর ভাই তো পরে ঠাকুমার সাথে এসেছি।
বলে কাকলি ঠাকুমাকে দেখাল তাতাই।
---- আমার সাথে! আর নভেন্দু…
কিছু একটা বলতে গেল কাকলি ঠাকুমা। কিন্তু তার আগেই পিকলু এসে তাকে আটকে দিল। মেয়েটা আর কিছু প্রশ্ন করার আগেই তাতাই মুখ বিকৃত করে বলল,
----ওয়াশরুম…
---- ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।
পিচাইকে ঠাকুমার কাছে দিয়ে তাতাই মেয়েটার সাথে চলে গেল ভেতরে।
মেয়েটা সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুমাকে হামলা করল পিকলু,
---- এখানে কি করছো দিদা?
---- কেন?
---- এটা কার বাড়ি জানো?
---- কেন? কার বাড়ি?
---- আমিও জানিনা। আর তাই তো বলছি কি করছো এখানে?
---- তোরা কি করছিস?
---- উফফ পিকলু ঠাকুমাকে এতো কনফিউজড করার সময় নেই এখন। ঠাকুমা আসল কথা হল তুমি ভুল বাড়িতে ঢুকে গেছো, এটা কাকুর বাড়ি নয়। আমরা বাই চান্স তোমাকে এখানে দেখতে পেয়ে এসেছি। এখন কেউ কিছু বোঝার আগেই চুপচাপ চলো এখান থেকে।
ফিসফিস করে বলল রনি।
---- বলিস কি?
---- ঠিকই বলছি। আর কোনো কথা নয়, চলো। কুইক।
পিচাই ঠাকুমার প্লেট থেকে একটা শোনপাপরি তুলে সবে কামড় বসিয়েছিল, ঠাকুমা ওকে বগলদাবা করে নিয়ে ছুটলেন বাইরের দিকে। রনি বলে উঠল,
---- ঠাকুমা নরম্যাল ভাবে হাঁটো।
গতিটা কমল ঠাকুমার। কিন্তু দরজার কাছাকাছি আসতেই বরের ছোটো দাদুর সঙ্গে আবার দেখা। ঠাকুমাকে দেখেই তিনি অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,
----এই তো এলেন, আবার কোথায় যাচ্ছেন!
---- হেঁ হেঁ আসলে আমার নাতিগুলো আইসক্রিম খেতে চাইছে তাই নিয়ে যাচ্ছিলাম।
আমতা আমতা করে জবাব দিলেন ঠাকুমা। বৃদ্ধ হাঁ হাঁ করে উঠলেন,
---- বলেন কি! এই ঠান্ডায় আইসক্রিম? শরীর খারাপ করবে যে!
---- আমাদের ডাক্তার শীতকালেই আইসক্রিম খেতে বলেছে। তাহলে গলা ধরবে না। আমরা এখন আসছি দাদু। রাতে দেখা হবে।
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে তড়িঘড়ি গেটের বাইরে চলে গেল রনি। ওর পেছন পেছন এগিয়ে গেল পিকলু আর ঠাকুমাও।
এদিকে বিয়ে বাড়ির ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ বাথরুমে মিনিট পাঁচেক প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল তাতাই। তারপর বাইরে থেকে কেউ দরজায় ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে বেরিয়ে এলো ও। যে দরজা ধাক্কাছিল তার বোধহয় খুব তাড়া ছিল, সে তাতাইয়ের দিকে ভালো করে না তাকিয়েই ঢুকে গেল ভেতরে। তাতাই দেখলো এখানে যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। ও চুপিসারে বেরিয়ে এলো বাইরে। দেখল রাস্তার ওপারে সবাই দাঁড়িয়ে, নিমকি আর চিনি দিদিও আছে। কিন্তু পিচাই ত্রাহি ত্রাহি চিৎকার করে যাচ্ছে। বাকিরা ওকে চুপ করানোর চেষ্টা করছে নানা ভাবে।
তাতাই আসতেই পিচাইয়ের কান্না বন্ধ হল। সে লাফ দিয়ে তাতাইয়ের কোলে উঠে বলল,
----আমি ভাবলাম ওলা তোকে লেখেই দিল।
---- ধুরর বোকা।
কাকলি ঠাকুমা ব্যাজার মুখে বলে উঠলেন,
---- তাই তো ভাবি কাউকে চেনা লাগছে না, তার ওপর বিয়ের আগের দিন বরের দাদুই বা কি করছে এখানে!
বলেই ফিকফিক করে হাসলেন ঠাকুমা।
বাকিরা তখন এক সঙ্গে বলে উঠল,
---- আর বোলো না তুমি। ভালোয় ভালোয় বেরিয়ে আসা গেছে এই ঢের। নয়তো তুমি তো করে ফেলেছিলে কেলেঙ্কারির একশেষ!